#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭
বৃষ্টির এই সন্ধ্যেতে লাস্যময়ী ঝুমুরকে দেখতে মনের কোণে কোথাও একটা ভালোলাগা জ্বলে ওঠলেও দপ করে নিভিয়ে ফেললো তাখলিফ। মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে একপ্রকার জোর করেই ঝুমুরকে টেনে সরিয়ে আনলো। তবে সিঁড়িঘরে আসতেই দেখতে পেলো, পাখি বেগম
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দু’জনের দিকে!
পাখি বেগমকে দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেলো দু’জনেই। তাখলিফ ঝুমুরের হাতটা আলগোছে ছেড়ে দিলো।
মা আবার উল্টাপাল্টা কিছু ভেবে তাখলিফকে না আবার ভুল বুঝে সেই চিন্তা হলো ঝুমুরের। উপস্থিত বুদ্ধি ওর নিতান্তই কম। তাই কি বলে ব্যাপারটাকে সামাল দেবে তার আগেই পাখি বেগম রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কি হচ্ছে?”
তাখলিফ স্থির হয়ে দাঁড়ালো। প্রশ্নটা কার উদ্দেশ্যে করেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না তবে সে নিজেই
জবাব দিলো, “আপনার মেয়ে কথা শুনছে না।
ছাদে এসে দেখি এই বৃষ্টিতে ভিজছে। আমি বারণ করায় কথাই শুনছিলো না৷ নিয়ে যান
তো বেয়াদবটাকে! গেইটে তালা দেবো।”
পাখি বেগম ঝুমুরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
ঝুমুর বোকা হেসে বলল, “একটু ভিজছিলাম,
দেখো না…”
“জ্বর বাঁধালে দেখিস শুধু কি করি, এক্ষুণি নেমে
ঘরে আয়।”
কড়া কন্ঠে মেয়েকে শাসন করে পাখি বেগম সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেলেন। ঝুমুর হাফ ছেড়ে তাখলিফের দিকে তাকালো। ও শক্ত মুখভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে আছে, কপালে ভাঁজ। চোখে একরাশ বিরক্তি, অদ্ভুত সুন্দর! আচমকা ঝুমুরের লোভী মনটাতে দুষ্টবুদ্ধি উঁকি দিলো। তাখলিফকে অবাক করে নিজের দু-পা উঁচু করে ফট করে ওর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে একদৌড়ে পালাতে গেলো। তবে নামতে গিয়ে হলো আরেক বিপদ! ভেজা সিঁড়িতে টাল সামলাতে না পেরে পা পিছলে পড়ে গেলো। সাথে সাথেই ব্যথা পেয়ে আর্তনাদ করে ওঠলো। চিৎকার শুনে পাখি বেগম, প্রমিলা, শামসুল হক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। পা নাড়াতে পারছে না ঝুমুর। নীল হয়ে গেছে গোড়ালি। পাখি বেগম এসেই বকাঝকা শুরু করলেন৷ এদিকে মেয়ের অবস্থা দেখে শামসুল হক বুঝতে পারলেন পা মচকে গেছে। ঝুমুর ব্যথায় কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা গেলো। সকলে ধরাধরি করে ওকে ঘরে নিয়ে গেলো। এদিকে সিঁড়িঘরে হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো তাখলিফ। ঝুমুরের এই আকস্মিক চুমুটি কিছুতেই মাথা থেকে বেরুচ্ছে না ওর। হুট করে এত সাহস কি করে হলো মেয়েটার মধ্যে? তাখলিফ কিছু ভাবতে পারলো না।
পরে কি ভেবে যেন দোতলায় গেলো! সাজেদা বেগমের সাথে কথা বলার ফাঁকে একবার দেখতে গেলো ঝুমুরকে। নীল রঙের ড্রিম লাইটের আলোতে ওর ঘরটা ভীষণ অদ্ভুত লাগছিলো। তাখলিফ এই হাতেগোনা কয়বার এসেছে এই ঘরে। তাও খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। ঝুমুর বিছানায় বসে পা ধরে মৃদু শব্দে ব্যথায় কাতরাচ্ছিলো। তাখলিফের আগমন তখনো টের পায়নি। যখনি ঘর আলোকিত হয়ে ওঠলো বিরক্তি নিয়েই ও বলে ওঠলো, “আলোটা প্লিজ অফ করো মা।”
তাখলিফ কপাল কুঁচকে সরু চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো, “ব্যথা পেয়েছিস পায়ে। আলোতে কি সমস্যা?”
