#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪
ঝুমুর বিরক্ত ভঙ্গিতে চুল কানের পেছনে গুঁজে মাথায় ওড়না টেনে দিলো। তাখলিফ চোখ সরিয়ে খাবারে মনোযোগ দিয়ে বলল, “ইদানীং বউ বউ লাগছে তোকে ঝুমুর।”
ঝুমুর শুনে ফেললো সেটা। ঘাড় ঘুরিয়ে বিস্মিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো, “কি বললেন?”
তাখলিফ কেশে ওঠলো। তড়িঘড়ি করে বলল,
“ভুল শুনেছিস তুই। বিশ্বাস কর ঝুমুর!”
ঝুমুর অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। সবকিছু কেমন হালকা লাগছে। গত দুই বছরে লোকটা একবারও তো এভাবে বলেনি ওকে! ঝুমুর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তাখলিফের দিকে। ওকে অবাক করে আলতো করে ওর বুকে মাথা রেখে শান্ত স্বরে বলল, “ভুলটা তো মিথ্যে না বরংচ খুব মধুর। আপনি সবসময় এমন ভুল করবেন। আমি কত অপেক্ষায় থাকি জানেন?”
তাখলিফ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। ইচ্ছে করে এরকম বলেনি, মুখফুটে বেরিয়ে গেছে। একটু বেশিই ভেবে ফেলেছিলো ও, নিজেকে তাই সামলাতে পারেনি। সবসময় সবকিছু পাওয়ার আশা করাটা বোকামি। আর ঝুমুরের কিশোরী বয়সের আবেগকে আস্কারা দিয়ে ওর ভবিষ্যৎ দুর্বিষহ করতে পারবে না সে। এই মেয়ে কতটা ওকে চায় তাখলিফ সেটা টের পায়! কিন্তু এর আগে কখনোই ঝুমুর এমন আচরণ করেনি। তাখলিফ বিব্রত গলায় শুধু বলে, “কি করছিস? সর।”
ঝুমুর জেদী গলায় বলে, “সরবো না।”
“বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু।”
“হোক। আপনি আমাকে সবসময় দূরছাই করেন।”
“এসব কিন্তু ঠিক হচ্ছে না, তুই পরে ঠিক বুঝতে পারবি।”
“বোঝার দরকার নেই। আমার শুধু আপনি হলেই চলবে।”
ঝুমুরটা যেন নিজের মধ্যে নেই। তাখলিফ রুক্ষ স্বরে বলে, “না। তুই স্বার্থপরের মতো এতদূর ভাবতে পারিস না৷ সামান্য কারণে আমাদের পরিবারকে তুই কষ্ট দিতে পারিস না। তোর চোখে এখনো রঙিন চশমা আছে, তুই তাই সামনের দিনগুলো দেখতে পাচ্ছিস না। রঙিন চশমাটা যেদিন খুলবি আর বাস্তব জগৎটাকে উপলব্ধি করবি দেখবি আমি ছাড়াও এই পৃথিবীতে তোর আশেপাশে অনেক মানুষ আছে, যারা তোর কাছে অনেক কিছু আশা করে। তখন তুই নিজেই কষ্ট পাবি।”
ঝুমুর ওকে ছাড়লো না। বরংচ আরও শক্ত করে ওর বুকে মাথা রেখেই বলল, “আপনার থেকে দূরে যাওয়ার কষ্টের চেয়ে সেসব কষ্ট কিছুই না। আমি সব মেনে নেবো, কিন্তু আপনি আমায় দূরে ঠেলে দিলে তা মানতে পারবো না। আমি জানি না মৃত্যু যন্ত্রণা কেমন, তবে আপনি আমায় সরিয়ে দিলে আমি ঠিক ততটাই যন্ত্রণা, দুঃখ পাবো।”
“আমি এতবড় হনু হয়ে যাইনি যে আমার জন্য তুই
দুঃখ পাবি।”
ঝুমুর বিষন্ন গলায় প্রশ্ন করে,
“এইযে, পাচ্ছি! এটাকে কি বলবেন?”
“কিশোরী বয়সের আবেগ!”
ঝুমুর হেসে ফেললো, “কিশোরী বয়স ছেড়ে তরুণীতে পদার্পণ করেছি। আমি এখন আগের চেয়ে আরও বুঝদার হওয়ার চেষ্টা করছি। আপনি তো কিছুই
দেখেন না!”
তাখলিফ অস্বস্তি নিয়ে বলল, “হু। আমার কাছে তুই সবসময় ছোটই রয়ে যাবি। আমি তোকে বড় ভাবতে পারি না।”
“বড় ভাবলেই তো বউয়ের মর্যাদা দিতে হবে৷ আমি জানি না বুঝি?”
তাখলিফ চমকে ওঠে পরক্ষণেই ভ্রু কুঁচকালো,
“তুই কি আমাকে কাপুরষ ভাবছিস?”
