#বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প
#পর্ব-৩৮
#লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )
সপ্তাহ খানিক হলো রুদ্ধ আর হুর বাংলাদেশে এসেছে।দিন গুলো ভালোই যাচ্ছে তাদের। হুর আগের থেকে ফায়াজ আর সোহেল শেখ এর সাথে বেশ ফ্রি হয়েছে৷সবকিছু নজরে আসে রুদ্ধর। তবে কিছু বলে না। ফায়াজ এর একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে। বেতন আহামরি না হলেও তার এতেই চলে যাবে।এমন ধারণা সোহেল শেখ এর।এ চাকরি সুবিধার না হলে চাকরি করতে করতে না,হয় আরেকটা চাকরির জোগার হয়ে যাবে।এমন টা বলেছেন তিনি। তার কথা শুনেই রাজি হয়েছে ফায়াজ।রিফা কে ইদানীং শান্ত দেখাচ্ছে। যা সন্দেহের চোখ পড়লেও সন্দেহ করে না হুর।দেখেও অদেখার মত থাকে।কাল হুরের এক্সাম, তাই বইয়ের ভেতর মুখ ডুবিয়ে পড়ছে।বিছানার অর্ধের জায়গায় বইয়ের ছড়াছড়ি।আর মাঝে বসে আছে হুর। পড়ার ধ্যান এর মাঝে কেউ তাকে ডাক দেয়। মনোযোগ বই থেকে সড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল রিফা এসেছে।হুর স্মিত হেসে বলল,
“ভেতরে আসো আপু।
রিফা রুমে প্রবেশ করলো।বিছানার অবস্থা দেখে চোখ চড়কগাছ। বিস্ময় নিয়ে বলল,
“হে আল্লাহ!বিছানার এ অবস্থা কেন?
বো/কা হাসলো হুর। অসহায় ফেইস করে বলল,
“কাল আমার পরিক্ষা আপু। তাই টেনশনে এই অবস্থা৷ বারবার মনে হচ্ছে কি যেন পড়িনি! তাই সব বই খুলে চেক করছি।
বলেই কয়েকটা বই সরিয়ে জায়গা করে দিল রিফা কে বসার জন্য। বসলো রিফা। হুরের দিকে পূর্ন মনোযোগ দিল। চোখ ধাধানো সুন্দর মেয়েটা। একে টক্কর দেয়া মানে কয়েক শ” হাজার ফুট পানির তলে ডোবা একই ব্যাপার মনে হলো রিফার কাছে৷রিফাকে নিজের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে হুর জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বলতে এসেছিলে আপু?
ধ্যান ভেঙে যায় রিফার।বলে,
” না,রুমে একা একা ভালো লাগছিল না তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু কথা বলা যাক।কিন্তু তুমি তো পড়ছ।
“তুমি বস! আমার তেমন পড়া নেই। সব কমপ্লিট। এখন সব গোছাবো। অপেক্ষা করো একটু।
সায় জানালো রিফা। হুর সব বই খাতা টেবিলে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছে।রিফার চোখ গেল হুরের খোলা চুলের দিকে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হুরের সৌন্দর্য দেখে মোহিত হচ্ছে। সে আজ অব্দি কারো হাটু অব্দি চুল এবং ঘন চুল দেখেনি।নিজের যেমন কঁধ অব্দি চুল তেমনি তার বান্ধবীদেরও কাঁধ অব্দি চুল ছিল।ছোট চুল রাখার একটাই কারণ ছিল। তা কেবল ফ্যাশন। ছোট চুল ফ্যাশন মনে করে সবাই। তাই তো কখনো লম্বা চুল রাখার কথা মস্তিষ্কে আসেনি। কখনো ভাবেনি বড় চুল হলে কেমন লাগবে!কিন্তু হুরের চুল দেখে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে তার বড় চুল করার। শুধু চুলে নয় মেয়েটার রূপে ও জাদু আছে। যা যে কেউকে ঘায়েল করতে সেকেন্ড খানিক সময়ও লাগবেনা। টেবিলে বই পত্র গুছিয়ে বিছানার কাছে এসে দেখলো রিফা আগের মতই গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে তাকানোর মানেটা ধরতে পারল না হুর। তবে আকস্মিক ভাবে অস্বস্তি হতে লাগলো।বলল,
“কি খাবে আপু কফি না চা?
