অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৭।

0
315

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭।

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল প্রিয়তা। প্রথমেই অন্ধকার দেখল সব। ভালো ভাবে তাকাল। তাও আলো দেখতে পাচ্ছে না কোনো। মস্তিষ্ক সজাগ হতেই শুনতে পেল এক নাগাড়ে কিছু কান্নার স্বর। ঘাবড়াল সে। আশেপাশে চোখ বুলাল। আবার কি স্বপ্ন দেখছে? না না, স্বপ্ন না এটা। অন্ধকারের মাঝেও যে অতি সামান্য আলো আসছে তাতে স্পষ্ট সে কিছু মেয়েকে দেখছে। তারা তার পাশেই বসা। অস্পষ্ট অস্ফুট স্বরে কাঁদছে তারা। অস্থির হয়ে উঠে প্রিয়তা। এখানে কী করে এল সে? তার মনে আছে, চোখ বোজার আগে সে ওয়াদির ঘরে ছিল। এখন এইখানে কী করে? প্রিয়তা উঠে দাঁড়াতে নেয়, পড়ে যায় সে। খেয়াল করে হাত পা বাঁধা তার। এবার আরো বেশি ভয় পেয়ে যায় সে। উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে,

‘আমি এখানে কেন? ওয়াদি কোথায়? আমি এখানে কী করে এলাম?’

তার পাশের মেয়েটি কান্না থামিয়ে চাইল তার দিকে। তার বাংলা কথা বোঝার চেষ্টা করে জবাবে বলল,

‘আমাদের তুলে আনা হয়েছে। এরা নারী পাচারের লোক, আমাদের অন্য দেশে পাচার করে দিবে।'(উর্দু)

মেয়েটার কথা শুনে প্রিয়তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। শব্দ বের হলো না মুখ থেকে কোনো। ঠোঁট কাঁপতে লাগল। তবে কি ওয়াদি তাকে ঠকিয়েছে? প্রিয়তা চিৎকার করে বলে উঠে,

‘না না, এটা হতে পারে না। ওয়াদি আমার সাথে এমন করতে পারে না। আমাকে ও এভাবে ঠকাতে পারে না। মিথ্যে বলছো তুমি।'(উর্দু)

আরেকটা মেয়ে এবার মেজাজ দেখিয়ে বলল,

‘মিথ্যে বলছে? আমাদের সবাইকে কি তোমার নাটকের চরিত্র মনে হচ্ছে? এখানে কি কোনো নাটক হচ্ছে, মেয়ে? বুঝতে পারছো না তুমি, কত বড়ো বিপদে আছি আমরা। বর্ডার পার হলেই আমাদের জীবন শেষ। নরক বানিয়ে ছাড়বে ওরা।'(উর্দু)

প্রিয়তা হতভম্ব। নিজের কানে শোনা কথাগুলোও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার। এভাবে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতে পারে না। প্রিয়তা কেঁদে উঠে। চিৎকার দিয়ে কাঁদে সে। পাশের মেয়েটি বলে,

‘আরে মেয়ে, এত জোরে কেঁদো না। অত্যাচার করবে ওরা। থামো তুমি, তোমার জন্য আমরা সবাই শাস্তি পাব।'(উর্দু)

প্রিয়তা থামতে পারছে না। চোখের সামনে কিছু কুৎসিত দৃশ্য ভেসে উঠছে তার। যেন এগুলোই তার ভবিতব্য হতে চলেছে। এই আশায় তো দেশ ছাড়েনি সে। তবে কেন এমন হলো? কেন?

প্রিয়তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চলন্ত গাড়িতে বারবার বারি খাচ্ছে সে। অন্ধকারের মাঝে যেন হারিয়ে গেছে তার সবটুকু প্রাণ। এবার কী হবে? কী করবে সে? তবে কি আর কখনোই মা, বাবা, ভাইকে দেখতে পাবে না? এখানেই জীবনের সমাপ্তি তার?

