অন্তহীন💜 #পর্ব_১৬ #স্নিগ্ধা_আফরিন

0
197

#অন্তহীন💜
#পর্ব_১৬
#স্নিগ্ধা_আফরিন

অসুরার গাঢ় তমসাকে দূর করে দিতে আদিত্যের চমকদার মৃদু উদ্ভাসে ভরে উঠছে ধরিত্রী। নগরীর অলি গলি ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষের কোলাহলে। রাত্রি ফুরিয়ে প্রভাত হলো যে! প্রতিদিনকার নিয়ম অনুযায়ী সবাই যে যার মতো নিজেদের কর্মস্থলে ছুটছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৮টা। চৈতির ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক আগেই। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিলো না।শোয়া থেকে উঠে বসে। আগের চেয়ে শরীর এখন অনেকটাই ভালো।জ্বর নেই বললেই চলে। স্বাভাবিক তাপমাত্রা আছে। হাঁটুতে কনুই রেখে দুই হাত দিয়ে চোখ কচলিয়ে নেয়। বিছানা থেকে নেমে ওয়াস রুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
মিসেস ইয়াসমিন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জুনাইদার সাথে খোশ গল্পে মেতে উঠেছেন। রেদোয়ান চৌধুরী আর সরদার সাহেব দুজনে মিলে বাজারে গেছেন। চৈতি ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমের দিকে এগিয়ে যায়। চৈতি কে আসতে দেখে মিসেস ইয়াসমিন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দুই মাকে দেখে মুচকি হাসলো চৈতি। মিসেস ইয়াসমিন চৈতির কপালে হাত দিয়ে পরক্ষ করলেন জ্বর আছে কিনা!
চৈতির শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা অনুভব করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মিসেস ইয়াসমিন। চৈতির কে জুনাইদার পাশে বসতে বলে তিনি রান্না ঘরে চলে গেলেন। চৈতির সকালের নাস্তা এনে দিতে।

জুনাইদা চৈতির কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
“আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমার মেয়ে কে নিয়ে।”

চৈতি মায়ের কাঁধে মাথা রাখে ধীর কন্ঠে বলে,
“আমি এখন ঠিক আছি তো।আর ভয় পেতে হবে না।”

জুনাইদা আলতো হাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর মিসেস ইয়াসমিন চৈতির জন্য গরম গরম পরোটা আর মাংস ভুনা নিয়ে আসলেন। চৈতির পাশে বসে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলেন। মিসেস ইয়াসমিন এর চৈতির প্রতি এহেন যত্ন দেখে প্রশান্তিতে বুক ভরে যায় জুনাইদার।অথচ সে কখনোই তার দুই ছেলের বউকে এমন করে খাইয়ে দেয়নি।মনে মনে আফসোস হলো তার।মনের গভীর থেকে চিন্তা করলেন বাড়িতে গিয়ে রুপা আর সিফা কে হাতে তুলে খাইয়ে দিবেন। ঠিক চৈতি কে যেমন করে দিতেন।ওরা ও তো কোনো মায়ের আদুরে সন্তান।
.
.
প্রহনদের বাড়িতে এত দিন হলো চৈতি এসেছে।অথচ সেদিন রাত ছাড়া দিনের বেলায় একবার ও ছাদে যাওয়া হয়ে উঠেনি তার।এক সিঁড়ি,এক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যেতেই মিসেস ইয়াসমিন এর ডাক পড়লো।
“চৈতি প্রহন কল করেছে হয়তো। আমার রুমের বিছানার উপর থেকে মোবাইল টা নিয়ে দেখ তো।”
থেমে গেল চৈতি।দ্রুত সিড়ি বেয়ে নেমে দৌড়ে যায় মিসেস ইয়াসমিন এর রুমের দিকে।

বিছানার উপরে মোবাইল রাখা আছে।বাজতে বাজতে নিভৃত হয়ে গেল।মন খারাপ হয়ে গেল চৈতির।ফের বেজে উঠতেই হাসি মুখে মোবাইল হাতে নিয়ে কল রিসিভ করতেই প্রহনের মুখটা ভেসে উঠলো স্ক্রিনে।ভিডিও কল করেছে প্রহন। চৈতি কে দেখেই মুচকি হাসলো। ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় প্রহন কে দেখে কিছুক্ষণ চোখ আটকে গেল চৈতির। মুখে দাড়ি নেই।ক্লিন শেভ করা। অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে।
“ভালো আছো পিচ্চি?জ্বর কমেছে? ঔষধ খেয়েছো?”

প্রহনের এত প্রশ্ন শুনে ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেললো চৈতি।
“এত প্রশ্ন কেউ এক সাথে করে? আমি উত্তর দিবো কী করে?”

প্রহন হেসে ফেললো।অধর জুড়ে হাসির রেখা টেনেই বললো,”তুমি ও তো এখন প্রশ্ন করলে।প্রশ্নের প্রত্যত্তরে কী কেউ প্রশ্ন করে?”

