বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প #পর্ব-৩১ #লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )

0
708

#বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প
#পর্ব-৩১
#লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )

২ দিন পর…
সকাল হতেই রুদ্ধ চলে গিয়েছে বাহিরে।অফিসে নাকি অন্য কাজে তা বলে যায়নি। হুর সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠলো। আজ একটু বেলা করে ঘুমিয়েছে। গায়ের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে উঠে বসে। বড় এক হামি দিয়ে ছেড়ে রাখা চুলগুলো দুই হাতের সাহায্যে খোপা করে নিল। খোপা করতে সময় লাগলো।বিছানা থেকে নেমে বিছানা গুছিয়ে নিল। কাপড় নিয়ে সোজা চলে গেল ওয়াশরুমে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চুল থেকে তোয়ালে খুলে চুল মুছতে লাগলো। চুলের পানি ভালোভাবে না মুছেই চুল ছেড়ে দিল। হাত দুটো বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে।তাই পুরোপুরি ভাবে চুল না মুছেই ছেড়ে দিয়েছে। কোন রকমে চুল আছড়ে হাতে পায়ে লোশন লাগাল।সিঁড়ির কাছে আসতেই কলিং বেলের তীব্র শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছালো। সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে থেকেই হুর আশেপাশে লিলি আর জেরিনকে খুজলো। কাউকেই পেল না। বুঝলো দুজনেই ব্যস্ত আছে কাজে। তাই নিজেই নেমে আসলো। যতই নিচে যাচ্ছে ততই কলিং বেল এর আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে মেইন ডোর এর অপর পাশে থাকা ব্যক্তি খুবই অধৈর্য ।কলিং বেল বাজিয়ে যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় তা নূন্যতম জ্ঞান তার মধ্যে নেই। একনাগাড়ে কলিং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। বিরক্ত হলো হুর। পায়ের গতি বাড়িয়ে ড্রয়িং রুমে আসলো। তখন দেখলো জেরিন ও রান্না ঘর থেকে ছুটে আসছে। হাতে তার ময়দা মাখানো। জেরিন হুর কে দেখে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে,

“হুর প্লিজ তুমি দরজাটা খোলো না!আমার হাতে ময়দা লাগানো। আল্লাহ ই জানে কে আছে দরজার বাহিরে।সে কখন থেকে একনাগারে কলিং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে!

মেইন দরজার দিকে এক পলক তাকিয়ে হুর জেরিনকে বলে,

“আচ্ছা, ঠিক আছে আমি দরজা খুলছি, তুমি গিয়ে কাজ কর।

চলে গেল জেরিন। দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হুর।দুহাত দিয়ে দরজার হেন্ডেলে মুঠ করে ধরল। শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দরজা নিজের দিকে টেনে খুলল। বিরক্তিতে দু ভ্রুয়ের মাঝে কয়েকটা ভাজ পড়েছে। দরজা খুলতেই সামনে তাকালো। শিথিল হয়ে আসলো মুখশ্রী।একটি মধ্যবয়স্ক লোক এবং একটি ছেলে আরেকটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তিনজনের চেহেরায় চোখ বোলালো হুর।নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“কে আপনারা?

হুরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা হুরকেই প্রশ্ন করে বসলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক ছেলে,

“ইট ডাজ’ট ম্যাটার হু উই আর!বাট হু আর ইউ?

শিথিল হয়ে থাকা দু ভ্রুদ্বয়ের মাঝে আবারো ভাজ পরলো।আবারো সবাইকে একবার ভালো করে দেখে নিলো। মধ্য বয়স্কর মুখ ভঙ্গি স্বাভাবিক। তবে দুটো ছেলে মেয়ের মুখো ভঙ্গিতে বিরক্তির রেখা দেখা যাচ্ছে। তাদের বিরক্তির কারণ বুঝতে পারল না হওয়ার। বুঝতে চাইল ও না। যেখানে সে নিজেই বিরক্ত হয়ে আছে সেখানে অন্যজনের বিরক্তির কারণ জানা খুবই বেমানান ।আপাতত তাকে এইটা যাচাই করতে হবে যে,এই মানুষগুলো কারা।নিজেকে নরম রাখল হুর।সাবলীলভাবে আবার প্রশ্ন করল,

“কাকে চাইছেন?

