#বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প
#পর্ব-৬
#লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )
আজ কলেজের প্রথম দিন হুরের।শহরের কলেজে পড়বে বলে খুব এক্সাইটেড সে।এতদিন গ্রামের কলেজে পড়েছে। তাই জানেনা শহরের কলেজ গুলো কেমন,কেমন সেখানের পড়ালেখা, কেমন সেখানের স্টুডেন্ট এবং কেমন সেখানের পরিবেশ।আজও জেরিন গতকালের মত হুরকে ড্রেস সিলেক্ট করে দিয়েছে।আজকে তাকে স্কার্ট আর শার্ট দিয়েছে পড়ার জন্য। হুরও খুশিমনে তা পরিধান করেছে।রোজকার মতো আজও চুল খোপা করা।খুশিমনে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে দেখে রুদ্ধ ও ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে।রুদ্ধকে দেখে সব এক্সাইটমেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে।লোকটাকে দেখলে কেন জানি মুখের বলি,আনন্দ সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় নিঃশ্বাসটাও যেন না আরো বন্ধ হয়ে যায়। এমন হলে তো সে মারা যাবে।অহেতুক কথা না ভাবাই শ্রেয়। তাই হুর ও আর অহেতুক কথা না ভেবে সোজা ডাইনিং টেবিলে বসে গেল।রুদ্ধের দিকে তাকালো। রুদ্ধের মনোযোগ তার খাবারে এবং হাতে থাকা ফোনে।রুদ্ধ বুঝল হুর ডাইনিং টেবিলে এসেছে। তারপরও সে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো না।মনে মনে হুর রুদ্ধকে দেখে ভাবের গোডাউন মনে করল। এত ভাব বুঝি কেউ হয়?এত ভাব নিয়ে একটা মানুষ থাকে কিভাবে? কেউ যদি সামনে আসে মানবতার খাতিরে না হয় একবার তাকাতেই পারে।কিন্তু রুদ্ধকে দিয়ে এমন আশা করাটা নিতান্তই বো’কামি।তাই হুর আর এই বো’কামি করতে চাচ্ছে না।মনে এক্সাইটেড নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। তার জন্য রাধা খাবার খেতে লাগলো।কার কি লাগবে না লাগবে তা দেখতে আসলো জেরিন।হুরকে আরেক রূপে দেখে আনন্দিত হলো তার মন।বিমোহিত ও হল।মেয়েটা সবকিছু পড়লেই তাকে দেখতে ভালো লাগে।যেটা গায়ে জড়াবে সেটাই ফুলের মত ফুটে উঠবে।জেরিন হুরের দিকে তাকিয়ে আদুরে স্বরে বলে,
“কলেজে যাবেন দেখে এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে মনে তাই না?
হুর নিজের এক্সাইটমেন্ট ধরে রাখতে না পেরে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো।
“আপু আমার ইচ্ছে করছে উড়ে উড়ে কলেজে চলে যাই।আমার অনেক দিনের শখ ছিল শহরের কলেজে পড়ার।কিন্তু কোনদিন পড়তে পারিনি। তাই আমার মাঝে অনেক এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে।ইচ্ছে করছে দৌড় মেরে ছুটে চলে যাই কলেজে।
ঠোঁট এলিয়ে হাসলো জেরিন।মেয়েটা নিজের খুশি দমিয়ে রাখতে পারেনা।নিজের মনে থাকা সব কথা গরগর করে বলে দেয়।এই বিষয়টা ভালো লাগে জেরিনের।মেয়েটার সবকিছুতেই একটা আকর্ষণ আকর্ষণ ভাব আছে।যে কেউ তাকে দেখলে তার টুকুর টুকুর চোখের চাহনি দেখলে এবং কি বো’কা বো’কা কথা শুনলে যে কেউ মোহগ্রস্ত হয়ে যাবে।শুধু ছেলেরা না মেয়েরাও মহগ্রস্থ হয়ে যাবে। এই যেমন এখন জেরিন হচ্ছে। মেয়ে হয়েও মেয়ের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।ভুলবশত যদি জেরিন ছেলে হতো তাহলে পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করে হলেও হুরকে সে নিজের কাছে রাখতো।এসব ভাবতেই মনে মনে হাসলো অনেক জেরিন।তার চিন্তা ভাবনা আজকাল একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।সেসব চিন্তা কে প্রাধান্য না দিয়ে হুরকে বলে,
