চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় #মিমি_মুসকান #পর্ব_১০

0
307

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১০

ফরহাত সিগারেট ধরালো। সারফারাজ নাক কুঁচকে বলল, “এসব খাওয়া এখনো ছাড়তে পারলি না তুই?”

ফরহাত হাসল। অমায়িক তার হাসি। সারফারাজ বিরক্তি স্বরে বলে উঠল, “তোর প্রেমিকা কি বারণ করে না তোকে। কি সারাদিন এসব খেয়ে খেয়ে ম’রার দিকে চলে যাচ্ছিস। আমাকে তার নাম্বার দিয়ে যাবি, আজই কথা বলে তোর এসব বন্ধ করাবো।”

“কাকে বলবি?”

“কাকে বলবো মানে? ওই তো তোর ওই নায়িকা কে।”

”নায়িকা! হ্যাঁ নায়িকাই বটে। তবে আমি কখনো তার নায়ক ছিলাম না সারফারাজ। আমি তো ছিলাম তৃতীয় পক্ষ। কখন যে তৃতীয় পক্ষ হয়ে গেলাম সেটাও টের পেলাম না!”

কথাগুলো শোনা মাত্র স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সারফারাজ‌। তার পুরো শরীর ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। ফরহাতের আচরণ তাকে অবাক করে তুলছে‌। ফরহাত সিগারেট মুখে দিতেই ধোঁয়া ছাড়ল। সেই ধোঁয়া শূন্যে উড়ে গেল। তার দিকে ফিরে আচমকা হাসল। এই হাসি কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করছে মাত্র। সফল হলো না। সারফারাজের মনে হলো, সে নিজেকে দেখছে। ঠিক কয়েক বছর আগে এখানে বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। বলেছিল কাঁদবে না, সে কাঁদেনি। অথচ তার হৃদয় চূর্ণ/বিচূর্ণ হয়ে গেছিল। জান্নাত তখন কবুল বলে অন্য ঘরের ঘরণী হয়ে গেছিল। অথচ সে কথা দিয়েছিল। বিয়ে শুধু তাকেই করবে, শুধুমাত্র তাকে। আর কাউকে না। কিন্তু জান্নাত কথা রাখেনি। বোকার মতো বিশ্বাস করে ঠকতে হয়েছিল সারফারাজ কে। সে বহু পুরনো কথা। টিনেজার বয়সে নতুন নতুন প্রেম আবেগ ভর্তি হয়। তাই বোধহয় সেই প্রেমের কথা এখনো ভুলতে পারেনি। তবে কষ্টটা ভুলা গেছে। আর ভুলে যাওয়াই উচিত। সে তো এখন তার না। অন্য কারো। কিন্তু ফরহাতের কি হলো? যখন ওর প্রেম হয়েছিল তখন সে টিনেজার মোটেও ছিলো না। এরপরেও প্রেমটা টিকল না তাদের।

ফরহাত হালকা কেশে বলা শুরু করল, “তেমন কিছু না সারফারাজ। আমি বেকার, ওর মা বাবা আমায় মেনে নেয়নি। তাই সে অন্যের হাত ধরে চলে গেছে।”

“তুই তো বোঝাতে পারতি।”

“আমি বুঝায়নি বলছিস। ওর পা দুটো জড়িয়ে ধরেছিলাম। শুধু সময় চেয়েছিলাম। ও দেয়নি আমায়। আমার মা বাবার তো কম ছিল না ফারাজ। তারাও রাজী ছিল এই বিয়েতে। তবুও এটা হলো না। কেনো হলো না বলতো?”

সারফারাজ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল নিশ্চুপ হয়ে। ফরহাত সিগারেট টানছে তখনো। সারফারাজ বলে উঠল, “কারণ সে তোকে চায়নি। আমরা বোকা, তাদের চেয়ে বসি যারা কখনোই আমাদের চায়নি। চাইলে মানুষ কি না পায়। চাইতে তো হয বিধাতার কাছে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। আমরা দুভার্গা। শুধু একপাক্ষিক ভাবে আমরাই চেয়ে গেলাম, আমরাই ভালোবেসে গেলাম। ওরা কখনো আমাদের চায়নি, কখনো না।”

শেষবারের মতো সিগারেট টান দিয়ে নিচে ফেলে দিল ফরহাত। হেসে উঠে বলল, ”আমি তোমায় চেয়েও পাইনি আর তুমি আমায় পেয়েও চাইলে না। আফসোস হয় না তোমার প্রিয়?”