নিজের তর্জনী হুরের মুখের সামনে ধরে দাঁড়াতে চিবিয়ে চিবিয়ে কোন কিছু বলার পূর্বেই মধ্য বয়স্ক লোকটি মেয়েটিকে থামিয়ে দেয়।চোখের ইশারায় দুজনকে শান্ত থাকতে বলে। তারপর হুরের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

“রুদ্ধকে চাইছি।কোথায় এখন ও?

মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোকের কথা পছন্দ হলো হুরের।এবং তার চেহারা দেখেও কিছুটা চেনা চেনা মনে হল। তবে সঠিক হতে পারল না। কিন্তু কোন না কোন জায়গায় দেখেছি এটা ঠিক ঠাহর করতে পারল।মস্তিষ্কে আর প্রেসার দিল না ।ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বিনয়ি স্বরে বলল।

“জ্বি, উনি তো তো বাড়িতে নেই।

ভদ্রলোক এবার হুরের মাথা থেকে পা অব্দি দেখলেন।হুরের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন।

“কখন আসবে?

“বলে যায়নি কিছু।কিছু কি কাজ আছে আপনাদের?

এবার আর নিজের সীমা থাকতে পারো না ভদ্রলোকের পাশে থাকা মেয়েটি। খেকিয়ে উঠলো,

“হাউ ডেয়ার ইউ কুয়েশ্চন মাই পাপা?আমার পাপা যা জিজ্ঞেস করছে তার উত্তর দাও।

ভদ্রলোক এবার নিজ মুখ খুললেন।ভারী কন্ঠে মেয়েটিকে বললেন,

” রিফা…Behave yourself!কিছু বলার পূর্বে ভেবে নিবে কি বলছো!

চুপ হয়ে যায় মেয়েটি। তবে মুখে রয়ে যায় ক্ষিপ্ততা। তীক্ষ্ণ চোখে হুরের দিকে তাকিয়ে চোখ মেঝেতে রাখে।ভদ্রলোক হুরকে আবার বলে,

“তার সাথে জরুরী কিছু কথা ছিল আমাদের।কতক্ষণ সময় লাগবে তার আসতে?

হুর ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখল তার চেহারায় অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। পিছনে তাকিয়ে এই ড্রয়িং রুমে থাকা আর দেয়াল ঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলে,

“কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি চলে আসবেন। আপনারা চাইলে অপেক্ষা করতে পারেন।

হুরের কথা শুনে ভদ্রলোক বোধ হয় খুশি হলেন।স্মিত হেসে সম্মতি জানালেন। দরজা ছেড়ে ভেতরে প্রবেশ করার জন্য সবাইকে জায়গা দিল হুর। সবাই ভেতরে প্রবেশ করে ড্রয়িং রুমের দিকে আসলো। হুর ড্রয়িং রুমে থাকা সোফার সবাইকে বসতে বলল।ততক্ষনে লিলি এ ড্রয়িং রুমে চলে আসলো। অপরিচিত কয়েকটি মুখ দেখে হুর কে জিজ্ঞেস করল,

“উনারা কে হুর?

হুর বলে,
“উনারা তোমার রুদ্ধ স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছে।

গলার স্বর নিচু রেখে লিলি বলে,
“অপরিচিতদের এভাবে ঘরের ভেতরে আনাটা কি উচিত হলো তোমার হুর। রুদ্ধ স্যার যদি তোমার ওপর রাগারাগি করে তখন কি করবে?