প্রহনের অদ্ভুত যুক্তি!ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইলো চৈতি। ভালো লাগছে কেন জানি।

“এই ভাবে তাকিও না মেয়ে।প্রেমে পড়ে যাবে।”

প্রেম!থমকালো চৈতি। রিফাত যখন তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল ঠিক এই শব্দ উচ্চারণ করেছিল।প্রেম!
মিসেস ইয়াসমিন রুমের দিকে এসে ছিলেন দেখতে যে কে কল করেছে।চৈতি কে কথা বলতে দেখে নিশ্চিত হলেন যে প্রহনই কল করেছে। দরজার কাছ থেকেই চলে যান তিনি।
চৈতি বিছানার উপর বসে পড়লো।ভ্রু কুঁচকে প্রহন তাকিয়ে আছে চৈতির দিকে।
“কী হয়েছে পিচ্চি? এমন উদাসিন হলে কেন?”

“আপনি এত প্রশ্ন করেন কেন?”

হাসলো প্রহন। “আমার প্রশ্নের জবাবে তুমি ও কেন প্রশ্ন করো বলো তো?”

চৈতি নিরুত্তর। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে নিজ থেকেই বললো,”কেমন আছেন?”

প্রহনের সোজা সাপ্টা উত্তর,
“ভালো না।”

চিন্তিত কন্ঠে চৈতি বলে উঠলো,”কেন?”

“তুমি যে এখনো বলো নি তুমি ভালো আছো কিনা।”

বাচ্চাদের মতো প্রহনের এমন কথা শুনে খিল খিল করে হেসে উঠলো চৈতি। প্রহন এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে সেই হাসি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মনে মনে আওড়ে গেলো,”কখন মেয়েটা বড় হবে?”১৮ তে পা রাখলেই তার কাছে চৈতি কে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা এখনি করে রেখেছে প্রহন।
হাসি থামিয়ে ছোট করে বললো”ভালো আছি।”

“আচ্ছা রাখছি।ফ্রী হয়ে রাতে কথা হবে ঠিক আছে পিচ্চি?”

“আচ্ছা”

কল কেটে গেল। অদৃশ্য হয়ে গেল প্রহন। দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল।কাছ থেকে কথা বলার যে অনুভূতি টা তা কি আর ভিডিও কলে পাওয়া যায়?ডিফেন্সে চাকরি করলে এই এক সমস্যা। কিছুক্ষণ কথা বলার ও সময় নেই যেনো।এত ব্যস্ততা কীসের বুঝলো না চৈতি।

রৌদ্রতপ্ত ঝলমলে দিন।অন্তরীক্ষ জুড়ে ভাসমান তুলোরাশির ছড়া ছড়ি। নীলের সমারোহ অম্বরে।ক্ষীপ্ত আদিত্য তেজ দেখাচ্ছে কলোহল পূর্ণ নগরীর উপর। ঘর্মাক্ত,ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত ফুটপাতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় রিকশা চালক গুলো গলার গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে যাত্রীর অপেক্ষা করছে।ময়লার স্তূপে ক্ষুধার্ত কাক গুলো ঠোঁট দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাবারের সন্ধান করতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে কর্কশ গলায় কা কা বলে উড়ে এসে আবারও ব্যস্ত হচ্ছে খাদ্যের সন্ধানে।
রেদোয়ান চৌধুরী আর সরদার সাহেব বাজার থেকে এসে ড্রইং রুমের সোফায় বসে হাসি তামাশায় মেতে উঠেছেন। মাথায় কাপড় দিয়ে চৈতি যখন তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো তখন সরদার সাহেব ডাক দিলেন।”আম্মা এ দিক আয়।”
বাধ্য মেয়ের মতো বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো চৈতি। সরদার সাহেব মেয়েকে নিজের পাশে বসিয়ে দিয়ে বললেন,”শ্বশুড় কে নাকি তুই এখন ও আব্বু বলে ডাকিস নি আম্মা? উনি ও তো আমার মতই তোর এক আব্বু।”

হঠাৎ বাবার এমন কথায় খানিক লজ্জা পেলো চৈতি। রেদোয়ান চৌধুরীর সঙ্গে এখনো তার তেমন কোনো কথা হয়নি। বাবার কথার প্রত্যত্তরে কী বলা উচিত তা বুঝতে না পেরে চুপ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
রেদোয়ান চৌধুরী হেসে বললেন,
“আহ ভাই ওর সাথে তো আমার এখনো তেমন কথা হয়নি। বাচ্চা মেয়ে হুট করে কী আর অন্য একজন কে আব্বু বলে ডাকতে পারবে বলেন?সময় হোক ঠিক ডাকবে।”

রান্না ঘর থেকে মিসেস ইয়াসমিনের ডাক পড়লো,”চৈতি,মা একটু এদিকে আয় তো।”

চৈতি বসা থেকে উঠে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। মিসেস ইয়াসমিন চৈতির হাতে এক গ্লাস শরবত ধরিয়ে দিয়ে বললেন,”যা গরম পড়েছে আজ,শরবতটা খেয়ে বিশ্রাম করবি বুঝলি?”