“থাক আপনাকে আর উড়ে উড়ে যেতে হবে না।আস্তে ধীরে খাবার শেষ করে তারপর কলেজে যাইয়েন।এখনও অনেক সময় আছে কলেজের।
হুর জেরিনের দিকে ঠোঁট চওড়া করে হাসি দিয়ে খাবার খেতে লাগলো।নাস্তা শেষ করে সোফার উপর থেকে কলেজের জন্য আনা নতুন ব্যাগ আরো একবার চেক করে নিল।গতকাল রাতেই রুদ্ধ হুরের জন্য বই, খাতা, কলম, পেন্সিল ব্যাগ সবকিছুই নিয়ে এসেছে।ড্রেস সেলাই করতে কয়েকদিন সময় লাগবে দেখে দ্রুত ড্রেস আনতে পারেনি।রুদ্ধ অফিসে যাওয়ার আগে হুরের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে।
“বাহিরে গাড়ি রাখা আছে ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে কলেজে।আসার সময়ও ড্রাইভার তোমাকে নিয়ে আসবে।কোথাও যেতে হলে ড্রাইভার কে নিয়ে যাবে।
বলেই সে চলে গেল।হুর বুঝে উঠতে পারে না এই লোকটা সবসময় এভাবে কেন কথা বলে।মিষ্টি ভাবে কি লোকটা কথা বলতে পারে না।এভাবে শক্ত গলায় কথা বলার কি দরকার?হুহ্!মনে মনে ভেংচি কেটে ড্রাইভারকে নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে চলে গেল হুর।কলেজের ভেতর প্রবেশ করেই টুকুর টুকুর চোখে আশপাশে দেখছে।বড় বড় চোখে টুকুর টুকুর চাহনি বেশ মানিয়েছে।আশেপাশে যে কয়েকটা ছেলে আছে সবাই হুরের দিকে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।গতকাল রুদ্ধের সাথে আসার সময় সে মাস্ক পড়ে এসেছিল। তাই কেউ তাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু আজ! আজ তো সে মাস্ক বিহীন এসেছে।আসলে মাস্ক পড়তে তার অস্বস্তি হয়। মাঝে মাঝে দম আটকে আসে। তাই সে পড়ে না।কিন্তু গতকাল রুদ্ধের করা আদেশে সে একপ্রকার বাধ্য হয়েই মাস্ক পড়েছিল।তবে আজ সে বাধ্য না।তাই আজ মাস্ক পড়েনি।সামনে আরো কিছুদূর এগিয়ে যেতেই সাক্ষাৎ হলো প্রিন্সিপালের সাথে।প্রথমত খেয়ে প্রিন্সিপাল তার দিকেই এগিয়ে আসছে।প্রিন্সিপাল হুরের কাছে এসে বলে।
“মামনি তুমি এসেছ?চলো তোমার ক্লাস অলমোস্ট শুরু হয়ে গিয়েছে।আমি তোমায় ক্লাসের সবার সাথে পরিচিত করে দেয়।
প্রিন্সিপালের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে হুর।প্রথমত তিনি এই কলেজের প্রিন্সিপাল। তার ওপর হুর কলেজের কাউকে চিনে না। তাই প্রিন্সিপাল যদি তার সাপোর্টে থাকে তাহলে ভেতরে ভয় কাজ করবে না।এমনটা ভাবনা হুরের।গুটিসুটি পা ফেলে প্রিন্সিপালের সাথে সাথে যাচ্ছে হুর।একটা ক্লাসের সামনে থামলো তারা।প্রিন্সিপাল সেই ক্লাসের ভেতরে গিয়ে হুরকেও ভেতরে আসতে বলল।হুর ও ছোট ছোট কদম ছেলে প্রিন্সিপালের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রিন্সিপাল কে দেখে ক্লাসের সকল ছাত্র-ছাত্রী উঠে দাঁড়ালো।সবাইকে বসতে বললে সবাই বসে যায়।তারপর গলার স্বর উঁচু করে বলে।
“ওর নাম হচ্ছে উম্মে তাহিয়্যাহ্ হুর।আজ থেকে ও তোমাদের ক্লাসমেট।তোমাদের সাথে পড়বে ও।
