অন্তহীন💜 #পর্ব_১৫ #স্নিগ্ধা_আফরিন

0
188

#অন্তহীন💜
#পর্ব_১৫
#স্নিগ্ধা_আফরিন

গোধূলির মেহেদীরাঙা অন্তরীক্ষ পরিযায়ী পাখিদের দখলে। সায়াহ্নের প্রহর ঘনিয়ে এসেছে।ব্যস্ত নগরীর কোলোহল বেড়ে গেছে। গাড়ির বিরক্তিকর হর্নের শব্দে মুখরিত চার পাশ।ঘরে ফেরার জন্য ব্যস্ত যে যার মতো।
বিশাল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নিরিবিলি এক জায়গায় হাঁটুতে কনুই রেখে মুখে হাত দিয়ে বসে আছে প্রহন। নিজের উপর চরম বিরক্ত সে। মেয়েটা কে একটু বলে আসলে কী এমন ক্ষতি হতো? পরক্ষনেই মন বলে উঠে,
“অসুস্থ ছিল তো। সারারাত ছটফট করে সকালের দিকে ঘুমিয়ে ছিল।কী করে এই অসুস্থ মেয়েকে জাগিয়ে দিতাম আর?”বিষন্ন অবস্থায় হঠাৎ আনমনে হেসে ফেললো প্রহন। একটা কথা মনে পড়তেই এক ঝাঁক ভালো লাগা এসে ছুঁয়ে গেলো। গভীর নিদ্রায় মগ্ন কিশোরীর কপালে অধর ছুঁয়ে দেওয়ার কথা যে প্রহন ছাড়া কেউ জানে না। সেই নিদ্রাময়ী ও না।
বিয়ে করতে না করতেই মেয়েটার প্রতি একটা আলাদা অদৃশ্য টান কোথা থেকে চলে এলো বুঝতে পারে না প্রহন।বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।সিও স্যার এর সাথে দেখা হয়েছে। কথা ও হয়েছে। মানুষ টা যথেষ্ট ভালো। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এর মতো রাগী না।যদিও
প্রহনের সাথে কখনো রেগে কথা বলেনি তবুও তাকে ভালো লাগে না প্রহন এর।
.
রেদোয়ান চৌধুরী সন্ধ্যার পর ডাক্তার নিয়ে আসেন। বিছানার সাথে মিশে আছে চৈতির দেহ। উঠে দাঁড়ানোর ও শক্তি নেই তার শরীরের মধ্যে। সরদার সাহেব বিকেলে ফোন করলে মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনে জুনাইদা কে নিয়ে রেদোয়ান চৌধুরীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মিসেস ইয়াসমিন চৈতির মাথায় পানি ঢেলে মাথা মুছিয়ে বালিশের উপর শুইয়ে দিলেন।
জ্বরে একে বারে ঘায়েল হয়ে গেছে মেয়েটা।ডাক্তার চৈতির শারীরিক অবস্থা দেখে স্যালাইন পুশ করে দেন। শরীর একে বারেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। থার্মোমিটারে শরীরের তাপমাত্রা মাপলে তা ১০৪ ডিগ্রির ঘরে গিয়ে থামে। ঔষধ লিখে দিয়ে ডাক্তার বিদায় নিলেন। রেদোয়ান চৌধুরী মিসেস ইয়াসমিন কে চৈতির পাশে থাকতে বলে ডাক্তার কে এগিয়ে দিয়ে ফার্মেসি থেকে ঔষধ নিয়ে আসবেন জানিয়ে চলে যান।
মিসেস ইয়াসমিন এর ফোন বেজে ওঠে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখেন প্রহন ভিডিও কল দিয়েছে। মিসেস ইয়াসমিন কল রিসিভ করতে না করতেই চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“চৈতি কেমন আছে আম্মু?জ্বর কমেছে ওর?”

