বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প #পর্ব-২৪ #লেখনিতে-আসমিতা আক্তার( পাখি )

0
727

#বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প
#পর্ব-২৪
#লেখনিতে-আসমিতা আক্তার( পাখি )

কেটে গেল কয়েকটি দিন।চঞ্চল হুর উদাসীনতায় পরিণত হয়েছে। মুখে তার এক বিন্দুও খুশির ঝলক দেখা যায় না। সারাদিন মুখ চুপসে থাকে। এই কয়েকদিনে রুদ্ধের কথা সে জানতে পারেনি। লোকটা কিভাবে আছে, না আছে, খেয়েছি কি খায়নি তাও জানে না।কোন পরিস্থিতিতে আছে সেটাও জানে না। এমন না যে জানতে ইচ্ছে হয়নি। ভীষণ করে জানতে ইচ্ছে হয়েছিল রুদ্ধ কেমন আছে।তবে মনে পাথর চেপে রয়েছে সে।এর মাঝে কয়েক দিন কলেজে গিয়েছে। কয়েকটা ক্লাস করেছে। কারণ ২ দিন পরই লাস্ট সেমিস্টার।নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে ড্রইং রুমে আসল সে৷ড্রইং রুমের সোফায় শাহেদ আর রোকসানা বসে আছে। শাহেদ হুর কে দেখে সোফায় বসতে বলে।স্মিত হেসে হুর বসে।সেন্টার টেবিলে চায়ের তিনটি কাপ রাখা। শাহেদ সেখান থেকে একটা কাপ নিয়ে হুরের সামনে ধরে।হুর ভাবুক হয়ে কাপ হাতে নেয়। শাহেদ নিজেও এক কাপ নেয়।রোকসানাও নেয়।চায়ে এক চুমুক দিয়ে শাহেদ বলতে শুরু করে,

“দেখো হুর, তোমায় এখানে আমি আমার ভরসায় এনেছিলাম। তোমার গার্জিয়ান বলতে আমি আর তোমার বোন রোকসানা। শুরুতে যেভাবে লাইফ লিড্ করছিলে, এখনও সেভাবেই করবে।রুদ্ধর মিশনে যে তোমায় এভাবে জড়াবো তা আমি আগে কল্পনা করিনি। কিন্তু শেষ অব্দি মিশন সাকসেসফুল হয়েছে।আমি তোমার অনেক কৃতজ্ঞ থাকবো আমার এত বড় উপকার করার জন্য।রুদ্ধকে আজ অব্দি কেউ জেলে নিয়ে যেতে পারেনি। বলাবাহুল্য তার ক্ষমতার কাছে সবাই হেরে গেছে৷ কিন্তু এটা যেন আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।তাই তো না চাইতেও তোমায় এতে জড়াতে হয়েছিল৷তুমি আমাকে ভুল বুঝো না৷ আমি তোমাকে কখনও শালি’র নজরে দেখিনি।এটাও ভাবিনি তুমি রোকসানার চাচাতো বোন৷সর্বদা নিজের ছোট বোন মনে করেছি।তাই বলছি রুদ্ধের চ্যাপ্টার ভুলে আগের হুর হয়ে যাও।মনে করবে রুদ্ধ ছিল একটা কালো অধ্যায়।

এক ধ্যানে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আছে হুর। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর চাচাতো বোন আর তার স্বামী ই তাকে আগলে রেখেছে। শাহেদের কথাও মিথ্যে নয়। সে সব সময় হুরকে তার নিজের ছোট বোনের মতোই স্নেহ করেছে।যখন যা প্রয়োজন হয়েছে সব এনে দিয়েছে।বাবা মাকে হারিয়ে যখন পাগলের মত প্রায় অবস্থা ছিল তখন শাহেদ তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাইতো কৃতজ্ঞতা পোষণ করার জন্য শাহেদের কথা মতো রুদ্ধকে ধরিয়ে দিতে সহায়তা করেছে।

