অপ্রিয়_রঙ্গনা #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-৩

0
133

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩

“এমনভাবে বলছিস যেন তুই আগে অনেক
বিয়ে করে রাখছিস!”

দাদীর ঠাট্টা শুনে ঝুমুর হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে।
মাথা কাজ করছে না কেন আজ? বারবার ভুলভাল কথা বলছে। কেন বলছে নিজেও জানে না। অথচ যার জন্য ওর এই অবস্থা সেই লোকটা দিব্যি আছে! এদিকে তার জন্য ভেবে ভেবে ঝুমুরের মাথা খারাপ হওয়ার দশা!

ঝুমুরের পাংশুটে মুখভঙ্গি দেখে সাজেদা আর প্রমিলা নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করলেন। আবারও ভাবনায় ডুবে গেছেএই মেয়ে। ওর মনোভাব তারা কেউই বুঝতে পারছে না। আগে যতটা চঞ্চল, হাসিখুশি, উৎফুল্ল ছিলো এখন তার কানাকড়িও যেন নেই। সুন্দর পানপাতার ন্যায় মুখখানা এতটুকু হয়ে গেছে, যেন রাজ্যের সব চিন্তা ঘুরে
ওর মাথায়। এতটুকু বয়সে এই মেয়ের কি এমন হলো বাড়ির কেউই ভেবে বের করতে পারে না। ঝুমুরকে আনমনা দেখে সাজেদা ওর পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে
জিজ্ঞেস করলেন, “হারাইলি কই?”

হকচকিয়ে ওঠলো ঝুমুর। থতমত খেয়ে বলল,
“কই, কোথাও না তো!”

নাতনির সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ মনে
পড়ে যাওয়ায় সাজেদা বেগম বললেন, “ভুইলা গেসি। সানওয়ার তো বাড়ি নাই। আমার নাতিডা রাইতে খাইবো কি? এই ঝুমুর ওরে বইলা আসিস তো আমাগো এখানে খাইতে! আমার নাতিডার খেয়াল কেউ রাখোস না
তোরা। সব স্বার্থপর।”

ঝুমুর একটু অবাক হলো। চাচা বাড়ি নেই তারমানে লোকটা দুপুরেও নিশ্চয়ই খায়নি। এইজন্যই তখন মুখটা শুকনো দেখাচ্ছিলো। ও কত করে সাধলো অরেঞ্জ কেকটা খাবে কি-না! লোকটা নিজের ইগো বজায়ই রাখলো। খেলে এমন কি হতো? দাদীর কথায় শুনে ঝুমুর তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“ভুল বকো না তো। সবাই স্বার্থপর না, বড় স্বার্থপর তোমার প্রিয় নাতিই।”

সাজেদা তেঁতে ওঠলে, “মা মরা পোলাডারে স্বার্থপর কইলি? সোনার টুকরো নাতি আমার!”

ঝুমুর বিব্রত গলায় বলল, “মাফ করো। আমি বলে আসবো। চলো এখান থেকে, তেল দিয়ে তোমার মাথা ঠান্ডা করে দিই।”

বলে দাদীকে একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেলো সে। প্রমিলা বেগম তা দেখে হাসছেন!

________

তাখলিফ বারান্দায় চেয়ারের ওপর পা তুলে বসে আছে। হাতে কফির মগ। অফিস থেকে ফিরে
কাপড় পর্যন্ত বদলায়নি এখনো। সানওয়ার সাহেব ব্যবসায়িক কাজে চট্টগ্রাম গেছেন। পুরো ফ্ল্যাটে সে একা। একা থাকলে ওর কিছু করতে ইচ্ছে করে না। রান্নাও না। দুপুরে অফিসে লাঞ্চ নিতেও ভুলে গেছে সে। পেটে ক্ষিধে মোচড় দিলেও রান্নাঘরে যেতে একদম ইচ্ছে করলো না। বাধ্য হয়ে ফুডপান্ডা থেকে খাবার অর্ডার করার জন্য ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো ঝুমুর ম্যাসেজ পাঠিয়ে রেখেছে, “বড়চাচ্চু নেই বাসায়, দুপুরে নিশ্চয়ই খাননি। দাদী আপনাকে আমাদের এখানে খেতে বলেছে। নয়তো রাগ করবে। প্লিজ আসবেন।”

ম্যাসেজ দেখে তাখলিফ চুপচাপ বসে রইলো। ফুডপান্ডায় অর্ডার দেওয়ার ব্যাপারটা বাদ দিলো সে। কফির মগে চুমুক বসাতে বসাতে বলল, “দাদী না তুই রাগ করবি ঝুমুর? বোকা, গর্দভ একটা।”

