বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প #পর্ব-২৩ #লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )

0
735

#বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প
#পর্ব-২৩
#লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )

খোলা এক বিশাল মাঠে অবস্থান করছে রুদ্ধ এবং খোকন।দুজনই সাথে করে নিয়ে এসেছে তাদের লোক। কিছুটা দূরে রাখা আছে বড় তিনটা ট্রাক। তিন ট্রাক মিলিয়ে একশ জনের উপরে মেয়েরা বন্দী আছে।বড়োসড়ো এক ঝগড়া লেগে আছে খোকন আর রুদ্ধের মাঝে। কেউ কারো থেকে কম যাচ্ছেনা। একজন আরেকজনকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। ঝগড়ার এক সময়ে তাদের চারদিক থেকে পুলিশ এবং র‍্যাব ঘিরে ধরল। খোকনকে বিচলিত দেখালো। স্বাভাবিক মুখভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রুদ্ধ। সে এক এক করে সবাইকে পরখ করছে। গুনে নিল সব মিলিয়ে কতজন পুলিশ এবং র‍্যাব এসেছে।সর্বনিম্ন ৪০ জন তো অবশ্য হবেই। সবার হাতেই বন্দুক বা পিস্তল। যা তাদের দিকেই তাক করা আছে। র‍্যাবের হেড অফিসার চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

“যে যেখানে আছো সে সেখানেই থাকবে। অন্যথায় গু’লি করতে বাধ্য হব।

খোকনের লোকরা পালাতে চাচ্ছিল দেখে হেড অফিসার তাদের উদ্দেশ্যে বললেন।থেমে গেল খোকনের দলবল।ইতিমধ্যে সবাই হাত উঁচু করে রেখেছে। সাথে খোকন ও। কিন্তু রুদ্ধ ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এবং সবার দিকে তাকিয়ে আছে।সবার হাতে হাতকড়া পড়ানো হলো। সিনিয়র অফিসার রুদ্ধের দিকে এগিয়ে আসছে ভয়ে ভয়ে। হাতে তার পিস্তল। সিনিয়র অফিসারের পিছে এক কনস্টেবল ও আসছে। তার হাতে হাতকড়া। অফিসার রুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে বললেন,

” ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট মিঃহিমায়েত এশহ্যান রুদ্ধ।

রুদ্ধের স্বাভাবিক কন্ঠস্বর,
“কিসের দায়ে আপনি অ্যারেস্ট করতে চান?

অফিসারের ভয় একটু কমে আসলো।কঠিন হয়ে বললো,
” নারী পাচারকারীর দায়ে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে। আর আপনার উপর আগেরও অনেক অভিযোগ ফাইল করা আছে।আর আপনার বিরুদ্ধে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ও বের হয়েছে।

“আমি নারী পাচারকারী কেস এর মধ্যে লিপ্ত নই। যাচাই করে দেখতে পারেন,আসল কালপ্রিট খোকন। অহেতুক আমার পিছে না পড়ে নিজের কাজ করুন।না,হলে আমার পিছে লাগার সাজা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন।

অফিসারের বোধহয় একটু ভয় লাগলো। তবুও প্রকাশ করলো না।রুদ্ধের নাম অনেক চর্চা শুনেছে সবার মুখে।লোকটা মারাত্মক লেভেলের ডেঞ্জারাস। এর পিছে যে লেগেছে তাকে দ্বিতীয় বার আর খুজে পাওয়া যায়নি।অফিসার শক্ত গলায় বললেন,

“এসব ধমকি দিয়ে আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন আমি ভয় পাচ্ছি?খোকন কে তো অ্যারেস্ট করা হচ্ছেই।মেইন কালপ্রিট কে তাও প্রমান হবে। এখন আপনি আমাদের সাথে যেতে বাধ্য। এবং আপনি মনে করবেন না যে আপনি এবার বেঁচে যাবেন। বড়ই ফাঁসা ফেসেছেন।খুব সুন্দর আয়োজন করা হয়েছে আপনাকে জেলের মধ্যে রাখার। নিশ্চিন্তে জেলের ভেতর দিন গুনতে থাকবেন৷

বলেই কনস্টেবল কে ইশারা করলো রুদ্ধকে হাতকড়া পড়াতে। কনস্টেবল নিজেও ভয় পেয়েছে রুদ্ধকে এত সামনে থেকে দেখে।সেই সাথে তার তেজযুক্ত কথা।ফুল কনফিডেন্স নিয়ে একেকটা কথা বলছে সে। হাতকড়া পড়াতে হাত কাঁপছে তার।রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার মুখ শীতল থাকলেও চোখ দিয়ে আগুন ঝড়ছে।রুদ্ধ কিছু বললো না। দু হাত মুঠ করে সামনে বাড়িয়ে দিল। কনস্টেবল এর মনে সাহস এলো। সে কাঁপা কাঁপা হাতে রুদ্ধের হাতে হাতকড়া পড়ালো। কিছু সময় নিজের ফর্সা হাতের সিলভার রঙা হাতকড়ার দিকে তাকিয়ে রইলো রুদ্ধ। দেখনে মন্দ লাগছে না। শরীরের রঙের সাথে ফুটে উঠেছে। রুদ্ধ স্বইচ্ছেয় হাতকড়া পড়তে চাইলো দেখে অবাক হলো রুদ্ধের দলবল।রুদ্ধ কিছু বলছে না দেখে তারাও কিছু বলতে বা করতে পারছে না।

