অপ্রিয়_রঙ্গনা #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-৯

0
127

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯

ঝুমুর বিরক্ত হয়ে বলল, “সবসময় বাজে কথা আপনার। প্রথমে সবাই অমন রাগটাগ করে, পরে ঠিকই মেনে নেয়। আমাদেরটাও তাই হবে।”

তাখলিফ ঝমুরের সামনে এসে ওর দিকে
তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল, “না হবে না।”

“হবে। চাইলেই হবে।”

বলে আবার ঝুমুর ভ্রু কুঁচকে সন্দেহী চোখে তাকায়,
“আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি অন্য
কাউকে ভালোবাসেন? আমাকে পছন্দ না? আরো মর্ডান হলে পছন্দ করতেন?”

তাখলিফ এসব শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে কিভাবে
যে ঝুমুরের দিকে তাকায়, ওর বুকের ভেতর আস্ত একটা নদী মুহূর্তেই উত্তাল হয়ে ওঠে! ঝুমুর অস্বস্তি নিয়ে চোখ লুকায়। তাখলিফ তা বুঝতে পেরে উত্তর
না দিয়ে প্রসঙ্গ পালটে ফেলে, “গিয়ে দেখ নতুন কপোত-কপোতীর কিছু লাগবে নাকি?”

“আপনাদের বাসায় থাকছে, আপনি জিজ্ঞেস করুন।
আমি কে!”

মুখ ঝামটা মেরে সেখান থেকে ঝুমুর চলে এলো।
ওর একদম ভালো লাগে না তাখলিফের এই খাপছাড়া আচরণ। এমন একটা আচরণ করে যেন ঝুমুর ম’রুক বা বাঁচুক ওর কিছু আসে যায় না। আবার মাঝেমধ্যে এমনভাবে কেয়ারিং দেখাবে যেন ওর জন্য কত ভাবে! আচ্ছা বিয়েটা নাহয় ওদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো এক দুর্ঘটনা ক্রমে হয়েই গেছিলো। তাই বলে কি এরকম করা সাজে? ঝুমুর তো ওর থেকে দূরে থাকতে পারে না, চায়ও না। তবুও কেন এরকম দূরে ঠেলে দেওয়া ব্যবহার? বাড়ির মানুষ হয়তো জানে না, কিন্তু এক সময় তো ঠিকই জানবে। হয়তো বাবা-মা সমস্যা করবে সেটাও ঝুমুরের কাছে অতোটা কষ্টের হবে না। তবে তাখলিফ নিজেই যদি
ঝুমুরকে দূরে সরিয়ে দেয়, সেই বিরহ হয়তো ঝুমুর সহ্য করতে পারবে না। টুকরো টুকরো অনুভূতি জমা করে দু’বছর যাবৎ মানুষটাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসেছে সে। কতো সময় নির্লজ্জ হতে ইচ্ছে করে, দুনিয়া ভুলে মানুষটার বুকে মাথা রাখতে ইচ্ছে করে। সে-ই যদি এভাবে দূরছাই করে ঝুমুর যাবে কোথায়? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝুমুর ইয়াসিফ আর তুসিকে বিদায় জানিয়ে দোতলায় চলে আসে। বাসার অবস্থা থমথমে। রাতে হয়তো কেউ খায়ওনি। মায়ের ঘরে উঁকি মেরে দেখলো মা কাঁদছে গুনগুন করে আর বাবা চুপ করে বসে আছে। ঝুমুর রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসে রাতের আকাশ দেখে। হাওয়ায় ভেসে আসে গোলাপের সুগন্ধ! বিমোহিত হয় ঝুমুর! সবার সব কষ্ট যেন রাতের অন্ধকারে নিশ্চুপ মিলিয়ে যায় এই প্রার্থনা করে মনেপ্রাণে।

___________________

সানওয়ার হক ব্যবসার কাজে বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকেন। বাড়ির বড় ছেলে তিনি, পারিবারিক গোলযোগ গুলোতে তিনিই একমাত্র মানুষ, যে ঠান্ডা মাথায় সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন। কোনো সময় রেগেও যান। তবে কেউই তার ওপরে কথা বলেন না। ব্যাপারটা ভয়ের নয় শ্রদ্ধার! ইয়াসিফ বিয়ে করে বাড়িতে বউ এনেছে আর সেই বউকে কেউ মানতে চাইছে না শুনে তিনি পরদিনই চট্টগ্রাম থেকে ফিরে আসেন। এরপর রাতে খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে দোতলায় বসার ঘরে বৈঠক বসে। পাখি বেগম,
শামসুল হকের অভিযোগ শুনে সানওয়ার সাহেব
গম্ভীর কণ্ঠে শামসুল হককে বলেন ইয়াসিফের গালে চড় মারতে। সবাই ঘাবড়ে যায়! শামসুল হক আমতাআমতা করে বলেন, “কি বলেন ভাই…”

“কি বলি মানে? তোকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে তুই শাসন করবি না? কাপুরষ নাকি?”