শাহেদ নিজের কথা শেষ করে চলে গেল তার অফিসে। শাহেদ একজন পুলিশ অফিসার। এবং সে তার কর্মে অনেক খ্যাতি অর্জন করেছেন।শাহিদের সাথে রোকসানার বিয়ে পারিবারিকভাবেই হয়েছিল।বিয়ের পর রোকসানা চলে এসেছিল শহরে।আপন চাচাতো বোন রোকসানা হুরের। সেই ক্ষেত্রে তার ঠাই কোথাও না হলেও তার বোনের কাছে ঠিকই হয়েছে।তার এক সৎ মামা ছিল। সে হুরকে নিতে চেয়েছিল।কিন্তু হুর যেতে নারাজ। ঢিলে চরিত্র তার।এবং তার ছেলেদেরও। তাই সে প্রতিজ্ঞা করেছে মরে গেলেও কখনো তার মামার কাছে যাবে না। হুর যখন কোন আলোর সন্ধান খুঁজে পায় না তখন শাহেদ-ই হুরের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। হুরকে কথা দিয়েছিল তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার কাঁধে। সেই থেকে হুর শাহেদের বাড়িতে থাকে।দু’মাস অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন শাহের তার কাছে একটা আবদার নিয়ে আসে।প্রথমে কিন্তু পড়ন্তু করলেও পরবর্তীতে মেনে নিয়েছিল। সাহায্য করেছিল শাহেদের মিশনে।

চা পান না করেও হুর তার রুমে চলে আসে। সবকিছু বিষাক্ত লাগছে। কোন কিছুতে শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না। চারপাশটায় বিষাক্ত ভাব যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। তাইতো নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। চোখে মুখে পানি দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো সে। বই খুলে টেবিলে বসে পড়লো।

পরদিন…
সন্ধ্যা!আনমনা হয়ে হুর জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে।শুন্য মস্তিষ্ক।আকস্মিক চোখ বেয়ে গালে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।যখন টের পেল তখন গালে হাত দিল।পানির অস্তিত্ব পেয়ে চমকে গেল।দ্রুত গাল মুছে নিল।রুমে থাকতে আর মন চাইছে না। দম বন্ধ লাগছে। তাই রুম থেকে বের হয়ে গেল। রোকসানার রুমের দিক দিয়ে ড্রইং রুমের দিকে যেতে নিবে তখন কেউর কথা শুনে পা থেমে যায়।আড়াল হয়ে জানালার সাইডে দাঁড় হয়। কান পেতে কথা শোনার চেষ্টা করে। কেউ একজন বলছে,

“স্যার, রুদ্ধ স্যার কে তো ছেড়ে দেয়া উচিত।উনি তো নারী পাচারকারী মামলায় ইনভলভ না।আর..

“তোমার কাছ থেকে আমি কোনো অ্যাডভাইস চাইনি ফারুক।আর সে নারী পাচারকারী মামলায় জড়িত না থাকলেও তার বিরুদ্ধে আরো মামলা আছে।

” কিন্তু স্যার উনি তো শুধু ধোঁকা..

আবারও থামিয়ে দিল শাহেদ। বললো,
“এ নিয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না।গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা থাকলে বলতে পারো।

সেখান থেকে সরে আসলো হুর।গোলকধাঁধা মনে হচ্ছে সব কিছু।মস্তিষ্ক এলোমেলো লাগছে।হাঁসফাঁস লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে কোন না কোন এক জায়গায় তার ভুল হয়েছে। ভুলটাকে সংশোধন না করলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু কিভাবে!কিভাবে সত্য বের করবে?মাথাব্যথা তিরতির করে বেড়ে যাচ্ছে। এই বুঝি ফেটে যাবে।রাতে ভালোভাবে ঘুম না হওয়ার কারণে প্রায়ই মাথাব্যথা হয়।বিছানায় চিন্তিত হয়ে বসে আছে হুর। মাথায় একটাই চিন্তা কিভাবে রুদ্ধের সত্য জানতে পারবে। রুদ্ধের সত্য জানতে হলে স্বয়ং রুদ্ধোর সাথে দেখা করতে হবে।কিন্তু রুদ্ধের সাথে দেখা করাটা তো অসম্ভব।হুর কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না।হঠাৎ মাথায় ইমতিয়াজের কথা আসলো। চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এখন ইমতিয়াজকে কোথায় পাবে সেটা ভাবতে লাগলো।

ড্রেসিং টেবিলের উপরে থাকা পার্স নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। ড্রয়িং রুমে রোকসানা বসেছিল। হুরকে বের হতে দেখে রোকসানা জিজ্ঞেস করল।

“কিরে সন্ধ্যাবেলা কোথায় যাচ্ছিস?