ঝুমুর হতচকিত হয়ে মুখ তুলে চাইলো। সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে ঠোঁট দুটো আপনাআপনি ‘হা’ হয়ে গেলো। থতমত খেয়ে পাজামা টেনে পা ঢেকে বলল, ” আপনি এখানে?”
“হু, দেখতে এলাম নির্লজ্জ কাজটা করে কিভাবে
বসে আছিস?”
ঝুমুর ব্যথা ভুলে অভিমানী গলায় বলল, “আমি যে
পা মচকে ফেললাম আপনি দেখেন নি?”
“দেখেছি। আর যদি কখনো এসব বেয়াদবি করিস আমি কিন্তু কঠোর হতে বাধ্য হবো। কিছু বলি না তার মানে এই না তুই আমার ওপর দিয়ে যাবি!”
ঝুমুর সব শুনলো। এরপর অবাক হয়ে বলল, “আমি ঠিক আছি কি-না সেটা জানতে ইচ্ছে করেনি একবারও?”
“আমি তো আর সিনেমার হিরো না। তাছাড়া দেখতেই পাচ্ছি দিব্যি তুই ঠিক আছিস।”
“ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে হিরো হতে হয় না।”
তাখলিফ প্রত্তুত্তর দিলো না। কয়েক সেকেন্ড এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেই যেভাবে হুট করে এসেছিলো সেভাবেই বেরিয়ে গেলো। ঝুমুর সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পাখি বেগম রাতের খাবারটা ঘরে নিয়ে এলেন ঝুমুরের জন্য। এসেই বিমর্ষ গলায় ওকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি বলতাছিলো ওয়? আগে তো দেখিনাই তোর ঘরে আসতে?”
ঝুমুর বিরক্ত হলো মায়ের কথায়। বলল, “আসতে পারে না নাকি? তুমি যে কি বলো! পা মচকে কতটুকু ব্যথা পেয়েছিলাম আর এখন ঠিক আছি কি-না তা জানতেই এসেছিলো।”
পাখি বেগম মেয়ের কাছে বসলেন। ভাত মেখে মেয়ের মুখে তুলে দিতে দিতে বললেন, “এর থেকে দূরেই থাকিস। মতিগতি একটুও ভালো না। কাক যেমন কখনো ময়ূর হয় না। খারাপও কখনো ভালো হয় না।।আমি তো চিন্তা করি সেই কপালপুড়ীর জন্য যে ওর বউ হইবো। আমার পোলা ভাগ্যিস ওমন না, নিজে দেইখা ওরে আমি বিয়ে দিমু।”
পাখি বেগম ইয়াসিফকে নিয়ে গর্ব করলেন। ঝুমুরের খাওয়ার ইচ্ছেটাই মাটি হয়ে গেলো। তাখলিফকে নিয়ে আজেবাজে কিছু শুনতে চায় না ও। মায়ের এমন কান্ড ওর মোটেও পছন্দ হলো না৷ বিমর্ষ গলায় বলল, “খারাপও ভালো হয় মা, তুমি ভুল জানো। আর ভাইয়া তো খারাপও নয়।”
পাখি বেগম তাচ্ছিল্য করে বললেন, “তুই আর কতটুকু চিনিস ওরে? তাছাড়া তুই কেন, তোর পুরা গোষ্ঠীও এই ছেলের আসল রুপ জানে না। তুই কি ভাবছিস আমি হুদাই ওরে পছন্দ করি না? তা নয় রে…”
ঝুমুর এবার ধৈর্য্য হারালো। ব্যাকুল কন্ঠে জানতে চাইলো, “তাহলে কি মা? কি এমন অপরাধী ওনি?”
পাখি বেগম সাথে সাথেই মুখে কুলুপ আঁটলেন। ঝুমুর অনেক জোরাজুরি করেও মায়ের মুখ থেকে আর একটি কথাও বের করতে পারলো না৷ তবে মেয়েকে এমন উতলা হতে দেখে তিনি খানিকটা অবাকই হলেন বটে!
