অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৬।

0
785

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬।

মাছের একটু টুকরো মুখে তুলে চমকায় প্রিয়তা। ফ্যালফ্যাল করে ওয়াদির দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘এটা তুমি রেঁধেছ?'(উর্দু)

ওয়াদি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,

‘হ্যাঁ। কেন, মজা হয়নি?’

প্রিয়তা আরেকটুকু মুখে তুলে বলে,

‘দারুণ হয়েছে।’

খুশি হয় ওয়াদি। প্রিয়তা মজা করে সবগুলো খাবার খায়।
খাবার শেষ করে ওয়াদিকে সব গুছিয়ে রাখতে সাহায্য করে সে। যদিও এবারও ওয়াদি তাকে বারণ করছিল তবে প্রিয়তা সেসব অগ্রাহ্য করে একপ্রকার জোর করেই সাহায্য করেছে তাকে। সব গুছিয়ে ওয়াদি বলল,

‘তুমি ঘরে যাও, আমি আসছি।’

তার কথা মতো প্রিয়তা ঘরে চলে আসে। ওয়াদি হাত মুছে ফোন বের করে কাউকে একটা কল লাগায়। কল রিসিভ হতেই সে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘ঠিক নয়টায় তৈরি থাকবি। আমি যেন গেইটের বাইরে গাড়ি পাই।’

ঐপাশের ব্যক্তি কী বলে সেটা আর শোনা যায় না। ওয়াদি কল কেটে দেয়। তারপর সে যায় তার ঘরে।

প্রিয়তা বারান্দায় দাঁড়ান। ওয়াদি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে। হঠাৎ স্পর্শে চমকে যায় প্রিয়তা। নিজেকে ছাড়িয়ে অপ্রস্তুত হেসে বলে,

‘তোমার বারান্দায় কয়েকটা ফুলের গাছ থাকলে ভালো হতো।'(উর্দু)

ওয়াদি বলল,

‘বিয়ের পর নিজের ইচ্ছে মতো করে নিও সব।'(উর্দু)

প্রিয়তা খুশি হয়ে বলল,

‘আচ্ছা। মা বাবার আসতে আর কতক্ষণ সময় লাগবে?’

‘এই তো সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাবেন।’

প্রিয়তা ছোট্ট করে বলল,

‘ওহ।’

ওয়াদি তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। বলল,

‘কাল যাদের বাড়িতে ছিলে উনারা কি তোমার কোনো আত্মীয় হয়?'(উর্দু)

‘না না। ঐ আন্টির সাথে তো আমার রাস্তায় দেখা হয়েছিল। তুমি আসছিলে না বলে রাস্তায় বসে কাঁদছিলাম আমি। উনি রাস্তা থেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে উনার বাড়িতে আশ্রয় দেন। জানো, উনারা অনেক ভালো। আমাকে পুরো নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছেন।'(উর্দু)

ওয়াদি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

‘বাঙালি পরিবার না-কি? বাংলায় কথা বলল দেখলাম।’

‘হ্যাঁ, আন্টি বাংলাদেশী। তবে পঁচিশ বছর যাবত দেশের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। আমাকে পেয়ে তাই অনেক খুশি হয়েছিলেন।'(উর্দু)

ওয়াদি এক পল কী যেন ভাবল। বলল,

‘ঐ মহিলার স্বামী কী করেন?'(উর্দু)

প্রিয়তা ভাবুক সুরে বলল,

‘সেটা তো জানি না। ঐ বাড়িতে কেবল উনার একটা ছেলে আর মেয়েই ছিল। স্বামী সম্পর্কে তাই জানি না কিছু।’

ওয়াদি ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে বলল,

‘আচ্ছা, বাদ দাও এসব। তুমি বরং তোমার ফোন আর আইডি কার্ডটা দাও, আমি একটা সিম তুলে নিয়ে আসি।'(উর্দু)

‘এখন বাইরে যাবে?'(উর্দু)

