অপ্রিয়_রঙ্গনা #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-৮

0
107

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮

দরজা খুলে ইয়াসিফকে বউ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাখি বেগম মূর্ছা গেলেন! বাড়ির সবাই ইয়াসিফের কান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, পাখি বেগমের এ অবস্থা দেখে ধরাধরি করে সকলে ভেতরে নিয়ে গেলো। মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে হুঁশ ফিরিয়ে আনতেই পাখি বেগম হা হুতাশ করে কেঁদে ওঠে বললেন, “আমার শিক্ষায় কি ভুল আছিলো যে পোলা মা-বাপ বাদ দিয়া কেমনে এই কামডা করতো পারলো? ও আল্লাহ তুমি কি দিন দেখাইলা!!”

বলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলেন। বসার ঘরে ইয়াসিফ তুসিকে নিয়ে বসেছিলো। মায়ের হুঁশ ফিরেছে শুনেই একছুটে ঘরে গেলো। অপরাধী চোখমুখ নিয়ে মায়ের পায়ের কাছে বসে অকপটে বলল, “আমি তুসিকে ভালোবাসি আম্মা। সমস্যায় পড়ে এই কাজটা করতে হলো, নয়তো আপনাদের সবাইকে মানিয়ে নিয়েই করতাম।”

পাখি বেগম চিৎকার করে কেঁদে বললেন,”আমি কখনো মানবো না এই মাইয়ারে। আমার চান্দের
মতো সুন্দর পোলা ওই কালা মাইয়া নিয়া ঘর করব, আমি তা চাই না।”

ইয়াসিফের কথাটা শুনে খারাপ লাগলো ভীষণ। তবুও মা রেগে আছে ভেবে সে এ প্রসঙ্গে কথা এড়িয়ে বলল,
“ও খুব ভালো মেয়ে আম্মা। আপনার সব খেয়াল রাখবে।”

পাখি বেগম খ্যাঁকিয়ে ওঠলেন, “ভার্সিটিতে পড়া প্রেম করা ঢ্যাঙঢ্যাঙ মাইয়া ভালো? আর আমি খারাপ মা? তাই না? মায়ের চাওয়ার দাম দিলি না একটুও! এই তোরে নিয়া আমি গর্ব করতাম?”

পাখি বেগম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ইয়াসিফ অপরাধী গলায় বলল, “আমি নিরুপায় ছিলাম। আজ এই বিয়েটা না করলে ওর বাবা অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিতো। আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারি না। তাই বাধ্য হয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছি…”

এবার শামসুল হক রেগে গেলেন, “মহান কাজ করছো তুমি! সেইটা আবার বড় গলা কইরা বলতাছো! সাহস তো কম না! এই বংশে কেউ কোনোদিন হারাম সম্পর্ক কইরা জীবনে বিয়া করে নাই। আর তুমিই সেইটা কইরা দিলা। টাকাপয়সা খরচা করে পড়াশোনা করতে পাঠাইসিলাম, এইসব প্রেম-বিয়া না। এখনো একটা চাকরি জোগাড় করতে পারো নাই, তার আগেই বউ জুটাই ফেলছো। মা-বাপের চিন্তা নাই। যাও চোখের সামনে থেইকা দূর হও।”

বাবার কথা শুনে ইয়াসিফের মন ভেঙ্গে গেলো। কেউ কেন বুঝতে পারছেনা ওকে? সে তো বাধ্য হয়েছে এই অসময়ে বিয়েটা করতে। নয়তো বেকার অবস্থায় পালিয়ে বিয়ে করার ভাবনা ও কোনোদিন ভাবেনি। বাবা সবসময় চেয়েছে সে বড় চাকুরি করুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক যাতে ছেলেকে নিয়ে সবার কাছে গর্ব করতে পারে। আর মা তো সবসময় নিজের পছন্দমতো সুন্দর চামড়ার কোনো মেয়েকে
পুত্রবধূ করতে চেয়েছে। কেউ তো ওর মনের খবর রাখনি। ওরও যে ছোট্ট চাওয়াপাওয়া থাকতে পারে তা জানতে চায়নি! শ্যামলা রঙের মায়াবী মুখের অধিকারী এই তুসিকেই তো ও চেয়েছে সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে। যার দিকে তাকালেই এক বুক শান্তি অনুভব করে তাকে অন্য কেউ বিয়ে করে নিয়ে যাবে ভাবতেই কষ্ট হয় ইয়াসিফের। যে মেয়েটাকে এত আশা ভরসা দিয়ে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছে তাকে কি করে মুখ দেখাবে সে? মেয়েটা নিজের সব ছেড়েছুড়ে, ইউএসে স্যাটেল হওয়া পাত্র ছেড়ে ওর ভরসাতেই তো বাড়ি ছেড়েছে। ইয়াসিফ তবুও মায়ের হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে বলল, “আপনার ছেলে পছন্দ করে বউ এনেছে, তাকে একবার অন্তত পরখ করেই দেখুন না আম্মা! মেয়েটা আমার ভরসাতেই তো এসেছে, ও এসব দেখলে কষ্ট পাবে। আমার মুখটা ছোট করে দিয়েন না ওর কাছে!”

