নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে #ইফা_আমহৃদ পর্ব: ১৫

0
224

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৫

“তোর সাহস দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে আরু। ডাকলে কারো কথা শুনিস না। এক চ/ড়ে তোর সব দাঁত আমি খুলে ফেলব।” অপূর্ব-র বাজখাঁই গলা। আরু তবুও নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকে প্রতিক্রিয়া দেখল না।

অতঃপর অপূর্ব নিজেই যেতে বাহু টেনে বসাল আরুকে। আরুর আঙুলের ভাঁজে আঙুল রাখলেই মৃদু আর্তনাদ করে আরু। অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতে দৃষ্টি মেলাল। নিজের হাতে ছাপছাপ রক্তের দাগ দেখে বিচলিত হয়ে আরুর হাত পরখ করে। ক্ষতগুলো তার চেনা ঠেকল। অনন্তর তেজস্রী গলায় বলে, “আমাকে চুল-হলুদ লাগানোর সময় তোর হাতে এমন ক্ষত ছিলনা আরু। এই অবস্থা হলো কখন?”

প্রশ্নের জবাব না পেয়ে নির্ভীক হয়ে উঠে অপূর্ব। পুনরায় তেজপূর্ণ গলায় বলে, “কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি।”

“আমি.. আমি আপনার বিছানায় কাঁকড়া রেখেছিলাম। গতকাল আপনি বলেছিলেন না, আপনি ‘লিভ-ইন’এ ছিলেন। তাই রোষের বসে।” ক্রন্দনরত অবস্থায় আরুর ভাঙা গলা বলে। অপূর্ব প্রশান্তির হাসি দেয়। ‘আরুও যে প্রেমে জড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে’ – সে কি তা জানে?
দরজার বাইরে থেকে সেই মুহূর্তটি দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেন অনিতা। ছেলেকে তিনি আরও কিছুটা সময় দিবেন, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। কারণ একটি ভুল সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
_
ইলিশ মাছ দুটো নিয়ে বাবাইয়ের পাশাপাশি হেঁটে বাড়িতে এলো আরু। মেয়েকে পেয়ে ইমদাদ হোসেন মৃধার আনন্দের অন্ত নেই। বাড়িতে আরুর পদচারণ পড়তেই ময়না উড়ে এসে বসল আরুর কাছে। তিনবার আওড়াল, “আরুপাখি! আরুপাখি! আরুপাখি! এসেছিস! এসেছিস! এসেছিস!”

“হ্যাঁ, এসেছি ময়না। দেখ, বাবাই কতবড় ইংলিশ মাছ নিয়ে এসেছে।”

পারুল দিঘির পাড়ে বোলের ভেতরে পানি নিয়ে বসেছে। অয়ন সাবান ঘসছে। ময়না পাখির ডাক শুনে উঠানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই আনন্দে ভরে উঠলেন তিনি। কতদিন পর নিজের স্বামীকে দেখেছেন। ছেলেকে রেখেই ছুটে গেলেন ইমদাদ হোসেন মৃধার কাছে। বক্কে ঝাঁপিয়ে মায়াবী কণ্ঠে বললেন, “কেমন আছো তুমি? আসবে যে, একবারও তো বললে না।”

“বলে দিলে সারপ্রাইজ থাকতো? আমাকে দেখে কেউ চামকাতো?” মাথায় হাত রাখলেন পারুলের। আনন্দের অশ্রু আবির্ভাব। আরু পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তা লক্ষ্য করে ইমদাদ আদুরে গলায় বলেন, “ছেলেমেয়েরা পাশে দাঁড়ান। কখন কে আসে বলা তো যায়না। ঘরে গেলে জড়িয়ে রেখো।”

পারুল ছেড়ে দাঁড়াল। মেয়েকে দেখে তার মস্তিষ্কে অগ্নি প্রজ্বলিত হলো, কিন্তু মনে জেগে উঠল মাতৃত্ব। আপন করে নিল আরু-কে। মেয়ের মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “মাকে মনে পড়ল তোর? কোমরে ব্যথা পেয়েছি। কালকে সবাই দেখতে এসেছিল তুই বাদে।”

স্তম্ভিত হলো আরু। গতকাল সবাই আরুকে মিথ্যা বলে তার মাকে দেখতে এসেছিল? চকিতে আরুর হাত ধরে পারুল বললেন, “হাতে ব্যান্ডেজ কেন? কী হয়েছে মা?”

“একটু ব্যথা পেয়েছি।” মেয়ের হাতে চুমু খেলেন পারুল। ইমদাদের কাছ থেকে বাজার নামাতে নামাতে বললেন, “আরুর সাথে দেখা হলো কখন, না-কি ঐ বাড়িতে গিয়েছিলে?”

