বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প #পর্ব-৭ #লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )

0
928

#বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প
#পর্ব-৭
#লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )

কলেজের দ্বিতীয় দিন।হুর রেডি হয়ে তিড়িংতিড়িং করে সিড়ি দিয়ে নেমে আসছে।ডাইনিং টেবিলে রুদ্ধ নেই। সে অফিসে গেছে ভেবেই আনন্দ লাগলো হুরের।প্লেটে খাবার নিয়ে আয়েশ করে খেতে লাগলো।একটু বেশি করেই খাবার খাচ্ছে সে।কারন টিফিনের সময় অনেক ক্ষুধা লাগে।যা সহ্য করতে কষ্ট হয় হুরের।খাবার খেয়ে ড্রাইভার এর সাথে চলে গেল কলেজে।কলেজে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল দুই বান্ধবী মুক্তা আর মিমের সাথে।তবে পাশে একজন নতুন সদস্যকেও চোখে পড়লো।হুর জিজ্ঞেস করলো,

“ও কে?

মিম বলে,
” ও হচ্ছে স্নেহা।আমাদের সাথেই পড়ে।কাল কলেজে আসেনি তাই তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনি।

আরেকটি নতুন বান্ধুবীকে পেয়ে খুশি হলো হুর।কথা বলতে বলতে চারজন চলে গেল ক্লাস রুম।ঠেলে ঠুলে চারজন একই বেঞ্চে বসলো।আকাশ ক্লাসরুমে প্রবেশ করতেই সর্বপ্রথম হুরের দিকে নজর দিল।প্রতিদিনের মতো আজও সাধারণ ভাবেই এসেছে সে।মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো সে।বন্ধুদের সাথে সেও বসলো।স্যার ক্লাসে আসার পর ক্লাস শুরু হয়ে যায় পুরো দমে।মনোযোগ সহকারে সবাই ক্লাস করছে।কিন্তু বিপত্তি ঘটালো মিম।সে বারবার স্নেহা,হুর কে খুঁচিয়ে যাচ্ছে।মুক্তা সবার কোনায় বসাতে হাত নাগাল না পাওয়ায় তাকে খোচাতে পারছে না।তবে এতে আফসোস নেই মিমের।সে দিব্যি স্নেহা আর হুরকে খোঁচাতে ব্যাস্ত।দুজনই মনোযোগী হয়ে ক্লাস করছিল। কিন্তু মিমের খোঁচানোতে বারবার তাদের ধ্যান ভেঙ্গে যাচ্ছে।নেহা কয়েকবার চোখ রাঙিয়েছিল মিমকে।তবে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। মিম আবারও তাদের খোচাতে শুরু করলো।এবার আর সহ্য করতে পারল না স্নেহা।গলার স্বর নিচু রেখে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

“দেখ মিম নিজের ভালো চাইলে এই গুতাগুতির পর্বটা বন্ধ কর। না, হলে একবার আমি শুরু করলে তুই ছাড় পাবি না।

স্নেহা কে প্রতিবাদ করতে দেখে সাহস পেল হুরও।সে করুন স্বরে বলে,
” প্লিজ মিম আমায় আর খোঁচাইয়ো না।আমার ভীষণ সুরসুরি পাচ্ছে।কোনমতে নিজেকে শান্ত করে রেখেছি।যেকোনো মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবো।আমি চাইনা ক্লাসের মাঝে উদ্ভট কিছু ঘটুক।