পাখি বেগম হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হায় হায় করে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “দেখছেন ইয়াসিফের আব্বা! এই কালনাগিনী দু-দিনেই মাথা খাইয়া নিসে আমার
ভালা পোলাডার। মায়ের কথা না ভাইবা সে বউয়ের কষ্টের কথা ভাবতেছে৷ এই দিন দেখার লাগি পোলা
বড় করসিলাম?”

বলে ডুকরে কেঁদে ওঠলেন৷ বাড়ির সকলে চুপ। বসার ঘরে তুসি বসে কাঁদছে। তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে ঝুমুর, নিশি-তিথি। সাজেদা বেগম এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার কথা বলে ওঠলেন, “মেজোবউ তুমি আর রাগারাগি কইরো না৷ পোলাডা না হয় একটা ভুল কইরাই ফালাইসে। এখন রাগটাগ বাদ দিয়া সমাধানের পথে আসো।”

পাখি বেগম চোখ মুছে দৃঢ় স্বরে বললেন, “কিসের সমাধান? এই বউ আমি জীবনেও মানমু না। হয় এই কালা বউ নিয়া ভাত খাইবো নয়তো মায়ের কথা শুনবো।”

সাজেদা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন, “নাটক-সিনেমা বাদ দেও বউ। ছোট ছোট পোলা-মাইয়া ওরা, বিয়াই তো করছে অপরাধ তো না! আর যার যার পছন্দ তার তার। আমার নাতি যদি এই বউ নিয়া সুখে থাকে, তাইলে আমাগো কি? তোমার পছন্দ দিয়া তো ওগো কাজ নাই।”

শ্বাশুড়ির কথা শুনে পাখি বেগম তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠলেন, “মা-ছেলের মধ্যে আপনে আসবেন না আম্মা। আপনার কাজই সবসময় কথার মাঝে ঢুইকা ভেজাল লাগানো। আমার পোলারে শাসন-বারণ করার অধিকার নিশ্চয়ই আমারও আছে। আপনি দাদী হইয়া মা-পোলার সবকাজে নাক গলাইয়েন না।”

সাজেদা বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন পুত্রবধূর কথা শুনে। অপমানিত বোধ করলেন তিনি। শামসুল হক স্ত্রীকে ধমক দিলেন মায়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলায়। পাখি বেগম তা কানে না তুলে অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলতেই থাকলেন। প্রমিলা এসে তাকে বুঝ দিতে চাইলেও তিনি তার কথায় অটল। শামসুল হকও ছেলের কাজে ভীষণ মর্মাহত হয়েছেন। খুব রেগে আছেন তিনি৷ সব মিলিয়ে নিরিবিলি বাড়ির দোতলায় প্রলয় ঘটে যাচ্ছে। আর এসবের জন্য তুসি নিজেকেই দায়ী করছে। ইয়াসিফ মা-বাবাকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেও তা কোনো কাজে দিলো না। পাখি বেগমের এক কথা, এই কালো বউকে যেকোনো মূল্যে তালাক দিতেই হবে। ইয়াসিফ পড়লো বিপাকে। মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেলো ওর। মনের সাথে যুদ্ধ করে মাকে বলল, “মানুষের চরিত্র যদি ঠিক থাকে গায়ের রঙে কিচ্ছু এসে যায় না আম্মা। আপনি কালো বলে ওকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন যেটা নিতান্তই হাস্যকর যুক্তি। আমার কাছে ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর একজন। আপনি যদি মানেন ভালো নয়তো আমার কিছুই করার নেই। আমি অন্য ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।”

পাখি বেগম কানে হাতচাপা দিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে বলল, “আল্লাহ গো! এই দিন দেখার লাগি পোলা বড় করসিলাম? আমি আর নিতে পারতেছিনা এইসব। এই পোলায় কয় কী?”