_____________

রাতের খাবার টেবিলে তাখলিফকে গদগদ ভঙ্গিতে
এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে সবাই। পাখি বেগম বিরক্ত ভঙ্গিতে তা দেখছেন আর ভেতরে ভেতরে চাপা রাগে ফুঁসছেন। তবে ভেতরের এই উত্তপ্ত অবস্থার কথাটা কারো কাছে খোলাখুলি বলতে পারছেন না। কি অসহনীয় যন্ত্রণা! বড় জা তার খুব প্রিয় ছিলো। তাখলিফকেও বরাবরই ছেলের মতোই দেখেছেন। কিন্তু বড় জা’য়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থেকে এই ছেলেই হয়ে ওঠেছে তার চক্ষুশূল। এর কারণটা নিজের ভেতরে চেপে রাখলেও বাড়ির সম্মানের কথা ভেবে কাউকে জানাতে পারেনি আজ পর্যন্ত! আর জানালেও কেউ বিশ্বাস করবে না তাকে। পাখি বেগম স্বামীর পাতে মাছভাজা তুলে দিতেই শামসুল হক স্ত্রীকে বললেন, “আমাকে না। তাখলিফকে দাও আরেকটা মাছ। ওর তো ইলিশ খুব পছন্দ।”

মেজোচাচার কথা শুনে তাখলিফ একবার পাখি বেগমের দিকে তাকালো। চাচীর আঁধার মুখভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে কতক্ষণ চাপা হাসলো। এরপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “লাগবে না৷ আমার খাওয়া শেষ আপাতত।”

সাজেদা খেঁকিয়ে ওঠলেন, “দুই মুঠো খাস নাই, শেষ হইলো ক্যামনে? এই ঝুমু ওরে আরও ভাত দে। শরীরে হাড্ডি ছাড়া কিচ্ছু নাই পোলাডার।”

শ্বাশুড়ির আদিক্ষেতা দেখে পাখি বেগম অসহ্যকর হয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে। শামসুল হক আর সাঈদ হক খাওয়া সেরে ড্রয়িং রুমে গিয়ে আলাপ জুড়েছেন। এতক্ষণে নিশি-তিথি একটু সুযোগ পেয়ে দাদীকে বলল, “এটাই এখনকার ট্রেন্ড দাদী। মোটা, ভুড়িওয়ালা ছেলেদের এখন কেউ গোণায় ধরে না। বুঝলা? ভাইয়া ফিট আছে সেদিক দিয়ে।”

প্রমিলা মেয়েদের চোখ রাঙাতেই ওরা চুপ করে গেলো। সাজেদা বেগম দুই নাতনিকে খাবার কম খাওয়ার কুফল বোঝাতে গিয়ে গল্প জুড়ে দিলেন। গল্পের মূল বিষয়বস্তু তাখলিফ। ঝুমুর চুপচাপ এসব শুনছে আর মিটিমিটি হাসছে। সে অগোচরে তাখলিফের প্লেটে আরও বেশি করে ভাত আর তরকারি দিতেই ও চোখ রাঙিয়ে তাকালো। এই মেয়েটা ইচ্ছে করে এসব করছে। তাখলিফ তখন নিজেও ভাতের বোলটা নিয়ে ঝুমুরের প্লেটে সব ভাত ঢেলে দিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে দাদীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমার খাওয়া শেষ।”

সাজেদা বেগম জহুরি চোখে পাত লক্ষ্য করে
বললেন, “সেকি! প্লেটে তো সব পইড়াই আছে।
কিচ্ছু মুখে দিলা না নাতি।”

“যেগুলো আছে সেগুলো তোমরা সবাই মিলে খেয়ে নাও। যাচ্ছি আমি। ডিস্টার্ব করবে না কেউ।”

বলে হাত ধুয়ে চলে গেলো তাখলিফ। পাখি বেগম এসে এতসব ভাত-তরকারি নষ্ট করেছে দেখে বিরক্ত কন্ঠে বললেন, “এতবড় ছেলের আক্কেল জ্ঞান দেখো! ভাত কিনতে পয়সা লাগে না তাইনা? আম্মা আপনে কিছু কইলেন না কেন? বেয়াদ্দব হইসে একটা। অবশ্য শিক্ষা তো পায়নাই।”

সাজেদা পুত্রবধূকে কড়া গলায় বললেন, “শিক্ষা তো তুমিও দিতে পারতা। তা না করে ওরে দূরে ঠেইলা দিসো। যাইহোক, পুরানা কথা তুলতে চাই না। কথা কইলেই কথা বাড়ে। তাই চুপ কইরা যাও।”

শ্বাশুড়ির কথা শুনে পাখি বেগম মুখভার করে
সেখান থেকে চলে গেলেন। ঝুমুর বোকার মতো বসে রইলো। সে তো জানতো এই লোকটা রগচটা, শুধু শুধু খাবারগুলো নষ্ট করলো। অবশ্য দোষ তো ঝুমুরেরই। সে কেন আগ বাড়িয়ে এসব করতে গেলো? আবার খারাপও লাগছে, ওর জন্য মানুষটাকে এত কথা শুনতে হলো! মা কখনোই স্বাভাবিকভাবে কথা বলে না তাখলিফের ব্যাপারে, ওর
প্রতি কি যে এক চাপা রাগ আছে মায়ের; কে জানে! ঝুমুর ঘরে গিয়ে তখনকার আচরণের জন্য তাখলিফকে “স্যরি”
লিখে ম্যাসেজ করলো।

ম্যাসেজ সিন হলো কিন্তু উত্তর এলো না। এবং সেটা কখনোই আসবে না। জানে ঝুমুর! এরপরেও খারাপ লাগে, কষ্ট হয়! জানালা গলে আসা চাঁদের আলোয় ঝলমল করা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে অভিমানী, ব্যথাতুর স্বরেই ও বলে, “আমাদের জীবনটা কেন এমন হয়ে গেলো? কিভাবে সবকিছু ঠিক হবে? আমি যে দিনদিন ভীষণ লোভী হয়ে যাচ্ছি। আপনি কি কিছুই বুঝেন না? নাকি ভান ধরেন?”