হুর তাড়াহুড়ার সহিত বলল,
“আপু মুক্তাদের বাসায় যাচ্ছি। জরুরী কিছু নোটস আনা বাকি।কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসব।

“সাথে ড্রাইভারকে নিয়ে যাস।

“না, আপু ড্রাইভার এর প্রয়োজন হবে না। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব। এমনিতে অনেক দিন ধরে হাটা হচ্ছে না।

আর কিছু বললে না রোকসানা। হুর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। বাড়ির অনেকটা দূরে এসে সিএনজি নিল।সিএনজি মামা কে বলল “এ আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি” অফিসে নিয়ে যেতে।একদিন কথায় কথায় হুর জানতে পেরেছিল রুদ্ধের অফিসের নাম। সেটা আজও স্মরণ আছে।প্রায় ১৫ মিনিট রাস্তা অতিক্রম করার পর সিএনজি থামল অফিসের নিচে। পাশ থেকে টাকা বের করে দ্রুত গতিতে অফিসের ভেতর প্রবেশ করল হুর।তড়িঘড়ি করে রিসিপশনে আসলো। রিসিপশনিস্ট এর কাছে ইমতিয়াজের কথা জিজ্ঞেস করল।সে জানালো ইমতিয়াজ অফিসের মধ্যেই আছে।হুর তার সাথে দেখা করতে চাইলে রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞেস করে তার কাছে এপয়েন্টমেন্ট আছে কিনা!হুর মলিন মুখে “না” বলে।রিসেপশনিস্ট বলে,

“দুঃখিত ম্যাম এপয়েন্টমেন্ট ব্যতীত স্যারের সাথে কেউ দেখা করতে পারবে না আজ। আপনি কাল আসুন।

হুর বিনতি করে বলে,
“প্লিজ আপু, আমায় ভাইয়ার সাথে দেখা করতে দিন।খুব দরকারে তার কাছে এসেছি।প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন৷

রিসেপশনিস্ট কিছুক্ষন হুরের দিকে তাকিয়ে তার ভাব ভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলো।হুরের চেহারায় স্পষ্ট অসহায়ত্বের ছাপ।তাই রিসেপশনিস্ট বলল,

” ওকে ম্যাম, আমি স্যার কে আপনার কথা বলছি।নাম কি আপনার ম্যাম?

হুর নিজের নাম বললো। রিসেপশনিস্ট ইমতিয়াজ কে জানাকে ইমতিয়াজ বলে “সে আসছে”।ইমতিয়াজ দেরি না করে মিনিটের মাঝেই রিসেপশনের কাছে হাজির হয়। দৌড়ে আসার কারনে হাপিয়ে উঠেছে সে।হাপাতে হাপাতে হুরের দিকে তাকালো। বলল,

“ভাবি আপনি এসেছেন!

ইমতিয়াজের ভাবি সম্বোধনে কিছুটা থমকে গেল হুর। তাকে ভাবি কেন বলা হচ্ছে সেটা ভাবতে পারলো না। এখন এসব কে প্রাধান্য না দিয়ে হুর ইমতিয়াজ কে বলল,

“আপনার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে ভাইয়া।

নিঃশ্বাসের গতি কমে আসলো ইমতিয়াজের।হুরকে আদেশ করে বলল,
“আসুন আমার সাথে!

ইমতিয়াজের পিছে পিছে যাচ্ছে হুর।ইমতিয়াজ নিজের কেবিনে নিয়ে আসলো হুরকে।হুর কে চেয়ারে বসার জন্য অনুরোধ করলো।তবে হুর বসলো না। বিচলিত হয়ে আছে তার মন মস্তিষ্ক। যতক্ষণ না পর্যন্ত বিচলিত ভাব কমাবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে শান্ত থাকতে পারবে না।এই মুহূর্তে ইমতিয়াজের কাছ থেকে তার সব কথা জানতে হবে। রুদ্ধের সব সত্যি কথা জানতে হবে।তাই সময় ব্যয় না করে প্রশ্ন করে,

“উনি কেমন আছেন?