আরো কিছু বলে প্রিন্সিপাল চলে যান ক্লাস থেকে।এক পাশে ছেলেদের বেঞ্জ আরেক পাশে মেয়েদের বেঞ্চ।হুর মেয়েদের বেঞ্চের তৃতীয় সারিতে থাকা একটা সিটে বসে পড়লো।হুর ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ বসে আছে বেঞ্চে।একদম শান্তশিষ্ট।হুর নিজের আপন মানুষদের ক্ষেত্রে চঞ্চল থাকলেও বাহিরের মানুষদের জন্য সে খুবই নম্র ভদ্র। এই হুরকে দেখে কেউ আন্দাজই করতে পারবে না তার মধ্যকার চঞ্চলতা।হুরের বেঞ্চে থাকা দুটি মেয়ে হুরের সাথে বন্ধুত্ব করে নিল।হুরও নতুন বন্ধু পেয়ে অনেক খুশি।ক্লাসের স্যার হুরের সাথে পরিচয় হয়ে ক্লাস আরম্ভ করলো।ক্লাসের অর্ধেক ছেলেরা প্রায় হুরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে।কলেজের সব থেকে সুন্দর রমণী হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করছে।স্যার এখন রসায়ন ক্লাস করাচ্ছে।হুরের সম্পূর্ণ মনোযোগ ক্লাসের মাঝে। এদিক ওদিক কি হচ্ছে তাতে বিন্দুমাত্র তার ধ্যান নেই।দেখতে দেখতে সময় চলে আসলো টিফিন পিরিয়ডের।একটানা এতগুলো ক্লাস করে ক্লান্ত হয়ে বেঞ্চে গা এলিয়ে দিল হুর।হুরের নতুন দুই বান্ধবী ও ক্লান্ত হয়ে বেঞ্চে গা এলিয়ে দিল।হুরের পেট তাকে জানান দিচ্ছে এই মুহূর্তে তার খাবার খাওয়া খুবই জরুরী।কিন্তু খাবার পাবে কোথায়?সে তো সাথে করে টাকা ও নিয়ে আসেনি। তাহলে কিভাবে খাবে ভেবে পাচ্ছে না।নিজের জন্য অনেক কষ্ট হচ্ছে হুরের। এ কষ্ট কাউকে বলতেও পারছে না।তাই ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে বেঞ্চে বসে রইল।সদ্য নতুন দুই বান্ধবী হুর কে বলেছিল ক্যান্টিনে তাদের সাথে টিফিন করে আসতে।কিন্তু সে টাকা নিয়ে আসেনি এই লজ্জায় কেউকে বলতে পারছে না।এত লজ্জা কোথায় রাখবে সে?আগে যখন বাবা-মা ছিল তখন মুখ ফুটে কখনো টাকা চায়নি। সব সময় বাবা-মা তাকে নিজ থেকে টাকা দিয়েছে।বা মাঝে মাঝে ব্যাগের মধ্যেই টাকা ঢুকিয়ে রেখেছিল।কিন্তু এখন! এখন কে তাকে টাকা দেবে, কে তার ব্যাগে টাকা ঢুকিয়ে রাখবে?এসব ভেবে চোখে জল চলে আসলো তার।এখনো আরো দুইটা ক্লাস বাকি আছে।এই দুইটা ক্লাস অব্দি ক্ষুধার্থ পেট নিয়ে যেন বেঁচে থাকতে পারে হুর সেটাই দোয়া করছে।দোয়া দরুদ এর মাঝে হঠাৎ করে কাউর কন্ঠ ভেসে আসলো।পাশ ফিরে তাকাতেই হুর দেখলো পরিপাটি এক পুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।দেখতে সুন্দর।তবে কিছুটা হ্যাংলা টাইপের।শরীরে মাংসের ঘাটতি আছে।তবে খাওয়া-দাওয়া করলে মনে হয় ঘাটতি পূরণ হতে পারবে।এমন হ্যাংলা ছেলে হুর অনেকদিন পর দেখলো। তাই টুকুর টুকুর চোখে হ্যাংলা ছেলেটির দিকেই তাকিয়ে রইল।তবে সেই হ্যাংলা ছেলেটি হুরের টুকুর টুকুর করে দেখার মানে বুঝতে পারল না।তাই গলা খাকাড়ি দিল ধ্যান ভাঙ্গার জন্য।কিন্তু না! হুর তো একইভাবে এখনো তাকিয়ে আছে। ফ্যাসাদে পড়ে গেল সেই হ্যাংলা ছেলেটি।কি করবে কি বলবে বুঝতে না পেরে আবার কেশে উঠলো।বলল,
“হাই আমি আকাশ।
হুর মনে মনে ভাবলো।
“আপনার নাম আকাশ নয় বাতাস হওয়া দরকার ছিল। একটা ফু মারলেই বাতাসের সাথে উড়ে পুরো পৃথিবী চক্কর দিবেন।
তবে মনের কথা না বলে নিম্ন স্বরে বলে,
“হুম।
আকাশ নামক হ্যাংলা ছেলেটি বলে,
“আমরা কি বন্ধু হতে পারি?