‘হ্যাঁ। তোমার সিম নেওয়াটা জরুরি।'(উর্দু)

‘ঠিক বলেছ। দাঁড়াও, আমি বের করে দিচ্ছি সব।’

প্রিয়তার মোবাইল ফোন আর প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র নিয়ে ওয়াদি বেরিয়ে যায় তার কাজে। দরজা আটকে ফিরে আসে প্রিয়তা। এখন এই পুরো বাড়িতে সে একা। যদিও খুব একটা ভয় তার করছে না তাও একটু কেমন কেমন যেন লাগছে তার।

ওয়াদির ঘরে ফিরে আসে। বারান্দা দরজা আটকে বিছানায় গিয়ে বসে সে। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে এখন মা বাবার কথা যেন মনে পড়ছে খুব। উনারা কী করছেন কে জানে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই পুলিশ কেইস করে দিয়েছেন। মা’র অবস্থা নিশ্চয়ই খুব করুণ। সিদ্ধান্ত নেয়, বিয়েটা হয়ে গেলেই দেশে ফিরবে। মা বাবা আর ভাইয়ের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে সে। মা বাবা সবকিছু হাসি মুখে মেনে নেওয়ার পর আরেকটা কাজ করবে। কাজটার কথা মাথায় আসতেই সে হেসে ফেলে। মনে মনে ভাবে, তার ভাই জানলে নির্ঘাত কানে মলা দিবে। দিক, তাও এই কাজ না করা অবধি সে ক্ষান্ত হবে না। মৌমিকে তার বড্ড পছন্দ হয়েছে। তাকে সে ভাইয়ের বউ বানিয়েই ছাড়বে। ঠোঁট চেপে হাসে প্রিয়তা। ভাবে, এখন একবার পুরো বাড়ি ঘুরে দেখার দরকার। সেই মোতাবেক ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে। দরজা খুললেই আরেকটা দরজা চোখে পড়ে। ঐটা বোধ হয় আরেকটা ঘর। প্রিয়তা সেই ঘরের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানেও আহামরি কিছু নেই, একটা পালঙ্ক আর আলমারি ছাড়া। প্রিয়তা ভেবে নেয়, এটা তার হবু শ্বশুর শাশুড়ির ঘর। সে আশেপাশে চোখ বুলায়। নজরে পড়ার মতো নেই কিছুই। সে দরজাটা আটকে দিয়ে বেরিয়ে যায়। ছাদের সিঁড়িটা ডান দিকে। ছাদে যাবে ভেবে সিঁড়ির কাছে যায় সে। দুইটা সিঁড়ি উঠতেই মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল তার। রেলিং চেপে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। হঠাৎ এমন কেন হচ্ছে বুঝে উঠতে পারল না। মাথা ঘুরানোটা বাড়ল তার। চোখেও কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা দেখছে। প্রিয়তা সিঁড়ি থেকে দ্রুত নেমে আসে। ওয়াদির ঘরে যায়। মাথা চেপে বিছানায় বসে সে। মাথা ঘুরানো তো কমছেই না, উল্টো বাড়ছে বরং। কী করবে বুঝতে পারছে না। সে আস্তে করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে নিল। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে যদি মাথা ঘুরানোটা কমে।

রাত আট’টা। প্রিয়তাকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে উঠাল ওয়াদি। ড্রাইভিং সিটে সে বসল। চোখে মুখে তার চিন্তার ছাপ। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে দ্রুত ছুটল কোনো এক গন্তব্যে।

________

‘আম্মি, আমার প্রিয়তার আপুর জন্য ভীষণ মন খারাপ করছে।’

দিলরুবা বেগম কাঁথাটা পাশে রাখলেন। ম্লান হেসে বললেন,

‘খারাপ তো আমারও লাগছে। কিন্তু, কিছু তো করার নেই, না। মেয়েটাকে যেতেই হতো।’

মৌমি তখন জিজ্ঞেস করল,

‘আচ্ছা, ঐ ভাইয়াটাকে দেখে তোমার কেমন মনে হলো? উনি আসলেই ভালো মানুষ?’