ওর এত এত প্রশ্নের প্রতিউত্তর আসে না। চিত্তজুড়ে তীব্র অভিমান জমা হয়। নিশ্চুপ রজনীর আঁধারে হারিয়ে যায় অষ্টাদশী ঝুমুরের ছোট্ট হৃদয়ে জন্মানো ভালোবাসারা!

________________

খুব সকালেই ঘুম ভেঙে গেলো ঝুমুরের। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতেই প্রমিলা আর পাখি বেগম রান্না বসিয়েছেন। মেয়েকে দেখে পাখি বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “এত সকালে ঘুম থেকে ওঠেছিস কেন মা? ক্লাসটাস আছে নাকি?”

ঝুমুর মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, নেই। এমনিই ভেঙে গেছে। কি বানাচ্ছো নাস্তায়?”

“আলুর পরোটা। ভাতও আছে।”

ঝুমুর মুখভার হয়ে গেলো। তাখলিফ আলুর পরোটা খায় না। ও ছোট্ট করে বলল,
“ওহ।”

“চা খাবি?”

“দাও।”

এদিকে সাজেদা প্রমিলাকে ডেকে বললেন তাখলিফের জন্যও নাস্তা বানাতে। প্রমিলা ওর জন্য খিচুড়ি আর পাটিসাপটা পিঠা তৈরি করে দিলো। ঝুমুর আশেপাশে ঘুরাঘুরি করায় ওকে দিয়েই তিনতলায় পাঠালেন। কলিংবেলে চাপ দিয়ে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। অনেকক্ষণ পর উদোম শরীরে তাখলিফ ঘুমঘুম চোখে এসে দরজা খুলে ওকে দেখে হতচকিত হয়ে গেলো। ঠাস করে দরজা বন্ধ করে গায়ে গেঞ্জিটা চাপিয়ে আবারও দরজা খুলে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত ঝুমুরকে ধমক দিতে গিয়েও দিলো না। সরে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিয়ে বলল, “আমাকে বিরক্ত না করলে তোর চলে না, তাইনা?”

ঝুমুর ওর কথায় রাগ না করে ডাইনিংয়ের ওপর খাবারগুলো রেখে এরপর বলল, “এখনো ঘুমাচ্ছেন যে, অফিসে যাবেন না?”

তাখলিফ বিরক্ত গলায় বলল, “যাবো না৷”

“কেন?”

“এত কৈফিয়ত চাস কেন? কি এনেছিস সেটা বল।”

“আপনার নাস্তা।”

তাখলিফ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কার বুদ্ধি? নিশ্চয়ই তোর?”

ঝুমুর বিরক্তি চাহনি নিক্ষেপ করে বলল, “আমার বয়েই গেছে। আপনার শ্রদ্ধেয় দাদীর কাজ এসব।”

তাখলিফ ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এসে বলল,
“কেন? তোর বয়েই গেছে কেন?”

ঝুমুর উত্তর না দিয়ে রান্নাঘর থেকে প্লেট-বাটি, চামচ নিয়ে এলো। এরপর খাবার বেড়ে দিতে দিতে ভাবলেশহীন গলায় বলল, “এত কথার জবাব দিতে পারবো না৷ খেয়ে নিন।”

চেয়ার টেনে বসে পড়লো তাখলিফ। খেতে খেতে আড়চোখে দেখলো ঝুমুর ওর অগোছালো বিছানা-বালিশ গুছিয়ে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। জানালা খুলে দিতেই দৈবাৎ একগুচ্ছ হাওয়া এসে ওর একগাছি চুল ওড়িয়ে দিচ্ছে। ঝুমুর বিরক্ত ভঙ্গিতে চুল কানের পেছনে গুঁজে মাথায় ওড়না টেনে দিলো। তাখলিফ চোখ সরিয়ে খাবারে মনোযোগ দিয়ে বলল,
“ইদানীং বউ বউ লাগছে তোকে ঝুমুর।”

ঝুমুর শুনে ফেললো সেটা। ঘাড় ঘুরিয়ে বিস্মিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো, “কি বললেন?”

তাখলিফ কেশে ওঠলো। বিব্রত ভঙ্গিতে তড়িঘড়ি করে বলল, “ভুল শুনেছিস তুই। বিশ্বাস কর ঝুমুর!”

______________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here