#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০
তাখলিফের মনে কি যেন একটা অনুভূতি, বুকের ভেতর অন্যরকম দোনা মোনা… কাকে বোঝাবে সে? এমন একটা মানুষ বলতে তো ওর কেউ নেই, গোলগাল চেহারার সদ্য তরুণীতে পা দেওয়া ঝুমুরটার কাছেই দিনশেষে ও ঠেকা!
’
পরদিন খুব সকালে পাখি বেগম রান্নাঘরে এসে চমকে যান। হলুদ পাড়ের কমলা রঙের একটি শাড়ি পরে প্রমিলাকে রান্নায় সাহায্য করছে তুসি। মাথায় ঘোমটা দেওয়া, একটু পরপর সেটা পড়ে যাচ্ছে আর বারবার সেটা টেনে ঠিক করছে। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে হাঁটু অবধি লম্বা ভেজা চুল দেখে বিষম খেলেন পাখি বেগম। মেয়েটার চোখেমুখে স্নিগ্ধ একটা ভাব, ঠোঁটের কোণে হাসি। পাখি বেগম কোণা চোখে তাকিয়ে রইলেন ওর প্রতি। নাহ! গায়ের রঙ চাপা হলেও লম্বায়, চেহারাসুরতে ততোটা পিছিয়ে নেই। এই মেয়ের গায়ের রঙ ফর্সা হলে চোখ ধাঁধানো সুন্দরী হতো তা নিশ্চিত। পাখি বেগম বাস্তবে ফিরে এলেন। এসব কি ভাবছে সে? নাহ! কিছুতেই তিনি এই মেয়েকে মেনে নেবেন না। ফুঁসলিয়ে তার কোটিতে একজন সুন্দর ছেলেকে বিয়ে করেছে এই মেয়ে। এত সহজে ক্ষমা করবেন না তিনি। তুসি আচমকা পেছনে ফিরে তাকে দেখে চমকে ওঠে। মুখের হাসি মিলিয়ে যায় ওর৷ মিনমিন করে বলে, “আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
নাহ! মেয়ের আদব আছে। কিন্তু তাতে কি? পাখি বেগম একমনে প্রশংসা করে অন্যমনে খুঁত খুঁজতে থাকেন। মুখ কালো করে সালামের উত্তর না দিয়ে প্রমিলাকে রাগী সুরে বলেন, “দেখি সর! কি রান্না করিস? মাছ সব তো পুড়িয়ে ফেললি!”
প্রমিলা বলেন, “কই পুড়লো ভাবি! এটা তো ভাজা হচ্ছে।”
পাখি বেগম উত্তর দেন না আর। খুন্তি হাতে মাছ উলটে দিতে থাকেন। তার রাগের উত্তাপ প্রমিলা, তুসি দু’জনেই বুঝতে পারেন। তুসির চোখ ছলছল করতে থাকে। এরপর শাড়ির কোণা দিয়ে চোখ মুছে বলে,
“আপনি আমার সালামের উত্তর দেন নি আন্টি…”
পাখি বেগমের খ্যাঁকিয়ে ওঠেন, “প্রমিলা ওরে ক, আমার সাথে যাতে এমনে কথা না কয়। ছেলের জন্য শুধু ওরে জায়গা দিয়েছি তাই আমার থেকে যাতে দূরে থাকে! বেহায়া মেয়ে…”
প্রমিলা তাকে বুঝাতে গেলে পাখি বেগম আরও রেগে যায়। তুসির গাল বেয়ে পানি ঝরে পড়ে। ও একদৌড়ে ঘরে চলে যায়। কাঁদতে থাকে। কান্নার শব্দ আর হেঁচকি শুনে ইয়াসিফের ঘুম ভেঙে যায়। তুসিকে কাঁদতে দেখে ধরফড়িয়ে ওঠে বসে। ঘড়িতে মাত্র ছ’টা বাজে। এত সকালে ওঠে শাড়ি-চুড়ি পরে নববধূ তার শিয়রে বসে কাঁদছে ব্যাপারটা কেমন আশ্চর্যজনক! ইয়াসিফ ওকে বুকে টেনে নেয়৷ মাথায় হাত বুলিয়ে নরম সুরে কারণ জানতে চায়। তুসি উত্তর না দিয়ে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতেই থাকে। ইয়াসিফ এবার রেগে জিজ্ঞেস করে, “গ্র্যাজুয়েশন শেষ করবি ক’দিন পর! এত বড় ধেড়ে মেয়ে কিভাবে একটা বাচ্চার মতো সারাদিন কাঁদতে পারে তোকে না দেখলে বুঝতাম না৷ বয়সে বুড়ি, স্বভাবে তিন বছরের শিশু। কি যে করি তোকে নিয়ে! বল তো কি হয়েছে? কে কি বলেছে? কত সাহস! আমার টমেটোকে কাঁদায়, থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো তার!”
