#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১।
অকস্মাৎ “প্রিয়তা” নামের মানুষটার মুখ ফারজাদ মনে করতে পারল না। নামের সাথে মুখাবয়বটা মস্তিষ্কে ধারণ করতে পাক্কা দু মিনিট সময় লাগল তার। মনে পড়তেই সে কপাল কুঁচকাল। প্রথমেই প্রশ্ন করল,
‘আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?’
প্রিয়তা অপ্রস্তুত হলো। আমতা আমতা করে বলল,
‘না আসলে, আন্টি আপনার একটা কার্ড দিয়েছিলেন, সেখান থেকেই পেয়েছি।’
ফারজাদের কুঁচকানো ভ্রু আরো দৃঢ় হলো। বিরক্তির সহিত সে বলল,
‘আমাকে কল দেওয়ার কারণ?’
প্রিয়তা জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ভীষণ বিপদে পড়েছি, আপনার সাহায্য লাগবে।’
ফারজাদ গম্ভীর স্বরে বলল,
‘আম্মি আপনাকে একবার সাহায্য করেছে বলে কি আপনার মনে হচ্ছে আমরা এখানে সাহায্যের অফিস খুলে বসেছি? আর সবথেকে বড়ো কথা হলো, আপনাকে আপনার আত্মীয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, এখন কেন আপনি আমাদের কাছে সাহায্য চাইবেন?’
প্রিয়তার চোখ ছলছল করে ওঠল। এতটা অপমানিত জীবদ্দশায় এর আগে কখনো হয়নি। সে ঢোক গিলে নিজের সবটুকু আক্ষেপ গিলে নিল। অসহায় সুরে বলল,
‘যার হাতে আমাকে তুলে দিয়েছেন, হয়তো ঐ মানুষটার জন্যই আজ আমি এত বড়ো বিপদে। আমি এখন লাইয়াহ্ বাজার আছি। এখান থেকে করাচি অনেক দূর। আমার হাতে এক টাকাও নেই যে গাড়ি করে আসব। আন্টি বলেছিলেন, কোনো সাহায্য লাগলে যেন উনাকে জানাই। উনার নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছি, তাই বাধ্য হয়ে আপনাকেই কলটা করতে হয়েছে। প্লিজ একটু সাহায্য করুন, আমি আজীবন আপনাদের কৃতজ্ঞ থাকব।’
ফারজাদের মেয়েটাকে সুবিধার ঠেকল না। আজকাল কাউকে ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। এরা সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়। তাই ফারজাদও এত আমলে নিল না। বলল,
‘সেখানকার থানায় যোগাযোগ করুন, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
প্রিয়তা অস্থির হয়ে বলল,
‘আমি তো কিছু চিনি না।’
‘কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন, চিনিয়ে দিবে।’
প্রিয়তা থানা পুলিশের ঝামেলায় যেতে চাইছে না। এই দেশে একা সে। সাহায্য করার কেউ নেই। একা লড়া সম্ভব নয়। সে অনুনয়ের সুরে বলল,
‘প্লিজ, এভাবে বলবেন না। সত্যিই ভীষণ বিপদে পড়েছি। ঐ লোকগুলো নারী পাচার চক্রের। খুব কষ্টে পালিয়ে এসেছি, একটু সাহায্য করুন।’
ফারজাদ ভাবল। কী করবে বুঝতে পারছে না। আদৌ কি সব সত্যি? ভীষণ চিন্তায় নিবদ্ধ হলো যেন। মেয়েটার গলার স্বর এমনই কিছু একটা বলছে। বিপদের সুর অন্যরকম, মেয়েটার এহেন সুর’ই যেন বলে দিচ্ছে, মারাত্মক বিপদে আছে সে।
ঐপাশ থেকে জনৈকা ভদ্রমহিলা বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘আর কতক্ষণ?’
প্রিয়তা অনুরোধ করল ফের,
‘একটু সাহায্যও কি করা যায় না?’
