অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১২।

0
307

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১২।

ফোনটা রিসিভ করে কানে লাগাল ফারজাদ। এই পুরোটা সময় যতটা না বিরক্ত ছিল, তাকে বিলম্ব করে কল দেওয়াতে তার থেকে হাজার গুণ বেশি বিরক্ত বোধ করল সে। কলটা রিসিভ করেই ক্ষিপ্ত সুরে বলল,

‘সময় জ্ঞান একেবারেই নেই দেখছি। একটা মানুষকে আর কত হয়রানি করাবেন?’

অপরাধ বোধে সংকুচিত হয়ে পড়ে প্রিয়তা। চোখ মুখ শুকিয়ে আসে। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,

‘আমি ভীষণ দুঃখিত। ক্ষমা করবেন। আসলে.. আসলে ফোন জোগাড় করতে পারছিলাম না, তাই..’

আরো একবার মিথ্যে বলে থামল সে। ফারজাদ শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘কোথায় আছেন, তা বলুন।’

প্রিয়তা আশেপাশে তাকাল। নির্দিষ্ট কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে, যেটা বলে সহজেই ফারজাদকে চেনাতে পারবে। কিন্তু সেইরকম কিছুই চোখে পড়ল না তার। তাই সে জিজ্ঞেস করল,

‘আপনি কোথায় আছেন?’

‘বাজারের ডান দিকের মোড়ের ছোট হোটেলটার সামনে।’

প্রিয়তা আগ্রহ নিয়ে বলল,

‘মিয়া বিবি নাম যে, ঐটা?’

ফারজাদ হোটেলের নামফলকটা দেখে বলল,

‘জি, এখানেই।’

‘আচ্ছা, আপনি দাঁড়ান। আমরা দু’মিনিটে আসছি।’

‘আমরা?’

প্রশ্নটা কান অবধি যাওয়ার আগেই প্রিয়তা কল কেটে দেয়। তার মধ্যে অস্থিরতা ভীষণ। সে মিলির হাত টেনে বলল,

‘চলো, উনি চলে এসেছেন?’

ফোনটা অন্যহাতে সেই ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

‘ধন্যবাদ।’

ছেলেটা হেসে বলল,

‘আবার আসবেন, আমার বাড়ির চৌকাঠ আপনাদের ঘুমের জন্য সদা উন্মুক্ত।'(উর্দু)

প্রিয়তা তার কথা শুনে হেসে ফেলল। ভারি মজার মানুষ বোধ হয়। সময় থাকলে আরেকটু কথা বলতো অবশ্যই। তবে এখন যেতে হবে। তাই তাড়া দেখিয়ে বলল,

‘আজ যাই তবে। ভালো থাকবেন।’

ছেলেটা হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল। প্রিয়তা ছুটল দ্রুত। দু’মিনিট বললেও পাক্কা সাত মিনিট পর ফারজাদের সম্মুখে হাজির হলো সে। তাকে প্রথম দেখাতেই কপাল কুঁচকাল ফারজাদ। প্রিয়তা মেয়েটাকে তো কালই দেখেছিল, ফুরফুরে, স্ফূর্ত লাগছিল। একদিনেই মেয়েটার এমন বিধ্বস্ত অবস্থা কেন? তবে কি সে যা বলছিল সব সত্যি?

ফারজাদ প্রশ্ন করার আগেই প্রিয়তা বলল,

‘ও হচ্ছে মিলি। এই মেয়েটাও আমার মতো বিপদে পড়েছে। আমরা পালিয়ে এসেছি। এখান থেকে বের হতে না পারলে ওরা আবার আমাদের খুঁজে বের করে ফেলবে।’

ফারজাদ ভ্র কুঁচকে প্রশ্ন করল,

‘কারা?’

‘ঐ নারী পাচারের লোকেরা।’

ফারজাদ সন্দিহান সুরে শুধাল,

‘আপনি ওদের খপ্পরে পড়লেন কী করে?’