হুরের করুন স্বরের কথা শুনে মিমের মন গলে গেল।দুজনকেই খোঁচানো বন্ধ করে দিল।মনোযোগ দিল ক্লাসে।ক্লাস করতে করতে সময়টা চলে আসলো টিফিন পিরিয়ডের।এক এক করে সবাই ক্লাস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।উদ্দেশ্য তাদের ক্যান্টিন।হুর যখন গ্রামের কলেজে ক্লাস করত তখন মা সাথে করে তাকে টিফিন দিয়ে দিত।মাঝে মাঝে হুর টিফিন নিতো না কারণ বান্ধবীদের সাথে বাহিরে খাবে বলে।চটপটি, ফুচকা, ঝাল মুড়ি, বেলপুরি, আচার এসব চটপটে জিনিস খুব ভালোবাসে হুর।তাইতো তার মাকে ইনিয়ে -বিনিয়ে অনেক কিছু বুঝিয়ে বাসা থেকে টিফিন না নিয়েই বের হয়ে যেত।কিন্তু এটা হচ্ছে শহরের কলেজ।বড়লোকী কলেজ। নামিদামি কলেজ ।এখানে কেউ বাসা থেকে টিফিন নিয়ে আসে না।বাসা থেকে টিফিন নিয়ে আসলে যদি, প্রেস্টিজ বলে যে একটা কথা আছে নিলামে তুলে যাবে।সবাই হুর কে খ্যাত ভাববে।তাইতো টিফিনের কথা মাথায় আনতে গিয়েও আনলো না সে।এখানে সবাই যেভাবে চলাফেরা করে হুরও তেমন ভাবে চলাফেরা করতে চায়।বেঞ্চ থেকে মিম, মুক্তা, স্নেহা তিনজনই বের হয়ে যায়। রয়ে যায় শুধু হুর, সে একাই বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে আছে। তা দেখে স্নেহা তাকে জিজ্ঞেস করে,

“কি হয়েছে হুর তুমি এভাবে বসে আছো কেন? চলো আমাদের সাথে ক্যান্টিনে খেয়ে নিবে কিছু।

মাথা তুলে সবাইকে দেখেতে চাইলো হুর। ঠোঁটের কোণে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে বলল।
“তোমরা খেয়ে আসো।আমার ক্ষুধা নেই।বাসা থেকে আসার আগে আমি অনেক খাবার খেয়ে এসেছি। তাই আপাতত খিদে পাচ্ছে না।তোমরা খেয়ে আসো আমি অপেক্ষা করছি।

স্নেহা কিছুক্ষণ হুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।মেয়েটা যে মিথ্যা কথা বলছে তা ভালো করেই বুঝতে পারল।হুরের চোখ মুখই বলে দিচ্ছে সে মিথ্যা কথা বলছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতটা ক্লান্ত সে। কতটা ক্ষুধার্ত সে।ক্ষুধার্ত মুখ নিয়েও বলছে তার ক্ষুধা নেই।স্নেহা প্রথমে ভাবল ব্যাপারটা টাকার। টাকা নেই বলেই হয়তো হুর খাবার খেতে চাচ্ছে না।কিন্তু না মেয়েটার ড্রেসাপ কথাবার্তা কোন কিছু দাড়াই বোঝা যায় না তার টাকার কমতি আছে।তাহলে মিথ্যা কথা কেন বলল?ভাবছে স্নেহা।ভাবনার ধ্যান ভাঙ্গে মিমের কথায়।

“ওকে বলে লাভ নেই ও খাবেনা। গতকালকেও আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু কালকেও খায়নি।এখন চল আমরা গিয়ে খেয়ে আসি নাহলে টিফিনের সময় চলে যাবে।