“নাহ। আমি পরিস্থিতি বুঝি। আপনি তো আমার
নিজের পুরুষ!”
তাখলিফ অবাক হয়ে শুধু দেখে এই রমণীটিকে।
এত গভীর কথা কোথা থেকে শিখলো ও? সেদিনের লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে কান্নায় বারবার মূর্ছা যাওয়া বউরুপী ষোলো কি সতেরো বছরের ঝুমুরের মুখটা হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যেন ওর মন-মস্তিষ্কে! সুন্দর দেখাচ্ছিলো নাকি খেয়াল করেনি সে! এই দু’বছরেও নয়! তবে আজ কেন ইচ্ছে করছে? পরক্ষণেই বাস্তবে ফিরে এলো তাখলিফ! দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি তো তোকে এখনো নিজের কিছু ভাবি না। তাহলে তুইও এসব ভাবিস না। পড়াশোনায় মনোযোগ দে আর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল কর।”
ঝুমুর এসব শুনে ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমি তো আর আপনার মতো নই৷ তাছাড়া আপনি ভাবেন না কারণ আপনার মন নেই। মনহীন মানুষ কীভাবে অন্যের মন বুঝবে? তাই এসব বলে আমাকে ভোলানোর চেষ্টা করবেন না। আপনি মানুন আর না মানুন আমিই আপনার অর্ধাঙ্গিনী। তাই…”
কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই তাখলিফ চেয়ারে লাথি মেরে ফেলে দিলো। এরপর বলল, “নিশি-তিথি, ঝিনুকের মতোই তুই আমার কাছে। ছোট্ট একটা
ঘটনার জন্য তোর সাথে আমার সম্পর্কের পরিবর্তন হবে না। এক্ষুণি বেরিয়ে যা এখান থেকে।”
“নিয়ম করে ফোন বা ম্যাসেজে আমিই আপনার
খোঁজ নেই। নিশি-তিথি বা ঝিনুক আপু না।”
বলে ঝুমুরও আর এক পা দাঁড়ালো না। নিজেকে
ধাতস্থ করে সোজা বেরিয়ে গেলো। সত্য কঠিন হলেও সত্যই থেকে যাবে৷ ভুজুংভাজুং বুঝ দিয়ে মিথ্যে প্রমাণ করা যাবে না।
__________________
রাতের আকাশে অর্ধচাঁদ। ঝুমুরের টেবিলের ওপর ফোন বাজছে। নিশি এসে অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালিয়ে জানালার পাশে বসে চন্দ্রসুধা উপভোগ
করতে থাকা ঝুমুরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কখন
থেকে ফোন বাজছে। আপু তুমি শুনতে পাওনা?”
ঝুমুর সংবিৎ ফিরে পেয়ে ফিরে তাকালো। ফোনটা টেবিলের ওপর থেকে নিয়ে নিশিকে বলল, “খেয়াল করিনি।”
“কোথায় যে হারিয়ে যাও আজকাল….”
বলে নিশি চলে গেলো। ঝুমুর দরজা এঁটে আলো নিভিয়ে ফোন ব্যাক করলো। ইয়াসিফ রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করল, “ব্যস্ত নাকি? কতক্ষণ ধরে ট্রাই করছি!”
ঝুমুর লজ্জিত স্বরে উত্তর দিলো, “না ভাইয়া।
বলো কি বলবে?”
“কিছু না৷ তোর সাথে কথা বলে সময় কাটাতে চাইছিলাম!”
ঝুমুর ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমার না এক্সাম? আমার সাথে গল্প করলে পড়বে কখন?”
“মুড নেই পড়ার। এখন তোর সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে।”
“কেন? তোমার গার্লফ্রেন্ড কই?”
ইয়াসিফ হেসে ফেললো, “ওরও তো পরীক্ষা। বেচারিকে ব্যস্ত করা কি ঠিক? সারামাস তো কথা বলিই, এই ক’টা দিন না হয় নিজেকে দিক, এক্সামে ভালো করতে হবে তো!”
ঝুমুর ব্যঙ্গ করে বলল, “তোমার রেজাল্ট ভালো না হলে তোমাকে ভাবির পরিবার বুঝি মেনে নেবে?”
ইয়াসিফ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, “নিতে বাধ্য। নয়তো তাদের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাবো।”
ঝুমুর হাসতে হাসতে বলল, ” এদিকেও বিপদ ভাইয়া। মা তো মাদ্রাসা পড়া ছেলের বউ চায়, এসব শুনে শেষে না ঘুমের ঔষধ খেয়ে নেয় আমি তো ভয়েই আছি।”
ইয়াসিফ ভড়কে গেলো, “আসলেই নাকি? কিন্তু আমি তো তুসিকে ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারি না। ধুর… নাহ! আমার তো তুসিকেই চাই। দরকার পড়লে মায়ের পায়ে ধরে মাকে রাজি করাবো…”
ভাইয়ের কথা শুনে ঝুমুর ওকে ভয় দেখিয়ে বলল,
“ভয়াবহ বিপদ ভাইয়া!”