ইমতিয়াজ হুরের দিকে তাকায়। অনেকক্ষণ তাকায়। হুরের চেহারায় স্পষ্ট কষ্ট দেখতে পাচ্ছে। যা এতদিন ধরে রুদ্ধের চেহারাতেও দেখা গিয়েছে। দুজনেই কষ্ট পাচ্ছে কিন্তু কেউ কাউকে প্রকাশ করছে না। প্রকাশ করার মতো তো কোনো উপায় নেই। দুজন মানব দু প্রান্তে আছে। কেউ কারোর দেখা পাচ্ছে না।হুরের প্রশ্নের উত্তরে ইমতিয়াজ কাতর কণ্ঠে বলে।

“ভালো নেই ভাবি, ভাইয়া একদমই ভালো নেই।

কেঁপে উঠল হুরের বক্ষস্থল।নেত্রকোনায় পানিদের স্রোত বয়ে গেল।ইমতিয়াজ আবার বলল,

“আপনি আসতে এত লেট কেন করলেন ভাবি?

হুর চোখ নিচে নামিয়ে নিল। ইমতিয়াজ শুরু থেকে বলতে লাগলো,

” আপনি কি মনে করেছিলেন আপনি ভাইয়ের নাকের নিচ থেকে সব তথ্য কালেক্ট করে পুলিশদের দিবেন,আর ভাইয়া জানতেও পারবে না?ভাইয়া আপনাকে প্রথম দিনই সন্দেহ করেছিল৷ কিন্তু আপনাকে বুঝতে দেয় নি। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে আপনাকে প্রথম দিনই কিভাবে সন্দেহ করেছিল তাই না?আর যদি সন্দেহ করেই থাকে তাহলে কিছু বললো না কেন!

হুর অবাক হয়ে মাথা নাড়ালো। ইমতিয়াজ স্মিত হাসলো। আবার বলতে লাগলো,

“আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় বাহুডোরে যখন ভাইয়া আপনাকে রেখেছিল। তার কিছুটা দূরে গিয়েই বুঝতে পেরেছিল তার সাথে কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে।গাড়ির আয়না দিয়ে পিছনে কয়েকজনকে সে দেখতে পেয়েছিল। যদিও তারা লুকিয়ে ছিল। কিন্তু ভাইয়ের কাছ থেকে অগোচর হতে পারেনি। সে তখনই সন্দেহ করা শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু আপনাকে বুঝতে দেয়নি।সে দেখতে চেয়েছিল আপনাদের প্ল্যান কত দূর অব্দি যায়। এবং আপনি তার সাথে কি কি করেন।ভাইয়া বরাবরই মাস্টারমাইন্ড গেম খেলতে খুবই পছন্দ করেন। তাইতো সেও আপনার সাথে গেমে যুক্ত হয়েছেন।আপনার এক একটা পদক্ষেপ ভাইয়া মেপে মেপে রাখত। আপনি কখন কি করেন তাও জানত। আপনি যে লুকিয়ে ভাইয়ের রুমে প্রবেশ করতেন তাও জানতো। এখন অবশ্য মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে ভাইয়া কিভাবে জানলো আপনি তার রুমে গেছেন। ভাইয়ের রুমে এবং বাহিরে হিডেন ক্যামেরা লাগানো আছে।এবং আপনি একটা জিনিস হয়তো খেয়াল করেন নি৷ যখনই কেউ ভাইয়ের রুমের দরজা খুলে তখন খট করে একটা শব্দ হয়। সেটা একটা সিকিউরিটি সিস্টেম।সে শব্দটা হওয়ার সাথে সাথে ভাইয়ের ফোনে নোটিফিকেশন চলে যায়। তাই সহজে ভাইয়া বুঝতে পারে তার রুমে কে যাওয়া আসা করছে!