“গিয়েছিলাম। আরু ইলিশ মাছ খেতে পছন্দ করে, তাই নিয়ে এসেছি।”

“অপূর্ব বিদেশ থেকে এসেছে। ওর সামনে দিয়ে কীভাবে তুমি ইলিশ মাছ নিয়ে এলে?”

“ভাবীকে বলেছিলাম রেখে দিতে। রান্না করে কয়েক টুকরো পাঠিয়ে দিতে। আমাকে ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। একটা কাজ করো, ইলিশ মাছটা রান্না করে ওদের আসতে বলে দাও। ছেলেটা এখন পর্যন্ত ফুফু বাড়িতে বেড়াতে আসেনি। এসে দুদিন থেকে যাবে।” ইমদাদের কথা পছন্দ সই হলো পারুলের। আরু সুন্দর করে ইলিশ মাছ কা/টতে পারে তাই আরুকে বলতে চেয়েছিলেন ইলিশটা কে/টে নিতে, আরুর হাতের দিকে চেয়ে তা পারলেন না। অন্য আদেশ দিলেন, “একটা কাজ কর মা, অয়নকে গোসল করিয়ে দে। আমি কাজগুলো করে নিচ্ছি।”

এতক্ষণে ছেলের কথা স্মরণে এলো ইমদাদের। আশেপাশে চেয়ে ছেলের সন্ধান করতে করতে বলে, “অয়নকে দেখছি না কোথায় ও?”

“দিঘির পাড়ে। গোসল করছে। তুমি গিয়ে বিশ্রাম করো।” বলেই বাজার নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল পারুল। ইমদাদ ঘরে চলে গেলেন। আরু গেল দিঘির দিকে।
দাঁত চেপে বসে আছে অয়ন। বাবা এসে একবারও তার নাম করেনি, অথচ ফেরার সময় মেয়েকে নিয়ে এসেছে। ইটের বড়ো টুকরোটা পানিতে ছুড়ে দিয়ে বলে, “বাবাই আমাকে একটুও ভালোবাসে না। কেউ ভালোবাসে না। সবাই শুধু আরু আরু করে।”
_
পারুল মাছ ভাজছে আর দুই ছেলেমেয়ে বাটি সমেত উনুনের কাছে বসে অপেক্ষারত ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়ার জন্য। হলদেটে আলোয় মাছের দিকে তাকিয়ে বলে অয়ন, “মা আর কতক্ষণ লাগবে?”

“বাপুরে বাপু, এই নিয়ে সতেরবার জিজ্ঞেস করেছিস। একটু অপেক্ষা কর। এগুলো তো তোরাই খাবি।” বিরাগী হয়ে বলতে বলতে পাতা দিল উনুনে। ইমদাদ ছেলে-মেয়েদের দিকে চেয়ে আছে অনুভূতি পূর্ণ দৃষ্টিতে। কতগুলো দিন সে পরিবারের এই মুহুর্তটা মিস করেছে। এরমধ্যে পারুল ইমদাদকে আহসান বাড়িতে ফোন দিতে বললেন। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ফোন করে আসতে বলেছেন অপূর্বদের। অনিতা বারণ করে দিয়েছে, ‘ছেলে মেয়েদের জন্য মাছ কিনে এনেছে, ওরাই তৃপ্তি করে খাক।’

ফোন করার আগেই হাজির হলো অপূর্বরা। খালি হাতে আসেনি। অনেককিছু বহন করে এনেছে। তাঁরাও গোল করে উনুনের কাছে বসে। ততক্ষণে ইলিশের এক তাবা হয়ে গেছে। পারুল ভাজা মাছ তুলে রেখে বলে, “আরু পশ্চিম পাড়ায় কাঠালি কলা ‘গাছেই’ পেকেছে। তুই নেই বলে আমিও সাহস করে যাইনি। দা* খানা নিয়ে কলা ছড়া পেরে নিয়ে আয় মা। ভাবী দুধ পাঠিয়ে দিয়েছে। তোর বাবাই দুধকলা ভাত খেতে পছন্দ করে অনেক।”

“আচ্ছা, আগে মাছটা খেয়ে নেই।”

পারুল দিতে চাইলেন না। তালবাড়িয়ার শিমুলের মেয়েকে ভুতে ধরেছে ইলিশ মাছের জন্য। ভর সন্ধ্যা বেলা ইলিশ মাছ ধুতে গিয়েছিল নদীর পাড়ে। ঐ গায়ে দিঘি নেই, শুধু বড়ো একটা নদী। সবাই সেই নদীকে নিজের ভেবে শাসন করে।
ভুতের কথা বললে আরু ভয়ে যেতে চাইবে না, তাই খোলসা না করে ইঙিয়ে বলে, “তুই যদি কলা এনে খাস, তবে তোকে দুইটা মাছ খেতে দিবো।”

‘প্রয়োজনের সময় পান্তাও যেমন অমৃত’ー⁠ আরু সেই যুক্তি মেনে নিজহাতে মাছ পাতে তুলে খেতে লাগল। উপস্থিত সবাইকে মাছ খেতে দিলেন পারুল। বিদেশে অবস্থানরত সময়ে পারুল পদ্মার ইলিশ ভেজে অপূর্ব-র জন্য পাঠিয়েছেন। অপূর্ব-রও খুব প্রিয় এ মাছ। মৃদু হলদেটে আলোতে দ্রুত খেতে গিয়ে অঘটন ঘটিয়ে ফেলল। কাঁটা বাঁধল গলায়। দুবার কাশি দিয়ে গলা ধরে অপূর্ব। পারুল বিচলিত হয়ে বলে, “কী হয়েছে অপু? কাঁ/টা বেঁধেছে?”