শামসুল হক লজ্জিত স্বরে বলে, “ছোটরা আছে এইখানে…”

“তাতে কি? তোর ছেলে অন্যায় করেছে তাকে শাসন করবি, যাতে ছোটরাও দেখে শিখে কোন কাজ করা উচিৎ আর কোনটা নয়!”

“আ আমি…”

সানওয়ার হক মনে মনে মজা পেলেও শক্ত গলায় বলে, “আমতাআমতা না করে ছেলেকে শাসন কর। বংশের এতদিনের মানসম্মান সে বলি দিয়েছে হারাম প্রেম করে, পালিয়ে বিয়ে করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে যা আমাদের পূর্বপুরুষেরা কখনো করেনি, তাকে সামান্য থাপ্পড় দিতে পারবি না?”

শামসুল হক ইয়াসিফকে আরও একটা থাপ্পড় মারেন। ইয়াসিফ চড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তুসি ওর পিছনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়। এসব কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। পাখি বেগম দরজায় মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছেন। সানওয়ার হক তাকেও চড় মারতে বললেন৷ পাখি বেগম ভাসুরের কথা শুনে বিমর্ষ গলায় মিনিমিন করে বলেন, “মা হয়ে কেমনে হাত তুলি? মাফ করেন।”

সানওয়ার হক তা শুনে বাকি সবার উদ্দেশ্যে বলেন, “আর কারো অমত আছে এই বিয়েতে?”

বাড়ির কেউ কোনো শব্দ করে না। চুপ থেকে সবাই বুঝিয়ে দেয় এই বিয়েতে তারা রাজি। সানওয়ার হক এবার বলেন, “যাও, বউমাকে বরণ করার ব্যবস্থা করো মেজোবউ।”

পাখি বেগম চমকে ওঠেন, “সেকি ভাইজান! এইডা আপনের কেমন বিচার? কই আপনে বুঝাইবেন ওরে তা না কইরা আপনে বলতেছেন এই কালা বউ মাইনা নিতে? এইডা কখনো সম্ভব না।”

সানওয়ার হক ভাইয়ের দিকে তাকায়। শামসুল হক ইতস্তত বোধ করে এরপর বউকে বলেন, “যাও! বউ বরণের ব্যবস্থা করো।”

পাখি বেগম রাগে কটমট করে বলেন, “পারমু না…”

বসার ঘর থেকে সাজেদা বেগম প্রমিলাকে বলেন,
“তুমিই যাও ছোটবউ। মা হইয়া নিজের মান রাখতে জানে না, সবসময় জিদ দেখাইবো…”

পাখি বেগমের গায়ে লাগলো কথাটা। বর্ষার কালো মেঘ যেন তার মুখে ঘিরে ধরেছে! সানওয়ার হক তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “শুনো মেজো বউ! জানি ওরা ভুল করেছে, তবুও যা হওয়ার হয়েছে মাফ করে দাও। দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে স্বেচ্ছায় জীবনসঙ্গী বেছে নিয়েছে, ভালো-মন্দ থাকাটা ওদের ওপর নির্ভর করে। তুমি যদি এখন সামান্য গায়ের রঙ নিয়ে এইসব করো তাহলে কেমনে হয়? কেউ তো আর ইচ্ছেকৃত এমন জন্মায় না। আল্লাহ বানিয়েছে। বিয়েটা কপালে ছিলো বলেই তো হয়েছে। এখন তুমি আল্লাহর সিদ্ধান্তে নারাজ হলে তোমার ছেলের কি ভালো হবে? তাছাড়া তুসির পরিবারও শুনলাম ঝামেলা করছে, যদি ওরা মামলা করে তাহলে হবে আরেক বিপদ। তোমারই তো ছেলে, তাও একটাই। তাকে হারিয়ে ভালো থাকতে পারলে ভালো। তুমি ওদেরকে হয়তো ঘরে তুলতে চাও না এ কেমন অদ্ভুত যুক্তি! এরকম করলে তোমার ছেলে বউ ছেড়ে দিবে নাকি? যে এমন বলছো? বরং তুমিই ছেলের চোখে ছোট হয়ে যাবা। তাই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভেবে নিও।”

পাখি বেগম চুপ হয়ে গেলেন। আসলেই তো তার একটাই ছেলে। কত আদরের! ওই কালো মেয়ের জন্য ছেলেকে হারাতে পারবেন না তিনি। প্রমিলা বউবরণ করতে গেলে তিনি গাল ফুলিয়ে বললেন, “আমায় দে।”