হাত থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকালো সে।দূর থেকে একটি গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে আসছে।এক মনে সেদিকে নজর দিয়ে রাখলো রুদ্ধ।গাড়িটি এক সময় অতি নিকটে চলে আসলো৷ গাড়ি থেমে গেল। প্রথমে বের হয়ে আসলো একটি লোক।পিছন সিট থেকে আরো দুজন নেমে দাড়ালো। অন্ধকারের জন্য স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে দু’টো মেয়ে হবে। হেটে সামনে আসতে লাগলো।সামনে থাকা গাড়ির বাতির আলোয় একটু একটু করে নজরে আসছে।এক সময় সবাই রুদ্ধের চোখের খুব কাছে চলে আসলো। চেনা পরিচিত মুখ দেখে সে তার মুখের দিকেই তাকিয়ে রইলো।তাদের সাথে আসা লোকটি রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,

“কি মিস্টার রুদ্ধ,আপনাকে বলেছিলাম না আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করে ছাড়বো!সে দিন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সেভাবেই হোক না কেন আপনাকে আমি জেলের ভাত খাইয়েই ছাড়বো।নাও সি!ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।গ্যাংস্টার’দের আসল ঠিকানা জেলে হয়,খোলা ময়দানে না।

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।কোনমতে নিজের হাসি চেপে রেখে পাশে তাকালেন। নিমিষেই তাচ্ছিল্যের হাসি গায়েব হয়ে প্রানবন্তর হাসি দিয়ে বললেন,

“ধন্যবাদ হুর! আজ তোমার জন্য এত বড় ক্রিমিনাল কে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে পেরেছি।তুমি না থাকলে এই মিশন কমপ্লিট করতে খুব টাফ্ হয়ে যেত। তোমায় যত ধন্যবাদ দেই না কেন মনে হচ্ছে কম পড়ে যাচ্ছে।

ম্লান হাসলো হুর।এতক্ষন সে মাথা নিচু করে রেখেছিল।সাহেদ এর কথা শুনে মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকালো।রুদ্ধের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না। তবে তাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে।নিজেকে দমালো না সে।ধীর গতিতে মাথা উঁচু করে রুদ্ধের দিকে তাকালো। রুদ্ধ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল।যার দরুন চোখাচোখি হয়ে গেল। মলিন চেহারা রুদ্ধের। চোখ শীতল। হুর রুদ্ধের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখতে পেল না। যা ছিল তা কেবল অসহায়ত্ব। রুদ্ধের এমন দৃষ্টি সহ্য করতে পারলো না হুর। চোখ নামিয়ে নিল। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। যদিও এমনটা মনে করা উচিত নয়। কারণ রুদ্ধ একজন ক্রিমিনাল। কয়েকটা খু’নের কেস এর তকমা লেগে আছে তার উপর।হুর আবার তাকালো রুদ্ধের পানে। আগের বারের মতো এবারও চোখাচোখি হল।হুর বুঝলো রুদ্ধ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল।হুরের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি দিল সে। সে হাসিতে কেঁপে উঠল হুরের বক্ষস্থল।নেত্রকোনায় পানি জড়ো হলো। রুদ্ধ দেখল।অপলক দেখলো।

একসময় হেড অফিসার অর্ডার দেয় রুদ্ধকে গাড়িতে উঠাতে।অর্ডার পালন করে কর্মীরা।রুদ্ধকে পিছন থেকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রুদ্ধ সাবলীল ভঙ্গিতে হুরের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্ধকে যত তার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে,ততই হুরের ভেতর খালি হয়ে আসছে।চোখ জ্বলছে।দাঁড়া হওয়ার শক্তি পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পুরো শরীর অবশ হয়ে আছে।

২দিন পর…
এলোমেলো হয়ে বিছানায় পিঠ উপর করে শুয়ে আছে হুর।অন্ধকার রুম। লম্বা চুল ও এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে আছে। টকটকে লাল চোখ। যে কেউ দেখলে বলবে কতশত রাত সে ঘুমায় না।রাত এখন গভীর,কিন্তু চোখে ঘুম নেই হুরের। গত তিনটা রাত সে ঘুমাতে পারছে না। নির্ঘুমে কাটছে তার দিন রাত। পানি ছাড়া পেটে কোনো খাবারের এক দানাও পড়েনি।খটখট করে শব্দ তুলে দরজায় কেউ টোকা দিল।হুরের কর্নপাতে পৌছালো না। আবারও টোকা দিকে হুর শুনতে পায়।অবশ শরীর নিয়ে কোনো রকম উঠে বসলো।বিছানা থেকে উঠে রুমের বাতি জ্বলালো। দরজা খুললো।রোকসানা এসেছে। হাতে খাবারেএ প্লেট।রোকসানার করুন স্বর,

