স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_৭

0
324

#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৭

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

– কোনো কিন্তু না, আগে খাওয়া দাওয়া তারপর ঘোরাঘুরি।

কথাটা বলেই জায়ান একা একা হাঁটা ধরলো রেস্টুরেন্টের দিকে। বাকিদের আর কি করার তাঁরাও হাঁটা ধরলো জায়ানের পিছু পিছু। পূর্বাশা কৃতজ্ঞ হলো ছেলেটার প্রতি। হয়তো ছেলেটার ক্ষুধা লেগেছে তাই খাবে কিন্তু তার সাথে ওরও তো খাওয়া হবে। ভাগ্যিস ছেলেটা বলল খাওয়ার কথা নয়তো তাকে না খেয়েই কাটাতে হতো আজ।

ক্ষানিক সময়ের মধ্যেই পাশের এক রেস্টুরেন্টে চলে এলো তারা সবাই, বসলো এক টেবিলেই। চীনা খাদ্য তালিকার সাথে বিস্তর ফারাক বাংলাদেশী খাবারের। বাঙালীরা বরাবরই নিজেদের খাবারে ব্যাপক বাছ বিচার করে তবে চাইনিজদের মধ্যে এ ধরনের ব্যাপার তেমন একটা দেখা যায় না। তারা বেশিরভাগ পশু পাখিই খায়। যেখানে বাঙালীরা সামান্য একটা কাঁকড়া খেতে একশত বার চিন্তা করে সেখানে চীনের মানুষ কুকুরের মাংসও খেয়ে যাচ্ছে স্বানন্দে। তবে এখানে যে বাঙালীদের খাওয়ার মতো একদম কিছুই পাওয়া যায় না এটা ভুল কথা। চীনে যেমন শুকর, কুকুরের মাংস খাওয়া হয় তেমনি গরু, ছাগল, মুরগি, হাঁসের মাংসও খাওয়া হয়। এখানে নুডলস আছে, বার্গার আছে, পিজ্জা আছে, চিংড়ি, ভাত, স্যুপ, সবজি, আরও হাজারো খাবার রয়েছে বাঙালিদের খাবার যোগ্য। এখানে যেমন ড্রিংকসের ব্যবস্থা আছে তোমন কোমল পানীয়ও আছে এখন যে যেটা গ্রহন করবে সেটা এক মাত্র তার ব্যক্তিগত পছন্দ। এখন এর জন্য তো কোনো দেশের খাদ্য তালিকা কিংবা তার দেশের সংস্কৃতিকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করলে হবে না। রেস্টুরেন্টের খাবারের মেনু দেখে বাঙালিদের খাওয়ার উপযোগী বেশ কিছু খাবার অর্ডার করলো তৃষাম। খাবার আসতে হয়তো সময় লাগবে একটু। সেই সময়ের মধ্যেই এতক্ষন চুপ করে থাকা তৃষামের সাথে আসা তৃতীয় ছেলেটা মুখ খুললো। এতক্ষন এদের কথাপকথনে নিজের পরিচয় দেওয়ার সুযোগই পায়নি বেচারা। চুপচাপ শুধু দেখছিল এক একজনের কাজ কর্ম। এবার একটু সুযোগ পেয়ে সকলের উদ্দেশ্যে নিজের পরিচয় দিতে চাইলো সে, বলল – হাই, আমি চ্যাং লীন।

পূর্বাশা নামটা শুনে যেন বিষম খেল। অবাক দৃষ্টিতে সে তাকালো ছেলেটার পানে। এতদিন ধরে সে মাছের নাম শুনেছে চ্যাং ( টাকি মাছকে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বলে চ্যাং মাছ ) । এদেশে এসে কিনা এখন মানুষের নামও শুনছে চ্যাং? পূর্বাশার ভীষন ইচ্ছে হলো বলতে – চ্যাং মাছ আমি খাই না। আমার পরিবারের কেউও খায় না। আমাদের সবচেয়ে অপছন্দনীয় মাছ হলো চ্যাং মাছ।

তবে মুখ ফুটে সে বলতে পারলো না কিছুই। এই ধরনের কথা মোটেই তার স্বভাবের সাথে যায় না। এ ধরনের কথা শুধুমাত্র সে মনে মনে ভাবতেই পারে কারো সম্মুখে বলতে পারে না কখনও। সবার পরিচয় দিতে দিতে পূর্বাশার পালা এলো। বেশ নমনীয় কন্ঠেই সে বলল – আমি পূর্বাশা।