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ফারজাদকে রাজী হতে হলো। তার ভেতরের মানবিক বোধ যেন বাধ্য করছে এই কাজ করতে। সে মনের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
‘যেখানে আছেন সেখানেই একটা সেইফ জায়গা খুঁজে অপেক্ষা করুন। আমি আসছি, তবে সময় লাগবে অনেক।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা অপেক্ষা করছি। কিন্তু, আপনি এখানে পৌঁছার পর জানবেন কী করে আমরা কোথায় আছি?’
ফারজাদ ভাবল এক পল। বলল,
‘আপনার ফোন না এটা?’
‘না, অন্য আরেকজনের।’
‘আপনার ফোন কোথায়?’
‘ওটা…হারিয়ে গিয়েছে।’
ফারজাদ ঘড়ির দিকে চাইল। বলল,
‘আমার সেখানে পৌঁছাতে রাত নয়টা বাজবে। আপনি ঠিক সাড়ে আটটার দিকে কারোর একটা ফোন থেকে কল দিয়ে আপনার নির্দিষ্ট অবস্থানটা আমাকে জানাবেন।’
প্রিয়তা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘আচ্ছা।’
‘রাখছি।’
ফারজাদ কল কেটে দিল। প্রিয়তা আশ্বস্ত হয়ে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে ধন্যবাদ জানাল জনৈকা মহিলাকে। মিলি ছিল এতক্ষণ নীরব দর্শক। প্রিয়তার বাংলা কথা খুব একটা তার বোধগম্য হয়নি। সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইতেই প্রিয়তা উর্দুতে বলল,
‘সাহায্য পেয়ে গিয়েছি। আমাদের এখন শুধু অপেক্ষা করতে হবে।’
_______
ফারজাদ মা’কে ঘটনার আদ্যোপান্ত না বলেই বেরিয়ে পড়ল। মা শুনলেই হাজার প্রশ্ন করে ব্যস্ত করে তুলবেন তাকে। এমনিতেই এসবে তার আগ্রহ নেই। তাও ঐ মেয়েকে সে মুখের উপর “না” বলতে পারেনি। বিবেকে বাঁধছিল কেন যেন। এখন ঐ জায়গা থেকে মেয়েটাকে উদ্ধার করতে পারলেই যেন বাঁচে সে।
ছেলের ব্যবহারে দিলরুবা বেগম চিন্তায় পড়লেন। রেস্টুরেন্ট থেকে আসার পর থেকেই ছেলের মন মেজাজ ভালো নেই। এখন আবার হুট করেই কোথায় বেরিয়ে গিয়েছে কে জানে। আজকাল ছেলেটা তাঁকে একটু বেশিই জ্বালাতন করছে, তাকে একটা বিয়ে না দেওয়া অবধি তিনি শান্তি পাচ্ছেন না। অথচ এইদিকে ছেলে বিয়ে করবে না বলে দাঁত খিঁচে বসে আছে। তিনি যে কী করে এই ছেলেকে বোঝাবেন কে জানে।
_______
প্রিয়তা আর মিলি হাঁটতে হাঁটতে এসে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। এইদিকে মানুষের কোলাহল নেই খুব একটা। খিদা, তৃষ্ণা আর ক্লান্তিতে পা আর চলছে না যেন। বাড়ির গেইটের সিঁড়ির কাছটায় বসে পড়ল দুজন। মিলি পেটে দু হাত চেপে বলল,
‘আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।’
প্রিয়তা অসহায় সুরে বলল,
‘আমার টাকা সব ব্যাগে ছিল। আর ব্যাগটা তো রয়ে গেছে ওয়াদির বাড়িতেই।’
মিলি প্রশ্ন করল,
‘ওয়াদি কে?’
প্রিয়তা চাইল তার পানে। চোখ গুলো জ্বলছে, অন্তর পুড়ছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘কেউ না।’
মিলি দ্বিতীয় প্রশ্ন করল না আর। কিছুটা হলেও যেন আন্দাজ করতে পারল সে। তাই চুপচাপ’ই বসে রইল। এর মাঝেই সময় গড়াল অনেকক্ষণ। বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়ল দুজন।
আচমকা কারোর কাশির শব্দে হকচকিয়ে উঠল প্রিয়তা। চোখ মেলে চেয়ে হাঁসফাঁস করতে আরম্ভ করল। একটা লম্বা দেখতে ছেলে নাক অবধি চশমা নামিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে তাদের দিকেই চেয়ে আছে। প্রিয়তা মিলিকে কনুই দিয়ে গুঁতা দিল। মিলি ঘুমাচ্ছে বেঘোরে, যেন কতদিন পর একটু ঘুমানোর সুযোগ পেয়েছে সে। প্রিয়তা চিমটিও দিল, তাও মেয়ে জাগছে না। ছেলেটি এবার কপাল কুঁচকে উর্দুতে বলল,
‘মেয়েটা ম রে গেল না-কি? এত চিমটি গুঁতা খেয়েও উঠছে না যে?’