স্নেহা আরো কিছুক্ষন হুরের দিকে তাকিয়ে মিম আর মুক্তার সাথে চলে গেল।সবাইকে যেতে দেখে হুর এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ক্ষুধা লেগেছে হুরের।ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে।গতকালকের মতো আজকেও পেট জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।বাম হাতে দিয়ে পেট চেপে বেঞ্চের উপর মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল।হঠাৎ মনে পড়ল ব্যাগে পানি রাখা আছে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে গট গট করে পুরো বোতল ফিনিশ করল।বুঝতে পারল না তার পেট ভরেছে কিনা। ভাতের খুদা কি আর পানি দিয়ে মেটানো যায়!আবারো বেঞ্চে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলো সে।গতকালকের মতো আজকেও দুইটায় কলেজ ছুটি হয়েছে।ক্লান্ত শরীর এবং ঢুলুঢুলু পা নিয়ে বাগানের দিক দিয়ে হেঁটে আসছে হুর।হঠাৎ চোখ গেল তার রাজপ্রাসাদটির দিকে। বাড়িটাকে দেখে হুরের রাজ প্রাসাদই মনে হয়।বাড়িটির মাঝ বরাবর বড় বড় অক্ষরে রুদ্ধ ম্যানশন লেখা।তবে এক জায়গাতে চোখ আটকে যায় হুরের।তিন তলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি।কিন্তু হুর তো দোতলা দেখেছে।দোতালার পরে আর কোন সিড়ি দেখতে পায়নি।তার খুব ইচ্ছে ছিল বাড়িটির ছাদে যাওয়ার। ছাদে থেকে পুরো বাড়িটি দেখার, আশেপাশের দৃশ্যটা দেখার। কিন্তু ছাদের সিঁড়ি দেখতে না পেয়ে তার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।মনে করেছিল ছাদের কোন ব্যবস্থা নেই।কিন্তু এখন তার ধারণা ভুল মনে হচ্ছে।ছাদের সিঁড়ি অবশ্যই অবশ্যই আছে।তা না হলে তিন তলা কিভাবে থাকতো?এখন সিঁড়ি কোথায় এটা বের করতে হবে তার।তার আগে খাবার খেতে হবে। তা না হলে যে কোন মুহূর্তে চটাস করে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।হুর আর কোন দিক বিবেচনা না করে সোজা চলে যায় বাড়ির ভেতর।বসার রুমে আসতে দেখল রুদ্ধ সোফায় বসে আছে।দেখে মনে হচ্ছে মাত্র এসেছে কাজ থেকে।হুর রুদ্ধের অপর পাশের সোফায় বসে সেন্টার টেবিলে থাকা পানি জগ নিয়ে গ্লাসে খেলে পানি পান করতে লাগলো।রুদ্ধ হুরের দিকে তাকালো।দুর্বল মুখ।পানি খাওয়া আগ অবদি রুদ্ধ হুরের দিকে তাকিয়ে ছিল।পানি খাওয়া শেষ হলে হুর ব্যাগ নিয়ে চলে যায় তার রুমে।গোসল করার সময় জেরিন একবার হুরকে ডেকে গিয়েছিল খাবার খাওয়া জন্য।আজ দ্রুতই গোসল শেষ করেছে হুর।ক্ষুধায় পেট যেন সু’ইসাইড করবে এমন অবস্থা। তাই কোনো রকমে গোসল করে চলে আসলো ডাইনিং টেবিলে।হুরকে দেখে রুদ্ধ তার প্লেটে খাবার বাড়তে লাগলো।চেয়ারে বসে পড়ল হুর।প্লেটে খাবার বাড়তে দেরি কিন্তু গিলতে তার দেরি হচ্ছে না।রুদ্ধ আড় চোখে তাকিয়ে সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করছে।তবে কিছু বলছে না।প্রতিদিনের তুলনায় আজ কিছুটা বেশি খাবার খেয়েছে হুর।পেটে খাবার পরতেই পেট থেকে গুর গুর করে শব্দ নিমিষেই বন্ধ হয়ে গেল।খাবার খাওয়া শেষ হতেই এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেল হুর।রুদ্ধ বসে বসে সব কিছুই দেখল।এক সময় নিজের খাবার কমপ্লিট করে সেও চলে গেল তার রুমে।

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে জানান দিচ্ছে বিকেল এখন ৪ঃ২০।কিছুক্ষণ হলো হুর ঘুম থেকে উঠেছে। ফ্রেশ হয়ে চলে আসলো রান্না ঘরে জেরিন এর সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য।রান্না ঘরের চেয়ারে বসে আছে হুর। হাতে তার কোকাকোলা।কিছুক্ষণ পরপর এক সিপ কোকাকোলা খাচ্ছে আর জেরিনের সাথে কথা জুড়ে দিচ্ছে।কথা বলতে বলতে একসময় জেরিনকে জিজ্ঞেস করে।

