প্রিয়_প্রাণ #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ১৪

0
280

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৪

ঠান্ডা রুমে’র মাঝে এতক্ষণ যাবৎ উত্তাপ ছড়িয়ে এখন শীতলতায় ঘিরে আছে এক প্রেম যুগল। তোঁষা’র মাথায় হাত বুলাচ্ছে আরহাম। মাত্র ঘুমালো বলে তুঁষ’টা। এতক্ষণ ঘুমাতে পারে নি সে। ছটফট করেছে শুধু। আরহাম যে মেডিসিন দিবে তারও সুযোগ হয় নি। তোঁষা’র অবস্থান এখন আরহামে’র উপর। আরহামে’র গলায় মুখ গুজে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে সে। আরহাম ভেবে কুল পায় না ঐ দিনের হওয়া সেই তুঁষ’টা কি পাগলামো’টাই না করলো। সেই পাগলামো’তে যখন আরহাম ও পাগল হলো তখন ই যেন কাহিল হলো তুঁষ’টা। আরহাম তখন থেকে বুকে তুলে রেখেছে তাকে। কতক্ষণ তো শুধু কাঁদলো। আরহাম উঠতে চাইলেই সেই কান্নার শব্দ যেন বেড়ে যায় অগত্যা এখনও উঠতে পারলো না ও।
তোঁষা’র চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বারকয়েক সময় পরপর চুমুও খাচ্ছে আরহাম তার মাথায়। বুকে এখনও কেমন ধ্রীম ধ্রীম শব্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগের মুহুর্তগুলো ভাবতেই গলা শুকিয়ে যায় আরহামে’র। কেমন চোখ ভিজে উঠে। দেশের বাইরে কমতো ছটফট করে নি ও। দেহের ব্যাথা মানুষ দেখে কিন্তু মনের ব্যাথা? এটা কেউ দেখে না। দেখলেও বুঝতে চেষ্টা করে না। শেখ বাড়ীর প্রতিটা সদস্য জানতো আরহাম কতটা অসহায় হয়ে পরে ছিলো সেই ভিনদেশে অথচ কারো মনে মায়াটুকু হয় নি তাই এখন আরহাম ও মায়া দেখাবে না। এতকষ্টে’র পর পাওয়া তুঁষ’কে কোথাও হারাতে দিবে না ও।
কথাগুলো ভাবতেই নিজের সাথে তোঁষা’র নরম দেহটা আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে নেয় আরহাম। মনে পরে যখন তোঁষা’কে ছেড়ে গিয়েছিলো সে হাসিমুখে অথচ সম্পূর্ণ’টা ছিলো শেখ বাড়ীর সদস্যসে’র পরিকল্পনা।

~তুরাগ বেশ ভালোই বুঝে যান ছেলে তার এত সহজে মানবে না। যথেষ্ট মেধাবী আরহাম৷ পাবলিকে চান্স তো আর এমনি এমনি পেলো না। তুরাগ ছোট ভাই তুহিন’কে ডেকে খুব মাথা খাটিয়ে এক পরিকল্পনা করলো। আরহাম’কে না জানিয়ে তার জন্য ভিসা এপ্লাই করে দেশের বাইরে। এতসবে তোঁষা শুধু জানলো আরহাম ভাই বাইরে পড়তে যাবে কিন্তু তুরাগ এখানে বড় একটা চাল করেছিলো।
আরহামে’কে নিজের রুমে ডেকে ঐ দিন বেশ নরম গলায় বললো,

— দেখো আরহাম আমার প্রথম সন্তান তুমি।

— কি বলতে চাও আব্বু?

আরহাম জানে বাবা এত সহজ মানুষ না৷ তুরাগ ও জানে ছেলে তার এত বোকা না। তাই তো নরম হয়ে বলেছিলেন,

— দেখ আরহাম তোমাকে যেমন ভালোবাসি তেমনই পুতুল’কেও সবাই ভালোবাসে। ওর কোন ক্ষতি হোক কেউ চাই না।

— কে করবে ক্ষতি? আমি?