চিন্তিত হল হুর ও। কিন্তু মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোকের অসহায়ত্ব দেখে তার একটু মায়া হল দেখেই তাকে ভেতরে এসে অপেক্ষা করতে বলল। কিন্তু রুদ্ধের দিক থেকে ভেবে দেখল না। রুদ্ধ কেমন রিঅ্যাক্ট করবে না করবে সেটাও ভাবলো না।চিন্তিত গলায় বলে,

“এই দিকটা আমি ভেবে দেখিনি আপু। ওনাদের হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ আছে উনার সাথে।তাই আমি তাদের ভেতরে আসতে বলেছি। আচ্ছা,এসব বাদ দাও। উনাদের জন্য নাস্তা পানির কিছু ব্যবস্থা কর। আর আমার বড্ড খিদে পেয়েছে আমায় খেতে দাও।

চলে যায় লিলি। হুর ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে নমনীয় স্বরে বলে।
“আপনারা বসুন!

হুর ও চলে গেল ডাইনিং টেবিলে। মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে আর আড় চোখে সোফায় বসে থাকা অচেনা মানুষদের দিকে তাকাচ্ছে। কে বা কারা কোন কিছুই বুঝতে পারছে না।এ বাড়িতে মানুষের আনাগোনা খুবই কম।হঠাৎ কোথা থেকে এই নতুন মানুষ গুলো উদয় হল সেটা নিয়েই দুশ্চিন্তা করছে হুর। প্রতিদিনের চেয়ে আজ একটু সময় করে খাবার খেলো সে। একমাত্র কারণ চিন্তা। চিন্তা একটাই ছিল যে রুদ্ধ তাকে কিছু বলবে কিনা!অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়ে এলো। রুদ্ধ বাড়িতে আসলো। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ড্রয়িং রুম অতিক্রম করার সময় পা জোড়া থেমে গেল।সময় নিয়ে সবাইকে দেখল।শীতল দৃষ্টি। রুদ্ধকে দেখে তিনজনই সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ভদ্র মহাদয়ের মুখ চুপসে এলো।কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেও মন তাকে বারবার থামিয়ে দিচ্ছে। যেন মুখ খুললেই কিছু অঘটন ঘটে যাবে। তাই নিশ্চুপ থাকা ভালো মনে করলেন। নিশ্চুপ থাকল না রিফা নামক মেয়েটি। রুদ্ধকে রেখে গদগদ কন্ঠে বলল,

“ওহ্ রুদ্ধ ডার্লিং, কতক্ষণ থেকে তোমার অপেক্ষা করছি জানো?You are so late…

নিজের কন্ঠস্বর অতি থেকে অতি ঠান্ডা রেখে রুদ্ধ প্রশ্ন করল।
“এখানে কেন এসেছ তোমরা?

এবার যুবকটি বলে ওঠে,
“ব্রো এতদিন পর আমাদের দেখা, আর তুমি আমাদের সাথে এভাবে কথা বলছ?

কঠিন দৃষ্টি যুবকদের উপর রাখল রুদ্ধ।সাথে সাথে চুপ হয়ে গেলেও যুবক।কন্ঠে হালকা তেজ নিয়ে হুরকে ডাকলো।হুর রান্নাঘরে ছিল। তাই রুদ্ধের ডাক শুনে অল্প সময়ের মধ্যে ড্রইংরুমে চলে আসলো। হুর কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুদ্ধতাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে।

“উনাদের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করার পারমিশন কে দিয়েছে?

ভয় হল হুরের। ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“উনারা আপনার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলতে এসেছেন। তাই আমি তাদের অপেক্ষা করতে বলেছি।

কর্কশ কন্ঠে হাক ছেড়ে গার্ড এবং দারোয়ানকে ডাকলো। কয়েক সেকেন্ডের মুহূর্তে এই গার্ডস আর দারোয়ান এসে ড্রয়িং রুমে হাজির হলো। মাথা নত করে সিরিয়ালে ৬ জন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। হুর হতবিহ্বল হয়ে গেল। সে শুধু জানে বাড়ির বাহিরে দুইজন দারোয়ান বসে।কে আসলো, কে গেল তার খেয়াল তারাই রাখে
কিন্তু কখনোও গার্ডদের চোখে পড়েনি। তাই গার্ডদের দেখে বিস্ময় ছেয়ে গেল সারা মুখশ্রীতে।জিজ্ঞেস করতেও পারলো না। কর্কশ গলায় চিল্লিয়ে উঠল রুদ্ধ।

“বাড়ির ভেতর অচেনা মানুষ ঢুকে যায় আর আপনারা সে খবর রাখেন না?উনারা যখন বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেছিল তখন আপনারা কোথায় ছিলেন?অ্যানসার মি!