তুসি ওকে ওমন রাগতে দেখে ঘাবড়ে যায়। মাকে থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবে নাকি এই ছেলে? ভয়ানক কান্ড হবে তখন। ও কান্না থামিয়ে বলে, “বাসার কথা মনে পড়ছিলো।”
ইয়াসিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এইজন্য কেঁদে কেঁদে আমার ঘুম নষ্ট করবি তুই? এমনিতেই কাল রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি তোর যন্ত্রণায়।”
তুসি জ্বলে ওঠে, “আমার জন্য? আমি কি করেছি? সব দোষ এখন আমার? তুই নিজেই নির্লজ্জের মতো কাছে…”
“বল বল, থামলি কেন…”
ইয়াসিফ গালে হাত দিয়ে আগ্রহী গলায় জানতে চায়। ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি। তুসি থতমত খেয়ে ওর বুকে কিল-ঘুষি মেরে দূরে সরতে গেলেই ইয়াসিফ জাপ্টে ধরে ওর কানে কানে ফিসফিস করে বলে, “অত
লজ্জা পাস কেন? লজ্জার কি আছে, তুই তো আমার বউ! তোর টমেটো গালটা দেখলেই চুমু চুমু জাগে। কাছে আয় তো, ভোরের আদরটা করে দিই…”
তুসির কান গরম হয়ে গেলো। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। পালাতে চাইলেও লাভ হলো না। ইয়াসিফ ওকে ধরে ফেললো! তুসি নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও কোনোমতেঅ জয়ী হলো না৷ ততক্ষণে ইয়াসিফের উত্তপ্ত চুমুতে বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে ওর! এই ছেলের অনুভূতি জাগ্রত হলে একদম সবকিছু ভুলে যায়। ভালোবাসা আর আদরের সংমিশ্রণে তৈরি এই পবিত্র অনুভূতি অদ্ভুত সুখকর লাগে! কমলা রঙের শাড়িটির আঁচল অবহেলিত ভাবে পরে থাকে বিছানার একপাশে। ইয়াসিফ ওর দু’চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বলে, “কাঁদবি না, একদম না।”
_______________
ভার্সিটিতে আজ জাঁকজমক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। সকল কপোত-কপোতী, প্রেমিক-প্রেমিকারা একসাথে ঘুরছে, সময় কাটাচ্ছে। দেখতে খুবই ভালো লাগছে ঝুমুরের। সবাই তাদের পছন্দের মানুষ নিয়ে কি সুখী! আর সে? ইহজীবনে বোধহয় তাখলিফের সাথে এভাবে সময় কাটানো হবে না ওর। ঝুমুর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাখলিফকে সে ভীষণ মিস করতে লাগলো। শেষমেশ নিজেকে দমাতে না পেতে ফোন বের করে ম্যাসেজে লিখলো, “কেন যে আমাকে স্বীকার করেন না, আমার খুব আফসোস হয়! একদিন হঠাৎ মরে গেলে দেখবেন আপনিও খুব আফসোস করবেন। হুহ!”