ভাবুক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে হুর।এমন অফার সে আগে অনেক পেয়েছে।কিন্তু সবার সাথে বন্ধুত্ব রাখেনি। যাকে তার ভালো লেগেছে যার কথাবার্তা স্বভাব ভালো লেগেছে চিনেছে তাকেই সে বন্ধু বানিয়েছে। তাই হঠাৎ করে আকাশের প্রস্তাবে সে রাজি হতে পারছে না। তাই ইনিয়ে বিনিয়ে বলে,
“আমার নতুন দুইটা বন্ধু হয়েছে। আপাতত আর বন্ধুর প্রয়োজন নেই। যদি কখনো বন্ধুর প্রয়োজন হয় তাহলে আপনাকে স্মরণ করব।
বলে সে মাথা নিচু করে নিল।আকাশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হুরকে দেখল।বিমোহিত হলো হুরের কথা শুনে।মেয়েটার কন্ঠ এতক্ষণ শুনতে পায়নি।তাই এখন শুনে তার মন নেচে উঠলো।ভালো লাগায় ছেয়ে উঠলো তার সর্বাঙ্গ।মেয়েটিকে প্রথম দেখায় তার ভালো লেগেছে।ভীষণ ভালো লেগেছে।তাইতো আঁক বাড়িয়ে চলে এসেছে মেয়েটির সাথে কথা বলতে।আকাশ সব সময় কথা কম বলে। বন্ধু ও তেমন একটা নেই।গুনে গুনে তার তিনটা বন্ধু।প্রথমে কয়টা মেয়ে এসেছিল তার সাথে বন্ধুত্ব করতে কিন্তু সেই সুযোগ দেয়নি।কিন্তু আজ নিজে যেচে গিয়ে হুরের সাথে সে বন্ধুত্ব করতে চাইলো।প্রত্যাখানা হল।কিন্তু এতে খারাপ লাগলো না তার।ভালোই লেগেছে বটে।চলে গেল সে নিজের বেঞ্চে।টিফিন পিরিয়ড শেষ হলে ক্লাসে স্যার আসলো। ক্লাসে আবার সবাই মনোযোগী হল।হুরের পেটে গুড়গুড় শব্দ বেড়েই যাচ্ছে।বেঞ্চের নিচ দিয়ে এক হাত দিয়ে পেট চেপে আছে।ইতিমধ্যে খালি পেটে ব্যথা হওয়া শুরু করে দিয়েছে।ক্লাস শেষ হলো দুপুর ২ টায়।কোনরকমে হেলে দুলে হুর কলেজ গেইট থেকে বের হলো।ভীষণ ক্লান্ত লাগছে শরীর।বাহিরে বের হয়ে দেখল ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসেছে।ড্রাইভার হুরকে দেখে বলে,
“আসুন ম্যাম!
