অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১৩।

0
308

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩।

প্রিয়তা ফারজাদকে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল যেন। সে দ্রুত হাঁটা ধরল সামনের পথে। টিমটিমে আলো, এই আলোয় মানুষ খোঁজা মুশকিল। কিছুটা এগুতেই দূরে এক টুকরো আলোর ঝলক পায় সে। মনে কিছুটা সাহস আসে। দু পা এগুতেই থেমে দাঁড়ায়। তার স্বল্প পরিচিত মানুষটা এদিকেই আসছে। বুকের ভেতরের পাথর নামে এতে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।

ফারজাদ দূর থেকে প্রিয়তাকে খেয়াল করে। তাকে এভাবে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয় ভীষণ। এমনিতেই এত বড়ো এক বিপদ পেরিয়ে এসেছে মেয়েটা, এখন আবার গাড়ি থেকে নেমে কীভাবে একা দাঁড়িয়ে আছে দেখো!

ফারজাদ তার সম্মুখে গিয়ে স্থির হয়। জিজ্ঞেস করে,

‘গাড়ি থেকে নামলেন কেন?’

প্রিয়তা মাথা নুয়াল। অস্বস্তি বোধ হচ্ছে ভীষণ। মিইয়ে যাওয়া সুরে জবাব দিল,

‘আপনাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাই…’

‘আমি নিশ্চয়ই আপনাকে একা রেখে চলে যেতাম না। এতটা নির্দয় আমি নই। যান, গাড়িতে গিয়ে বসুন। খাবার নিয়ে এসেছি; খেয়ে দেয়ে আবার রওনা দিব।’

কৃতজ্ঞতায় চোখ ছলছল করছে প্রিয়তার, তবে মুখে আর রা করে না। গাড়িতে গিয়ে বসে। ফারজাদ খাবার বের করে বলে,

‘খেয়ে নিন।’

‘আপনি খাবেন না?’

‘না, একেবারে বাড়ি ফিরে খাব।’

কাল রাত থেকে না খাওয়া সে। পেটের ভেতর গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। পেট ডাকছে বোধ হয়, “খাবার দে, খাবার দে” বলে। প্রিয়তা আর বিলম্ব করল না তাই। খেতে আরম্ভ করল। ততক্ষণে ফারজাদ মা’কে কল দিয়ে জানাল, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে পৌঁছে যাবে, মা যেন দুশ্চিন্তা না করেন।

প্রিয়তার খাবার শেষ। প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে বসে আছে সে। ফারজাদ দেখে বলল,

‘শেষ?’

‘জি?’

‘প্যাকেটগুলো দিন।’

প্রিয়তার হাত থেকে প্যাকেটগুলো নিয়ে সে পেছনের সিটে রেখে দিল। পরে নেমে ডাস্টবিনে ফেলে দিবে। তাদের যাত্রা শুরু হয় পুনরায়। পেট শান্তি তো মন শান্তি। কিন্তু এবারে পেট শান্তি থেকেও প্রিয়তার মনটাতে শান্তি নেই। এক অযাচিত ঝড়ে সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে। এমনটা হয়তো দুঃস্বপ্নে সে ভাবেনি কখনো। ওয়াদির প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। শুরু থেকেই ওয়াদি এতটাই ভালোবাসা প্রকাশ করেছিল যে, এক মুহূর্তের জন্যও সন্দেহ হয়নি তার। বরং মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রতিটা ব্যবহারে। অথচ, এখানে আসার পর যেন এক অন্য ওয়াদির সাথে তার দেখা হয়েছে; একেবারে বিপরীত তার। এত জঘন্য! কথাগুলো ভাবতেই বুক ফেটে যাচ্ছে যেন। এত নিষ্ঠুর, নির্দয়, জঘন্য এক মানুষকে সে এতদিন যাবত ভালোবাসে এসেছে? আর এই তার প্রতিদান?