________________
শুক্রবার, ছুটির দিন৷ অলস বিকেলটা কফি হাতে বারান্দায় বসে কাটাচ্ছিলো তাখলিফ। হুট করে ওর ফোন বেজে ওঠলো। ধরবে না ধরবে না করেও রিসিভ করলো। ইয়াসিফের গলা শোনা গেল ওপাশ থেকে, “কেমন আছো ভাইয়া?”
তাখলিফ নিজের কথা বাদ দিয়ে উপরন্তু প্রশ্ন করলো,
“তোর কি খবর? গলা এমন শুনাচ্ছে কেন?”
ইয়াসিফের গলা সত্যিই আজ অন্যরকম। পার্থক্য করতে অসুবিধা হয়নি তাখলিফের। কিছু নিয়ে চিন্তায় আছে তা বোঝা যাচ্ছে। ইয়াসিফ প্রথমে বলতে না চাইলেও পরে তাখলিফের ধমকের কাছে টিকতে পারলো না। বিষন্ন গলায় বলল, “একটা দোটানায় পড়ে গেছি! তুসির বিয়ে ভাইয়া।”
তাখলিফের কপালে ভাঁজ পড়লো। তুসিকে সে চিনতে পারলো না। কে এই মেয়ে যার জন্য ইয়াসিফ এত চিন্তিত? প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলো সে ইয়াসিফকে,
“কে তুসি? তোর সাথে কিসের সম্পর্ক? প্রেম করিস নাকি?”
ইয়াসিফ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, “তুসিকে আমি
ভালোবাসি ভাইয়া। কিন্তু পরিবার থেকে জোর করে
ওর বিয়ে দিতে চাচ্ছে। কি করবো বুঝতে পারছিনা। পরশু ওর আকদ।”
এতক্ষণে বিষয়টা পরিষ্কার হলো তাখলিফের কাছে। একটুক্ষণ সময় নিয়ে ভাবলো। এরপর বলল,
“কি করতে চাস তুই?”
“আমি জানি না কি করা উচিৎ কিন্তু ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না!”
তাখলিফ এই বিরুপ পরিস্থিতিতেও হেসে ফেললো, “বয়স হয়েছে তোর। বল যে বিয়ে করতে চাস! একটা মেয়ের জন্য মরে যাবি এসব সিনেমাটিক কথাবার্তা তোর মুখে মানায় না।”
ইয়াসিফ প্রতি উত্তরে বলল, “তোমার কাছে ও শুধুই একটা মেয়ে, কিন্তু আমার কাছে ও আমার স্বপ্নের চেয়েও বড় কিছু! তুমি যদি সত্যি কাউকে ভালোবাসো তাহলে বুঝতে পারবে একদিন ঠিকই বুঝতে পারবে ভালোবাসার মানুষহীন বেঁচে থাকা কতটা যন্ত্রণার!”
“তোরটা তো এখনো মরে নি, দিব্যি বেঁচে আছে।”
“তবুও আমার দম বন্ধ লাগছে।”
তাখলিফ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“বিয়ে করে ফেল।”
ইয়াসিফ বিষন্ন গলায় বলল,
“বেকার ছেলের প্রস্তাব ওর বাবা ফিরিয়ে দিয়েছে।”
“তোর প্রেমিকা কি চায়?”
“ও পালাতে চায়। কিন্তু…. ”
তাখলিফ রুক্ষ স্বরে বলল,
“কিন্তু? এখানে কিন্তু আসছে কোথা থেকে? মেয়ে
যখন রাজি তো সব ঠিক। বিয়ে করে ফেল।”
ইয়াসিফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
“মা মানবে না ভাইয়া।”
তাখলিফ বিরক্তির সুরে বলল, “প্রেম করার সময় মায়ের অনুমতি তো নিসনি। বিয়ের সময় মনে পড়লো মায়ের কথা? সেদিন তো বলছিলি মায়ের খোকনের সঙ্গে বোনের বিয়ে দিবি না, এখন নিজে খোকন হয়ে যাচ্ছিস! শালা দু’মুখো…”
ইয়াসিফ এ পর্যায়ে হেসে ফেললো, “আমি কিন্তু সত্যি তোমার শালা হই।”
তাখলিফ ভ্রু কুঁচকালো,
“তাই নাকি? কিন্তু তুই তো ঝুমুরের বড়।”
“তাতে কিছু আসে যায় না।”
তাখলিফ অধৈর্য হয়ে বলল,
“এসব প্যাচাল বাদ দে। বউ নিয়েই বাড়ি ফিরবি নাকি বউ ছাড়া?”