শামসুল হক ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বললেন, “হুমকি দেওয়া শিখেছো? বাহ! এতই যখন মুরোদ যাও বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় যাও। তোমার মতো সন্তানের দরকার নাই। দেখি কে হাতখরচা দেয়।”

ইয়াসিফ হতভম্ব হয়ে ক্ষণকাল পরে বলল, “জি চলে যাচ্ছি।”

শামসুল হক আরও রাগলেন,
“কি ভাবছিলা তুমি মনমতো বিয়ে কইরা আনবা আর আমি তোমার মতো বেকার ছেলের এই ধৃষ্টতা মেনে নিবো? মুরোদ নেই দুই টাকার আবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দেও? বেয়াদব কোথাকার।”

ইয়াসিফ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আব্বা আপনি কিন্তু অপমান করছেন আমায়!”

“বেশ করছি। আর তুমি কি করছো? বংশের মুখে চুনকালি লাগাইছো!”

মা-বাবার আহাজারি, চেঁচামেচিতে ইয়াসিফের ধৈর্য্যের বাঁধ ফুরিয়ে আসলো। একসময় প্রচন্ড অভিমানে না পেরে বলেই ফেললো, “সবসময় সবকিছু মানুষের ওপর চাপায় দিয়েন না আব্বা। বলতে বাধ্য হচ্ছি, ঝিনুকের বিয়েটাও আপনারা ওর মতের বিরুদ্ধে জোর করে দিয়েছেন৷ কি হলো? শহুরে মেয়ে গ্রামে গিয়ে হাত-পা পুড়িয়ে রান্না করে একশো এক মানুষের জন্য। পান থেকে চুন খসলেই কথা শোনে। এত ব্রিলিয়ান্ট একটা মেয়ে সে না করতে পেরেছে পড়াশোনা, না চাকরি। সারাদিন কলুর বলদের মতো সেবারাণী বানিয়ে পাঠাইসেন ওরে। কোনোদিন জানতে চেয়েছেন ও আদৌ ভালো আছে কিনা? না চাননি। এরপর আবার ঝুমুরের পিছনে লাগছেন, ঐ একই পরিবারে বিয়ে দিতে কত চেষ্টা আপনাদের! তলে তলে আপনি আর আম্মা যে কথাবার্তা এগিয়ে নিয়েছেন তাও আমি জানি। এখন আমাকেও কলের পুতুল বানাতে চান, পারবো না আপনাদের পুতুল হতে। নিজের সন্তানদের জীবন আপনাদের কাছে জীবন না যখন জন্মের পর মেরে ফেললেন না কেন? এত অশান্তি দিচ্ছেন আমাদের ভাইবোনগুলোকে আপনারা দুইজন যে কোনোসময় মনে হয় পাপের শাস্তি পাচ্ছি!”

পাখি বেগম চুপ মেরে গেলেন। শামসুল হক পুত্রের গালে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে দিলেন। সকলেই আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলো। বললেন, “বেরিয়ে যা কুলাঙ্গার। ভাবছিলাম মানুষ হবি, কিন্তু হইছোস আস্ত অমানুষ… ”

ইয়াসিফের রাগও আকাশচুম্বী হলো। ও সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে তুসিকে নিয়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। এখানে আর একটাক্ষণও থাকবে না সে। ঝুমুররা এসে ওদের আটকাতে চাইলো। কিন্তু ইয়াসিফ তুসিকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। জানে না কোথায় যাবে, কিন্তু এই জায়গায় আর নয়! ভেতর থেকে পাখি বেগমের চিৎকার-চেঁচামেচি আর শামসুল হকের বকাঝকা শোনা যাচ্ছে। বাড়ির বাইরে পা রাখতেই তাখলিফকে দেখা গেলো। রিকশা থেকে নামছে সে। অফিস থেকে ফিরেছে মাত্র। ইয়াসিফকে এমন অবস্থায় দেখে কিছুক্ষণ ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা
করলো। তুসিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল সে ইয়াসিফকে, “বিয়ে তাহলে করেই ফেলেছিস?”