পুনরায় ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটে রিফার।কিছুটা হকচকিয়েও যায়। পরক্ষণে আবার নিজেকে ধাতস্থ করে। বলে,
“কফি হলে মন্দ হয় না।
হুর স্মিত হেসে বলে,
“আচ্ছা, তুমি বসো আমি জেরিন আপুকে বলে আসছি কফি দিয়ে যাওয়ার জন্য।
সম্মতি প্রকাশ করে রিফা। হুর চলে যায় জেরিন এর কাছে। এদিকে রিফা পুরো ঘরে চোখ বোলাতে থাকে। নিখুঁতভাবে একেকটা জিনিস তৈরি করা হয়েছে। রুম, রুমে থাকা জিনিস এবং সাজসজ্জা আর সবকিছুই মনে ধরেছে রিফার।
রিফা বিছানা থেকে উঠে এক একটা জিনিস স্পর্শ করছে আর দেখছে।একেকটা জিনিস লোভনীয় লাগছে তার কাছে।হুর চলে আসে রুমে। সাথে করে দু মগ কফি নিয়ে এসেছে। রিফাকে ব্যালকনির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
“কি করছো আপু?আসো কফি নিয়ে এসেছি। খেয়ে নাও।
ব্যালকনির কাছ থেকে সরে আসল রিফা।হুর সোফার টি-টেবিলের উপর কফির মগ রাখল। সোফায় বসল। রিফাও বসল। দুজনের হাতে কফির মগ।এক চমক কফি খেয়ে রিফা হুরকে বলে,
“তোমাদের তো লাভ ম্যারেজ তাই না?
গতবারের মতো এবারও দ্বিধায় পড়ে গেল হুর।ম্যারেজ সম্পর্কিত কোন কথা উঠলেই তার দ্বিধা হতে লাগে। সে ভেবে পায়না তার লাভ ম্যারেজ না অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় ম্যারেজটা তাদের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ না। কারণ তারা আগে থেকে চিনত জানত।অনুভূতি প্রকাশ না করলেও মনে মনে ঠিকই জানে তারা একে অপরকে ভালোবাসে। হোক না বিয়েটা জোর করে। তাতে কি?দুজনের প্রতি অনুভূতি আছে এটাই তো অনেক। আর কিছু ভাবলো না হুর। সহসা উত্তর দিল।
“হ্যাঁ, আমাদের লাভ ম্যারেজ।
“তা কতটুকু ভালোবাসো তুমি তোমার স্বামীকে?
ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে হুরের। সে তার স্বামীকে কতটুকু ভালবাসে এটা অন্য এক নারীকে বলতে হবে কেন?আর এই নারীটাই বা জানতে চাচ্ছে কেন? বোধগম্য হলো না হুরের। তবে বেয়াদবি ও করলো না। শান্ত স্বরে উত্তর দিল,
“যতটুক ভালবাসলে সে আমার হয়ে থাকবে ততটুকুই তাকে ভালোবাসি।
বিদ্রুপ হাসলো রিফা।তা দেখল হুর। বিদ্রুপের হাসির কারণ ঠাহর করতে পারল না। রিফা তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,
“কখনো যদি মনে হয় তোমার স্বামী তোমাকে ধোঁকা দিচ্ছে,বা তোমার কাছ থেকে গোপনীয় কোন কথা লুকাচ্ছে তাহলে কি করবে?
ছ্যাত করে উঠলো হুরের বু/ক।রুদ্ধ তাকে ধোঁকা দিবে সেটা মানতে তার মন নারাজ ।আর যদিও বা কোন গোপনীয় কথা লুকিয়ে থাকে তাহলে সেটা অবশ্য কোন কারণেই লুকাবে। কিন্তু রিফার কথায় রহস্যের গন্ধ পেল হুর।প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মানে! উনি আমায় কেন ধোকা দিবেন?আর কি-ই বা গোপনীয় কথা লুকাবেন?