“আচ্ছা, আপু আমি না একটা বিষয় কোনভাবে মিলাতে পারছি না।বাহির থেকে প্রাসাদটি তিন তলা দেখায়।কিন্তু আমি তো দোতলা ছাড়া কোন কিছুই দেখতে পাই না। এমনকি ছাদের সিঁড়িটাও দেখতে পাই না।এমন কেন?

জেরিন কাজ করতে করতে বলল,
“এই বিষয়টা প্রথম প্রথম আমিও লক্ষ্য করেছিলাম।ছাদের সিড়ি আমিও খুঁজেছিলাম। কিন্তু পাইনি।আর রুদ্ধ স্যারকে জিজ্ঞেস করার মত আমার সাহস নেই। তাই মনের মাঝে এই বিষয়টা দমিয়ে রেখেছি।

এ বিষয় নিয়ে আর কোন কথা বলল না হুর।সে নিজের মতো করে কোকাকোলা খেতে লাগলো।আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর হঠাৎ করে কলিংবেল বাজার শব্দ কানে আসলো।জেরিন তার হাতের রাখা কাজ রেখে দরজার কাছে যেতে নিলেই হুর তাকে বাধা দেয়। বলে,

“আপু তুমি কাজ করো আমি দেখছি কে এসেছে।

জেরিন এর কাছথেকে কোন কিছু না শুনে দৌড় লাগালো দরজার কাছে।দরজা খুলে একজন মেয়েকে দেখতে পেল। এর আগে কখনোই দেখা হয়নি এই মেয়েটিকে। তাই ব্লু কুছ খেয়ে হুর সামনে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল।জিজ্ঞেস করল,

“কে আপনি?

দরজার ওপাশে থাকা মেয়েটি বলল ,
“জ্বি আমাকে রুদ্ধ স্যার এখানে পাঠিয়েছেন।হুর নামক এক বাচ্চার খেয়াল রাখার জন্য।

বিস্ময় চোখ বড় বড় হয়ে আসলো হুরের।সে বাচ্চা?কোন অ্যাঙ্গেল থেকে তাকে বাচ্চা মনে হয়?১৮ বছরের একটা অ্যাডাল্ট মেয়েকে বাচ্চা বলতে লজ্জা করছে না?মেয়েটির উদ্দেশ্যে প্রতিবাদী স্বরে বলল,

“একদম আমায় বাচ্চা বলবেন না। আমায় দেখে কি বাচ্চা মনে হয়?আমার বয়স এখন ১৮ প্লাস। তাহলে আমায় কোন দিক থেকে বাচ্চা মনে হয়?

হেসে দিল সেই মেয়েটি। বুঝল যার জন্য এখানে এসেছে সেই ব্যক্তি সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটি বলল,

“আচ্ছা, ঠিক আছে আমি আর তোমায় কখনো বাচ্চা বলবো না। এখন তো আমায় ভেতরে আসতে দাও।

হুর মুখ ফুলিয়ে দরজা থেকে সাইড হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দিল।হুর মেয়েটিকে নিয়ে সোফার রুমে বসালো।গলার স্বর কিছুটা উঁচু করে জেরিনকে ডাকলো। জেরিন আর সোফার রুমে আসতেই নতুন একটি মেয়েকে দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকে এলো।হুর কে জিজ্ঞেস করল,

“এই মেয়েটি কে হুর?