মুখভার করে বউবরণ করলো পাখি বেগম। এরপর ইয়ায়াসিফের ঘরে বউ নিয়ে যাবার অনুমতি দিলেন।সকলে মিলে ওদেরকে ঘরে নিয়ে গেলো। এদিকে মায়ের কান্ড দেখে ইয়াসিফের হাসি পাচ্ছে। সকলে কিছুক্ষণ ওদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তুসি মনমরা
হয়ে আছে। বারবার ইয়াসিফের পেটে খোঁচা দিচ্ছে পেছন থেকে। ইয়াসিফ খপ করে ওর হাত ধরে নিচু স্বরে বলল, “ব্যথা পাই তো।”

তুসি মিনমিন করে বলল, “সবই তো হলো। কিন্তু তোর মা তো আমাকে মানলো না।”

“সময় দে, ঠিক মেনে যাবে।”

তুসি বিষন্ন গলায় বলল,
“কবে সেটা? কেউ আমার ওপর রাগ করে থাকলে আমার ভালো লাগে না।”

ইয়াসিফ হতাশ হয়ে বলল,
“একটু সময় দে ভাই। মা আর তোর চাপে পড়ে জীবন কয়লা করে ফেলছি। ওদিকে তোর বাড়ির হানাদার বাহিনীকেও তো সামলাতে হবে। যত্ত ঢং, মেয়ে দিবে না। এই যে, নিয়ে এলাম তোকে কেউ কিছু করতে পেরেছে?”

তুসি ভার গলায় বলল, “এভাবে বলছিস কেন?”

ইয়াসিফ ব্যাপারটাতে মজা পেলো বেশ। তুসিকে আরেকটু জ্বালাতে ভান করে বলল, “কীভাবে বলবো আর! কালো দেখতে মেয়ে তুই। সকলে বড়লোক জামাইয়ের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। বেকার অথচ সুন্দর ছেলের কাছে মেয়ে দিবে না। বেনিফিট পাবে ওমন ছেলের কাছে দেবে। বুঝলি এবার তোর পরিবার কেমন?”

তুসি রেগে ওঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে আমাকে বিয়ে করলি কেন? যা সুন্দরী দেখে বিয়ে কর আবার। তোর মায়ের ইচ্ছা পূরণ কর।”

ইয়াসিফ ওকে একটানে কাছে এনে উরুর ওপর বসিয়ে গালে নাক ঘষে বলল, “এই কয়লাটাকে যে আমি ভালোবাসি, কীভাবে তাকে দূরে যেতে দিই? কালো হোক, ধলা হোক দিনশেষে তো তুই আমারই ভালোবাসা!”

তুসি এবার কেঁদে ফেললো, “তুই এত ভালো কেন?”

“তুই ভালোবেসেছিস বলে।”

_______________

ঝুমুর বেশ খুশি। মা-বাবা যে এত সহজেই মেনে নেবে ওদেরকে ও সেটা ভাবেনি। ফুরফুরে মনে তাখলিফকে ম্যাসেজ করে জানালো পুরো ব্যাপারটা। সেই সাথে নিজের ব্যাকুল মনের অনুভূতিও জানালো। ইনিয়েবিনিয়ে সেই একই কথা! তাখলিফ টেক্সট পড়ে ভাবলেশহীন হয়ে গেলো। ঝুমুরের আচরণ দিনদিন যেমন বেপরোয়া হয়ে ওঠছে তাতে আগত দিনগুলো ততোটা সুখের হবে না। এই মেয়ের জন্য ওর অনুভূতিটা কেমন তাও সে বুঝতে পারে না৷ যতই দূরে ঠেলে দেয়, এই মেয়ে ততোই কাছে চলে আসে। বিয়ের পরপর যখন ওর সামনে পরতো তখন পথ ঘুরে অন্যদিকে চলে যেতো। ভয়ও পেতো। সেই ঝুমুরের হঠাৎ কি হলো কে জানে! তাখলিফ আস্কারা দেয়নি, তবুও ভালোবেসে ফেললো ওকে। এটা কি পবিত্র সম্পর্কের কোনো আশ্চর্য শক্তি নাকি অন্যকিছু জানে না সে। তবে ঝুমুরের মুখে তাকালেই সে কিছুটা প্রশান্তি অনুভব করে, একান্তই নিজের মানুষ হিসেব মনে হয়। ওর জন্য যখন সম্বন্ধ এসেছিলো তখন তাখলিফের কি ভীষণ হাঁসফাঁস লাগছিলো কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না সে। বরাবরই এমন হয়। এটাকে ভালোবাসা হিসেবে স্বীকার করে না ও, ভালোবাসা এত সহজ নয়! তবুও কি যেন একটা অনুভূতি, বুকের ভেতর অন্যরকম দোনা মোনা… কাকে বোঝাবে সে? এমন একটা মানুষ বলতে তো ওর কেউ নেই, গোলগাল চেহারার সদ্য তরুণীতে পা দেওয়া ঝুমুরটার কাছেই দিনশেষে ও ঠেকা!

_________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। বাকিটা কাল পাবেন ইনশাল্লাহ। তাখলিফকেও জানতে পারবেন, এখনো তো বাকি!!]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here