ম্যাম ডাকায় প্রতিবাদ করতে চাইলো হুর।তবে প্রতিবাদ করার মতো শক্তি তার শরীরে নেই।তাই কোনো কথা না বলে সিটে গিয়ে বসলো।সিটে মাথায় এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল।অনেকটা সময় লেগে গেল বাড়ি পৌঁছাতে।হুর কোনরকমে দুর্বল শরীর নিয়ে গেইটের ভেতর প্রবেশ করল।কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা চলে আসলো বাড়ির ভেতর।সোফার রুমে আসতে সোফার উপর কাধের ব্যাগ রেখে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল।কিছুক্ষণ পর ড্রইংরুমে আসলো জেরিন।হুরকে দেখে তার ঠোঁটের কোনায় হাসি চলে আসলো।হুলের চেহারা দেখতেই তার হাসি মুখ চুপসে এলো। মেয়েটাকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে।জিজ্ঞেস করল,
“অনেক ক্লান্ত লাগছে তাইনা?আজ প্রথমদিন ক্লাসের তো তাই এমনটা মনে হচ্ছে। রেগুলার কয়েকদিন যাওয়া আসা করলে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে।তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার টেবিলে দিচ্ছি।খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে পড়ো।
হুর কোনমতে নিজের শরীরটা কে টেনেটুনে চলে গেল তার রুমে।কাপড় নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে।৪৫ মিনিটে লম্বা এক শাওয়ার নিলো।চুলগুলো মুছে ভালোভাবে আচড়ে নিল।চুল শুকাতে অনেক সময় লাগবে। তাই চুল এখন ছেড়ে রেখে দিল।চলে আসলো ডাইনিং টেবিলে।রুদ্ধ বসে আছে।রুদ্ধকে দেখে হুরের চঞ্চলতা নিমিষেই উবে গেল।একদম শান্ত বাচ্চার মতো চেয়ারে বসে গেল।জেরিন আগে থেকেই টেবিলে খাবার দিয়ে রেখেছিল।রুদ্ধ মাথা উঁচু করে একবার হুরকে দেখল।নজর সরিয়ে প্লেটে খাবার বাড়তে লাগলো।রুদ্ধের দেখাদেখি হুরও প্লেটে খাবার নিতে লাগলো।খাবার খাওয়ার মাঝে রুদ্ধ জিজ্ঞেস করল,
“কেমন হয়েছে ক্লাস?
খাওয়া থেমে গেল হুরের।রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখল রুদ্ধের মনোযোগ খাবারের দিকে।নিজেকে কালোয় আবৃত করে রেখেছে রুদ্ধ।দেখতে তাকে মারাত্মক লাগছে।ফর্সা শরীরে কালো রংটা বেশ মানায়।রুদ্ধের চুল আর দাড়ি অনেক ভালো লাগে হুরের।তবে সাহস করে একবারও বলা হয়নি।বলতে ইচ্ছে হয়নি।রুদ্ধের মুখশ্রী শক্ত হয়ে আছে।হুরের রুদ্ধকে পরিদর্শন করা হলে সে রুদ্ধের প্রশ্নর জবাব দেয়,
“হুম ভালো গিয়েছে।
নীরবতা ছেয়ে গেল আবারো দুজনের মাঝে।তৃপ্তি সহকারে দুজন দুজনের পছন্দের খাবার খাচ্ছে।একত্রে দুজনের খাওয়া শেষ হলো।চেয়ার থেকে উঠে পড়ল হুর।এটো হাত নিয়ে বেসিনের কাছে যেতে লাগলো।রুদ্ধ এখনো চেয়ারে বসে আছে।হুরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।পিছনের দিক দেখা যাচ্ছে।বড় বড় ছেড়ে রাখা ঘন কালো চুল। ভেজার কারণেই হয়তো মেয়েটা চুল ছেড়ে দিয়েছে এমন ভাবনা রুদ্ধের।রুদ্ধ এক পলকে ভেজা চুলের দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটার সাথে অতিরিক্ত সবকিছু যায়।যেমন অতিরিক্ত সুন্দর, অতিরিক্ত লম্বা কালো ঘন চুল, অতিরিক্ত চঞ্চল, অতিরিক্ত খাদক ও বটে।হুর হাত ধুয়ে চলে গেল উপরে।তার রুমে।এখন একটা ঘুম দেয়া উচিত।দরজা একটু চাপিয়ে দিয়ে বিছানার ওপর শুয়ে পিঠের পিছে এবং বুকে একটা বালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।দুপাশে বালিশ না রাখলে তার ঘুম হয় না।এপাশ ওপাশ ফিরলে তার জড়িয়ে ধরার জন্য বালিশ প্রয়োজন হয়।তাই শুরু থেকেই হুরের অভ্যাস বাচ্চাদের মতো দু’পাশে বালিশ রেখে ঘুমানোর।