প্রিয়তা থামল। ভাবল এক পল। বলল,

‘দুপুরের খাবারের পর আমার একটু মাথা ঘুরাচ্ছিল বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর চোখ খুলতেই দেখি একটা ট্রাকে আমরা অনেক মেয়ে। সবাই এখনো বন্দি তাদের কাছে। আমরা এই দুজন ভীষণ কষ্টে পালিয়ে এসেছি।’

‘বলেন কী? এত বড়ো বিপদ সাথে নিয়ে আপনি এখন করাচি যাবেন? পুলিশ কেইস করতে হবে আগে।’

‘না না, আমি আর কিছু করতে চাই না। আমাকে করাচি নিয়ে যান, আমি দেশে ফিরে যাব।’

ফারজাদ তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,

‘দেশে ফিরে গেলে আপনার প্রেমিকের কী হবে?’

প্রশ্ন শুনে অবাক হলো প্রিয়তা। ওয়াদির কথা কি ফারজাদ জানে? সে প্রশ্ন করার জন্য উদ্যত হতেই ফারজাদ নিজ থেকেই বলল,

‘আম্মি আমায় সব বলেছেন। আর সব শুনে একটাই কথা মনে হয়েছে যে, মেয়েদের যে নির্বোধ প্রাণী বোধ হয় দুনিয়াতে আর একটাও নেই। একটা ছেলের জন্য মা বাবা, পরিবার ছেড়ে চলে এলেন? কী পেলেন এর বিনিময়ে? এই যে, এই বিভৎস কিছু মুহুর্ত। ভালো লাগছে এবার? কোথায় আপনার সেই প্রেমিক? এবার আসতে বলুন তাকে, আপনাকে বাঁচাতে বলুন। তাকে না ডেকে আমাকে কেন ডাকলেন?’

প্রিয়তার গাল উপচে জল গড়াল। মিলি কিছু না বুঝলেও এইটুকু বুঝতে পারল প্রিয়তা কষ্ট পাচ্ছে। প্রিয়তার চোখের জল ফারজাদকে আরো বেশি ক্ষেপাল। সে কাঠকাঠ গলায় বলল,

‘প্রেমিক ধোঁকা দিয়েছে বলে যে কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। কাঁদছেন কেন? কাঁদলে কি আপনার সেই জঘন্য মানুষের প্রতি খরচ করা সময়গুলো ফিরে আসবে? নাকি ফিরে আসবে, তার প্রতি আপনার খুইয়ে ফেলা অনুভূতিগুলো। আর কোনোকিছুই ফিরে আসবে না। মেয়ে বলেই যে চিমটি খেয়ে কাঁদতে হবে, তা ভুলে যান। কেউ আপনাকে চিমটি দিলে আপনি তাকে অস্ত্রাঘাত করবেন। তাও কাঁদবেন না। কেঁদে কেটে নিজেকে দূর্বল প্রমাণ করবেন না, দয়া করে।’

প্রিয়তা হতভম্ব, হতবিহ্বল, নিষ্পলক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। সে এই মানুষটাকে যেমন ভাবছিল, মানুষটা মোটেও তেমন না। বরং বিপরীত তার। সে কিছু বলার আগেই ফারজাদ বলল,

‘গাড়িতে উঠে বসুন। আমরা এখান থেকে আগে থানায় যাব। ওয়াদির নামে কেইস করা হবে। বাকি মেয়েগুলোকেও উদ্ধার করতে হবে।’

প্রিয়তা শক্ত করল নিজেকে। ওড়না দিয়ে নাক মুখ মুছে বলল,

‘জি, চলুন।’

ফারজাদ গাড়ি ঘুরিয়ে থানায় গেল আগে। প্রিয়তা আদ্যোপান্ত সব খুলে বলল ডিউটি অফিসারকে। ওয়াদির নামে কেইস হলো। অফিসার বললেন, “কেইসটার একটা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত প্রিয়তা যেন দেশের বাইরে না যায়।”
এটা শুনে আরেক মাথা ব্যথার সূত্রপাত হলো যেন। এই কেইস কি আর এত তাড়াতাড়ি সমাধান হবে? এই মাঝের এত সময় সে কার কাছে থাকবে? কোথায় থাকবে? একটা হোটেলে যে থাকবে, তারও তো অনেক খরচ। এত টাকা তো আর সে সাথে করে নিয়ে আসেনি। আর যতটুকুই নিয়ে এসেছিল, সবটাই ওয়াদির বাড়িতে তার ব্যাগেই রয়ে গিয়েছে। প্রচন্ড আফসোস হচ্ছে তার। নিজের সুন্দর, স্বাভাবিক জীবনটাকে সে নিজের হাতে নষ্ট করেছে। আবার কবে সবটা আগের মতো হবে কে জানে।