একজন দারোয়ান বলে উঠলো,
“স্যার আমরা প্রথমে তাদের ঢুকতে দেইনি। কিন্তু ওই লোকটি বললেন সে নাকি আপনার বাবা। তাই আমরা তাদের ঢুকতে দিয়েছি।

“যেকোনো অপরিচিত ব্যক্তি যদি নিজেকে রুদ্ধর বাবা বলে, তাহলে কি তাদের আপনারা ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিবেন?আপনারা কি জানেন আপনাদের এই একটা ভুলের কারণে আপনাদের সাথে কি কি হতে পারে?

চারজন গার্ড এর মধ্যে একটি গার্ড বলে উঠলো।
“হ্যাঁ, স্যার দারোয়ান ঠিক বলছে।মধ্য বয়স্ক লোক নিজেকে আপনার বাবা বলে দাবি করেছেন।তাই আমরা আর কোন অ্যাকশন নেইনি।

প্যান্টের পিছে কোমরে লুকায়িত পিস্তলটি বের করে গার্ড এর মুখের দিকে তাক করলো।দাঁত খিচে বলে,

“কু/ত্তা/র বা/চ্চা তোদের আমি কি কারনে পুষে রেখেছি?কোন জঙ্গল থেকে উঠে এসে নিজেকে রুদ্ধর বাবা দাবি করছে আর তাকে তোরা যাচাই-বাছাই না করে এই বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছিস। তোদের ইচ্ছে করছে বন্দুকের গুলি দিয়ে ঠুকে দিতে।

ভয়ে কুঁকড়ে গেছে গার্ড। মাথা নত করে গলার স্বর নিচু রেখে প্লিজ অপরাধের ক্ষমা চায়।বলে,

“দুঃখিত স্যার এমন ভুল আর কখনো হবে না।এবারের মতো প্লিজ আমাদের ক্ষমা করে দিন।ভবিষ্যতে লক্ষ রাখবো আমরা।

কড়া গলায় রুদ্ধ বলে।
“নাও ডু ইউ’র ওয়ার্ক!

গার্ডরা মধ্য বয়স্ক এবং যুবকের কাছে গিয়ে তাদের হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো।তারা বারবার খোঁটা চেষ্টা করছে কিন্তু গার্ডদের শক্তির কাছে হেরে যাচ্ছে।দারোয়ান রিফার কাছে গিয়ে বলে,

“ম্যাম প্লিজ আপনিও চলুন। না, হলে আপনার জন্য অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

রিফার চোখ বড় বড় হয়ে আসলো। বিস্ময় নিয়ে রুদ্ধের দিকে তাকাল। এতটা অপমান যে হতে হবে তা ভাবতে পারিনি রিফা।ভদ্রলোকের চেহারায় বিস্ময় না থাকলেও অসহায়ত্ব দেখা গিয়েছে।অপমানে থমথমে হয়ে এসেছে তার মুখ।যুবকটি বলে,

“ব্রো প্লিজ তুমি আমাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দিও না। আমাদের কথা শুনো প্লিজ। খুব বিপদে পড়ে আমরা এখানে এসেছি। আমাদের এভাবে তাড়িয়ে দিও না।

কথা শেষ করে গার্ডদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে আসলো রুদ্ধের কাছে। ধস্তাধস্তি করে হাপিয়ে উঠেছে সে। মুখে হাঁ করে কয়েকবার শ্বাস নিল। আবার বলল,

“প্লিজ ব্রো বাবাকে ছেড়ে দিতে বল।অত্যন্ত আমার কথাটা শুনে নাও তারপর তোমার যা মন চাইবে তাই করবে।