মিসেস ইয়াসমিন হতাশ কন্ঠে প্রত্যত্তর করলেন,
“নারে বাবা। মেয়েটার শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে।ডাক্তার স্যালাইন দিয়ে গেছেন। ঘুমিয়ে আছে চৈতি।”

প্রহন দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। চাইলে ও সে কিছুই করতে পারছে না। খারাপ লাগা এসে ছুঁয়ে গেছে তার মন, শরীর,আত্মাকে।শত শত মাইল দূরে তার প্রিয়সী তার বিরহে জ্বলে পুড়ে মরছে।অথচ ব্যার্থ প্রেমিক দূর থেকেই ছটফট করে মরছে।প্রিয়সীর এই অসুস্থতা তার উপরে ও প্রভাব ফেলেছে ভীষণ।

মোবাইল এর ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে মিসেস ইয়াসমিন ঘুমন্ত চৈতিকে দেখালেন। ভিডিও কলে চুপ করে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই প্রহনের।

নিস্তেজ,নিষ্প্রান,চৈতন্যহীন,নিঃসড়, চৈতি কে দেখে ভালো লাগছে না তার।মন চাচ্ছে উড়ে যেতে তার চঞ্চলা হরিণীর কাছে। কিন্তু, এই একটা কিন্তুর জন্য অন্তহীন অপেক্ষা করতে হবে। প্রহন লাইন কেটে দিল।এই অবস্থায় মেয়েটা কে দেখতে ইচ্ছে করছে না।চিত্ত জুড়ে খারাপ লাগার বাতাস বয়ে যাচ্ছে।

সরদার সাহেব আর জুনাইদা এসে পৌঁছেছেন কিছুক্ষণ আগেই। মেয়ের এমন অসুখ দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো সরদার সাহেব এর।কতো আদরের মেয়ে। সেই মেয়ের এমন অবস্থায় প্রতিটি বাবাই ভেঙ্গে পড়বেন। সরদার সাহেব চৈতির মাথার পাশে গিয়ে বসলেন।আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলেন। জ্বর কমেছে।পিট পিট করে চোখ মেলে তাকায় চৈতি।জ্বরের ঘোরে সে যেনো প্রহন কে দেখতে পাচ্ছে।
বিড় বিড় করে বলছে,
“আপনি আপনার উপর ভীষণ অভিমান করেছি ক্যাপটেন সাহেব। ভীষণ অভিমান!”
বিড় বিড় করে বলা কথা অসুস্থ চৈতির মাঝেই হারিয়ে গেল।কারো কর্ণপাত হয়নি অভিমানী কিশোরীর অভিমানে ভরা কথা গুলো।

সরদার সাহেব আদুরে গলায় মেয়েকে ডাকলেন,
“আম্মা, বেশি খারাপ লাগছে?এত জ্বর কী করে উঠলো আম্মা?”

চোখ পিটপিট করে বাবার দিকে তাকালো চৈতি। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছে সে। সরদার সাহেব বুঝতে না পেরে চৈতির মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে শোনার চেষ্টা করেন মেয়ের কথা।
“আপনি আমাকে কেন বলে গেলেন না?” এই একটা কথাই বার বার করে বলছে চৈতি। মেয়ের কথার কিছুই বুঝলেন না সরদার সাহেব।
রেদোয়ান চৌধুরী ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফিরে সরদার সাহেব আর জুনাইদা কে দেখে অপরাধী কন্ঠে বললেন,
“দুঃখিত ভাইয়া, আমরা আপনার আদরের কন্যার সঠিক খেয়াল রাখতে পারিনি। আমাদের মাফ করবেন। নতুন জায়গায় মেয়েটা মানিয়ে নিতে না পেরে এমন অসুস্থ হয়ে পড়লো।”

সরদার সাহেব রেদোয়ান চৌধুরীর এমন ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন।কয়েটা মেয়ের শ্বশুর এই ভাবে বলতে পারে? তার মেয়ে যে ভাগ্যবতী।এত ভালো মানুষ গুলো কে জীবনে পেয়েছে।
সরদার সাহেব রেদোয়ান চৌধুরী কে জড়িয়ে ধরে বললেন,”আমার মেয়ে সহজে অসুস্থ হয় না। একবার অসুস্থ হলে একে বারে ঘায়েল হয়ে বিছানার সাথে লেগে যায়। ছোট থেকেই এরকম ও।”

