#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২২
ব্রীজ থেকে বড়ো রাস্তার দূরত্ব অনেকটা। সেই পথে পায়ে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। ছোটো সেই রাস্তাতে রিকশা অতিক্রম করে। অপূর্ব ও আরু বড়ো রাস্তায় ওঠার জন্য রিকশা নিয়েছে। পাশাপাশি বসে আছে দুজন। কারো মুখে বুলি নেই। রোদ্দুর থেকে বাঁচতে হুড তোলা।
দুজনের মাঝখানে অনেকটা ব্যবধান রেখে আরু বসেছে। অসম্ভব একটু সেঁটে গেল আরুর দিকে। বিনিময়ে আরু বিপরীত দিকে আরেকটু সরল। ঠেকে গেল হুডের সাথে। এবার অপূর্ব আর এগোল না। নিজের হাতটা সন্তর্পণে আরু শাড়ির ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিল। পরক্ষণে টেনে নিল অতি নিকটে। রিকশা ওয়ালার দিকে তাকিয়ে আরু শব্দ করে না, এতে অপূর্ব-র অসম্মান হতে পারে।
হাত সরিয়ে দিতে দিতে নত গলায় বলে, “আপনি বিদেশে ছোটো ছোটো পোশাক পড়া মেয়েদের সাথে লিভ-ইন সম্পর্কে ছিলেন। আপনি সেকেন্ড হ্যান্ড জেনেও আপনাকে গ্রহণ করে নিতে রাজি হয়েছি। অথচ আপনি আমার খুঁত নিয়ে সবার সামনে যা নয় তাই বলেছেন। আপনি আমাকে একা বলতে পারতেন। সব কাজের মতো রান্নাটাও আমি শিখে নিতাম।”
আরুর অভিযোগে অপূর্ব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। মেয়েটা অভিযোগ করেছে মানে অভিমান শূণ্যতায় নেমে এসেছে। অন্য একটি শব্দে বড্ড চমকেছে- ‘লিভ-ইন’। নারীরা তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আগ বাড়িয়ে লিভ-ইন করতে চেয়েছে। অথচ আরু ধরে নিয়ে অপূর্ব সত্যি সে সম্পর্কে ছিল।
অপূর্ব নিজের অন্যহাত দিয়ে আরুর মাথাটা নিজের কাঁধে নিল। ঘুমে আরুর মাথা হেলে পড়েছে। লেপটে যাও কাজল মুছতে গিয়ে ছড়িয়ে গেছে অনেকটা। অপূর্ব সেই কাজল চোখে চেয়ে বলে, “সব কথা শুনতে নেই পদ্মবতী। তুমি আমার কাছে নিখুঁত। আমার পদ্মাবতী অদ্বিতীয়। পদ্মাবতীর নিখুঁত নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তা প্রদ্মরাজকে কতটা পিড়া দেয়, তাকে কি তুমি জানো?”
প্রেমময় সময়টা সংক্ষিপ্ত করে বড়ো রাস্তায় রিকশা থামে। অদূরে তিস্তা, তিয়াস, শেফালী, তুর দাঁড়িয়ে। আরু রিকশা থেকে নেমে ওদের মাঝে ছুটে গেল। অপূর্ব ভাড়া মিটিয়ে অগ্রসর হতেই চলন্ত টমটম ওদের সামনে থামল। সুজন মাথা বের করে হাতের ইশারায় সবাইকে ভেতরে আসার ইঙ্গিত দিয়ে মুখ ফুটিয়ে বাক্য তোলে, “সবাই এটায় চলে আসো, জায়গা আছে।”
আরুর আসার কথা সুজন জানত না, তাই ছয়টা সিট দখল করেছে। অন্যদিকে সুজনের কথা বলে আরুকে আনা হয়েছে। আরু চোখ পাকিয়ে অপূর্ব-র দিকে তাকাল। কেউ কিছু বলার আগেই আরু কপাট রাগ দিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। অপূর্ব-কে ব্যঙ্গ করে বলে, “ফুফু, সুজন ভাই আরুকে নিয়ে যেতে বলেছে।”
অপূর্ব পেছন থেকে আরুর হাতটা ধরে দিল রাম ধমক, “রাস্তার মাঝে চ/ড় খেয়ে মান সম্মান খোয়াতে না চাইলে বাধ্য হ।”
রিকশাটা এখনো সেই পথে দাঁড়ান। ব্রীজের যাত্রী পেলে ফিরে যাবে। অপূর্ব তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “শহরের দিকে যাবেন চাচা?”
