স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_১৯

0
560

#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৯

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

ঠাস করে একটা থাপ্পর লাগিয়ে দিল জায়ানের ফর্সা গালে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল – আপনার সাহস হলো কি করে আমার হাত ধরার, আমাকে স্পর্শ করার। একটা চরিত্রহীন, খারাপ, বাজারি মেয়ের হাত ধরতে লজ্জা করলো না আপনার?

থাপ্পরটা মেরে নিজেই হতবম্ব হয়ে গেল পূর্বাশা। সে কারো গালে থাপ্পর মারলো। তাও নিজের জন্য প্রতিবাদ করতে? এত সাহস, এত শক্তি তার ভিতরে কবে থেকে সঞ্চিত হলো? কই এমনটা তো সে আগে করতে পারেনি। নক্ষত্র যখন তার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে তাকে ধোঁকা দিল, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল তার ভিতরটা। তখনও তো সে পারেনি নক্ষত্রের গালে কষে একটা থাপ্পর মা’র’তে বরং নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। নক্ষত্রের তাকে ছেড়ে চলে যাওটার জন্য দায়ী করেছিল নিজের চেহারা, নিজের সৌন্দর্যকে। এই কুৎসিত রূপ নিয়ে বেঁচে না থেকে আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্তই নিয়ে নিয়েছিল সে। কই তখন তো নক্ষত্রকে কষে একটা থাপ্পর মারতে পারলো না, তার ধোঁকার বিপরীতে কোনো জবাব দিয়ে গর্জে উঠতে পারলো না। আজ কিনা সেই ভীত হীনমন্যতায় ভোগা মেয়েটা থাপ্পর মে’রে দিল জায়ানের গালে? পূর্বাশা অবাক দৃষ্টিতে তাকালো নিজের হাতের পানে। বাকহারা হয়ে পড়েছে সে। ভিতরে ভিতরে ভয়ও লাগছে ভীষণ। এ কয়দিনে আর কিছুর সাথে পরিচিত হোক বা না হোক জায়ান নামক ছেলেটার ক্রোধ এবং নাক উঁচু স্বভাবের সাথে বেশ ভালো পরিচিত লাভ করেছে সে। আর এক মুহুর্তও পূর্বাশা দাঁড়ালো না জায়ানের সম্মুখে। ব্যস্ত পায়ে এক প্রকার দৌড়ে সে ঢুকে হোস্টেলের ভিতরে দিকে।

জায়ানও তাজ্জব বনে গেছে পূর্বাশার হাতে শক্তপোক্ত একটা থাপ্পর খেয়ে। নিজের গালে হাত দিয়ে হতবম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মেয়েটা কিনা শেষ পর্যন্ত তার গালে থাপ্পর মে’রে দিল? ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত কেউ তার গায়ে হাত তোলেনি কখনও অথচ এই মেয়েটা থাপ্পর মেরে দিল তাকে?

****

সময় গড়ালো কিছুটা। জায়ানও ফিরে এলো নিজের হোস্টেল রুমে। কতক্ষন আর চড় থাপ্পর খেয়ে মেয়েদের হোস্টেলের নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোক পালন করবে? নিজের হোস্টেল রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই তার পানে ফিরে তাকালো চ্যাং। আঁতকে উঠলো ছেলেটা। বিস্মিত হলো তার চোখ মুখ। হতবাক কন্ঠেই বলল – একি জায়ান তোকে এভাবে থাপ্পর মেরে লাল বানিয়ে দিয়েছে কে?