আরহামে’র কন্ঠে রাগের আভাস। তুরাগ ছেলে’কে পাশে টেনে বসান। আরহামে’র হাত ধরে বলেন,

— বাবা আমার, তোমার সমস্যা’র কথা তুমি জানো। আমার ছোট ভাই’টার একটা মাত্র মেয়ে। আমারও কোন মেয়ে নেই। বংশের একমাত্র মেয়ে পুতুল। কোন বাবা কি চাইবে নিজের মেয়ে’কে অসুস্থ কোন ছেলের সাথে বিয়ে দিতে? হাজার থাকুক ভালোবাসা।

— ওকে কেন ক্ষতি করব আমি? ভালোবাসি তুঁষ’কে। ও ওতো ভালোবাসে আমাকে। ওকে কারো কাছে ঘেঁষতে দিব না আব্বু। শুধু একটা বার ওকে আমাকে দিয়েই দেখো। কাউকে অভিযোগ করার সুযোগ দিব না।

— সুযোগ টা যদি আগে দেই?

আরহাম তাকালো। তুরাগ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

— তোমার ট্রিটমেন্ট এর জন্য দেশের বাইরে পাঠাতে চাইছি আরহাম। সম্পূর্ণ সুস্থ হও আগে। ততদিনে তোঁষা’কে আগলে রাখব। ওয়াদা করছি।

আরহাম তখন তোঁষা পেতে মরিয়া। তাই তো নিজের শখে’র সাবজেক্ট ইন্জিনিয়ারিং ছেড়ে দেশের বাইরে যেতে রাজি হয়ে গেলো ততক্ষণাৎ। সবাই জানল আসল ঘটনা অথচ তোঁষা’কে জানালো হলো আরহাম যাচ্ছে পড়াশোনা’র জন্য। অর্ধ সত্য জানা তোঁষা তাতেই কেঁদে অস্থির। তাকে কোন ভাবে জানানো হয় নি আরহাম’কে দূরে পাঠানোর আসল কারণ। এতসবে একমাত্র বিরোধীতা করলো তুষা’র। কারণ একটাই। ও জানে বাপ-চাচাদের আসল উদ্দেশ্য। তোঁষা’র সাথে কখনো তারা আরহাম’কে মিলতে দিবে না। জেনেটিক ভাবে আরহাম অসুস্থ। এখানে সুস্থ হওয়াটা একটু কঠিন। বাপ-চাচা অতকিছু বুঝতে চাইলো না। তাদের ধারণা আরহাম থেকে তোঁষা দূরে থাকলেই ভুলে যাবে। একসময় তোঁষা’কে বিয়ে দিয়ে দিবে। তাহলেই শেষ। তুষা’র সোজা বাবা’র রুমে ঢুকেই তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,

— কি করতে চাইছো তোমরা?

তুহিন কিছু বলার আগেই তুরাগ বললো,

— আমার ছেলে আমি চিনি তুষা’র। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইছি না।

তুষা’র কথা মানলো না। জোর করেই বাবা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

— তোমাদের উদ্দেশ্য আমার জানা আছে আব্বু। আরহাম’কে দূর করতে চাইছো? ভাবছো আরহাম একাই পাগল পুতুলের জন্য? নিজেরা কি দেখছো না পুতুল নিজে কতটা পাগল? কারো কথা শুনে না আরহাম ছাড়া। ওর জেদ আরহাম ছাড়া কেউ ভাঙাতে পারে না। দু’জনকে বিয়ে করিয়ে রাখ। এ বাড়ীতেই থাকুক একসাথে। অন্তত চোখের সামনে থাকবে।

— হ্যাঁ এরপর ঐ পাগল আমার মেয়ে’কে মে’রে ফেলুক!