“ভরদুপুরে ব্রীজের খ্যাপ পামু না। আপনারা গেলে যামু।” রিকশা ওয়ালার প্রত্যুত্তর পেয়ে অপূর্ব সুজনকে বলে, “তোরা দুজনে রিকশায় চলে যা, আমরা টমটমে আসছি।”
চাতক পাখি জোড়ার তৃষ্ণার নিবারণ করতে সুযোগ খুঁজে দিল অপূর্ব। সুজন হাসল অপূর্ব-র কথায়। সুজন নেমে রিকশায় বসতেই তিস্তা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। গ্ৰামেরা মেয়েরা প্রকাশ্যে প্রিয় মানুষটির দিকে তাকাতেও লজ্জা পায়। তিয়াস তাড়া দেয়, “তাড়াতাড়ি উঠ, তাড়াতাড়ি আবার ফিরতে হবে।”
সবাই যুগলদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গাড়িতে উঠতেই তিস্তা রিকশায় চড়ে। টমটম ততক্ষণে অনেকটা পথ পেরিয়ে গেছে। রিকশা ওয়ালাও রিকশা গতিশীল করছে। হুড তোলা। তিস্তা সুজনের বাহু জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। প্রেম পিয়াস মেটাতে তাকে সাদরে গ্রহণ করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। তিস্তা কেঁপে তাকাল।প্রেমপূর্ণ কণ্ঠে বলে, আর কয়েকটা দিন তিস্তা নদী। বিয়ে নামক নৌকাটা হাতে পাই। তোমার নদীতে নৌকা ভাসাতে সুজন মাঝি হাজির।”
__
আরু তিয়াসের পাশে বসেছে। টমটমের ঝাঁকুনিতে আরুর মাথা ধরেছে। পৃথিবীতে একমাত্র রিকশাতে আরুর মাথা ধরে না, তবে রিকশায় উঠলে আরুর ঘুম পায়। টমটমের হ্যান্ডেলটা অনেকটা উঁচুতে। আরুর হাত তত লম্বা নয়। সে তিয়াসকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বসে আছে। এ যাবৎকালে যতদিন শহরে গেছে তিয়াসকে কিংবা মিহিরকে এভাবে জড়িয়ে রেখেছে। অপূর্ব বসে ছিল তাদের মুখোমুখি। প্রিয় মানুষটাকে অন্য কারো বাহুডোরে দেখে অশান্ত হয়ে উঠল অপূর্ব। সহজ করে বলে, “কী হয়েছে ওর?”