অনেকক্ষণ পর গাড়ির ভেতরে একটু আলো এসে পড়ে। যদিও চারদিক ঠাসা মালামালের মাঝে আলোর প্রতিফলন কম, তাও সেইটুকুতেই সবটা অবলোকন করল প্রিয়তা। দেখল, সে একা না, তার মতো আরো প্রিয়তা আছে এখানে। তারই মতো ভয় সবার চোখে মুখে। কেউ কেউ কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে বসে আছে, আবার কেউ কেউ এখনো কাঁদছে। প্রিয়তা দেখল, প্রায় ছয় জনের মতো মেয়ে আছে এখানে। না ঠিক ছয় জন মেয়ে না, ছয়টা পরিবার। প্রিয়তা ততক্ষণাৎ ঠিক করল, বাঁচতে হবে তাদের। প্রশ্নটা ছয়জন মেয়ের হলেও হতো কিন্তু, এখানে ছয় জন পরিবারের প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে। হেরে গেলে চলবে না। প্রিয়তা তার পাশের মেয়েটির দিকে চেয়ে বলল,

‘এটা কোন জায়গা তুমি জানো?'(উর্দু)

‘তা জানি না। তবে, আমাদের কাশ্মীর সীমান্তে নিয়ে যাচ্ছে সেটা জানি।'(উর্দু)

‘কেন?'(উর্দু)

‘কাশ্মীর সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে দিবে বলে।'(উর্দু)

প্রিয়তা ঢোক গিলে। আশেপাশের সবার চোখমুখ পরখ করে আরেকবার। বলে,

‘বাঁচতে চাও সবাই?'(উর্দু)

সবাই অসহায় চোখে চাইল। একজন বলল,

‘কে না চায়? আমরাও বাঁচতে চাই কিন্তু, কীভাবে?'(উর্দু)

‘সবাই মিলে একসাথে লড়াই করলে বিশাল বড়ো বিপদও কাটিয়ে উঠা সম্ভব। আমাদের এখন এক হতে হবে।'(উর্দু)

প্রিয়তা এই বলে তার হাতযুগল এগিয়ে দিল পাশের মেয়েটার দিকে। বলল,

‘দেখো তো খুলতে পারো কি-না।'(উর্দু)

মেয়েটার হাতও বাঁধা। তাও ঐ বাঁধা হাতেই চেষ্টা চালাল সে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সেই বাঁধন খুলে ফেলল। প্রিয়তার মুখে হাসি ফুটল। দ্রুত পায়ের দড়িটাও খুলে ফেলল সে। বাকি সবারটাও খুলে দিল। মেয়েটি বলল,

‘এবার কী করবে?'(উর্দু)

‘ট্রাকের শাটার বাইরে দিয়ে তালা মারা, তাই না?'(উর্দু)

‘হ্যাঁ।'(উর্দু)

‘সামনে কয়জন লোক আছে?'(উর্দু)

‘দুই জন।'(উর্দু)

‘শুনো, কিছু একটা দিয়ে ভেতরে খুব জোরে জোরে শব্দ করবে। তারপর যখন তাদের মধ্যে কেউ শাটার খুলে দেখতে আসবে তখনই আমরা তাকে আঘাত করে পালিয়ে যাব।'(উর্দু)

মেয়েগুলো ভীত চোখে একে অন্যের মুখ দেখে। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করে,

‘ভয় পাচ্ছো? আমিও পাচ্ছি। কিন্তু, বাঁচতে হবে আমাদের। আর বাঁচার জন্য একটা রিস্ক নিতেই হবে।'(উর্দু)

মেয়েরা রাজি হলো। তাছাড়া আর করার কিছু নেই। কথা মতো হাত পা দিয়ে আঘাত করছে সবাই। তাতে শব্দ হচ্ছে বেশ। গাড়িটা থেমে গেল। প্রিয়তা সহ সতর্ক হলো সবাই। গাড়ির ভেতরে তেমন কিছু নেই যেটা দিয়ে আঘাত করা যাবে। তবে একপাশে অল্প বালির স্তুপ রয়েছে। সেখান থেকে মুঠো ভরে বালি নিল সবাই; শাটার খুললেই চোখে মুখে বালি ছুড়ে মারবে বলে।