কিছুটা খলবলিয়ে কথাটা বললেন তুহিন। তুষা’র পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা করেও বাসায় কাউকে মানাতে পারে নি। একবার চাইলো আরহাম’কেই জানিয়ে দিবে বাবা-চাচা’র আসল উদ্দেশ্য কিন্তু মায়ের দেয়া কসম তাকে বাঁধা দিলো সেটা করতে। সেদিন রাগে বাসা ছেড়ে চলে যায় তুষা’র। তার হাতে করার জন্য কিছুই ছিলো না। কাকে বুঝাবে তোঁষা’র সাথে আরহাম আর আরহামে’র সাথে তোঁষা ই ভালো থাকবে। এদের আলাদা করতে গেলেই হয় ভেঙে যাবে নয় একদম গুড়িয়ে দিবে।

এই তো অতঃপর একদিন আরহাম চলে গেলো। সেদিন দুটো নারী’র কান্নায় শুধু মুখরিত হলো শেখ বাড়ী। তোঁষা’কে সামলাতে অবশেষে আরহাম’কেই লাগলো। যদিও বাসার সবাই চেয়েছিলো তোঁষা স্কুলে থাকাকালীন আরহাম’কে পাঠিয়ে দিবে কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি। তোঁষা ঐ দিন স্কুল পালিয়ে বাসায় ফিরেছিলো। কেন জানি ওর মন বলছিলো ওর প্রাণ চলে যাচ্ছে। বহুদূরে। সেদিন সেই প্রাণে’র টানেই তো প্রাণের প্রাণেস্বরী ছুটে এলো।
আরহাম তোঁষা’কে ধরে রুমে নিয়ে দরজা লাগাতেই সবাই কিছুটা ভরকে যায়। কি করবে আরহাম?
আরহাম তেমন কিছু করলো না। শুধু তোঁষা’র হাত ধরে পাশে বসে শান্ত স্বরে বলেছিলো,

— আমার প্রাণ না তুই তুঁষ? তুই কাঁদলে এই প্রাণহীন দেহ নিয়ে কিভাবে যাব?

ব্যাস তোঁষা শান্ত হয়ে যায়। উল্টো সেদিন নিজে আরহাম’কে বলেছিলো,

— আমার প্রাণ যাতে তারাতাড়ি ফিরে আসে।

— প্রাণ কি প্রাণে’র জন্য নিজের খেয়াল রাখবে?

— রাখবে?

— ওয়াদা দে।

— দিলাম।

— যাব?

— আচ্ছা।

— সত্যি?

— তিনসত্যি।

— কাঁদবি?

— হু।

— তুঁষ?

— কাঁদব না।

অতঃপর আরহাম তোঁষা’র মাথায় হাত রেখে রুম থেকে বেরুলো। গাড়িতে উঠার আগে আদনানকে জড়িয়ে ধরে আরহামে’র দুটো আবদার,

— মা আর তুঁষ’টাকে দেখে রাখিস। শুন রাতে আম্মুর কাছে এসে ঘন্টা খানিক থাকবি। তোকে দেখলে আমার কথা কম মনে পরবে।

আদনানে’র চোখ ভিজে উঠে। ভাই’কে সে ভালোবাসে। দুই ভাইয়ের ভালোবাসার কমতি কখনো ছিলো না।
আরহামে’র গাড়িটা ছাড়তেই একই সাথে সস্তি আর হতাশার শ্বাস ফেললো সকলে। আচ্ছা তুরাগে’র ভেজা চোখটা কি কেউ দেখলো না? একজন বাবা’র কষ্ট’টা সবসময় ই অদৃশ্য থাকে। আড়ালে। আবডালে।
তোঁষা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপলক দেখে সেই যাওয়া। ওর চোখদুটো কেন জানি আর কাঁদে না। মনে হয় আরহাম যায় নি। কখন জানি এসে বলে,
“তুঁষ ইনসুলিন নিয়েছিস? মিষ্টি খেতে মন চায়?”

কিন্তু বছরের পর বছর আরহামে’র দেখা পায় না তোঁষা। অপেক্ষা কাটে। যখনই তোঁষা জানতে পারে তাকে আর আরহাম’কে ধোঁয়াসায় রাখা হ’য়েছে তখনই সে প্রতিবাদ করে।মিনতি করে। লাভ হয় না।
তোঁষা’কে আরহামে’র সত্যিটাও জানানো হয় কিন্তু ততদিনে তার কি সেই বিশ্বাসটা বহাল ছিলো শেখ বাড়ীর সদস্যের উপর?

#চলবে….

[বর্ধিতাংশ আসবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here