কঠিন মুখ নিয়ে যুবকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রুদ্ধ। তারপর গাড়িদের দিকে তাকিয়ে মত বয়স্ক কে ছেড়ে দিতে বলল। রুদ্ধর কথা অনুযায়ী গার্ডরাও মধ্যবয়স্ককে ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেল। দারোয়ানরাও গেল। পিনপতন নিরবতা।কঠিন মুখস্ত নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে যুবকটির দিকে তাকিয়ে আছে রুদ্ধ। যুবক বুঝল রুদ্ধ তার সাথে কোন কথা বলবে না।তাই নিজ থেকে বলতে শুরু করল।

“বাবার ব্যবসা ডুবে গেছে ব্রো।বাড়িটাও নিলামে উঠে গেছে। সবকিছু হারিয়ে এখন আবার রাস্তার ফ/কি/র।যাওয়ার মত কোন জায়গা নেই। খাওয়ার মত কোন টাকা নেই। কোন আশ্রয় নেই। তাই বাধ্য হয়ে তোমার কাছে আসতে হয়েছে। বাবা আসতে চায়নি, তাকে জোর করে আমরা নিয়ে এসেছি।পুরোপুরিভাবে শূন্য হয়ে গেছি আমরা।এক বুক আশা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি।প্লিজ তুমি আমাদের এভাবে ফিরিয়ে দিও না।অনেক অসহায় হয়ে পড়েছি আমরা।আমাদের তুমি নিজের আশ্রয়স্থলে রেখে দাও।

এত আকুতি শুনে রুদ্ধর মন গললো কিনা ঠিক বোঝা গেল না। কাঠের মত শক্ত হয়ে সে একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। মুখের মুখ ভঙ্গি ও আগের মতোই।পুরুষালী গম্ভীর কন্ঠে একটি লাইন বলল,

“ফ/কি/রদের রাস্তায় মানায়,রাজমহলে নয়।

থালা পড়ে যাওয়ার মত ঝনঝন করে শব্দ তুলে এই বাক্যটি সবার কর্ণ কুহুরে পৌছালো।স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল যুবকটি। রুদ্ধর কাছ থেকে সে এমন কথা আশা করেনি। তৎক্ষণাৎ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল তার হৃদয়। অবিশ্বাস্য চোখ নিয়ে রুদ্ধর দিকে তাকিয়ে রইল। বলল,

“এসব তুমি কি বলছো ভাইয়া?এভাবে বলতে পারলে তুমি?

“বের হয়ে যাও বাসা থেকে!

ভাইয়ের কাছ থেকে এত বড় অপমান সহ্য করতে না পেরে করুন হয়ে আসলো তার মুখ। চোখে নোনা জল। গড়িয়ে পড়তে চাইলে গড়াতে দিচ্ছে না।ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে লিলি আর জেরিন সবকিছু দেখছে। রুদ্ধের খানিকটা পিছনে হুর দাঁড়িয়ে আছে।এদের কথোপকথন শুনে বিস্মিত হলো হুর। আরো বেশি তো হলো রুদ্ধের কড়া ব্যবহারে। আজ অব্দি হুর দেখেনি যে,রুদ্ধ কাউকে সহায়তা করেনি। যখন যে বিপদে পড়েছে সবাইকে সাহায্য করতে দেখেছে। তবে আজ কেন করছে না! আজ কেন তাদের সাথে এত কড়া ব্যবহার করছে।আর একটু আগে ছেলেটা কি বলল? ভাই! রুদ্ধ তার ভাই হয়। আর ওই মধ্যবয়স্ক লোকটি তার বাবা! এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে হুরের মাথা। কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। তবে রুদ্ধের কথা শুনে সবাই যে আশাহত হয়েছে এবং তাদের মন ভেঙ্গেছে তা ঢের টের পেল।হুর বুঝলো এখন নিশ্চুপ হয়ে থাকলে চলবে না। তাই রুদ্ধের কাছে গিয়ে রুদ্ধের হাত ধরে পিছনের দিকে টেনে এনে যুবকটির উদ্দেশ্যে বলল।

“আপনার কোথাও যাবে না ভাইয়া। কিছুক্ষণ বসুন,আমি উনার সাথে কথা বলে আসছি।

থেমে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে লিলি আর জেরিনের দিকে তাকালো। বলল,