আর আপনি যখন চুরি করে ভাইয়ের হাতের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়েছিলেন তখন ভাইয়া ও বুঝে গিয়েছিল। সেটা কিভাবে বুঝেছিল তা ভাইয়ের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নিবেন।তবে এসবের ব্যাপারে আমি প্রথমে কোন কিছুই জানতে পারিনি। একদিন ভাইয়াকে দেখছিলাম ল্যাপটপে বসে বসে আপনার কার্যকলাপ দেখছিল। সেদিন আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। তবে ভাইকে দেখা গিয়েছিল স্বাভাবিক। যেন সে প্রথম থেকেই এসবের ব্যাপারে অজ্ঞাত ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলে সে সবকিছুই আমায় বলে দেয়। আমি এসব মানতে পারিনি। তাই ভাইয়াকে বলেছিলাম আপনার কোন একটা ব্যবস্থা করতে। কিন্তু ভাইয়া করতে দেয়নি। ভাইয়া চায়নি আপনার উপর একটা আচর লাগুক।আপনি যে ছাদের রুমেও গিয়েছিলেন তাও ভাইয়া জানে। সেখান থেকে আপনি কি কি ডকুমেন্টস কালেক্ট করে পুলিশদের হাতে দিয়েছেন তাও জানে।
কিন্তু কখনো এ নিয়ে আপনাকে প্রশ্ন করেনি। ভাইয়া মনে করেছিল আপনি তাকে বুঝবেন। আপনি যেই উদ্দেশ্যে এসেছিলেন তা ভাঙবে। কারণ ভাইয়া সঠিক ছিল। ভাইয়া খু’নি! তবে সে কখনো ভালো মানুষদের খু’ন করেনি। যারা তার সাথে ধোঁকাধারী করেছে,যারা তার ক্ষতি করতে চেয়েছে তাদেরকে সে দুনিয়া থেকে গায়েব করে দিয়েছে।যারা নরপশু তাদেরকেই ভাইয়া খু’ন করেছে।

চোখে টইটুম্বুর পানি। তবে মুখে লেগে আছে আশ্চর্য।হুর কখনো ভাবতেও পারেনি যে রুদ্ধ সব আগে জেনে গিয়েছে। এবং সত্য কথা জানার পরও তাকে জানে বাঁচিয়ে রেখেছে। এবং তার সাথে খুব স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করেছে।

এটা মানতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে হুরের।রুদ্ধ ইচ্ছে করে হুরের কোনো ক্ষতি করেনি। সে জানত হুর তার শত্রু। তারপরও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।যখন যেটার প্রয়োজন হয়েছিল সব দিয়েছিল।আগের তুলনায় এখন নিজেকে আরো বেশি দোষী মনে হচ্ছে নিজেকে।সব সত্য কথা শোনার পর মাথায় একটাই কথা ভন ভন করছে।

“ভাইয়া উনি,উনি এখন কোথায়?

ইমতিয়াজের আহত কন্ঠস্বর,
“ভাইয়াকে এখন রিমান্ডে রাখা হয়েছে।গত দুদিন ধরে সে রিমান্ডে আছে। এতদিন ক্ষমতার পাওয়ারে তাকে হেফাজতে রাখতে পারলেও দুদিন ধরে পারছিনা। যেখানে ভাইয়ার নিজেরই ইচ্ছে নেই হাজত থেকে বের হয়ে আসা সেখানে আমি বা কি করতে পারি!আমি জামিন পত্র রেডি করে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভাইয়ের আদেশ, সে এখানেই থাকতে চায়। অনেক বুঝিয়েও লাভ হয়নি। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে আমায় ফেরত আসতে হয়েছে। এখন শেষ ভরসা আপনি। ভাইয়া বলেছিল আপনি আসবেন। কিন্তু আসতে যে এত লেট করবেন তা জানতাম না। এখন আপনিই পারেন ভাইয়াকে জেল থেকে বের করে আনতে। ভাইয়ের অবস্থা খুবই শোচনীয়।মারতে মারতে ভাইয়াকে আধমরা করে দিয়েছে।আপনি প্লিজ ভাইয়াকে বোঝেন।

অনর্গল গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে হুরের। নিজের অজান্তে সে রুদ্ধকে কষ্ট দিয়েছে। ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে। হুর কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,

“আমাকে উনার কাছে নিয়ে চলুন প্লিজ!