সময়টা এখন রাতের। ঘন্টার কাটা নয়ের ঘর থেকে দশে পৌঁছালো।ড্রয়িং রুমের সোফায় গুটিসুটি হয়ে বসে গুনগুন করে কান্না করছে হুর।একা একটা বাড়িতে থাকতে, তার ভীষণ ভয় করছে।জেরিন চলে গিয়েছিল সন্ধ্যার একটু পরেই।এতদিন সে রাতে হুরের জন্য থেকে ছিল।হুর তখন অসুস্থ ছিল তাই চলাফেরার জন্য কাউকে প্রয়োজন ছিল। জেরিন তার সঙ্গ দিয়েছে। কিন্তু এখন তো হুর ঠিক আছে।তাই জেরিন আগের নিয়ম অনুযায়ী সন্ধ্যা হতেই চলে গিয়েছে তার বাসায়।বাসায় তার মা একা থাকে তাই জেরিনকে বাসায় যেতেই হয়।নাকের পানি চোখের পানি এক হয়ে গেছে হুরের।কান্না করতে তার মোটেও ইচ্ছে করছে না।কিন্তু ভয়ের চোটে কান্না চলে আসছে।আশেপাশে কোনো বাড়িও নেই যে মানুষের সারা শব্দ আসবে।হুরের এখন বাড়িটা ভুতুড়ে মনে হচ্ছে।ওড়না দিয়ে নাকের এবং চোখের পানি বারবার মুছছে।কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছে না।চোখ এবং নাক দিয়ে আবারো পানি ঝরতে শুরু হয়েছে।হুরের ভয়ের মাঝেই হঠাৎ করে কলিংবেলের আওয়াজ পায়।কেঁপে উঠে সে।নিস্তব্ধ রাতে কলিংবেলের আওয়াজ তীব্রভাবে কর্ণপাত হলো।এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছে ভূত কলিং বেল বাজিয়েছে।এমন ভাবনা মস্তিষ্কে আসতেই আবার অঝোরে কান্না করতে লাগলো হুর।পরক্ষণে আবার মনে হলো এখন রুদ্ধ ও আসতে পারে।এই সময় রুদ্ধ বাড়িতে আসে। দুরু দুরু মন নিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে দরজার কাছে গেল। দরজা খোলার সাহস কোনো মতেই পাচ্ছেনা সে।হাত সামনে এগিয়ে আবারো গুটিয়ে নিচ্ছে।কলিংবেলের আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। বারবার বেজে যাচ্ছে।তবে খোলার নাম নিচ্ছে না হুর।এই মুহূর্তে সে আতঙ্কের মধ্যে আছে। আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে।নিজের মনে কোনমতে সাহস যুগিয়ে দরজায় হাত রাখল।দরজার ছিটকানি খুলে আস্তে আস্তে দরজা খুলে দিল।সামনে রুদ্ধ আগুন চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তবে সামনে তাকিয়ে হুরকে দেখে তার চোখ শীতল হয়ে আসলো।মেয়েটার চোখ,নাক,মুখ অস্বাভাবিক ভাবে লাল হয়ে আছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেকক্ষন যাবত কান্না করেছে।রুদ্ধকে দেখে আবারও হু হু কান্না করে দিল হুর।রুদ্ধ বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে কান্না করছো কেন?
কান্না থামছে না হুরের।সে নিজের মতো করে কান্না করতে ব্যস্ত।নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে রেগে গেল রুদ্ধ। ক্রোধিত নয়নে বললো,
“কি হলো বলছো না কেন? কান্না কেন করছো?কেউ কিছু বলেছে?
ফোঁপানো শব্দ বন্ধ হল।তবে চোখ দিয়ে অশ্রুকণা ঝড়া বন্ধ হলো না।অশ্রুসিক্ত নয়নে ঠোঁট ফুলিয়ে রুদ্ধের দিকে ভালো করে তাকালো।কান্না নিয়ন্ত্রণে রেখে বলল ,
“না, কেউ কোন কিছু বলেনি।
বলেই দরজা থেকে সরে আসলো। ভেতরে প্রবেশ করল রুদ্ধ।হুরের দিকে তাকিয়ে থেকেই সোফায় বসলো।রুদ্ধ হাতের ইশারায় হুরকে বিপরীতে থাকা সোফায় বসতে বলল। বসলো হুর।কান্না করে চেহারার তার বেহাল দশা।মাথা নিচু করে এখনো ফুপিয়ে যাচ্ছে সে।রুদ্ধ এবার শান্ত স্বরে বলল,
“এবার বলো কান্না করছো কেন?