প্রিয়তা তার কথা শুনে হাসবে না ভয় পাবে বুঝতে পারছে না। সে মিলির কাঁধ জোরে ঝাঁকিয়ে বলল,
‘এই মিলি, উঠ না।’
ধরফরিয়ে উঠল মিলি। আচমকা বুঝতে পারল না কিছু। তাই ড্যাবড্যাব করে চাইল আশেপাশে। সামনে এক অজ্ঞাত ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল সে। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘খবরদার আমাদের ধরবেন না, আমরা কিন্তু চেঁচাব।’
ছেলেটা ভড়কে যায়। চশমাটা চোখে ঠেলে বলে,
‘কেন চেঁচাবেন?’
‘আপনি আমাদের ধরে নিয়ে যাবেন বলে।’
ছেলেটা হা করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর প্রশ্ন করল,
‘কোথায় নিয়ে যাব?’
‘কোথায় আবার নিয়ে যাবেন, কাশ্মীর।’
ছেলেটা পুরো বোকা বনে গেল যেন। মেয়েটা কীসব বলছে, মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। প্রিয়তা মিলিকে শান্ত হতে বলল। তারপর সে ছেলেটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি কি এই বাড়িতে থাকেন?’
‘মনে হয়।’
‘মনে হয় মানে? আপনি শিওর না?’
‘একটু আগেও শিওর ছিলাম। তবে এখন আপনাদের দেখে কনফিউজড হয়ে পড়েছি, ভুল বাসায় চলে এসেছি বোধ হয়।’
প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল। ইতস্তত স্বরে বলল,
‘না না, সঠিক বাসাতেই এসেছেন। আমরা এখানে বসে একজনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। দুঃখিত।’
ছেলেটা তাদের ভালো ভাবে পরখ করে বলল,
‘কিন্তু আপনারা তো ঘুমাচ্ছিলেন?’
প্রিয়তা মাথা চুলকে বোকা বোকা হেসে বলল,
‘না, ইয়ে মানে, আসলে একটু ক্লান্ত ছিলাম বলে চোখ লেগে গিয়েছিল। কিছু মনে করবেন না, প্লিজ। আমরা এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।’
প্রিয়তা চোখের ইশারায় মিলিকেও উঠতে বলল। ছেলেটা এক পল ভাবল কী যেন। প্রিয়তাকে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি পাকিস্তানী নন, তাই না?’
প্রিয়তা সত্যি না মিথ্যে বলবে ভাবনায় পড়ল। ছেলেটা চমৎকার হাসল প্রিয়তার দ্বিধাগ্রস্থ মুখ দেখে। বলল,
‘আপনার এক্সেন্টে কিছু সমস্যা আছে। তবে আশা করছি, টানা এক মাস পাকিস্তানে থাকলে এটা একেবারে ঠিক হয়ে যাবে।’
প্রিয়তা অপ্রস্তুত হাসল। এরই মাঝে অকস্মাৎ তার মনে পড়ল ফারজাদের কথা। এখন কয়টা বাজে কে জানে? সে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল,
‘কয়টা বাজে বলতে পারবেন?’
ছেলেটা ঘড়ি দেখে বলল,
‘নয়টা দশ।’
আঁতকে উঠল প্রিয়তা। সাড়ে আটটায় কল দেওয়ার কথা আর এখন বাজে নয়টা দশ। মানুষটা নিশ্চয়ই রেগে আগুন হয়ে গিয়েছেন। প্রিয়তা অস্থির স্বরে বলল,
‘আপনার ফোনটা একটু দিবেন, আমি একজনকে কল দিব।’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/