চ্যাং এর কথা শুনে চকিত হলো তৃষাম। জায়ানের সাথে রেগে থাকায় এতক্ষন সে ফিরে তাকায়নি ছেলেটার পানে। কিন্তু এবার চ্যাং এর কথা শুনে আর ফিরে না তাকিয়ে পারলো না। দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে জায়ানের পানে। ফর্সা গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ একদম জ্বলজ্বল করছে। অতিরিক্ত ফর্সা এবং গালে দাঁড়ি না থাকায় সে দাগ যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু এভাবে ছেলেটার গালে থাপ্পড় কে মারলো? তৃষাম যতদিন ধরে চিনে জায়ানকে তাতে তাকে এভাবে থাপ্পর মারার সাধ্য কারো নেই। আর যদি থেকেও থাকে তাহলে জায়ানের এই মুহূর্তে এতটা শান্ত মোটেই থাকার কথা নয়। মারামারির দায়ে পুলিশ স্টেশনে থাকার কথা। তৃষাম উৎসুক হয়ে পড়লো। জায়ানের সাথে কথা না বললেও তার গালে চড় মারা ব্যক্তিটা কে জানার জন্য কৌতুহলী হয়ে পড়লো ছেলেটা। তৃষামের কৌতুহলের মধ্যেই চ্যাং আবার জায়ানকে প্রশ্ন করলো – কে মেরেছে তোকে এই থাপ্পর? কার এত বড় সাহস যে তোর এমন মূলার মতো গালকে গাজরে পরিনত করেছে?

সাথে সাথেই জবাব পাওয়া গেল জামানের। তার বাজখাঁই কন্ঠে সে ধমকে উঠলো চ্যাংকে, বলল – যে মারার মেরেছে। তাতে তোদের কি? যা পড়তে বস।

জায়নের ধমকে চুপসে গেল চ্যাং। তৃষামের কৌতুহলেরাও দিক পরিবর্তন করলো। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো বইয়ের পাতায়। জায়ান ধপ করে বসে পড়লো তার জন্য বরাদ্দকৃত পড়ার টেবিলটার চেয়ারে। টেবিল থেকে হাতে নিল একটি বই। মনযোগী হওয়ার চেষ্টা করলো বইয়ের ভাঁজে। কিন্তু পারলো না। বারবার চোখের সম্মুখে তার ভেসে উঠছে পূর্বাশার থাপ্পর মারার দৃশ্যটা। মেয়েটা ওকে থাপ্পর মেরে দিল? শুধু তো একটু হাতই ধরেছিল। তাও তো কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে নয়। শুধুমাত্র মেয়েটাকে চলে যাওয়া থেকে আটকাতে। সেদিন যে পার্কে পূর্বাশা পড়ে যাওয়ার সময় তাকে বাঁচানোর নাম করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল ইয়ান ছেলেটা। কই তাকে তো কোনো থাপ্পর মারলো না পূর্বাশা। তাহলে তাকে কেন মারলো? ফুঁসে উঠলো জায়ান। রেগেমেগে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো সে, সজোরে লাথি মারলো চেয়ার খানায়। কেঁপে উঠলো চ্যাং আর তৃষাম। আজ বুঝি তাদের প্রিয় জিনিসগুলো শ’হী’দ হবে এই নাক উঁচু রাগচটা জায়ানের হাতে। তৃষাম আর চ্যাং নিজেদের প্রয়োজনীয় সব জিনিসগুলো নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে চাইলো। এই ছেলের আবার রেগে গেলে ভাংচুরের অভ্যাস আছে। আগেও কয়েকবার এমন করেছে। এর জন্য অবশ্য মোটা অংকের জরিমানাও দিতে হয়েছে তাকে। বাপের টাকা আছে তাই জরিমানা দিয়েও আবার ক্রোধের বশে ভাংচুরে লিপ্ত হয়েছে। তবে আজ জায়ান তেমন কিছুই করলো না। শুধু মাত্র চেয়েরে লাথি মেরে হনহন করে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন চ্যাং আর তৃষাম। যাক অবশেষে জায়ানের হাত থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তো রক্ষা পেল।