কিছু শব্দ হতেই বুঝল শাটারটা খুলছে কেউ। প্রিয়তা সহ বাকি মেয়েগুলো ঢোক গিলে শক্ত হয়ে দাঁড়াল। শাটারটা খুলে গেল আস্তে করে। প্রিয়তা চেঁচিয়ে উঠতেই একসাথে বালি মেরে দিল সবাই। কিন্তু, ভাগ্য সহায় হলো না তাদের। বালি সেই মানুষটার কিছুই করতে পারল না। কারণ তার মুখে হেলমেট পরা। লোকটা ভেতরে গিয়েই শাটার আটকে দিল। শব্দ করে হেসে বলল,

‘আমাকে বোকা বানাতে চেয়েছিলি, তাই না? এসবে এখন অভ্যস্ত আমি। আমাকে বোকা বানানো এত সহজ না।'(উর্দু)

কথাটা বলেই লোকটা সজোরে গিয়ে থাপ্পড় মারল একটি মেয়ের গালে। মেয়েটি ধপ করে পড়ে গেল নিচে। কেঁদে ফেলল। গালটা যেন জ্বলে যাচ্ছে তার। ক্রোধে জ্বলে উঠল প্রিয়তা। লোকটিকে সর্বস্ব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বসল। আচমকা ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল সে। এই সুযোগ, প্রিয়তা দ্রুত গিয়ে শাটার তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু, তার আগেই পা ধরে তার হেঁচকা টান দিল লোকটা। প্রিয়তাও পড়ে গেল। বাকি মেয়েগুলো আর অপেক্ষা করল না। একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল সবাই। একটা মেয়ে গিয়ে সজোরে লাথি মেরে দিল লোকটার অন্ডকোষে। লোকটি এবার চেঁচিয়ে উঠল। তার চিৎকার শুনে গাড়ির ড্রাইভারও নেমে এল। শাটারের ভেতর থেকে শব্দ আসছে দেখে সে দ্রুত তালা দিল শাটারের বাইরে। প্রিয়তা আর শাটার খুলতে পারল না। অনেক চেষ্টা করেও না।

ড্রাইভার যেন কাকে একটা ফোন লাগাল। বলল, এইদিকে মেয়েরা হৈ চৈ শুরু করেছে। খুব তাড়াতাড়ি তাদের একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে ধরা পড়ে যাবে তারা নিশ্চিত। ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটি কিছু একটা বলে ফোন কাটল।

মাঝ রাস্তা। নীরব, নিস্তব্ধ চারদিক। প্রিয়তাসহ বাকি মেয়েগুলো এখন একটু শান্ত হয়ে বসেছে। ভেতরের লোকটা জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে নিচে। তাকে বেদম কেলানি দিয়েছে সবাই মিলে। তাদের গাড়িটা চলছে না এখন। কোনো সাড়াশব্দও পাচ্ছে না আশপাশ থেকে। কান খাঁড়া করে রেখেছে প্রিয়তা, অথচ একটাও গাড়ির শব্দ পায়নি এখন অবধি। বেশ কিছুক্ষণ পর বাইরে থেকে শব্দ আসে। গাড়ির শব্দ। তার পরপরই আবার শাটার খুলে যায়। দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে চারটি লোক। এবার মেয়েরা কিছু করার আগেই লোকগুলো তাদের জবরদস্তি গাড়ি থেকে নামিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে তিনটি গাড়িতে উঠায়। প্রতি গাড়িতে দুজন করে মেয়ে। গাড়িতে তুলেই হাত, পা, মুখ সব বেঁধে দেওয়া হয় তাদের। প্রিয়তা আর কিছু করতে পারে না। কেবল চঞ্চল, ভীত চোখে দেখে যায় সবকিছু।

চলবে……

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here