“আপু তোমরা সবার খাবারের ব্যবস্থা করো।

বলে এই রুদ্ধের হাত ধরে টানতে টানতে উপরের দিকে নিয়ে গেল।ড্রয়িং রুমে থাকা সব সদস্য বিস্ময় নিয়ে রুদ্ধর হুরের যাওয়া দেখতে লাগলো।রুদ্ধের মত রাগী মানুষ যে কিনা নিজের গায়ে কেউর ছোঁয়া সইতে পারে না,তারই হাত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে একটি মেয়ে।এবং সে তাকে কিছুই বলছে না। বিষয়টা খুবই বিস্ময়কর।বিশেষ করে বিস্মিত হল রিফা।

রুমে প্রবেশ করতেই রুদ্ধ হুরের হাত ঝটকা মেরে নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল।ক্ষোভে ফেটে পড়ে চিল্লিয়ে উঠলো।

“কোন সাহসে তুমি তাদের এখানে থাকতে বলেছ?আমি বারণ করার পরও কেন আদিখ্যেতা দেখিয়ে থাকতে বললে?আমার কথার কোন গুরুত্ব নেই?আমি যখন বলেছি ওরা এই বাড়িতে থাকবে না মানে থাকবে না।তাহলে আমার সিদ্ধান্ত বদলানোর কে তুমি?

প্রথমে রুদ্ধর চিল্লানি শুনে ভয় কেঁপে উঠেছিল হুর। তবে শেষের কথা শুনে ভয় কমে এসেছে।ভয়ার্থ মন হঠাৎ করেই কঠোর হয়ে উঠেছে।কঠোরতার সহিত শান্ত স্বরে বলে,

” আপনার বউ!

কিছু সময়ের জন্য শান্ত হয়ে গেল রুদ্ধ। পরমুহূর্তে দাউ দাউ করে রাগে হাত মুঠো করে নিল। থর থর করে কাঁপছে হাত।তা দেখে হুর বলল,

“দেখুন প্লিজ রাগ করবেন না।তাদেরকে প্রথমে দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম তারা খুবই অসহায়।এবং এখন বুঝতে পারছি তারা আপনার কেউ আপনজন।জানিনা আপনার অতীতে কি হয়েছিল।আপনার অতীত জানার যোগ্যতা আমি রাখি কিনা তাও জানিনা ।তবে এতোটুকুই বলবো অসহায়ত্ব ব্যক্তিদের সাহায্য করুন। তারা আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছে। তাদের নিরাশা করবেন না। নিজের রাগ জিদ একপাশে ঠেলে তাদের আপন করে নিন।

সাথে সাথে রুদ্ধ বলে উঠে,
“ওরা কখনো আমার আপন কেউ ছিলনা। আর না কখনো হবে।

এগিয়ে এসে রুদ্ধের হাত নিজের হাতে নেয় হুর।আবার বলা শুরু করে,

“আচ্ছা, ঠিক আছে মানলাম তারা আপনার আপন কেউ না। আপনি তো বহু অপরিচিত মানুষদের সাহায্য করেছেন। আমাকে করেছেন, জেরিন আপুকে করেছেন। তাহলে তাদের করতে কেন এত দ্বিধা?আমরা অসহায় ছিলাম তাই আপনি আমাদের সাহায্য করেছিলেন। তারাও তো অসহায়। থাকার মতো ঘর নেই, খাওয়ার মত খাবার নেই। তাহলে তাদের কেন সাহায্য করছে না?কেন তাদের অপমান করছেন?তাদের দিকটা একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নিন।নিজেকে তাদের জায়গায় দাড় করিয়ে ভেবে দেখুন।

চুপ হয়ে হুরের মুখপানে তাকিয়ে আছে রুদ্ধ।অনেক সময় কেটে গেল। তবে রুদ্ধের মুখ থেকে কোন কথা বের হলো না। চুপ থাকা সম্মতি লক্ষণ মনে করল হুর। তাইতো অধরকোণে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো।খুশিতে জড়িয়ে ধরল রুদ্ধকে।শার্ট এর উপর দিয়েই বুকে শব্দ করে চু’মু খেল।বলল,

“থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।

….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here