ইয়াসিফ জোর গলায় বলল, “সে আমি সামলে নেবো। সবাইকে মানিয়ে নেবো…”
ঝুমুরের হাসিখুশি চেহারাটা পাল্টে গেলো মুহূর্তেই।
কিছু একটা ভেবে এরপর বলল, “আচ্ছা ভাইয়া, তুমি বিব্রতবোধ করো না? তোমার আগে ছোট বোনের বিয়ে হয়ে গেলো তাও তোমার প্রিয় বড় ভাইয়ের সাথে?”
ইয়াসিফ থমকে গেলো। অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, “তুই ভালো আছিস?”
ঝুমুর কেঁদে ফেললো, “না নেই, একদম নেই।”
ইয়াসিফ অপরাধী গলায় বলল,
“তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না।”
ঝুমুর ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, “মা জানলে আমাকে আস্ত রাখবে না ভাইয়া। এতদিন ধরে কীভাবে সবকিছু লুকিয়ে রেখেছি তা শুধু আমিই জানি। আমি কি করবো? আজকাল আমার খুব ভয় হয়!”
ইয়াসিফ নিজেও চিন্তিত। তবুও বোনকে সে
বুঝ দিলো, “এত ভাবিস না। মা সরলসোজা, তাই বলে নির্দয় নয়।”
ঝুমুর অভিযোগের সুরে বলে, “মা তো ভাইয়াকে একটুও পছন্দ করে না৷ তুমি তো চেনো মাকে। সেদিন তুমি পাত্রকে পিটিয়ে বিদেয় করার পর মা যাচ্ছেতাই অপবাদ দিয়েছে ওনাকে। এমনল বলেছে ওনি যদি মায়ের পেটের ছেলে হতো তাহলে গলাটিপে মেরে ফেলতো। তুমি নাকি ওনার কথা শুনে নষ্ট হয়ে গেছো…”
ইয়াসিফ বোনের কথা শুনে বলল, “তুই ভাইয়াকে ভালোবেসে ফেলেছিস তাইনা?”
ঝুমুর নাক টেনে বলল, “খুব।”
ইয়াসিফ হাসলো। বোনকে আশ্বস্ত করতে বলল, “যাই হোক না কেন ঝুমু, আমি তোদের মিল করিয়ে দেবো। ভরসা করিস তোর ভাইয়াকে।”
ঝুমুর বিষন্ন গলায় বললো, “ওনি তো পারে না শুধু আমার গায়ে হাত ওঠাতে। তুমি কিভাবে মিল করাবে? শেষে তোমাকেও পেটাবে। আমার জন্য তোমার মার খাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
ইয়াসিফ হাসলো, “আমার চঞ্চল ঝুমুরটাও এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। বাই দ্যা ওয়ে, ভাইয়া কি আমার বোনকে মারধর করে নাকি?”
ঝুমুর লজ্জা পেয়ে বলল, “আরে না, কথার কথা…”
বলে ফোন কেটে দিলো। ধুর! ভাইকে এসব কি
বললো সে? ঝুমুর নিজের মাথায় নিজেই চাপড়
দিলো। তখনি দরজায় ঠুকঠুক শব্দ হলো। ঝুমুর “কে” জিজ্ঞেস করতেই নিশির গলা শোনা গেলো। ঝুমুর
গিয়ে দরজা খুলতেই নিশি অসহায় স্বরে বলল, “আপু ভাইয়াকে খাবার দিয়ে আসো না। আমার পড়া বাকি, দাদী চেঁচামেচি করছে!”
“আমি পারবো না।”
“প্লিজ আপু।”
“তুই যা…”
নিশি ওর হাত ধরে অনুনয়-বিনয় শুরু করলো ওকে। ঝুমুর বাধ্য হয়ে তাই রাজি হলো। নিশি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলো। ঝুমুর ঠিক করলো সকালের দুর্ব্যবহার করার জন্য তাখলিফের সাথে কথা বলবে না। যেই ভাবা সেই কাজ! কলিংবেল বাজিয়ে দরজা খুলার অপেক্ষা করতে থাকলো। দরজা খুলতেই তাখলিফকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে গিয়ে খাবার রেখে ঠাস করে চলে এলো ঝুমুর। তাখলিফ দরজা লাগাতে লাগাতে ভাবলো এর আবার কি হলো! প্লেটে খাবার নিতে গিয়ে দেখলো একটা চিরকুট। সেখানে লিখা, “সকালের দুর্ব্যবহার ভুলিনি। ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত আপনার সাথে কথা বলবো না।”
তাখলিফ দু’বার পড়ে চিরকুটটা। এরপর দুমড়েমুচড়ে পকেটে রেখে বলে ওঠে, “নাটকবাজ মেয়ে একটা।”
_____
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
চলবে….