বড় ভাইকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার মতো বেয়াদবি করা ইয়াসিফের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে সে দাঁড়ালো। দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে বলল, “ফেললাম!”

“বাড়িতে মানছে না?”

ইয়াসিফ বলল, “না। মা-বাবা ঝামেলা করছে।”

“কি বলে? আই মিন কি চাইছে ওরা? বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে নাকি?”

ইয়াসিফের গলা করুণ শোনালো,
“মা চায় তুসিকে যাতে আমি ছেড়ে দিই। কিন্তু এটা তো সম্ভব না। আব্বা বলেছে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। আপাতত এটাই সম্ভব আমার কাছে। তাই যাচ্ছি।”

তাখলিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তো এখন কোথায় যাবি?”

ইয়াসিফের পকেটে সব মিলিয়ে বারোশো টাকা পড়ে আছে। এই সামান্য টাকায় কি করে কি করবে বুঝতে পারছে না। ধীর গলায় বলল, “জানি না। দেখি আজ রাতটা হোটেলে কাটানো যায় কিনা!”

তাখলিফ ওর পিঠে চাপড় মেরে নির্লিপ্ত কন্ঠে
বলল, “চল।”

ইয়াসিফ ভ্রু কুঁচকালো, “কই?”

“ওপরে।”

ইয়াসিফ অবাক হয়ে বলল, “ওপরে মানে?”

তাখলিফ ধমক দিলো,
“আমাদের ফ্ল্যাটে। বাপ যখন ঘাড়ধাক্কা মেরে তার বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে যেতে বলেছে তখন না হয় চাচার বাড়িতেই থাক। তাছাড়া তুই তো এখন বেকার, বউ নিয়ে তো এই রাতে রাস্তায় ঘুরতে পারিস না। বড় ভাই হই তোর। দায়িত্ব আছে না?”

ইয়াসিফের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠলো। মাথা থেকে একটা চিন্তা দূর হলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “চিন্তামুক্ত করলে ভাইয়া।”

____________________

ঝুমুর দোতলার সিঁড়িঘরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মা-বাবা কেন এমন করে বুঝে পায় না
ও। দু’জন মানুষ একে-অপরকে ভালোবেসে যদি সুখী হতে চায় তাহলে সমস্যাটা কোথায়? নতুন বউকে নিয়ে ভাইটা রাগ করে চলে গেছে বিষয়টা হজম হচ্ছে না আপাতত। মেয়েটা কত স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছিলো সব ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। গায়ের রঙটা চাপা হলেও তুসি খুবই নিরীহ প্রকৃতির মেয়ে। সেই সাথে ভালো ছাত্রীও। ইয়াসিফ আর তুসি দু’জনেই সমবয়সী। চার বছরের প্রেম তাদের। কতশত সুন্দরী ইয়াসিফের পাশে ঘুরঘুর করেছে তার ইয়ত্তা নেই, তবুও ছেলেটা এই চাপা গায়ের রঙের মেয়েটার মাঝেই খুঁজে নিয়েছিলো অদ্ভুত মুগ্ধতা! প্রথম থেকেই ওদের
ব্যাপারে সব জানতো ঝুমুর। ফোনেও তুসির সাথে
কথা বলেছে বহুবার। এত ভালো একটা মেয়েকে মা এভাবে অপমান করেছে ভাবতেই খারাপ লাগলো ওর। ভাবনার মাঝেই দেখলো সিঁড়ি দিয়ে তাখলিফ ওঠছে। পেছনে ইয়াসিফ আর তুসি। দু’জনকে ফিরতে দেখে আনন্দে মনটা ডগমগ হয়ে ওঠলো ঝুমুরের। অবশ্য পরমুহূর্তেই তা বিলীন হয়ে গেলো। দেখলো দোতলায় না এসে ওরা তিনতলায় যাচ্ছে। ইয়াসিফ পেছনে ফিরে বোনকে বলল, “বাবার বাড়ি জায়গা হয়নি, তাই চাচার বাড়ি যাচ্ছি। বলে দিস সবাইকে। চাচা ফিরে নিশ্চিয়ই আমার বউকে মেনে নিবে।”