“হ্যাঁ ফুফু।”

“দেখে খাবি না। আমাকে বললে আমি কাঁ/টা বেছে দিতাম। (অতঃপর আরুকে আদেশ করে) যা কয়টা শুকনো ভাত নিয়ে আয়।”

আরু ছুটে যেয়ে ঘর থেকে শুকনো ভাত নিয়ে এসে ক্ষান্ত রইল না। দলা পাকিয়ে অপূর্ব-র মুখে তুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “না চিবিয়ে গিলে ফেলুন। নেমে যাবে কাঁ/টা।”

প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হলো আরু। তৃতীয়বার সফল হলো। আরুর কথা মেনে গলা বেয়ে নেমে গেল কাঁ/টাটা। অপূর্ব-র চোখ রক্তিম হয়ে আছে। তবুও মাছ খাবে অপূর্ব। পারুল কাটা ছাড়াতে ছাড়াতে অপূর্ব-র মুখে তুলে দিল। ফুফুর ভালোবাসা গ্ৰহণ করতে পেরে পূর্ণ হলো অপূর্ব। কত ভালোবাসে অথচ আরুর জন্য ফুফুর সাথে কেমন ব্যবহার করল সে। সকলের অগোচরে আরু দা* নিয়ে ছুটেছে উত্তর পাড়ায়। আলাদা কলা বাগান। হাতে একটা টর্চ, যার তুখোড় আলো। আজকের হাওয়াটা অন্যরকম, কেমন গাঁ ছমছমে পরিবেশ। আকাশে একটা তাঁরাও নেই, চাঁদ তো অনুপস্থিত।
আজ অমাবস্যা তিথি। মুরুব্বিরা বলে, এরাতে একটা দড়ি উঠানে পড়ে থাকলে তা-ও না-কি সাপ হয়ে শব্দ করে। আরও শরীরে ইলিশ মাছের গন্ধ। কলা বৃক্ষের কাছে ফল চেয়ে অনুরোধ করে দা বসাল বৃক্ষে। কলা কেটে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে পেছন থেকে আরু আরু বলে ডেকে উঠল কেউ অথচ সেই দিকটা জনশূন্য, মানবশূন্য, থাকেনা কেউ। আরুর মতো একটা মেয়ে কেঁপে উঠল ভয়ে। পায়ের নূপুরের ঝুনঝুন শব্দে আরু হয়ে উঠল উদাসীন। তার পা কাঁপছে। মনে হচ্ছে বৃক্ষের শিকড় সর্প হয়ে তার চরণ জোড়া আবদ্ধ করে রেখেছে। যেন গলা চেপে ধরেছে কোনো অজ্ঞান বস্তু। তার হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিক নেই। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। আকাশমণি গাছটা মুঠো করে ধরে চিৎকার করে উঠে আরু, “মাআআআ!”

লোহা, রসুন, আগুন সঙ্গে থাকলে তারা কাছাকাছি আসতে পারেনা। আরুর হাতে লোহার দা*। আরুর ভীত ভাবটা কিঞ্চিৎ দূর হলো। একহাতে কলা ছড়া অন্যহাতে দা নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ছুট লাগাল বাড়ির দিকে। তালগাছ পর্যন্ত আসতেই আরুর বড়ো খোঁপাটা খুলে চুলগুলো উড়তে লাগল শীতল হাওয়াতে। ষষ্ঠইন্দ্রিয় সতেজ হয়ে উঠল। লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল।

তদানীং মেয়ের চিৎকার শুনে উপস্থিত সবাই ছুটে এসেছে। ল্যাম্প নিয়ে একই রাস্তা দিয়ে আরুকে ছুটতে দেখে তারাও ছুটল। পারুল গিয়ে ধরল আরুকে। পরক্ষণে হাত থেকে খসে পড়ল বস্তু দুটি। চেতনা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ার পূর্বেই অপূর্ব তার শক্তহাতে আরুকে আষ্টেপৃষ্ঠে আবৃত করে‌ নিল। পারুল দ্রুতহাতে চুলগুলো খোঁপা করে ল্যাম্পের অগ্নিশিখার তাপ আরুর দেহে স্পর্শ করাল। পারুলের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

Page:
https://www.facebook.com/profile.php?id=100092431226303

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here