______________________________________

মধ্যরাত। চারদিক নীরব নিস্তব্ধ। ব্যস্ত শহরটা যেন ঝিমিয়ে পড়েছে এই মুহুর্তে। হয়তো সারাদিন ব্যস্ততায় ক্লান্তিভরা শরীরটাকে বিশ্রাম দিচ্ছে একটু। শুরু বিশ্রাম নেই জায়ানের। নিজ ফ্ল্যাটের অন্ধকার কক্ষে চুপচাপ বসে রয়েছে ছেলেটা। অবশ্য নিজের ফ্ল্যাটে এলে তার প্রথম কাজ হলো ঘর অন্ধকার করা। এই অন্ধকার ঘরের টানেই যে তার নিজ ফ্ল্যাটে ফেরা। নয়তো এখানে আসে না সে কখনও। তখনকার পূর্বাশার মারা থাপ্পরটা যেন কিছুতেই ভুলতে পারছে না জায়ান। তাকে এভাবে থাপ্পর মারলো মেয়েটা? কই আর তো কাউকে থাপ্পর মারলো না সে। ইয়ানকে মারলো না, ঐ যে মেয়েগুলো যারা পূর্বাশাকে ডা’র্কি, কা’লো, নি’গ্রো বলে তিরস্কার করে তাদের তো কখনও মারলো না। তাহলে তাকে কেন মারলো? মেয়েটা কি তাহলে পছন্দ করে না তাকে? ধক করে উঠলো জায়ানের হৃদয়টা। অবশ্য সে যা ব্যবহার করেছে তাতে তাকে অপছন্দ করাই উচিৎ। আচ্ছা এভাবেই কি পূর্বাশা তাকে অপছন্দ করবে সারাজীবন? তার থেকে হারিয়ে যাবে? পূর্বাশার হৃদয়ের ঘৃনার পাতায় হাতছানি দিয়ে ঘুরে বেড়াবে সে? জায়ানের হৃদয়টা সাথে সাথেই হাহাকার করে উঠলো। ডুকরে উঠে যেন বলল –
“সে আমায় ভালো না বাসুক,
তবুও তার ঘৃনায় আমায় না রাখুক।
সে আমার না হোক,
তবুও তার ঠোঁটের হাসিটা আমার জন্য বিস্তৃত হোক।
– ( কলমে : সাদিয়া শওকত বাবলি )

পরক্ষনেই তার হাহাকার রত হৃদয়টা আবার এই বাক্যগুলোর তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলো। পূর্বাশা তাকে ভালোবাসবে না? তার হবে না? কেন, কেন মেয়েটা তার হবে না। আর ভাবতে পারছে না জায়ান। পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। ছোট এই মাথাটা যেন এত চাপ নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। মস্তিষ্ক তাকে বারবার সাবধান করছে। বারন করছে সেই বহু বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে। আর মন বলছে পূর্বাশা তোর, মেয়েটাকে ধরে রাখ। তোর প্রথম অনুভূতি ও মেয়েটা। দরকার হলে ধরে বেঁধে রেখে দিবি তোর কাছে। বহুবছর আগে সে হারিয়ে গিয়েছিল বলে কি পূর্বাশাও হারিয়ে যাবে নাকি? বহুবছর আগে সেই মানুষটা প্র’তা’র’ক, ঠ’ক বলে কি এই মেয়েটাও প্র’তা’র’ক ঠ’ক হবে? কি করবে এখন জায়ান? কোন দিকে যাবে? জেনে বুঝে বহুবছর আগের ভুলটার আবার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে কি সে? আর তো উপায় নেই। কিন্তু মেয়েটার শরীরে যে সেই বাঙালির রক্তই বইছে। সাথে সাথেই জায়ানের মনটা আবারও প্রতিবাদ করে উঠলো তার মস্তিষ্কের বলা বাক্যের বিরুদ্ধে। মেয়েটার শরীরে বাঙালির রক্ত বইছে তাহলে তাদের শরীরে কাদের রক্ত বইছে? সে কি নিজের অস্তিত্ব ভুলতে বসেছে? ভুলে গিয়েছে কি তার শরীরেও একজন বাংলাদেশীর রক্ত বইছে? মাথা চেপে চিৎকার করে উঠলো জায়ান। এখন কি করবে সে। পূর্বশা মেয়েটার কাছ থেকে ফিরে আসার সব পথ যে বন্ধ হয়ে গেছে তার। না সে হারিয়ে যেতে দিতে পারবে না পূর্বাশাকে। জোর করে হলেও ঐ মেয়েটাকে তার চাই। চাই মানে চাই।