হুর কে বলতে না দিয়ে মেয়েটি বলে,
“আমার নাম হচ্ছে লিলি।রুদ্ধ স্যার আমাকে হায়ার করেছে এই হুরকে দেখে রাখার জন্য।

আর কিছু বলল না জেরিনন। রান্নাঘরে চলে গেল লিলির জন্য কিছু স্ন্যাক্স আনতে।লিলি এবং হুরের মাঝে কথোপকথন শুরু হল।হুর ও আনন্দের সাথে গল্প করছে লিলির সাথে।মেয়েটা মিশুক।কথা বলার মাঝে লিলি হুরের সব ডিটেলস জেনে নিল।জেরিন নাস্তা নিয়ে এসে লিলিকে দিল।লিলি কিছুটা খেল।নিজের রান্নাবান্নার কাজ করে বাসায় চলে গেল জেরিন।

পরদিন!আজ স্কুল ড্রেস পড়ে রেডি হয়ে নিচে নামছে হুর।রুদ্ধ সোফায় বসে ছিল।ফোনে কিছু ইমেইল চেক করছিল।গতকাল রাতে তার বাসায় আসা হয়নি।জরুরী কিছু কাজের জন্য বাহিরে থেকেছে। সিড়ি বেয়ে শব্দ করে নামছে হুর।নড়ে চড়ে উঠে রুদ্ধের মনোযোগ।সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল হুর লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে নামছে।মেয়েটাকে এখন আরো বাচ্চা মনে হচ্ছে।ড্রেসের কালার পুরো সাদা।বরাবরের মতো চুল খোপা।মুখে নেই কোন সাজসজ্জা।হুরকে স্ক্যান করা হলে রুদ্ধ পুনরায় নিজের ফোনে মনোযোগ দেয়।দ্রুত পা ফেলে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসতে পেছন থেকে লিলি বলে ওঠে।

“এই পিচ্চি তোমার ব্যাগ আমি সোফার উপরে রেখে দিয়েছি।

রাগান্বিত হলো হুর। পিচ্চি বলাটা সে মোটেও পছন্দ করে না।হুর লিলির দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
“আপু একদম আমায় পিচ্চি বলবে না ।কতবার বললাম আমি এখন অ্যাডাল্ট!তারপরও তুমি আমায় পিচ্চি বলেই যাচ্ছ।এত কষ্ট করে লাভ কি হলো আমার অ্যাডাল্ট হওয়ার?যেখানে তুমি বারবার পিচ্চি বলে আমায় অপমান করছ।

ট্যারা চোখ করে লিলি হুরের দিকে তাকালো।মেয়েটা যেভাবে নিজেকে বড় বলে দাবি করে আসলে সে ততোটাও বড় না।উল্টো মনে হয় বয়সের তুলনায় তার আচার-আচরণ খুব ছোট। লিলি নিজের চোয়াল শক্ত করে সিরিয়াস ভঙ্গিতে হুরের দিকে তাকিয়ে বোঝানোর মত করে বলল।
” দেখো হুর তুমি যতই বড় হও না কেন তুমি সব সময় আমার কাছে পিচ্চি থাকবে।যেখানে আমার বয়স হচ্ছে ২৬ সেখানে তোমার মাত্র ১৮।সে ক্ষেত্রে আমি তোমার অনেক বড়।আর পিচ্চি বলে আমি তোমার অপমান করছি না। পিচ্চি বলে আমি নিজেকে সন্তুষ্ট রাখছি। তোমায় পিচ্চি বলার মাঝে মনে হয় আমি আমার ছোট বোনকে খুঁজে পেয়েছি। আর পিচ্চি বলে যে মানুষ পিচ্চি হয়ে যায় এমন তো কোন কথা না।

হুর কিছুক্ষণ লিলির দিকে ভাবলেসহীন ভাবে তাকিয়ে রইল।কিছু সময় নিয়ে লিলির কথা বোঝার চেষ্টা করল। বুঝলোও।মুখের ভঙ্গি বদলে আসলো। লিলির কথা তো আর খুবই ভালো লেগেছে।তাকে নিয়ে যে ছোট বোনের সাথে কম্পেয়ার করেছে।ভালোলাগার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। মনের মাঝে নিজের খুশি দমিয়ে রেখে নিজের চোখ মুখ কুঁচকে হুর বলল।
“হয়েছে এখন আমায় ইমোশনালি অ্যাটাক করবে না।তোমার যত মন চায় তুমি আমায় পিচ্চি বল।তাও প্লিজ এভাবে সিরিয়াস হয়ে কোন কথা বলবে না। কেউ সিরিয়াস হয়ে কথা বললে আমার বুক ধুকপুক করে।কেউর সিরিয়াস ফেইস রিঅ্যাকশন দেখলে আমার ভীষণ ভয় লাগে।