আবারো হাসলো রিফা।হুরের সারা মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে বলল,
“তুমি বড্ড সহজ সরল হুর। তোমায় যে যেভাবে বলবে, যে যেমন তোমাকে দেখাবে তুমি তাই বিশ্বাস করবে। যেমনটা তোমার স্বামী তোমার সাথে করছে। তুমি এখনো রুদ্ধ কে চিনতে পারোনি। বলা যায় তুমি তাকে চেনার চেষ্টা করনি। রুদ্ধ সব সময় তোমাকে তার মুখোশালী রূপ দেখায়। যা সে একদমই তেমন নয়। মুখোশের পিছে লুকিয়ে থাকা আসল রুদ্ধকে তুমি আজ অবধি চিনতে পারোনি।
থেমে যায় রিফা। লম্বা একটা শ্বাস নেয়।হুরের দিকে তাকিয়ে হুরের মুখভঙ্গি দেখে তার মনোভাব দেখার প্রচেষ্টা। মেয়েটার মুখ বলে দিচ্ছি রিফার কথায় তার মনে কিছুটা ইফেক্ট পড়েছে। তা দেখে রিফা হাসলো। আবার বলতে লাগলো,
“আমি শুরু থেকেই তোমাদের কাহিনী জানি। তোমার সাথে দেখা কিভাবে হয়েছিল এবং তুমি কিভাবে তাকে ধোঁকা দিয়েছো সবই আমি জানি। তবে একটা জিনিস আমি প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি। তুমি তাকে এত বড় একটা ধোঁকা দিলে আর রুদ্ধ তোমাকে এভাবেই ছেড়ে দিল। ব্যাপারটা হজম হচ্ছিল না আমার।কারণ রুদ্ধকে কেউ ধোকা দিলে সে এমনি এমনিই তাকে ছেড়ে দেয় না। ভেঙ্গে গুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। সে জায়গায় তুমি নিমিষেই ছাড় পেয়ে গেলে। এবং তার জীবনের সাথে গভীর ভাবে জড়িয়ে গেলে। প্রথমে আমি কিছুটা শকড হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সে হয়তো তোমায় ভালোবেসে নিজের সাথে জড়িয়েছে। তবে পরবর্তীতে বিষয়টা উল্টো ভাবে আমার সামনে ধরা দিল।বুঝতে পারলাম রুদ্ধ আড়ালে মাস্টার মাইন্ড একটা গেম খেলছে।হয়তো তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। তাই সবটুকু আমি বলতে চাচ্ছি না। ক্লু আমি দিয়েছি। নিজের জীবন ধ্বংস হওয়ার আগে সত্যের মুখোমুখি হও।বাকিটা তুমি যা ভালো মনে করো তাই-ই করো।
স্তব্ধ হয়ে গেল হুর। এ কি বলছে রিফা?রুদ্ধ তাকে ধোকা দিচ্ছে?এমন তো তার কোনো দিন মনে হয় নি।কখনও মনে হয়নি যে, সে রুদ্ধকে চিনতে পারেনি।পরক্ষনে আবার মনে হলো রিফা তাকে উষ্কানোর জন্য এমন টা বলছে।তাই নিজেকে নরমাল রাখল।বলল,
” আমি সহজ-সরল তা আমি জানি। কিন্তু তাই বলে যে আপনি আমার স্বামীর নামে যা নয় তাই বলবেন তা তো আর আমি বিশ্বাস করব না তাই না?আমি আমার স্বামী কে যতটুকু চিনি তা-ই আমার জন্য যথেষ্ট।আমি এতটাও বো/কা না যে,অন্য মানুষের কথা শুনে নিজের সংসারে আগুন লাগাব।
হাতের মগ টেবিলের উপর রাখল রিফা। সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। উপহাস করে এক হাসি দিল। যেতে যেতে বলল,
“আগুন লাগা থেকে সতর্ক করলাম আমি।শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করে আমার কথা ভেবে দেখতে পারো। আর না,হয় দুশমন মনে করে সব এড়িয়ে যাও।তবে পরিশেষে একটাই কথা বলব,সরল হয়ে থাকো,বো/কা না৷