দিলরুবা বেগম গম্ভীর সুরে বললেন,

‘ভালো না খারাপ সেটা যদি মুখ দেখে বোঝা যেত তবে, আমার মতো অনেক অসহায় মানুষ আজ বেঁচে যেত, কোনোপ্রকার ধোঁকার কবলে পড়ত হতো না তাদের। বোঝা যায় না বলেই তো আজ পৃথিবীর এই দশা।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। মৌমি চিন্তিত সুরে বলল,

‘আমার কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না ঠিক। মানুষটা যদি সত্যিই ভালো হতো তবে কাল সারাদিন কি একটাবারের জন্যও প্রিয়তা আপুর খোঁজ নিতেন না? এভাবে একটা মেয়ে তার জন্য নিজের দেশ ছেড়ে চলে এল, আর তিনি পুরো দিন উধাও ছিলেন। কেমন অদ্ভুত যেন!’

‘তোর এত মাথা ব্যথা কেন হচ্ছে? যার বিষয় তাকে বুঝতে দে।’

ফারজাদের গলা পেয়ে মৌমি মাথা নুইয়ে ফেলে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

‘আম্মি, আমি পড়তে যাই।’

মৌমি দ্রুত ঘর ছাড়ল। ফারজাদ মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

‘আম্মি, ঐ মেয়েকে নিয়ে এত আলোচনার তো কিছু দেখছি না। আপনার যতটুকু দায়িত্ব ছিল, আপনি তা করে দিয়েছেন। আমার মনে হয়, বিষয়টাকে নিয়ে আর মাতামাতি না করাই ভালো।’

ফারজাদ তার মতামত জানিয়ে চলে যাচ্ছিল। দিলরুবা বেগম আবার ডাকলেন। ফিরে চাইল ফারজাদ। দিলরুবা বেগম ইতস্তত স্বরে বললেন,

‘এই ছবিটা একটু দেখবে, বাবা?’

বলেই তিনি বালিশের নিচ থেকে একটা ছবি বের করলেন। ছবি না দেখেই বিষয়বস্তু আন্দাজ করতে পেরে ফারজাদ বলল,

‘আমি কিছু দেখতে চাই না, আম্মি।’

দিলরুবা বেগম অসহায় সুরে বললেন,

‘একবার দেখে তো নাও, ফারজাদ। সবাই এক হয় না, কেন বুঝতে চাইছো না তুমি।’

ফারজাদ শক্ত সুরে বলল,

‘আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না, আম্মি? আমি বিয়ে করব না, এই সহজ জিনিসটা কেন আপনারা মেনে নিতে পারছেন না।’

‘এটা মোটেও কোনা সহজ জিনিস না, ফারজাদ। যথেষ্ঠ বয়স হয়েছে তোমার, এবার তো একটু বোঝো। সারাজীবন আমি থাকব না তোমার পাশে। তোমার একজন মানুষের প্রয়োজন, বোঝার চেষ্টা করো।’

ফারজাদ জোরে নিশ্বাস নিল। বলল,

‘আমার কাউকে প্রয়োজন নেই, আম্মি। আমি যেমন আছি, ভালো আছি। আপনিও আমাকে দয়া করে এভাবে থাকতে দিন। নয়তো এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে আমি বাধ্য হব।’

হনহন করে বেরিয়ে গেল ফারজাদ। দিলরুবা বেগমের বুকে ব্যথা শুরু হলো। ছেলেটা তাঁকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিতে পারল? ভীষণ কষ্ট পেলেন তিনি। শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছলেন। ছবিটা আবার রেখে দিলেন আগের জায়গায়। তারপর মনোযোগ দিলেন কাঁথায় ফুল তুলতে।

চলবে…..

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here