প্রিয়তা জোরে নিশ্বাস ফেলে। অন্তরের দহনে পুড়ে ছাই হওয়া বাষ্পগুলো যেন সেই নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে এসেছে। সে বাইরে চাইল। নীরব, নিস্তব্ধ রাস্তায় তাদের গাড়ি ছাড়া আর তেমন কোনো গাড়ি নেই। প্রিয়তা দেখল, তার সাথে সাথে আকাশের অর্ধবৃত্ত চাঁদটাও আসছে। হাসল সে। শুকনো মুখের বিষন্ন হাসি। আনমনেই বলল,

‘আমি ওয়াদিকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করেছিলাম। ওর জন্য সব ছেড়ে ছুড়ে এখানে এসেছি আমি। আর আজ ওর জন্যই আমার এই করুণ দশা। ওর সাথে শেষ দেখার কালে আমি কষিয়ে ওর গালে একটা চ ড় মারতে চাই। আমি জানি, সামান্য এক চ ড়ে ওর কিছুই যায় আসবে না তবে, আমি শান্তি পাব।’

ফারজাদ শুনল সব। বলল না কিছু। প্রিয়তা বাকিটা সময় বাইরে চেয়েই কাটিয়ে দিল।

এক ঘন্টার ভেতরেই গন্তব্যে পৌঁছে গেল তারা। বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ পেয়েই দরজা খুলে দাঁড়ান দিলরুবা বেগম। মৌমি ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি কেবল ছেলের দুশ্চিন্তায় চোখের পাতা এক করতে পারেননি। ফারজাদ গাড়ি পার্কিং করে এগিয়ে আসে। তাকে দরজার সামনে দেখে দিলরুবা বেগম আশ্বস্ত হলেও প্রিয়তাকে দেখে চমকে যান তিনি। বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলে উঠেন,

‘প্রিয়তা, তুমি?’

ফারজাদ প্রিয়তার দিকে চাইল। প্রিয়তার মাথা নুয়ানো। যেন কোনো এক অপরাধ করে ধরা পড়েছে সে। ফারজাদ বলল,

‘সে অনেক কাহিনী, আম্মি। সকাল হলে সব জানতে পারবেন। আপাতত উনার ঘুমের প্রয়োজন। উনাকে গেস্ট রুমে নিয়ে যান।’

দিলরুবা বেগম আন্দাজ করে নিলেন, মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গিয়েছে, যার বিন্দুমাত্র আভাস তিনি পাননি। এবার আর সারারাত উনার ঘুম হবে না নিশ্চিত। তাও ছেলের কথামতো প্রিয়তাকে নিয়ে গেস্ট রুমে গেলেন। বললেন,

‘তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি খাবার আনছি।’

‘আমি খেয়েছি, আন্টি। উনি খাননি, উনাকে খাবার দিন।’

‘কে, ফারজাদ?’

‘জি।’

‘আচ্ছা, তবে তুমি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ো; সকালে কথা হবে।’

দিলরুবা বেগম দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেলেন। গিয়ে খাবার টেবিলে খাবার বাড়লেন ছেলের জন্য। ফারজাদ কিছুক্ষণের মাঝেই ফ্রেশ হয়ে এল। চেয়ার টেনে বসল সে। দিলরুবা বেগম প্লেটে খাবার দেন, তরকারি দেন। অন্য প্লেটে নিজের জন্যও বাড়েন। ফারজাদ চিন্তিত স্বরে বলে উঠে,

‘আপনি এখনো খাননি, আম্মি? আপনার না ঔষধ খেতে হয়, সময় কেন মেনে চলেন না, বলুন তো?’

দিলরুবা বেগম হেসে বললেন,

‘তোমার অপেক্ষাতে ছিলাম।’

ফারজাদ হতাশ স্বরে বলে,

‘আমার জন্য কেন অপেক্ষা করে নিজের ঔষধের সময়টা নষ্ট করেন? আর এমন করবেন না, আম্মি। নয়তো আমি কিন্তু খুব রাগ করব।’

দিলরুবা বেগম উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন,

‘খুব বড়ো হয়েছ, তাই না? এখন মা’কেও শাসন করছো?’