সেদিন রাতে শরীর ঘামিয়ে সব জ্বর চলে গেল চৈতির শরীর ছেড়ে।ক্যানেলার টা হাত থেকে খুলে ফেলে ছিলেন রেদোয়ান চৌধুরী। গভীর নিশুতি শর্বরে ছেয়ে গেছে। রাত জাগা পাখিদের ডাক ভেসে আসছে। নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মানুষ জনের কথার শব্দ নেই।সবাই নিদ্রায় মশগুল হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা টুং টুং আওয়াজ করে জানান দিচ্ছে রাত ২টা বেজেছে।
মিসেস ইয়াসমিন এর মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইল এর রিংটোন এর শব্দ বেশ জোরেই শোনা যাচ্ছে। তন্দ্রা ভাব কেটে গেল মিসেস ইয়াসমিন এর। কিছুক্ষণ আগেই দু চোখের পাতা এক করে ছিলেন।এত জোরে মোবাইল এর রিংটোন এর আওয়াজ কানে যেতেই ঘুম ভাঙ্গল চৈতির। মোবাইল হাতে নিয়ে প্রহন এর নাম্বার দেখে দ্রুত কল রিসিভ করে চৈতির হাতে মোবাইল দিয়ে বললেন,”তোর চিন্তায় আমার ছেলেটার ঘুম হচ্ছে না। কথা বলে ঘুমাতে বল।ওর আবার সকাল সকাল উঠতে হয়।”
চুলে খোঁপা করে বসা থেকে উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন মিসেস ইয়াসমিন।জল তেষ্টা পেয়েছে খুব। জগের মধ্যে জল নেই।হাতে জগ নিয়ে ডাইনিং টেবিলের ও দিকে চলে গেলেন মিসেস ইয়াসমিন।

কাঁপা কাঁপা হাতে কানের কাছে মোবাইল ধরলো চৈতি।
“আম্মু, পিচ্চি ঠিক আছে?জ্বর কমেছে?”

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর পায় না প্রহন। চিন্তায় কপালের ভাজ গাঢ় হলো।
“কী হলো? কথা বলছো না কেন?”

কোনো জবাব নেই।রেগে গেলো প্রহন।রাগি কন্ঠে চিল্লিয়ে বললো,”আর আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। আমি কিন্তু এখনি চলে যাবো। চাকরি গেলে যাক।”

“ঘুমাননি কেন এখানো?”
অনেক অপেক্ষার পর প্রিয়সীর কন্ঠস্বর শুনে কলিজায় পানি আসলো প্রহন এর।এক নিমিষেই হারিয়ে গেল সব রাগ।”পিচ্চি ঠিক আছো তুমি?জ্বর কমেছে? সুস্থ হয়েছো?শুনো না আমি আর কখনো তোমাকে বৃষ্টিতে ভিজাবো না। তুমি চাইলে ও কখনো ভিজতে দিবো না।”

ঘুমে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না চৈতি। বিছানায় শুয়ে কানের কাছে মোবাইল রেখেই আস্তে আস্তে বললো,”ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি ঠিক আছি।”

সারাদিন এর এত খারাপ লাগা যেন এই মাঝ রাতে ভালো লাগা হয়ে গেছে। মিসেস ইয়াসমিন রুমে এসে দেখেন কানের কাছে মোবাইল পড়ে আছে আর চৈতি ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হাসলেন এই দুই জনের কান্ড দেখে।এত দ্রুত এরা এত আপন হয়ে উঠবে ভাবেননি তিনি। মোবাইল নিয়ে প্রহনের উদ্দেশ্যে আদেশি কন্ঠে বলেন,
“বউ এর জন্য আর চিন্তা করতে হবে না। আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। তুমি ও ঘুমাও। সকালে ফ্রী হয়ে ফোন করে কথা বলে নিও।”

ওপাশ থেকে একটা ছোট্ট উত্তর এলো,”আচ্ছা।”
লাইন কেটে গেল। চৈতির রুমের আলো নিভে গেল। চারদিক আবারো আলোহীন হয়ে গেল। শুধু দূরের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পোস্ট গুলোর আলো রয়ে গেল। পথচারী কে পথ দেখানোর জন্য।এই নিশিতেও যে নিশাচররা ঘুরে বেড়ায়।

বালিশের উপর মাথা রেখে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে প্রহন। মিটি মিটি হাসছে সে। এমন উন্মাদ কখনোই ছিল না যে ছেলে আজ সেই ছেলের মধ্যে কত পার্থক্য।একটা মানুষ কে পুরোপুরি বদলে দেওয়ার নামই হয় তো ভালোবাসা।
সেদিন রাতে কেউ একজন নীরবে বলে উঠে,
“আমি কার পথে তে ছুটে চলি,যেন কার মায়াতে বাঁধা পড়েছে জীবন যে!ডুবে মরছি সেই মোহতে।”

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here