বলেই নিজে ঠোঁট উল্টাল হুর।পাশ থেকে জেরিন আসতে আসতে বলল।
“হয়েছে তোমাদের মেলো ড্রামা?

জেরিনের দিকে দু’জন তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো।চোখ দ্বারা বোঝাতে চাচ্ছে জেরিন কোনো ভুল কথা বলেছে।বড় ধরনের অপমান করেছে।তীব্র অপমান হুর সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদী স্বরে বলে,
” আপু আমাদের একদম অপমান করবে না। আমরা মেলো ড্রামা করছি না।

জেরিন বললো – এখন ওদের সাথে কথা না বলে আমাকে খেতে দাও ।খুব ক্ষুধা লেগেছে।

জেরিন মুচকি হেসে হুরের নাক টিপে দিল।তবে শক্তিটা বোধ হয় একটু বেশিইই প্রয়োগ করেছে। তাইতো নাক টিপার সাথে সাথে নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে।বিস্মিত হল জেরিন।বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আনবিলিভেবল হুর,সামান্য হালকা ভাবে নাক ছুয়েছি। তাতেই তোমার নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে।কেউ যদি তোমায় জোরে চেপে ধরে সে জায়গায় তো রক্তবর্ণ ধারণ করবে। তুমি তো মারাত্মক সেনসিটিভ ধরনের মেয়ে।

মুখ ছোট হয়ে এলো হুরের। সে যে খুবই সেনসিটিভ তা তার অজানা নয়। বরং এটা নিয়ে সে মাঝে মাঝে বিশ্রিকর সমস্যার সম্মুখীন হয়। কলেজে থাকতে একবার পড়ে গিয়ে গলা ঘাড় ছিলে গিয়েছিল। যেটা নিয়ে তাকে খুবই ট্রোল এর শিকার হতে হয়েছে। সবাই ভেবেছে হুরের ব্যক্তিগত মানুষ তাকে ভালোবেসে এই চিহ্নগুলো দিয়েছে।শত চেয়েও হুর তাদের সত্যিটা বলে বিশ্বাস করাতে পারেনি। আর জখম গুলো এমনই ছিল যে, যে কেউ ভাববে সেগুলো আচরের চিহ্ন।গুরুতর ব্যথা না পেলেও তার চামড়া সেনসিটিভ হওয়ার কারণে আঘাত গুলো বাজে দেখতে লাগছিল।হুর তপ্ত এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

” আল্লাহ আমাকে এত সেনসিটিভ না বানালেও পারতো। সব বিরক্তিকর ঘটনা আমার সাথেই ঘটে। উফ আর ভালো লাগেনা।