‘মা’রা কথা না শুনলে এমন একটু আধটু শাসন করতেই হয়। পরেরবার থেকে আমার কথা শুনতে হবে।’

‘আচ্ছা বাবা, শুনব। খাও এবার।’

খাবারের মাঝেই প্রিয়তার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা সে খুলে বলল দিলরুবা বেগমকে। সব শুনে পুরো ভাতটুকু আর তিনি খেতে পারলেন না। গলায় যেন আটকে যায় সবটা। তাঁর কোটর ভরে ওঠে। ফারজাদ মা’কে কিছু বলে না। মা যে সব শুনে কাঁদবেন সেটা সে আগেই জানত। মা’কে তাই তাঁর মতো ছেড়ে দিয়ে খাবার খেয়ে উঠে যায় সে।

দিলরুবা বেগম অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে বসেছিলেন। তারপর আবেক শূণ্য নিষ্প্রাণ গতিতে বাকি কাজ সেরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান তিনি। আজ অনেকদিন পর আবার একটু প্রাণ খুলে কাঁদার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তারপর অনেক রাত অবধি কাঁদলেন দিলরুবা বেগম। কেন কাঁদলেন, কার জন্য কাঁদলেন সেই ব্যাপারে অজ্ঞাত যদিও।
কাঁদতে কাঁদতে মাথা ধরেছে এবার। এখন ঘুমাতে হবে। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েন। চোখ বোজেন। কিন্তু, জল ভেজা ভারি পল্লবে ঘুম আজ দেখা দিচ্ছে না। হয়তো এভাবেই রাত কাটবে, ভোর হবে, দিলরুবা বেগম আর ঘুমাতে পারবেন না।

_____

চোখ পিটপিট করে তাকায়, প্রিয়তা। মার্তন্ডের উজ্জ্বল আলোটা চোখে লাগছে ভীষণ। সে উঠে বসল। ঘড়িতে চেয়ে দেখল, নয়টা বাজছে। ফ্রেশ হয়ে অতঃপর বাইরে বের হলো সে। বসার ঘর অবধি গেল, কাউকে চোখে পড়ল না। তাই ধীর পায়ে এগিয়ে রান্নাঘরের সামনে গেল সে। দিলরুবা বেগমকে দেখে আনমনে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছেন। পাতিলে বসানো চায়ের লিকারটা উপচে পড়ছে, সেদিকে উনার খেয়াল নেই। প্রিয়তা দ্রুত এসে চুলাটা বন্ধ করল। দিলরুবা বেগম চকিত চেয়ে বললেন,

‘চা পড়ে গিয়েছে?’

‘না, পড়েনি।’

তিনি পাতিল নামিয়ে রাখলেন। প্রিয়তার দিকে চেয়ে প্রসন্ন হাসলেন। বললেন,

‘ঘুম ভালো হয়েছে তো?’

প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘জি।’

‘আচ্ছা, ডাইনিং-এ গিয়ে বসো, আমি খাবার নিয়ে আসছি।’

প্রিয়তা একটু দূরে সরে দাঁড়াল। আমতা আমতা করে বলল,

‘আমি সাহায্য করব, আন্টি?’

দিলরুবা বেগম চেয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বললেন,

‘না, মা। সাহায্য লাগবে না। তুমি বসো গিয়ে।’

প্রিয়তার অস্বস্তি লাগছে। সে ক্ষীণ সুরে বলল,

‘আমি চা’টা কাপে বেড়ে নিয়ে যাই?’

দিলরুবা বেগম বুঝলেন, মেয়েটার বসে খেতে অস্বস্তি হচ্ছে। তিনি মাথা হেলিয়ে বললেন,

‘বেশ তবে, নিয়ে যাও। আর চা রেখে মৌমিকে ডেকে দিও।’

প্রিয়তা হেসে মাথা নাড়াল।

চলবে….

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here