ম্যাসেজটা সেন্ড করে ভাবলেশহীন হয়ে এদিকওদিক হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো ঝুমুর। তাখলিফ নিশ্চয়ই ওর ম্যাসেজ দেখবে, কিন্তু তাতে হেলদোল হবে না ওর।
এত পাষাণ! ঝুমুরের মনটা যে কেন ওর মতো শক্ত হতে পারলো না। পরক্ষণেই মনে হলো, ও নিজে এত পাষাণ হলে এই পাষণ্ড লোকটাকে ভালোবাসতো কে তাহলে!
_____________
তাখলিফ ঝুমুরের ম্যাসেজ পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। এই মেয়ের কি মাথা খারাপ? এসব কি লিখেছে? তাখলিফের ইচ্ছে করলো ঠাটিয়ে এক চড় মেরে ওর ভিমরতি ছাড়িয়ে দিতে। বয়স কত ওর? ১৮/১৯! এখনি মরার কথা বলে, পেয়েছেটা কি এই মেয়ে? মৃত্যু কি এত সহজ? না নয়। এই যে তাখলিফ একটা মৃত মানুষ, তবুও জীবন্ত পুতুল হয়ে বেঁচে আছে সে। কার জন্য? বাবার জন্য! তাহলে এই ঝুমুর এত অবলীলায় মরার কথা কীভাবে বলে? তাখলিফই তো ওর সব নয়, আস্ত একটা পরিবার আছে ওর। সবচেয়ে বড় কথা বাবা-মা আছে৷ তাহলে এই ঠুনকো তাখলিফের বিরহে কেন সে মরে যাওয়ার কথা বলে? ওর বিরক্ত লাগলো সবকিছু। কফির মগটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। কাচ ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। শব্দ শুনে পিয়ন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। মেঝেতে ভাঙা কফির মগ দেখে বলল, “কি হইসে স্যার? কোনো অসুবিধা?”
তাখলিফ দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো। কি করলো এটা সে? ও নিজেকে সামলে এরপর বলল, “না কিছুনা। ফ্লোরটা পরিষ্কার করে ফেলুন।”
পিয়ন মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো ফ্লোর পরিষ্কার করে। তাখলিফ কাজে মনোযোগ দিতে পারলো না। কেন যে ঝুমুরটা এমন করে, ওর সব শূন্য লাগে। লাঞ্চ আওয়ারে কি ভেবে চলে এলো ঝুমুরের ভার্সিটিতে। সকালে দেখেছে এই মেয়ে সেজেগুজে ভার্সিটি এসেছে। ক্যাম্পাসে কি একটা উৎসব চলছে, খাবারের স্টল বসেছে অনেকগুলো। তাখলিফ এদিকওদিক কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে একসময় ফিরে আসতে যাবে তখনি পেছন থেকে কে ওর শার্ট টেনে ধরলো। বিচলিত হয়ে ফিরতেই ঝুমুরকে দেখতে পায়। রোদে ঘুরাঘুরি করে রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে মুখ! তাখলিফ ধমক দিয়ে বলে, “শার্ট ছাড়! এভাবে ধরবি না।”
“ধরবো। আপনি এখানে এসেছেন কেন?”
তাখলিফ বিব্রত কণ্ঠে বলল,
“তোকে কৈফিয়ত দেবো কেন? আর তুই এখনো বাড়ি ফিরিসনি? ভার্সিটিতে ওঠে বেশ ডানা গজিয়েছে দেখছি। আবার সাজগোজও করেছিস! বাহ!”
ঝুমুর মুখভার করে বলল, “একটুই তো সেজেছি। এভাবে বলার কি আছে? আপনি সবসময় এমন। আমাকে কি ভালো দেখাচ্ছে না?”
তাখলিফ অস্বস্তিবোধ করে। কিভাবে বলবে এই মেয়েকে দেখে বুকের ভেতর সূক্ষ্ম এক অনুভূতি খোঁচা দিচ্ছে৷ ও প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করে, “কিছু খেয়েছিস?”