ইমতিয়াজের মুখে হাসির ঝলক ।সে দ্রুত গতিতে মাথা নারালো। মাথা নাড়ানো অবস্থায় বলল,

“হ্যাঁ ভাবি চলুন ,আমি এখনই আপনাকে উনার কাছে নিয়ে যাচ্ছি।

পুলিশ স্টেশনে চলে আসলো দুজন। রুদ্ধের সাথে দেখা করতে চাইলে অফিসাররা দেখা করতে দেয় না। তবে ইমতিয়াজ তাদের কানে এমন কিছু বলে যে অফিসাররা আমতা আমতা করে পারমিশন দিয়ে দেয়।ইমতিয়াজ অনেক সময় চেয়েছে। কমপক্ষে 1 ঘন্টা তো দিতেই হবে। সাবলীলভাবে অফিসাররাও মেনে নিয়েছে।ঘুটঘুটে অন্ধকার একটি রুমের মধ্যে ছোট একটি ল্যাপ জ্বলছে টেবিলের ওপর।টেবিলের দুপাশে দুটি চেয়ার। যার একটিতে একজন বসে আছে। মাথা নিচু করে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব উশৃঙ্খল।দুহাতে হাতকড়া পড়ানো,টেবিলের উপর মুঠো করে রাখা।দরজার কাছ থেকে কাউর হাটার শব্দ শোনা গেল।শব্দটা দরজার কাছে এসেই বন্ধ হয়ে গেল। মাথা নিচু রেখেই রুদ্ধ চোখ উঁচু করলো।দৃষ্টিগোচরে আসলো অবয়ব এক নারীকে। সেভাবে থেকেই মুচকি হাসলো। তবে নারীটি টের পেল না। রুদ্ধ নিজের জায়গা ছাড়লো। চেয়ার থেকে উঠে রুমের মাঝ বরাবর দাঁড়া হল। মাথা তার তখনও নিচু।

হুর দৌড়ে রুদ্ধকে জাপ্টে ধরলো। সাথে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।কান্নার মাত্রা একসময় তীব্র হলো। জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। রুদ্ধের দুই হাত সামনে থাকায় জড়িয়ে ধরতে সুবিধা পাচ্ছিলো না হুর। তাই রুদ্ধকে ছেড়ে রুদ্ধের দু হাত উঁচু করে তার মাঝে সে ঢুকে পড়লো। দু হাতে পিঠ জড়িয়ে বুকে মাথা রাখলো।মনে হচ্ছে কত বছর এ বুকে সে মাথা রাখে না।শান্তি পায় না।রুদ্ধ নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে হুরকে।এতে কান্না বেড়ে যায় হুরের। কান্না করা অবস্থায় বলে,

“কেন এমন করলেন?কেন জেনে বুঝে সবটা হতে দিলেন?আপনি তো জানতেন আমি ভুল ছিলাম। তাহলে কেন সঠিক রাস্তা দেখান নি?

গোঙালো রুদ্ধ, বিচলিত হলো হুর। ছাড়তে চাইলো, রুদ্ধ ছাড়লো না। জড়িয়ে ধরে রাখলো। কিছুক্ষন হুরকে ধরে নিস্তব্ধতার সময় কাটিয়ে দিল। তারপর রুদ্ধ নিজেই হুরকে ছাড়তে চাইল।এবার হুর ছাড়তে নারাজ। হুর তাকে ছাড়ছে না দেখে রুদ্ধ নিজের মুখ খুলে,

” ছাড়ো হুরপাখি….অনেক দিন হলো গোসল করিনা৷ বিশ্রী গন্ধ আসছে শরীর থেকে।

রুদ্ধের কথায় যেন জড়িয়ে ধরার জোর আরো বেড়ে যায়। রুদ্ধ উপায় না পেয়ে বলে,

“হুরপাখি…ব্যাথা পাচ্ছ তো।

তৎক্ষণাৎ রুদ্ধকে ছেড়ে দিলে হুর।ইমতিয়াজ বলেছিল পুলিশের লোকরা রুদ্ধকে অনেক মেরেছে। কিন্তু অন্ধকারের জন্য কোন কিছু বুঝতে পারছে না।হুর রুদ্ধের হাত টেনে টেবিলের কাছে নিয়ে আসলো। সাথে সাথে রুদ্ধের চেহারা স্পষ্ট হলো।চেহারার কিছু কিছু জায়গায় কালশিটে দাগ পড়ে গেছে। ধক করে উঠলো হুরের ক’লিজা। রুদ্ধের হাত টেনে হাত দেখতে লাগলো। অসংখ্য মা’রের দাগ। ডুকরে কেঁদে উঠলো হুর।রুদ্ধের পরনের ময়লা টি-শার্ট উঠিয়ে পিঠের মা’রের দাগগুলো দেখলো।কাঁপা কাঁপা হাতে দাগ গুলোর উপর স্পর্শ করল হুর।বলল ,

“এত মেরেছে আপনাকে!