চলে গেল রিফা।সেকেন্ডের মাঝে রুমে রুদ্ধ প্রবেশ করল।হাতের ফোন বিছানায় ছুড়ে হুরের কাছে আসল।এক হাত হুরের গাল,অন্য হাত হুরের কোমড় স্পর্শ করে অধর চেপে রাখল তার অধরে। আকস্মিক রুদ্ধের হামলায় হতবিহ্বল হয়ে গেল হুর। বুঝতে সক্ষন হচ্ছিল না তার সাথে কি হচ্ছে!কিছু সময় যেতে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রুদ্ধকে সরাতে লাগল। রুদ্ধ আরো আঁকড়ে ধরল হুরকে৷মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হতেই হুরকে ছেড়ে দেয় রুদ্ধ।আটকে রাখা নিঃশ্বাস লম্বা ছাড়ে যা আঁচড়ে পড়ছে হুরের মুখে। তপ্ত গরম নিঃশ্বাস মুখে আঁচড়ে পড়তে পুনরায় চোখ মুখ খিচে রইলো হুর। চোখমুখে খিচে থাকার কারণে এক গালে টোল স্পষ্ট দেখা গেল। তা দেখে রুদ্ধ। হুরের টোল পড়া গালে হালকাভাবে কামড়ে ধরল। কিছুক্ষণ সে ভাবে রইল। তারপর ছেড়ে দিয়ে কপালে উষ্ণ পরশ একে দিল। ক্লান্ত স্বরে বলল,
“খুব মিস করছিলাম তোমায়।
হুরের শক্ত গলা,
“মিস করলে বুঝি কি/স করতে হয়?
” হয় তো! না,হলে শরীরে এনার্জি পেতাম না। মিস করতে করতে শরীরের এনার্জি লস হয়েছে। তাই কি/স করে শরীরে এনার্জি লোড করে নিলাম।
রুদ্ধর ফালতু লজিক শুনে বিরক্ত হল হুর। প্রকাশ করল না। তবে হুরের মুখভঙ্গি দেখে রুদ্ধ বুঝলো হুর বিরক্ত হচ্ছে। তবে এতে তার কি!হুর বিরক্ত হোক না হোক সেটা তার দেখার বিষয় না।সে তার শরীরে এনার্জি লোড করতে পেরেছে এটাই অনেক। রুদ্ধ গলার টাই ঢিলে করে সোফায় হাত পা ছুড়ে আধশোয়া হয়ে রয়।হুরকে বলে,
“হুরপাখি…আমার কোট খুলে দাও!
হুরের মুখে গম্ভীর্যতা আরো প্রকাশ পায়।পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে রুদ্ধকে দেখে। লোকটাকে ক্লান্ত লাগছে।একটু বেশি-ই লাগছে।তাই আর কথা না বাড়িয়ে রুদ্ধের সামনে এসে ঝুকে কোট খুলতে থাকে। ঝুকে থাকার কারনে হুরের উন্মুক্ত গলার সাথে বু/কের কিছু দৃশ্য ভাসমান হল।নিমিষেই ঘোর লেগে গেল।আনমনে হাত উঠিয়ে হুরের গলা স্পর্শ করল। দু আঙ্গুলের সাহায্যে আলতো ভাবে ছুঁয়ে দিতে লাগল।কাজে ব্যাঘাত ঘটালো হুরের। রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখল তার পরিবর্তন চাহনি।সে দিকে তেমন পাত্তা দিল না।পুনরায় মন দিল কোট,টাই খুলতে।রুদ্ধের হাত থামলো না। সে ঘোর লাগা দৃষ্টি নিয়ে হুরের উন্মুক্ত জায়গায় হাত দিয়ে খেলতে লাগল।ঘোর বোধহয় বেশি ই মনে হচ্ছে। তাই তো বউয়ের আরো কাছে পেতে মন চাচ্ছে।ঘড়িতে সময় দেখল। সন্ধ্যা ৭ টা বাজে। ডিনারের জন্য অনেক সময় আছে। বউকে কিছু সময় দিতে ক্ষতি হবে না।তাই কোনো কিছু না ভেবেই ঝট করে সোফা থেকে উঠে বউকে জড়িয়ে ধরলো। গলায় মুখ গুজে কোলে তুলে বিছানায় গেল।