ঝুমুর মাথা নাড়ায়। একটু আগেই বান্ধবীদের সাথে সে ফুচকা, ঝালমুড়ি খেয়েছে। তবে এই লোককে তা বলা যাবে না৷ রাস্তাঘাটে তাখলিফের সাথে এভাবে দেখা হলে ভালোবাসুক আর না বাসুক এই লোক ঠিকই ওর খাওয়াদাওয়ার খোঁজ নেয়। মানুষটার সঙ্গ পাওয়া যাবে ভেবে ও মিথ্যে বললো। তাখলিফ ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে হাঁটতে থাকে। ঝুমুর ওর এই আচরণে পুরোপুরি শকড হয়ে যায়৷ তাখলিফ সত্যিই ওর হাত ধরেছে? এ যে অবিশ্বাস্য কান্ড!
তাখলিফ ওকে কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁতে নিয়ে আসে৷ খাবার খেতে খেতে আড়চোখে দু’বার ঝুমুরের দিকে তাকায়। তবে দুর্ভাগ্যবশত দু’বারই সে ধরা পড়ে যায়। চোখাচোখি হতেই ও অস্বস্তিবোধ করে। মাথা নামিয়ে নেয়। তাখলিফ এসবে মাথা না ঘামিয়ে খাওয়া শেষ করলো। বিল পে করে বেরিয়ে করে রেস্তোরাঁ থেকে বেরুতেই ঝুমুর ওকে জিজ্ঞেস করে, “আজ আপনার শরীরটা ঠিক আছে তো?”
তাখলিফ ওর কটুক্তি শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে। রুক্ষ গলায় বলে, “আমি একদম ঠিক আছি। দেখ ঝুমু, তুই এত জ্বালাস না আমায়। ইদানীং বেশি বেশি করছিস! আগের চেয়ে বেশি চালাকি করছিস। তখন কেন ওমন একটা ম্যাসেজ করলি? আর কখনো এসব বেয়াদবি দেখলে সোজা ব্লকলিস্টে পাঠাবো। মাইন্ড ইট!”
ঝুমুর অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“বোকা ঝুমুরকেও ভালো লাগে না আবার চালাক ঝুমুরকেও পছন্দ করেন না। ঠিক কি চানটা আপনি? বলে ফেলুন তো!”
তাখলিফ ওকে বোঝাতে চাইলো,
“আমি চাই তুই আমাকে নিয়ে মাথা না ঘামা। একটা ইন্সিডেন্টকে কেন্দ্র করে তুই তোর লাইফটা ঘেঁটে ‘ঘ’ করে দিস আমি তা চাই না। এভাবে আমার পেছনে লেগে না থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন কর, আমার মতো। আমি সেটাই চাই।”
ঝুমুর কেঁদে ফেললো,
“আপনি চান, সব আপনিই চান৷ আর আমার চাওয়া-পাওয়া নেই? আমি কি মানুষ না? বিয়ে-সম্পর্ক পুরোপুরি বোঝার আগেই আমার সাথে আপনার
বিয়ে হয়ে গেলো। যেভাবেই হোক, হয়েছে তো! আগে আপনাকে আমি অন্যভাইদের মতোই দেখতাম, তখন এত কষ্ট হতো না৷ কিন্তু ওই যে, বিয়ে হয়ে গেলো আমাদের৷ এরপর থেকে আপনাকে ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারি না আমি। সবকিছু পালটে গেছে, আপনার জন্য আমি খুব কষ্ট পাই। আমার মন পুড়ে সবসময় আপনার জন্য, খুব খুব ভালোবাসি আপনাকে….”