একটু বাদেই খাবার দেওয়া হলো তাদের টেবিলে। টেবিলের সবাই কম বেশি কথা বলছে, হাসাহাসি করছে আর খাচ্ছে। শুধুমাত্র কথা নেই, হাসাহাসি নেই পূর্বাশা আর জায়ানের মুখে। পূর্বাশা মেয়েটা তো এমনিই কথা বলতেই ভুলে গেছে। হাসা তো ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। ছোট বেলায় কখনও সখনও যদি জোরে মন খুলে একটু হেসেছে তখন পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন নির্দিধায় তাকে বলেছে এমনি তো মেয়ের ঐ শ্রী তার মধ্যে হাসিরও মাধুর্য নেই কোনো। স্কুলের সহপাঠিরা বলেছে তুই ওমন হাসিস না তো পূর্বাশা। এমনিই তো কালো পে’ত্মী। তার মধ্যে সাদা দাঁত বের করে হাসলে তোকে একদম রা’ক্ষ’সী’র মতো লাগে। ভয় লাগে আমাদের। সেই থেকেই আস্তে আস্তে মেয়েটা হাসতেও ছেড়ে দিয়েছে। এখন অবশ্য না হাসতে হাসতে আর পাছে মানুষের সর্বদা তিরস্কারমূলক কথায় প্রাণ খুলে হাসাটাই ভুলে গেছে মেয়েটা।

আর জায়ান, তার কোনো কালেই এই সকল অতিরিক্ত বা অপরিচিত মানুষ পছন্দ নয়। বরাবরই একা একা থাকতেই বরাবর পছন্দ করে সে। এই ভার্সিটিতে এসে তার রুমমেট হিসেবে পড়লো তৃষাম। নিজের ভিতরকার কোনো এক টানে তার বন্ধুত্ব হলো এই বাঙালী ছেলেটার সাথে। যদিও সে এখনও বেশি কথা বলে না বা নিজের কোনো কথাই শেয়ার করে না বরাবর তৃষামই বলে, চিৎকার করে, হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখে চারপাশ। জায়ান বসে বসে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এখনও যেন করছে কি আবার মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকিয়ে দেখছে পূর্বাশার পানে। মেয়েটাকে যত দেখছে ততই যেন অবাক হচ্ছে জায়ান। বিদেশে এসেও এমন পোশাক, মলিন মুখ, কথা না বলা, না হাসা সবটাই অবাক করে দিচ্ছে তাকে। ক্ষনে ক্ষনে কেমন যেন মেয়েটার প্রতি তার কৌতুহল বেড়ে যাচ্ছে। এই প্রথম কোনো মেয়ের প্রতি কৌতুহল অনুভব করছে জায়ান তাও কিনা কোনো বাঙালী মেয়ের প্রতি। বিষয়টা খুবই অবাক করা হলেও এটাই সত্যি। পূর্বাশার দিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎই নিজের অবস্থান ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। পূর্বাশার সামনে থেকে খাবার প্লেটটা হঠাৎই টেনে নিল জায়ান। আকস্মিক ঘটনায় হতবাক হলো সবাই। কেউ কিছু বলার আগেই জায়ন খাবার প্লেটটা নিয়ে হাঁটা ধরলো রেস্টুরেন্টের বাইরের দিকে। বাইরে বেরিয়েই রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটা কুকুরকে ঢেলে দিল প্লেটের সব খাবার। এবার যেন হতবাকে সপ্তম আকাশে পৌঁছালো সবাই। নৈরীতাও অবাক হলো ভীষন। তার খাবার কেড়ে নিয়ে রাস্তার কুকুরকে দিয়ে দিল এই নাক উঁচু ছেলেটা? যদিও পূর্বাশা খেতে পারছিলো না আর। আবার লোকলজ্জা আর চাপা স্বভাবের কারনে কাউকে বলতেও পারছিলো না যে, “আমি খেতে পারছি না।” তাই বলে তার সমস্ত খাবার রাস্তার কুকুরকে দিয়ে দিবে? মনে মনে ভীষন অপমানিত বোধ করলো পূর্বাশা। অপমানে, লজ্জায় চোখ দুটো ভরে উঠলো তার। এই দেশে এসে এতগুলো ভালো মানুষের মধ্যে এমন একটা খারাপ মানুষের সাথে দেখা না হলেও তো পারতো। কেউ সাহস করে জায়ানকে কিছু না বলতে পারলেও তৃষাম চুপ রইলো না, সে কিছুটা রুক্ষ কন্ঠেই প্রশ্ন করলো – পূর্বার খাবারগুলো তুই কুকুরকে দিয়ে দিলি কেন?

জায়ান তাকালো রাস্তার কুকুরটার দিকে। হাত রাখলো বোবা প্রানীটার মাথার উপর। তাকে সযত্মে খাওয়াতে খাওয়াতে বলল – তোর বোনের থেকে খাবারটা ওর বেশি জরুরী ছিল বেশি।

– তুই অন্য খাবার দিতে পারতি। নয়তো আমাকে বলতি আমি আলাদা খাবার প্যাকেট করে দিতাম। তাই বলে তুই পূর্বার খাবারটা দিয়ে দিবি কুকুরকে?