____________________________________

ভোরের আলো ফুটেছে। সূর্যটা কেবল তার উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে। রাস্তার ধারের দোকানগুলোও খুলতে শুরু করেছে কেবল। জায়ান নিজ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পড়েছে। রাস্তার ধারের একটা দোকানে দাঁড়িয়ে কিছু ডাম্পিলিং আর একটা কোমল পানীয় প্যাকেট করে নিয়ে ছুটেছে নিজের হোস্টেল কক্ষের পানে। স্বাভাবিকভাবেই কক্ষের দরজা আটকানো। জায়ান বার কয়েক ধাক্কা দিল দরজায়। চ্যাং উঠে এসে দরজাটা খুলে দিয়ে আবার নিজের জন্য বরাদ্দকৃত বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। জায়ান একবার আড়চোখে তাকালো তার পানে অতঃপর গিয়ে দাঁড়ালো তৃষামের বিছানার পাশে। ছেলেটার সাথে কথা বলতে নিজের ইগোতে লাগছে। যদিও তাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া বিবাধ হয়নি। শুধুমাত্র তৃষাম তার সাথে কথা বলে না বলে সেও বলে না। কিন্তু আজ কথা বলাটা প্রয়োজন। অন্তত নিজের জন্য হলেও কথা বলাটা প্রয়োজন। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো জায়ান। নিজের ইগোকে পাশে সরিয়ে রেখে ডাক দিল তৃষামকে, বলল – তৃষাম! তৃষাম!

তৃষাম নড়েচড়ে উঠলো একটু অতঃপর আবার ঘুমিয়ে পড়লো। জায়ানের ডাক যে তার কর্ণে পৌঁছায়নি তেমন নয়। অবশ্যই পৌঁছেছে। তবে সে ভেবেছে স্বপ্ন দেখছে। জায়ান তো কথা বলে না তার সাথে। আর নিজের ইগো ফেলে আগে এসে নিজে থেকে ছেলেটা তৃষামের সাথে কথা বলবে এটা জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার মতোই একটা ঘটনা। জায়ান আরও বার কয়েক ডাকলো তৃষামকে কিন্তু ছেলেটা উঠলো না। মেজাজ বিগড়ালো জায়ানের। কাল রাতে এর বোনের একটা থাপ্পর খেয়ে গাল লাল আরে আজ আবার সকাল সকাল নিজের এত বছরের ইগো ভেঙে এর সাথে নিজে থেকে কথা বলতে এসেছে আর এ কিনা এখনও ঘুমাচ্ছে? জায়ান রেগেমেগেই ঠাস করে একটা থাপ্পর মারলো তৃষামের পশ্চাৎ দেশে। ধরফরিয়ে উঠে বসলো ছেলেটা। হঠাৎ লাফিয়ে ওঠায় মস্তিষ্ক যেন তার কার্য ক্ষমতা হারিয়েছে। চকিত কন্ঠে সে শুধালো – কে! কে!

জায়ান বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তাকালো তার পানে, বলল – ওঠ তাড়াতাড়ি কাজ আছে।

জায়ানের কন্ঠে যেন হুঁশ ফিরলো তৃষামের। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় যতটা না চকিত হয়েছে এর চেয়ে বেশি এবার চকিত হয়েছে তার সাথে জায়ানকে কথা বলতে দেখে। এর মানে সে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলো না? নাকি এখনও স্বপ্ন দেখতে সে। ইগোতে ভরপুর জায়ান তার সাথে নিজে থেকে কথা বলছে? বিস্ময়কর এক ঘটনা। তৃষাম নিজের হাতে নিজে চিমটি কাটলো। পরমুহূর্তেই “আআআআ” করে ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে লাফিয়ে উঠলো সে। এর মানে স্বপ্ন দেখছে না সে? সত্যিই জায়ান নিজে থেকে কথা বলছে তার সাথে? তৃষাম গোল গোল দৃষ্টিতে তাকালো জায়ানের পানে, চকিত কন্ঠে বলল – তুই! তুই নিজে থেকে কথা বলছিস আমার সাথে?

চলবে…….

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here