মিলি থানাতেই রয়ে যায়। ওর পরিবারের কাছে ওকে পৌঁছে দিবে থানা থেকে। প্রিয়তাকে ফারজাদ সাথে করে নিয়ে আসে। থানায় ফারজাদ প্রিয়তাকে তার কাজিন হিসেবে পরিচয় করায়। নয়তো পরে এই পরিচয় নিয়েও আরেক ঝামেলা হতো।

____

গাড়িটা চলছে তার গন্তব্যের দিকে। সিটে হেলান দিয়ে বসা প্রিয়তার চোখের পল্লব নিমীলিত। ভেজা পাপড়ি জানান দিচ্ছে, এখনো পানি আছে তার চোখে। ফারজাদ একবার পরখ করেছে তাকে। মেয়েটা যে মারাত্মক কষ্টে আছে, সেটা সে বুঝতে পারছে। কিন্তু, এমনটা বোধ হয় হওয়ার’ই ছিল। পৃথিবীতে আজ আর কোনো সুস্থ সুন্দর ভালোবাসা নেই, সব কিছুতেই ফরমালিন। আর এই অতিমাত্রায় ফরমালিন যুক্ত ভালোবাসা গ্রহণ করছে বলেই মানুষের আজ এই অবস্থা। তার আরো একটা প্রমাণ ফারজাদের চোখের সম্মুখেই। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজকাল ফরমালিনহীন ভালোবাসা পাওয়া যেন সোনার হরিণ পাওয়ার সমতুল্য।

গাড়িটা থেমে যায়। ফারজাদ ঘড়িতে চেয়ে দেখে সময় বারোটা অতিক্রম করে গিয়েছে। ইতোমধ্যেই দিলরুবা বেগম কল দিয়ে অস্থির বানিয়ে ফেলেছেন তাকে। সে জানিয়েছে, আসছে; সময় লাগবে। ঘুমিয়েও পড়তে বলেছিল তাঁকে। কিন্তু সে জানে, তার পদযুগল বাড়িতে স্থান না পাওয়া অবধি তিনি দু চোখের পাতা ভুলেও এক করবেন না।

সে একপলক প্রিয়তাকে দেখল। তখন খেয়ে রওনা দেওয়া উচিত ছিল। মেয়েটা সারাদিন কিছু খায়নি বোধ হয়। সে গাড়ির ভেতরের লাইটটা জ্বালিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। কিছুটা এগিয়ে আসতেই দূরে সে একটা ছোট্ট খাবারের দোকান দেখতে পায়।

চোখ মেলে তাকায় প্রিয়তা। হঠাৎই চারদিক ভীষণ নীরব, নিস্তব্ধ মনে হয় তার। কেমন যেন গা শিউরে উঠা একটা পরিবেশ। সে পাশে তাকিয়ে ফারজাদকে না পেয়ে আরো বেশি ঘাবড়ে যায়। বাইরে তাকায়, তবে দৃষ্টি সীমার ভেতর ফারজাদকে আর দেখতে পায় না। আচমকা এক অদ্ভুত ভয়ে বুকে মোচড় দেয় যেন। সে ঢোক গিলে। অস্থির হয়ে উঠে। ফারজাদকে খোঁজে এদিক ওদিক। বাইরে আলোও নেই খুব একটা। স্পষ্ট তাই কিছু দেখাও যাচ্ছে না। সে দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। এদিক ওদিক দেখে উদ্ভ্রান্তের মতো। কাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভীষণ ভাবে অস্থির করে তুলছে তাকে। ভয় পাচ্ছে সে, মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি ঐ লোকগুলো এসে তাকে তুলে নিয়ে যাবে। সে চেঁচিয়ে উঠে। ফারজাদের নাম ধরে ডাকে। সাড়া নেই। ঢোক গিলে প্রিয়তা। ফারজাদ এই মাঝ রাস্তায় তাকে একা রেখে কোথায় গেল?

চলবে….

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here