বলে আবার কান্না করতে লাগলো। রুদ্ধ শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। হুরের কান্না কখন শেষ হবে তাই ভাবছে।তবে এটা নিশ্চিত কান্না তার দীর্ঘ থাকবে। কান্নারত হুর কে পরখ করছে রুদ্ধ।কয়েকদিনে মেয়েটা আরো শুকিয়ে গেছে।চোখের নিচে কালি জমে গেছে। তবে টইটম্বুর হুরকে দেখতে বেশ লাগছে।হুর কান্না করতে করতে আবার বলে,

“ইমতিয়াজ ভাইয়া তো বেইল পেপার নিয়ে এসেছিল। তাহলে কেন আপনি নিজেকে এই চার দেয়ালের মাঝে আটকে রেখেছেন। কেন নিজেকে শাস্তি দিচ্ছেন।আপনি প্লিজ এখান থেকে চলুন।আপনাকে এভাবে দেখতে আমার একদমই ভালো লাগছে না। বুক ফেটে যাচ্ছে। আপনি এখনই আমার সাথে যাবেন। না, হলে আপনার সাথে আমিও আপনার কাছে থাকবো।

রুদ্ধ এবার হুরের এক হাতে ধরে হেচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। হুরের কান্নারত চেহারার দিকে তাকিয়ে স্লো ভয়েসে বলে।

“কেন তুমি না চাচ্ছিলে আমি জেলে থাকি?আমার জেলে ভরানোর জন্যই তো তোমাদের এই কারসাজি।এখন তোমাদের মিশন সাকসেসফুল। এখন আমি জেলে। তাই আনন্দ না করে শোক কেন পালন করছো?তোমাদের তো উচিত বড় একটা পার্টি থ্রো করা। আফটার অল গ্যাংস্টার হিমায়েত এশহ্যান রুদ্ধ কে জব্দ করতে পেরেছো তোমরা।খুশির কান্না তোমার চোখে কেন নেই? কেন তোমার চোখে দুঃখের কান্না? কেন শোক পালন করছো? কেন এসেছ এখানে? যা চেয়েছিলে তাই তো পেয়েছো।তাহলে আমাকে এখানে দেখে বু’ক কেন ফাটছে তোমার?ধোঁকাবাজদের কখনো বু’ক ফাটেনা।

আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল রুদ্ধকে। হু হু করে কান্না করছে সে।হিচকি তুলে বলে,

“বিশ্বাস করুন আমি এসব কোন কিছুই করতে চাইনি। দুলাভাই আমার কাছে অনেক রিকোয়েস্ট করেছিল তাই বাধ্য হয়ে করেছি। তবে বিশ্বাস করুন আমি আপনার কাছে কোন কিছুই মিথ্যা বলিনি। আমার অতীতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা সত্য। দুলাভাই বলেছিল আপনি মেয়ে পাচার করেন।এবং কি অনেক অবৈধ কাজে লিপ্ত আছেন।তাই আমায় এসব করতে বাধ্য করেছেন।কিন্তু কয়েকদিন আপনার সাথে থেকে আমি বুঝেছিলাম আপনি এমন লোক না। তাই আপনাকে জানতে চেয়েছিলাম, চিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন রাতে নারী পাচারকারীর কথা শুনে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। এ বিষয়ে আমি আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার সময় হয়ে ওঠেনি। কিছু করার আগেই দুলাভাই এবং তার টিম আপনাকে ধরার ফন্দি এটে বসে। তাই আমি চেয়েও কোন কিছু করতে পারিনি।

সে রাতের পর থেকে আমি ঘুমাতে পারছি না। কোন কিছুতে শান্তি পাচ্ছিনা। বারবার আপনাকে মনে পড়ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আপনি নির্দোষ। কিন্তু আমি এক বেড়াজালে আটক ছিলাম। তাই কোন কিছু জানতে পারিনি। আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারছি না রুদ্ধ। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে যাব। প্লিজ আমাকে বাচিয়ে নিন।

বিঃদ্রঃ আশা করি সবার কনফিউশন দূর হয়েছে। আর আমি যেভাবে কল্পনা করেছিলাম,সেভাবেই গল্পটা লিখছি।রি-চেক করা হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here