“আরু গাড়িতে উঠতে পারেনা, গাড়িতে উঠলে ওর বমি পায়। রিকশায় গেলে ঘুমায়। ওর জ্বালায় ফুফু শহরে যায় না। ফুফায় যখন ঢাকা থেকে আসে তখন নিয়ে আসে।” হাসতে হাসতে বলে তিয়াস।
_
একের পর এক শাড়ি কিনতে ব্যস্ত তিস্তা। সুজন হাসি মুখে তার সমস্ত আবদার পূরণ করছে। এমনকি দামী দামী জামদানি তিনটা কিনে ফেলেছে। অপূর্ব বাধা দেয় তিস্তাকে, “তিস্তা, এগুলো সব বিয়ের জামদানি। তিনটা কিনে কী করবি? একটা নে।”
তিস্তা মন খারাপ করে রেখে উঠে দাঁড়াতেই বাধ সাধল সুজন। আরও কয়েকটা জামদানি নামিয়ে দেখতে দেখতে বলে, “তোমার যতগুলো পছন্দ ততগুলো নাও। একবারই বিয়ে হবে আমাদের, তোমার কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ থাকুক আমি চাইনা।”
তিস্তা হাসি মুখে নিজের জন্য শাড়ি পছন্দ করে। এত শাড়ি বহনের জন্য দুজন লোক দিয়েছে অপূর্ব। শাড়ি পছন্দ হলে কসমেটিকসের দোকানে গেল। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দ্বিগুণ কিনল তিস্তা। সুজনের পূর্ণ ঘরওয়ালীর পাশাপাশি আধা ঘরওয়ালীদের কিনে দিল। আরু একাই কিছু কিনল না। অপলক চেয়ে রইল কসমেটিকসের জিনিসপত্রের দিকে। এগুলোর কোন বস্তু কীভাবে ব্যবহার করে, জানা নেই আরুর। সাজগোজ বলতে কাজল ও লিপস্টিক বোঝে আরু। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী ইমদাদ হোসেন মৃধাকে বললে সে এগুলো নিয়ে আসে। আরু তাকিয়ে আছে রংবেরঙের চুরির দিকে। দৃষ্টি সরিয়ে হাতের দিকে তাকাল আরু। তার হাতে কেবল একটিমাত্র রুপার চিকন ঝুনঝুন করা বালা। এবার বাবাকে বলবে রংবেরঙের চুড়ি আনতে।
অপূর্ব স্মিত হেসে তিয়াসকে বলে, “দেখ, আরুর কী লাগবে? চুড়ি পছন্দ হয়েছে বোধহয়।”
তিয়াস এগিয়ে চুড়ি বের করতে বলে চুড়িওয়ালীকে। রংবেরঙে রেশমি চুড়ি, কাঁচের চুড়ি বের করে। কাঁচের সাথে হেলান দিয়ে ফোন টিপতে টিপতে বলে তিয়াস, “কোন জোড়া নিবি আরু, তাড়াতাড়ি নে। রাত হয়ে আসছে, আমাদের যেতে হবে।”
আরু একমুঠো চুড়ি নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আরেক মুঠ ধরে। সৌন্দর্যে একে অপরকে পৃথক করা সম্ভব নয়। আরু মুখ ভার করে বলে, “সবগুলো সুন্দর। মন চাইছে সবগুলো নিয়ে নিতে।”
“আমার কাছে এত টাকা নেই আরু। কেবল দুই মুঠ নে।” তিয়াস বলে। আরু শাড়ির সাথে মিলিয়ে নীল রঙের দুই মুঠো চুড়ি নেয়। চুড়ি জোড়া প্যাকেট করে দিতে চাইলে নাকোচ করে আরু। কাগজ থেকে আলাদা করে দুই হাতে পরে। দুই হাত একসাথে করে ঘর্ষণ করতেই রিনিঝিনি শব্দ হলো। অপূর্ব হৃৎপিণ্ডে আঘাত করল সেই মাদক মেশানো শব্দ। বুকে হাত দিয়ে বলে, “প্রেমিকার হাতের একমুঠো কাঁচের চুড়ি প্রেমিকের বুকে এমন জোয়ারের সৃষ্টি করবে, তা জানলে বোধহয় চুড়ি কখনো আবিষ্কার হতো না।”
সবাইকে তাড়া দিয়ে বের করল মার্কেট থেকে। অতঃপর আরুর হাত মাপ অনুযায়ী সব চুড়িগুলো কিনে নিল অপূর্ব।
ফেরার পথে টমটমে গেল না কেউ। তিনটা রিকশায় সাতজনে বাড়ির দিকে রওনা হলো। আরুর ঘুমানোর অভ্যাস আছে বলে, অপূর্ব একাই নিল ওকে। হুড তোলা রিকশায় অপূর্ব আরু বসল। গতিশীল হতেই আরু ঢলে পড়ল রিকশার পেছনের দিকে। অপূর্ব হৃদমাঝারে আগলে নিল আরুকে। ঘুমের সাথে রাগটাও চাপা হয়ে গেছে ততক্ষণে। ঘুমের ঘোরে বিড়াল ছানার মতো লেপ্টে গেল অপূর্ব-র সাথে।
চলবে.. ইন শা আল্লাহ
রেসপন্স করার অনুরোধ রইল
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/
Page:
https://www.facebook.com/profile.php?id=100092431226303