জায়ান উত্তর দিল না কোনো। কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো সে। খাবার পেয়ে বোবা প্রানীটাও আনন্দে আত্মহারা। কতদিনের অভুক্ত ছিল কে জানে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল তৃষাম। সে বেশ ভালোই জানে এই জায়ানের সাথে কথা বলে লাভ নেই কোনো। তার যখন যা ইচ্ছে হয় করবে মানে করবে। বরাবরই হুটহাট কাজ করার ছেলে জায়ান। কোনো কাজ করে কখনও কইফিয়ত দিতেও দেখা যায়নি। বন্ধুর কাছে নতি স্বীকার করে তৃষাম তাকালো পূর্বাশার পানে, ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল – মনে কিছু করিস না পূর্বা, ও একটু এমনই।

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো পূর্বাশা। এসব কাহিনী তো তার কাছে নতুন নয় বরং নিত্যদিনের ঘটনা। এতে আবার তার মনে করার আছে কি? এই জীবনটার প্রতিই তো তার আর অভিযোগ নেই কোনো আর তো তুচ্ছ মানুষের প্রতি। কন্ঠ কিছুটা খাদে নামালো পূর্বাশা, বলল – আমি কিছু মনে করিনি তৃষাম ভাই।

এই ঘটনার পর আর ঘোরাঘুরির কথা তুললো না কেউ যে তার মতো হোস্টেলে ফিরে গেল।

__________________________________

রাত বেড়েছে কিছুটা। চারদিকে আঁধার ঘনিয়েছে। যদিও ভার্সিটির মধ্যে আঁধারের লাশ কম। চারপাশটা কৃত্রিম আলোর ঝলকানি আলোকিত করে রেখেছে। পূর্বাশাদের হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে তৃষামরাও ফিরেছে হোস্টেলে। রুমে ফিরেই জায়ান হাতের মোবাইলটা রাখলো তার জন্য বরাদ্দকৃত টেবিলের উপর। ওয়াশ রুমে যাবে ফ্রেশ হতে। কিন্তু তার আগেই তার উপর চড়াও হলো তৃষাম, বেশ রাগী কন্ঠে বলল – তুই কেন তখন পূর্বার খাবার কুকুরকে দিলি?

জায়ান পড়নের শার্টের বোতামগুলো খুলতে খুলতেই জবাব দিল – এক কথা আমি বারবার বলতে পছন্দ করি না তৃষাম।

জায়ানের কথায় আরও কিছুটা রেগে গেল তৃষাম, শক্ত কন্ঠ বলল – আমারই ভুল। আমি জানি বাঙালীদের প্রতি তোর এলার্জি। আর তা জেনে শুনেই আমি তোকে আনতে পাঠিয়েছি পূর্বাকে। তোকে আমার না সকালে পূর্বাশাকে আনতে পাঠানো উচিত হয়েছে আর না এখন ওর সামনে নিয়ে যাওয়া উচিৎ হয়েছে।

কথাটা বলে একটু থামলো তৃষাম, আবার বলল – এক মিনিট এক মিনিট তুই আবার সকালেও ওর প্রতি খারাপ ব্যবহার করিসনি তো।

জায়ান শীতল দৃষ্টিতে তাকালো তৃষামের পানে, শান্ত কন্ঠেই বলল – তোর কি মনে হয়?

– দেখ পূর্বা আমার বোন। আমার সাথে যা খুশি কর কিন্তু ওর প্রতি আমি কোনো খারাপ ব্যবহার মেনে নেব না। মেয়েটা ছোটবেলা থেকে সহ্য করেছে অনেক কিছু। আমি চাই না ভিনদেশে এসেও ও খারাপ কিছুর মুখোমুখি হোক। এমনিই অলরেডি একবার….

কথাটুকু সম্পূর্ণ শেষ না করেই থেমে গেল তৃষাম। পূর্বাশার আ’ত্ম’হ’ত্যার কথাটা বলতে গিয়েও চেপে গেল সে। জায়ান তার বন্ধু হতে পারে কিন্তু পূর্বাশার নয়। এভাবে একটা মেয়ের ব্যক্তিগত কথা কারো কাছে বলাটা মোটেও শোভনীয় নয় হোক সে তার বোন। তৃষামকে থেমে যেতে দেখেই ভ্রু কুঁচকালো জায়ান, বলল – একবার কি?

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তৃষাম, বলল – দেখ আমার বোনকে পছন্দ না হলে ওর সাথে কথা বলবি না বা ওর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবি। কিন্তু ভুলেও ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করবি না কোনো বলে দিলাম।

চলবে……

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here