শান্ত কন্ঠস্বর।কান্না করার মাঝে কেঁপে উঠলো হুর। বুঝলো না কান্না করার ফলে নাকি রুদ্ধের শান্ত কথার স্বর শুনে সে কেপেছে।গাল বেয়ে পড়া নোনা জল হাত দিয়ে মুছে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলতে লাগলো।
“আমি একা থাকতে খুবই ভয় পাই।জেরিন আপু সন্ধ্যার সময় চলে গিয়েছিল তার বাসায়।এর আগে কখনও আমি একা থাকিনি।তাই ভয় পেয়ে কান্না করে দিয়েছি। আর আশেপাশে আর বাসায় ও নেই।আজব আজব শব্দ আসছিল আমার কানে।তাই ভয়ে কান্না করছিলাম।এখনো শব্দ আসছে শুনুন।
রুদ্ধ কান খাড়া করে সেই শব্দ শুনলো।শিয়ালের ডাক।খুবই বাজে ভাবে ডেকে যাচ্ছে।কিছুক্ষন হুরের দিকে তাকালো।মেয়েটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে।রুদ্ধ হুরকে অভয় দিয়ে বললো,
” কাল থেকে তুমি একা থাকবে না।ভয় ও পাবে না।সময় এবং ভয় কাটানোর জন্য সঙ্গী পেয়ে যাবে।
রুদ্ধের দিকে টুকুর টুকুর চোখে তাকিয়ে রইলো হুর।রুদ্ধের বলা কথা বুঝতেই মনে মনে সে অনেক হৃষ্ঠ হলো।ঠোঁট চওড়া করে হাসলো।ধন্যবাদ দিলে কেমন হয়?ভাবছে হুর।মন্দ না!যে মানুষ তার জন্য এতসব করছে তাকে ছোট খাটো একটা ধন্যবাদ দেয়া ই যায়।তবে লোকটার নাম কি যেন ছিল!মস্তিষ্কে ক্যাচ করছে না হুরের।মনে মনে আওড়ালো,
“আচ্ছা লোকটাকে জেরিন আপু যেন কি নামে ডাকতো?উম,মনে পড়ছে না।কি যেন নাম ছিল!শুদ্ধ!মনে হয় শুদ্ধ ছিল নাম।
মনের কথা আওড়ানো শেষ হলে হুর কাচুমাচু হয়ে বলে,
” ধন্যবাদ শুদ্ধ স্যার!আমি অনেক কৃত..
কথা শেষ করার পূর্বেই রুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“কি বললে তুমি?
হকচকিয়ে গেল হুর।সে তো ভুল কোনো কথা বলেনি।তাহলে লোকটা এভাবে জিজ্ঞেস করলো কেন?ভাবছে হুর।মনে ভয় জমে গেল হুরের।রুদ্ধের হুটহাট শক্ত কন্ঠের কথা হজম করতে কষ্ট হয় তার।শুকিয়ে যাওয়া শুকনো ওষ্ঠ জোড়া মুখের ভেতর নিয়ে জিহবা দ্বারা ভেজালো।ওষ্ঠ জোড়া মুখ থেকে বের করে বলল,
” ধন্যবাদ বলেছি।
“তার পরে কি বলেছো?
হুর ভাবতে লাগলো সে ধন্যবাদ এর পরে কি বলেছে!যখন মনে পড়লো ধন্যবাদ এর পরে কি বলেছে তখন বলে,
” শুদ্ধ স্যার!
রুদ্ধ দাঁত চিবিয়ে বলে,
মাই নেইম ইজ রুদ্ধ,নট শুদ্ধ।”হিমায়েত এশহ্যান রুদ্ধ”
চকিত হয়ে রুদ্ধের দিকে তাকালো হুর।রুদ্ধকে উল্টো করে শুদ্ধ বানিয়ে সে আরামে লেকচার দিতে যাচ্ছিল।রুদ্ধকে সর্যি বলার জন্য মুখ খুলবে অমনি রুদ্ধ সেখান থেকে চলে যায়।হুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে রুদ্ধের নাম আওড়ায়,
” হিমায়েত এশহ্যান রুদ্ধ।
( To be continue…. )