“কি কারণে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছিস?এভাবে না খেয়ে খেয়ে তো মরে যাবি৷

হুর বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয়,
” উফ আপু, এক দুইদিন মানুষ না খেলে মরে যায় না৷ভালো লাগছিল না তাই খাই নি। ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিব।চিন্তা করো না।

খাবারের প্লেট বিছানার উপর রাখলো রোকসানা। প্লেটের উপর থেকে ঢাকনা সরানো অবস্থায় বলে,

“রুদ্ধের জেলে যাওয়াতে কি তোর কষ্ট হচ্ছে?

হুরের কঠিন উত্তর,
“সে অপরাধ করেছে তাই শাস্তি পাচ্ছে। এতে আমি কেন কষ্ট পাব?

হুরের অগোচরে হাসলো রোকসানা। হুরের উত্তর পুরোপুরিভাবে উপেক্ষা করে বলল,

“তাহলে তোর দেবদাস হয়ে থাকার কারণ কি?
“ওহো আপু তিল থেকে তাল কেন বানাচ্ছো?আমি দেবদাস হয়ে থাকছি না বরং এটা তোমার মনের ভুল। কিছুদিন আমায় সময় দাও আমি একা একাই ঠিক হয়ে যাব। অনেকদিন পর এখানে এসেছি তাই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে।

এ ব্যাপার নিয়ে আর কথা বললেন না রোকসানা। প্লেটের খাবার ঠিকঠাক করে দিয়ে হুরকে বললেন।

“ফ্রেস হয়ে আয় আমার সামনে খাবি।

“তুমি এত রাতে আমার রুমে কেন এসেছ? এত রাতে বুঝি খাওয়ার সময় হয়?তুমি তোমার রুমে চলে যাও, ঘুমাও। আমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিব।

“দুদিন ধরে তোর কথা শুনছি দেখে আজ তোর এই অবস্থা। এখন এই মুহূর্তে তুই আমার চোখের সামনে খাবার খাবি। না, হলে তোর রুম থেকে আমার এক চুলও নড়বে না।

হুর বুঝলো রোকসানার সাথে জেদ করে পারা যাবে না। অগত্যা ফ্রেশ হয়ে তার সামনে কিছুটা খেয়ে নিল। রোকসানা হুরকে ভালোভাবে বিছানায় শুয়ে দিল। কোমর অব্দি পাতলা চাদর জড়িয়ে দিল। মাথার কাছে বসে মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলালো। হালকা স্বরে বলল,

“ঘুমিয়ে যা। নিজের শরীরের সাথে আর হেঁয়ালি করিস না। যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। সব ভুলে যা।

চলে গেল রোকসানা ।যাওয়ার আগে রুমের বাতি বন্ধ করে দিয়ে গেল। বিছানায় শোয়া অবস্থায় সামনের জানালার দিকে তাকিয়ে রইল হুর। আধভাঙ্গা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। একটু একটু সোনালী রঙের আবরণ ধারণ করেছে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে বুক চিরে বের হয়ে আসলো এক দীর্ঘশ্বাস। আস্তে আস্তে করে চোখ বন্ধ করলো। মন বলে উঠলো,

“আপনার কর্মের সাজা আপনি ভুগছেন। তাহলে আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি?কেন আমার বুক পুড়ছে? স্বস্তি কেন পাচ্ছি না?বুক খালি কেন লাগছে? বারবার মনে হচ্ছে আমি কোন ভুল করেছি। কিন্তু আমি তো কোন ভুল করিনি। একজন ক্রিমিনাল কে সাজা দেয়াতে সাহায্য করেছি। বাকি দশটা মানুষের মতই যদি আপনি স্বাভাবিক একজন মানুষ হতেন তাহলে কি হত!আপনার জন্য ক্ষণে ক্ষণে পুড়তে হচ্ছে আমাকে।বারবার নিজেকে দোষী মনে করছি। মানতে পারছি না যে আপনি একটা খু’নি।বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছে আপনার সাথে আমার কাটানো সেই স্মৃতি।আপনাকে ভুলতে আমি ব্যর্থ হচ্ছি।হেরে যাচ্ছি নিজের হৃদয়ের সাথে। ঝড়ের দিনে আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা। আর শেষ দেখাতেও মনের মাঝে ঝড় তুলে দিয়ে গেলেন।আপনার সেই শীতল, অসহায়ত্ব চাহনি আমার হৃদয় জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য সক্ষম।আমাদের কাহিনী এতটুকুই ছিল। এতোটুকু কাহিনীর মধ্যে অনেক কিছুই স্মৃতি রয়ে গেল।জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার স্মরণে আপনি থাকবেন।আপনাকে ভুলা যে বড় দায়…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here