তাখলিফ কতদিন পর দেখলো! মায়ের পর এই রমণীই বোধহয় প্রথম যে ওর জন্য এভাবে হাউমাউ করে কাঁদছে। আবেগের কি অদ্ভুত বহিঃপ্রকাশ! ও পকেট থেকে টিস্যু বের করে কান্নায় হুঁশহারা ঝুমুরের নাক মুছে দিয়ে বলল, “বড় হচ্ছিস না গাধা হচ্ছিস? নাকের সর্দি মুছ! দেখি এদিকে আয় হাঁদারাম…”
ঝুমুর বাধ্য মেয়ের মতো ওর কথা শুনলো। রাস্তার মানুষগুলো হা হয়ে ওদেরকে দেখছে। এতবড় মেয়ের নাকের সর্দি মুছে দিচ্ছে কিনা রাস্তায় দাঁড়িয়ে! ঝুমুরের যখন সম্বিত ফিরে এলো তখন লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। তাখলিফ রিকশা ঠিক করতেই ঝুমুর নম্র স্বরে বলল, “আমার মাথাটা ঘুরছে। আপনি কি যাবেন আমার সাথে?”
তাখলিফ চিন্তিত হয়ে পড়ে,
“সে কি! মাথা ঘুরছে কেন?”
ঝুমুর অসুস্থতার ভান করে শুকনো মুখে বলল,
“জানি না, তখন রোদে ঘুরলাম না? মাথাটা কেমন
চক্কর দিচ্ছে। আচ্ছা থাক, আপনি অফিসে যান। আমি একাই যেতে পারবো।”
তাখলিফ এক মুহূর্ত সময় নিয়ে বিরক্তি হয়ে বলল, “চল। কোথায় আবার অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যাবি। পরে আরেক ঝামেলা। আমার কাছে এলেই একটা না একটা ঝামেলা নিয়ে আসিস…”
বিড়বিড় করে বলে ঝুমুরকে নিয়ে রিকশায় ওঠে বসলো। রিকশা চলতে শুরু করলে ঝুমুর হঠাৎ ওর কাঁধে মাথা রেখে চোখদুটো নিভু নিভু করে বলল, “আমাকে একটু ধরে বসুন তো, কেমন যে লাগছে! মনে হচ্ছে পড়ে যাবো…”
তাখলিফ বুঝতে পারে না কোথায় হাত রেখে ধরে বসবে। ঝুমুরই টেনে নিয়ে ওর কোমড়ে হাত রাখলো। তাখলিফ চমকে ওঠে বিব্রত হয়, গলা শুকিয়ে আসে। ঝুমুরের গা থেকে মিষ্টি একটা সুগন্ধে তাখলিফের ঘ্রাণেন্দ্রিয় ঝাঁঝিয়ে ওঠে। উফ, গরম লাগছে কেন এত! ও নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে। আড়ষ্টতা জেঁকে ধরেছে ওকে। ঝুমুর ওর কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দে হেসে ফেলে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ঝুমুর রিকশা থামিয়ে নেমে পড়ে। তাখলিফ হতভম্ব!
“তোর না শরীর খারাপ? এখানে নেমে পড়েছিস কেন? আরেকটু সামনে গেলেই তো বাড়ি…”
ঝুমুর কৃতজ্ঞতাসূচক হেসে বলল,
“এখন সুস্থবোধ করছি। আপনি যেভাবে সামলালেন আমায়! থ্যাংক্স ফর ইউ’র ট্রিটমেন্ট। বাই… ”
বলে ঝুমুর সেখান থেকে চলে আসে। তাখলিফ
বিষয়টা বুঝতে পেরে হতবিহ্বল হয়ে যায়। অফিসে
ফিরে পুরো কক্ষে শুধু পায়চারি করতে থাকে। এই যে ঝুমুরটা এতসব করছে ওর কাছে আসার জন্য, নিজেকে সামলাতে এত কেন কষ্ট হচ্ছে?