“প্রিয়!” হেসে উঠল সারফারাজ। ফরহাত লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরল। দুই হাতে পিঠ চাপড়ে বলল, ”এখনো প্রিয় বলছিস কোন সুখে। মিথ্যে আশা এসব ফরহাত। সব মিথ্যে। এই প্রেম, ভালোবাসা সব কিছুই মিথ্যে।”

“সত্যিই কি তাই। বাঁচার জন্য কি ভালোবাসার দরকার হয় না। আচ্ছা ফারাজ, তুই তো প্রায় ডাক্তার হয়ে গেছিস। মৃ/ত্যু দেখিস নি। কতো মানুষ তো মরে যায়। তাদের চোখে ম/রার আগে বেঁচে থাকার সুখ দেখতে পাস নি। কতোটা ব্যাকুল হয়ে তারা বাঁচার জন্য ছটফট করে দেখিস নি।”

সারফারাজ চুপসে গেল। তার অন্তর চুপসে গেল ভয়েতে। ভালোবাসা! হায় সেটা বড় করুণ কথা। খুশিতে কেউ ভালোবাসার নাম নেয় না। এই তো কয়েকদিনের আগে, কি ছটফট করেই মা/রা গেলো লোকটা। ম/রার আগে একটি মানুষকে দেখার জন্য কেবল ছট/ফট করছিলো। মৃত্যু পথযাত্রী কে পানি খাওয়াতে হয়, আল্লাহর নাম নেওয়াতে হয়। অথচ সে তার প্রিয়তমার নাম নিতে ব্যস্ত। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা কেঁদে চলছে। শার্টের মধ্যে চোখের জল মুছে আবারো কাঁদতে কাঁদতে বলল, “শা লা ম/রার আগেও ওই মাইয়ার নাম নিতে হয় তোর। ওই কখনো ভালোবাসছিলো তোরে। ভালোবাসলে কি তোরে ছাইড়া চইলা যাইতো। ৬ বছরের সংসার তোগো, এই ৬ বছরে যেই মা** তোরে ভালোবাসতে পারে নাই, আজ কেমনে ভালোবাসবো।”

ফারাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল লোকটার মুখের দিকে। তার দলের সবাই শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যতটুকু সম্ভব বি/ষ শরীরের ভিতর থেকে বের করা গেছে। তবুও লোকটা বাঁচবে না। তার ৬ বছরের সংসার ভেঙে সে অন্যজনের হাত ধরে চলে গেছে। ৬ বছরের ভালোবাসা নিমিষেই ধুলিসাৎ। এরপরেও ভালোবাসার নাম সে নেয় কি করে? নারী মানেই ছলনাময়ী। তারা অনেক ছল করতে জানে। তার শিক্ষা হয়ে গেছে তাদের দেখতে পেয়ে। কম তো দেখলো না। এই যে ফরহাত! কম ভালবাসতো! কতোই না সাধ ছিলো তার। ভালো, শিক্ষিত ছেলে অথচ বলল কি? বেকার! হাস্যকর! তার মা বাবার যা আছে তা দিয়েও তাদের আরামে ক’বছর চলে যেত। কিন্তু সেই তো চাইলো না। চাইলে কি আর পেতো না! কি অভাগী তারা। এই ভালোবাসার স্বাদ কি না খুঁজতে গেছে অন্য পুরুষের মনে। সত্যিই কি পাবে? হাত কাঁপবে না তাদের। মন কাঁদবে না। শরীরের স্বাদ কি সব! মনের স্বাদ বলে কিছুই কি নেই। মনের কি দাম নেই? এই যে হৃৎপিণ্ডের প্রতিটা ধ্বনি মিনিটে মিনিটে তার নাম উচ্চারণ করে এই বা করবে কজন?

ফরহাত বোধহয় কাঁদছে। ছেলেদের কাঁদলে বিশ্রী লাগে। কিন্তু ফরহাত কে দেখে মায়া হচ্ছে সারফারাজের। ওর কান্না মেয়েদের মতো। ঠোঁট চেপে আছে কান্না ধরে রাখতে, পারছে না। কেঁদেই দিল। সারফারাজ তার পিঠে হাত বুলালো। বলল, “ফরহাত! সত্যি ভালোবাসা কখনো মিথ্যে হয় না। আমাদের তাদের ভালোবাসা উচিত যে আমাদের ভালোবাসে। এই পৃথিবীতে কেউ তোকে ভালোবাসে না এমনটা হতেই পারে না। আড়াল হয়ে দেখ, দেখবি কেউ ব্যাকুল হয়ে খুঁজছে তোকে। তোকে ভালোবাসি বলার জন্য সে ছটফট করছে। তোর এই অশ্রুর দাম ওই অভাগী দিবে না। যে ভাগ্যবতী দেবে তাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাস। দেখবি সব ভালো!”