জেরিন আর লিলি কেউই বুঝতে পারল না হুরের বলা বিরক্তি কর ঘটনার কথা। তবে এ নিয়ে প্রশ্ন ও করলো না।হুর কোন কিছু না বলে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খেতে লাগলো।প্রতিদিন তার মন পছন্দের একটা না একটা আইটেম রান্না হবেই। তাই প্রতিদিন তৃপ্তি সহকারে সে খাবার খেতে পারে। পেট ভরে খেতে পারে। তবে কলেজে যাওয়ার আগ অব্দি তার পেট ভরা থাকে। কলেজে যাওয়ার সাথে সাথে মনে হয় ,পেট খালি টেংকি হয়ে গেছে।যতই কলেজে যাওয়ার আগে পেট ভরে খাবার খাক না কেন কলেজে গেলে কিভাবে যেন পেট খালি হয়ে যায়। এর সমীকরণ কোন ভাবে মেলাতে পারে না হুর।এ কারণে আরো ঠেসে ঠুসে খাবার খেতে লাগলো সে। রাক্ষসের মত খাবার খাওয়ার মাঝে আগমন ঘটল রুদ্ধের।শব্দহীনভাবে নিজের চেয়ারে বসলো। কোন দিকে না তাকিয়ে নিজের মত করে খেতে লাগলো।ভ্রু কুঁচকে আসলো হুরের।রুদ্ধ তাকে এই ইগনোর করে নাকি রুদ্ধের স্বভাব এমন বুঝে উঠতে পারে না সে।মাঝে মাঝে ভাবে সে অতিরিক্ত ভাব দেখায়।তাই কখনো সামনে থাকা ব্যক্তির দিকে চোখ তুলে তাকায় না। যদি তার ভাব কমে যায় তাই!মনে মনে ভেংচি কাটলো হুর। নিজের মতো করে আবার খাবার খেতে লাগলো। তবে ভুলেও এবার রাক্ষসের মত খাবার খাচ্ছে না সে।ধীর গতিতে খাবার খাচ্ছে।পেটের আনাচে-কানাচে খাবার ঢুকিয়ে এটো হাতে নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো সে।বেসিনের কাছে গিয়ে হাত ধুয়ে ডাইনিং টেবিল ক্রস করে ড্রয়িং রুমে যাওয়ার সময় কর্ণপাত হয় রাশভারি কণ্ঠের শব্দ।

” শুনো!

থমকে দাঁড়িয়ে রইল হুর। পিছন ঘুরে তাকাতে চাইলেও তাকাতে পারছে না। শরীরে বল পাচ্ছে না। তবে তাকে যে তাকাতে হবে তা বেশ ভালো করে বুঝতে পারলো। সে রুদ্ধের মত নিজেকে ভাবের গোডাউন হিসেবে পরিচিত দিতে চায় না। তাই শরীরে বল না, পাওয়ার মাঝেও অতি কষ্টে পিছন ফিরে চাইল। রুদ্ধ টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে হুরের কাছে আসলো। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে সেখান থেকে চকচকে দুটো এক হাজারে নোট বের করল। হুরের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল,
” নাও।

হুর একবার টাকার দিকে তাকিয়ে রুদ্ধের দিকে তাকালো। বোঝার চেষ্টা করল রুদ্র তাকে টাকা কেন দিচ্ছে।প্রশ্ন করেই বসলো,
“টাকা! টাকা কেন?

কপালের ভাঁজ ফেলে হুরের দিকে শক্ত নয়নে তাকালো রুদ্ধ ।হুরের মুখ পানে চেয়ে বলল,
“এ টাকা গুলো রাখো। সময়ে অসময়ে লাগতে পারে।যেভাবে মন চায় সেভাবে খরচ কর।টাকা শেষ হয়ে গেলে আমায় জানিয়ে দিবে।

বলে নিজের স্থান ত্যাগ করল। হুর টুকুর টুকুর নয়নে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যক্তিটা কেমন যেন!আজব!খুবই অদ্ভুত!রুদ্ধের পিছন সাইডের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। হাঁটার স্টাইল দেখে মোহিত হয়ে গেল হুর।এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে অন্য হাতে দিয়ে চুল ব্রাশ করতে করতে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো রুদ্ধ।পরনে তার গাঢ় নীল কালার কোট প্যান্ট।যা দেখতে মারাত্মক লাগছে।হুর রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় রুদ্ধ তার চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে যায়।রুদ্ধ তার চোখের আড়াল হলেও হুর দরজার দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। ঘোর কাটে জেরির কথায়,

“কি হল তুমি কলেজে যাবে না? লেট হচ্ছে না?

( দেরি করে দেয়ার জন্য দুঃখীত )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here