শেষ বিকেলে ঝুমুর যখন শুকনো কাপড় আনতে যখন ছাদে যায় তখন কে যেন ওকে হাত ধরে টেনে দরজাবিহীন স্টোর রুমে নিয়ে যায়। ঝুমুর খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। তবে যখন বুঝতে পারে এটা তাখলিফ তখন ওর বিস্ময়ের সীমা রইলো না। ওকে দেয়ালে ঠেসে দাঁড় করিয়ে তাখলিফ ওর সাজগোজ হীন মুখপানে দৃষ্টি দেয়। গোধূলির রঙিন আলোতে ঝুমুরও দেখে ওকে, অফিস ফেরত লোকটির মুখপানে ক্লান্তি! তবুও কি স্নিগ্ধ লাগছে, কপালের কাছে ছোট্ট কাটা দাগটাকে ছুঁয়ে দিতো ইচ্ছে করলো ওর। তাখলিফ কিছুক্ষণ ওভাবে থেকে এরপর বিদ্রুপাত্মক কন্ঠে বলে, “আগের সেই বোকা ঝুমুর তুই একদম নেই।
এত এ্যাডভান্স? কার জন্য হয়েছিস? আমার জন্য?”
ঝুমুর অবাক হয়ে বলল, “আমি আবার কি করলাম? অফিস থেকে ফিরে আজ হঠাৎ আমার পেছনে লাগলেন কেন?”
তাখলিফ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“তখনকার নাটকের স্ক্রিপ্ট দুর্বল ছিলো।”
জঝুমুর থতমত খায়। উফ, মাথা ঘোরার ব্যাপারটা
এই লোক বুঝে গেছে। ও তাও বলে, “আমি তো তেমন কিছুই করিনি।”
তাখলিফ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে, “এসব কাজ নাটক ফাটক
আমি বরদাস্ত করবো না। তবুও প্রথমবার বলে ক্ষমা করে দিলাম।”
ঝুমুর ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,
“ক্ষমা লাগবেনা। কি শাস্তি দিতে চান সেটাই বলুন। ভুল যখন করেছি, শাস্তি কেন মওকুফ করে দিবেন? দিন, শাস্তি দিন।”
ঝুমুরকে এগিয়ে আসতে দেখে তাখলিফ পিছু সরে যায়। উফ! এই আবেগে জর্জরিত মেয়েটাকে ধমকাতে এনে নিজেই ফেঁসে গেছে। কেন যে এমন ভুল হয়!
“বলুন কি শাস্তি…”
বলে ঝুমুর ওর চোখের দিকে তাকায়। তাখলিফ অস্বস্তি নিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। এই বাচ্চা মেয়েকে ভয় পাচ্ছে কেন সে? ও দৃঢ় গলায় বলে, “দূরে থাকবি আমার থেকে।”
“আপনার কি ছোঁয়াছে রোগ হয়েছে যে দূরে থাকতে বলছেন?”
তাখলিফ বিরক্তি নিয়ে বলে,
“বুঝেও না বোঝার ভান করিস না। দূরে মানে দূরে।
আমার মনের থেকে যোজন মেইল দূরে থাকবি।”
“কেন? আপনি ভয় পাচ্ছেন নাকি?”
তাখলিফ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“তোকে আমি ভয় পাবো?”
“পাচ্ছেনই তো। আমাকে ভালোবেসে ফেলার ভয়।”
তাখলিফ ভেতরে চমকে গেলেও ওপরে স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এই মেয়েকে এখানে নিয়ে আসাটা ভুল হয়েছে, তার চেয়ে বড় ভুল এসব অবান্তর কথা নিয়ে আলোচনা করা! ঝুমুরের ওর চোখের দৃষ্টিতে ওর চোখ আটকে গেলো। কি মোহনীয়! তাখলিফ অদ্ভুত ঘোরে পড়ে যায়! ঝুমুরের একদম কাছে গিয়ে ওর কোমড় টেনে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। ফিসফিস করে বলে, “সময় থেমে গেলে
কি খুব ক্ষতি হবে রে ঝুমুর?”
আচমকা এমন কান্ডে ঝুমুর যেন নিজের চিন্তা,
বোধশক্তি যেন হারিয়ে ফেলে। আজকের দিনটা এত
অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য কেন? সবকিছু কেমন ঘোর লাগা, স্বপ্নের মতো! ও নিচু গলায় শুধু বলে,
“একদম না।”
________________
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। বড় পর্ব, মন্তব্য জানাবেন।]
চলবে…