ঝুমুর হেসে ফেললো ভাইয়ের রসিকতায়। বড় চাচা বাড়ি থাকলে আজকের এসব চিৎকার, চেঁচামেচি কোনোটাই হতো না। ও একছুটে ভেতরে গিয়ে নিশি-তিথিকে খবরটা দিতেই ওরা খুশি হয়ে বলল, “ওদের জন্য আমরা বাসরঘর সাজাই না আপু? প্লিজ
প্লিজ।”

ঝুমুর মুখভার করে বলল, “দেখিস না বাড়ির সবার
কি অবস্থা? জানতে পারলে ক্যালাবে।”

নিশি বরাবরই একটু সাহসী। সে বলল, “ধুর বাদ দাও তো আপু। ভাইয়াকে বলো গিয়ে। সে ব্যবস্থা করে দেবে।”

ঝুমুর আড়ষ্ট বোধ করলো। সে তাখলিফকে জীবনেও এসব বলতে পারবে না। অগত্যা বাড়ির সবার চোখ এড়িয়ে নিশি-তিথিরাই গিয়ে জোরাজুরি করলো ওকে। তাখলিফ ঘর সাজানোর ফুলের ব্যবস্থা করে দিলো। ওদের ফ্ল্যাটে চারটা কক্ষ। সেখান থেকে একটা কক্ষ তুসি আর ইয়াসিফকে দেওয়া হলো। ঝুমুররা খাট সাজিয়ে দিলো ফুল দিয়ে৷ তাখলিফ বাবাকে ফোন দিয়ে সমস্ত কিছু জানিয়ে বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করলো। তুসি কান্নার চোটে কিছুই প্রায় খেতে পারলো না। ইয়াসিফ অসহায় বোধ করলো তা দেখে৷ সকলের সামনে সান্ত্বনাও দিতে পারছে না মেয়েটাকে। তাখলিফ তা বুঝতে পেরে ওঠে বারান্দায় চলে গেলো। সকলে মিলে তুসির কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। একটা সময় ঝুমুরও ওঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ঘাড় ফিরিয়ে ওকে একপলক দেখেই তাখলিফ জিজ্ঞেস করল, “কান্নাকাটি বন্ধ করেছে?”

ঝুমুর শুকনো মুখে বলল, “হুম।”

তাখলিফ সোজা হয়ে দাঁড়ালো,
“তোর আবার কি হলো?”

ঝুমুর চিন্তিত স্বরে বলল, “আজ যা হলো! ভাবছি আমাদের বিয়ের খবর জানতে পারলে কি হবে?”

তাখলিফ তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল, “কি আর হবে! তোকে জুতাপেটা করবে, আমাকে অপরাধী বানিয়ে পুলিশে দেবে। আমার জীবনটা ছাড়খাড় হয়ে যাবে। তোকে আবার অন্য জায়গায় বিয়ে দেবে। তোর তো আবার সাদা চামড়া, বিয়ের বাজারে অনেক মূল্য হবে! তোর মা-বাপ মনমতো পাত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে দুশ্চিন্তা মুক্ত হবে।”

ঝুমুর কল্পনা করেই ভয়ার্ত চোখে তাকালো। এরপর হাসার চেষ্টা করে বলল, “না এমনটা হবে না।”

তাখলিফ নির্বিকার স্বরে বলল, “এমনটাই হবে। সেদিন আর দূরে নয়। আমি বাবা জেলে যেতে চাই না৷ তাই এসব ফাঁস করা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। অবশ্য তুই আমাকে জেলের ভাত খাওয়াতে চাইলে পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিতেই পারিস।”

ঝুমুর বিরক্ত হয়ে বলল, “সবসময় বাজে কথা আপনার। শুনুন! প্রথমে সবাই অমন রাগটাগ করে, পরে ঠিকই মেনে নেয়। আমাদেরটাও তাই হবে।”

তাখলিফ ঝমুরের সামনে এসে ওর দিকে
তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল, “না হবে না।”

__________________________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। বড় পর্ব, কমেন্ট করবেন। একটু অনিয়মিত হবো। দুঃখিত।]

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here