জুনাইদা তেলের মধ্যে মাছের টুকরা ছাড়তে ছাড়তে বললেন,”এই মেয়ে করবে বিশ্রাম? আপনার মনে হয় আপা?”
জুনাইদার কথা শুনে মিসেস ইয়াসমিন চৈতির দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন,”বিশ্রাম না করলে আমার কাছ থেকে মাইর খাবে ও।”

গ্লাসে চুমুক দিয়ে এক ঢোক শরবত গিলে চৈতি অভিযোগি কন্ঠে বলে উঠলো,”এক বারো বলেছি বিশ্রাম করবো না?”

ভাজি মাছ প্লেটে রাখতে রাখতে জুনাইদা উত্তর দেন,”আপনি আমার পেট থেকে হইছেন আম্মা। আমি আপনার পেট থেকে না। আপনার চেয়ে ও বেশি আমি আপনারে চিনি।”

মিসেস ইয়াসমিন জুনাইদার কথা শুনে হাসলেন।মা মেয়ের কী সুন্দর কথা। বাহ!
“আপা আপনি কিন্তু আমার মেয়েকে শুধু শুধু বকছেন।মেয়ে আমার অনেক শান্ত।”

“নতুন পরিবেশে নতুন মানুষের মাঝে আছে তো তাই শান্ত। কয়েক টা দিন যাক নিজের চোখেই দেখতে পাবেন মেয়ে আপনার কত শান্ত।”
তাচ্ছিল্য করে বলেন জুনাইদা।
নিজের মায়ের কথায় বিরক্ত হলো চৈতি। কোথায় একটু প্রশংসা করবে তা না, শুধু বাঁদরামি গুলোর কথাই বলবে। গ্লাসের শরবত শেষ করে “ঘুমাতে গেলাম আমি” জুনাইদার দিকে তাকিয়ে কথা টা বলে দ্রুত পা রুমে চলে গেল চৈতি। “এই তপ্ত দুপুরে কী কারো ঘুম আসে?আজব!”বেলকনিতে গিয়ে মোড়া টেনে বসলো চৈতি।একে বারে ফাঁকা বেলকনি। পছন্দ হলো না চৈতির।গাছ প্রেমি মানুষের এমন বেলকনি কিছুতেই পছন্দ হবার কথা নয়।মন খারাপ এর সময়ে বেলকনি হবে মন ভালো করে দেওয়ার মতো জায়গা। সেখানে শুধু দুটো মোড়া রাখা থাকলে কেমনে হবে? বসে বসে এই সব ভাবছিল চৈতি। হঠাৎ কী মনে পড়তেই বসা থেকে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে সোজা রেদোয়ান চৌধুরী আর সরদার সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রেদোয়ান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে উনার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“আব্বু আপনি আমাকে কয়েক প্রজাতির ফুলের গাছ কিনে এনে দিবেন।”

চৈতির মুখ থেকে হঠাৎ আব্বু ডাক শুনে নড়ে চড়ে উঠলেন রেদোয়ান চৌধুরী। প্রথম বার আব্বু ডেকে মেয়েটা একটা আবদার করলো তা পূরণ না করে কি থাকা যায়?হয় তো যায়। কিন্তু কন্যাহীন রেদোয়ান চৌধুরী পুত্র বধু নামক মেয়ের আবদার অপূর্ণ রাখতে ইচ্ছুক নন।বসা থেকে উঠে খুশিতে গদগদ হয়ে চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”আমি এখনি এনে দিবো মা। অনেক গুলো এনে দিবো।”

মিসেস ইয়াসমিন শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন,
“কী এনে দেওয়ার কথা হচ্ছে শুনি?”

“আমার মেয়েটা আমার কাছে একটা আবদার করেছে তা পূরণ করতে হবে তো।”

মিসেস ইয়াসমিন চৈতির পাশে এসে দাঁড়ালেন।”কীসের আবদার করেছে মেয়ে?”

রেদোয়ান চৌধুরী সরদার সাহেব কে সাথে নিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন,”ফুল গাছ এনে দেওয়ার আবদার।”

রেদোয়ান চৌধুরীর চলে যাওয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল চৈতি। তার নিজের বাবা ও কখনো এত জলদি কিছু এনে দেওয়ার চেষ্টা তো দূরের কথা চিন্তা ও করেননি।যখনি কিছু আনতে বলতো তখনই তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বলতেন,”বিকেলের দিকে কাজ না থাকলে এনে দিবো। এখন অনেক কাজ বাকি আছে।”

#চলবে,,,,

(1k comments korar jonno valobasa ♥️🥀)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here