ফরহাত সামলে উঠল দ্রুত। চোখ মুখ মুছে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। মিনিট দুয়েক পর বলে উঠল, “অনি আসছে!”

ফারাজ চমকে উঠল। ছাদের দরজার দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টিতে। সত্যি সত্যি সেখানে অনির আগমন। ফারাজ অবাক হলো। এটা কি কাকতালীয়, না ফরহাত সত্যিই বুঝতে পারল অনির উপস্থিতি। কি আশ্চর্য! সে বাদে সবাই যেন অনিকে বুঝতে শুরু করেছে!
.
অনি এলো আবার চলেও গেল। এসেছিল চা দিতে। ফরহাত ফুরফুরে মেজাজে চায়ের কাপে চুমুক দিল।
“বেশ চা বানিয়েছে মেয়েটা।”

সারফারাজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মাথা নাড়ল। ফরহাত বলে উঠল, ”কি ভাবছিস এতো? আর শহরে ফিরছিস কবে?”

”এই তো কিছুদিন!”

“তা অনি কে নিয়ে যাচ্ছিস তো।

”অনি? কেন? অনি কে নিয়ে আমি কোথায় যাবো?”

“কেন? তোকে কেউ বলে নি। অনিকে তো শহরের ভার্সিটিতে ভর্তি করাবে। সাথে আরাফাত কেও।”

সারফারাজ ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, “অনিকে ভার্সিটিতে ও পড়াবে?”

“পড়াবে না কেন? মেয়েটা পড়াশোনায় কতো ভালো। আর আমাদের বংশের কোন মেয়ে কম পড়াশুনা করেছে। তোর মাও তো এমবি এ পাস। আমার মা ও তাই। অনি সেটা তো করবে!”

সারফারাজ কি জানি ভাবল। পরক্ষণে মাথা দুলিয়ে বলল, “তাই তো।”

“হ্যাঁ, তাই। শহরে গেলে তোর সাথে ছাড়া আর কোথায় থাকবে।”

“সেসব আলাপ পড়ে সাড়া যাবে। তুই বল! মন ঠিক আছে এবার।”

ফরহাত একগাল হেসে জবাব দিল, ”মন আবার ঠিক বেঠিক। সে তো হুট করেই খারাপ হয়ে ভালো হয়ে যায়। ওতোসব ধরতে হয় নাকি। বাদ দে তো।”
সারফারাজ এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে দিল। অথচ অন্য প্রসঙ্গ থেকে মন সরাতে পারছে না। সত্যিই কি অনি তার সাথে শহরে যাবে। তারা একসাথে থাকা শুরু করবে। কেমন অন্যরকম লাগছে।
.
এই প্রসঙ্গ আর উঠেনি। দিন ভালোই কেটে যাচ্ছিল। সারফারাজের শহরে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে। একদিন আরিফ হাসান তাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, “অনি কে তোমার সাথে করে নিয়ে যাও।”

“আমার সাথে করে?”

”অবাক হচ্ছো নাকি? একদিন তো তুমিই বলেছিলে তোমার স্ত্রীর দায়িত্ব একমাত্র তোমার। নাও এবার দায়িত্ব পালন করো। ভালো একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দাও। দেখো, ঠিকমতো খেয়াল রেখো ওর!”

কথাগুলো বলে বাবা চোখ সরিয়ে নিলেন। এর অর্থ এটাই তার শেষ কথা। সারফারাজ কিছু জিজ্ঞেস করল না। কেমন একটা ঘোরের মতো থেকে গেল। বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে। বাইরে এসে দেখল অনি ছোটাছুটি করছে। তার হাতে আচারের বোয়াম। চামচে করে একটু আচার সে খিচুড়ির প্লেটে দিল। এই খিচুড়ি সে নিশ্চিত তার জন্যই বাড়ছে। ফারাজ নিশ্চিত হয়ে রইল, অর্নিলা এখন এসে বলবে, “ফারাজ ভাই আসেন। আপনার জন্য খিচুড়ি রেঁধেছি, খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে!”

#চলবে….

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here