ইয়াসিফ একটু চিন্তা করে বলল, “বউ নিয়েই ফিরি, সেটাই তো ভালো?”
তাখলিফ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“তোর জীবন, তুই বোঝ!”
ইয়াসিফ নম্র স্বরে বলল, “এতটুকু মেন্টাল সাপোর্ট আশা করেছিলাম তোমার থেকে। থ্যাংক্স ভাইয়া।”
“মানে?”
“ঝুমু তোমার সাথে শেয়ার করতে বলেছিলো ব্যাপারটা।”
“ভাই-বোন মিলে শলা পরামর্শ করছিস? তোর বোনের আস্পর্ধা অনেক বেড়েছে। ফোন রাখ।”
ফোন রেখে গাঢ় নিঃশ্বাস ফেললো সে। কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে। তাখলিফ চেয়ারে গা এলিয়ে বসে থাকলো কতক্ষণ! দরজায় বেল বেজে ওঠলো। বাবা ফিরেছে ভেবে দরজা খুলতেই দেখলো ওড়নার একপাশ মুঠো করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমুর। ইয়াসিফের ব্যাপারটা উপেক্ষা করলো তাখলিফ।এরপর ঝুমুরের মচকানক পা ঠিক হয়েছে কি-না সেটা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলো “কি চাই এখানে?”
ঝুমুর ওকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে বলল, “একটা হাড়ি নিয়ে আসুন তো।”
তাখলিফ কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘর থেকে একটা হাড়ি এনে দিলো। ঝুমুর নিজের ওড়নায় করে আনা ফলগুলো রাখতে রাখতে সহাস্যে বলল, “আমার গাছের প্রথম ফল। আপনার জন্য এনেছি।”
তাখলিফ দেখলো অপরিপক্ক কিছু কমলা আর স্ট্রবেরি ওড়নায় করে লুকিয়ে নিয়ে এসেছে ঝুমুর। চোখেমুখে ক্লান্তি তবুও ঠোঁটের কোণে হাসি। ফলগুলো নিজেই ধুয়ে নিয়ে কাটতে বসলো। তাখলিফ চেয়ে চেয়ে দেখলো কতক্ষণ! ডাইনিংয়ের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল, “সব তো
মনে হচ্ছে আমার জন্যই নিয়ে এসেছিস, বাকিদের জন্য কি রেখেছিস?”
ঝুমুর অকপটে উত্তর দিলো, “পরেরবার যদি বেশি ফলন হয়, তখন ওরা খাবে৷ কিন্তু এবার তো প্রথম।
তাই আপনার জন্য নিয়ে এলাম।”
তাখলিফ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “এগুলো একটু বাড়াবাড়ি না ঝুমুর? তুই যা করছিস তাতে মনে হচ্ছে আমাদের মধ্যে সব স্বাভাবিক!”
ঝুমুর বিনিময়ে কঠোর গলায় বলল, “না বাড়াবাড়ি না। আপনার কাছে মনে হতেই পারে। কিন্তু আমি তো ভিন্ন মানুষ, আমার কাজে, চিন্তাভাবনায় প্রশ্ন তোলার অধিকার কারো নেই। ধ্রুব সত্য এটাই যে, আমি আপনাকে ভালোবাসি, আপনি আমার বর। সব স্বাভাবিক থাকুক না থাকুক এরবেশি কিছুর প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই।”
তাখলিফ বিড়বিড় করে বলল, “এর মাথাটা পুরোই গেছে। ভাবতে পারছে না সবাই যখন সত্যিটা জানবে তখন এরজন্য ও কতটা ভুগবে!”
___
দরজার সামনে ইয়াসিফকে বউ নিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখতে পাখি বেগম মূর্ছা গেলেন!
___________
’
[আগামী পর্ব পেতে বিলম্ব হতে পারে। বিয়ের কাহিনী আজই বলে দিতাম, কিন্তু আর লেখা সম্ভব হচ্ছে না৷ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
চলবে….