অপ্রিয়_রঙ্গনা #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-১

0
270

এইচএসসি পরপরই ঝুমুরকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। কিন্ত আচরণ দেখে বোঝা গেছে পাত্র ব্যক্তিত্বহীন, মা ভক্ত ছেলে। তারা অপমানজনক আচরণ করেছে। আর তা জানতে পেরে পাত্রকে একপ্রকার পিটিয়েই এলাকা ছাড়া করেছে ইয়াসিফ। টিপু মিয়ার ভাতিজার থেকে এই খবর শুনে “নিরিবিলি” বাড়ির সকলে হতভম্ব হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে সকলের থমকে যাওয়া মুখ দেখে ইয়াসিফ কিছু হয়নি এমন ভাব করে পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,
“হা হয়ে দেখছো কি? আমি মানুষ না ভাল্লুক?
চিড়িয়াখানার প্রাণী আমি?”

ইয়াসিফের বাবা শামসুল হক এসে ছেলের গালে
সশব্দে চড় মেরে বললেন, “মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে আবার বড়বড় কথা বলছিস? বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে কুলাঙ্গার।”

বাবার হাতে চড় খেয়ে গালে হাত রেখেই ইয়াসিফ বলল, “আপনাদের মান-সম্মানের জন্য আমি তো আমার বোনকে জাহান্নামে দিকে ঠেলে দিতে পারি না। নিজেদের বিচারবুদ্ধির ঠিক নেই আসছেন শাসন করতে। যত্তসব।”

ছেলের কথা শুনে শামসুল হক অপমানিত বোধ করলেন। তার চেহারা রাগে লাল হয়ে গেলো। মাথা নুয়ে কথা বলা ছেলেটাও এখন বাবার সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলে? কে দিচ্ছে এত আশকারা? কার সাথে থেকে এত অধপতন তার এই ভদ্র ছেলেটির? তিনি আরকিছু বলে ওঠার আগেই পাখি বেগম এসে ছেলেকে বললেন, “বড়দের সাথে এমনে কথা কয়? এই আমি শিখাইসি তোরে বাপ? মেহমান হইসে
বাড়ির শুভজন। আর তুই কি করলি? বোনের বিয়া
হইতে দিবি না নাকি?”

ইয়াসিফ বিরক্তির সুরে বলে ওঠে, “অবশ্যই দিবো। কেন দিবো না? কিন্তু এটা কি ওর বিয়ে করার বয়স? মাত্র কলেজ শেষ করলো। সামনে এত লম্বা সময় পড়ে আছে। আর আপনারা কি শুরু করেছেন?”

একটু থামে ইয়াসিফ। এরপর আবারও বলে,
“তাছাড়া কোনো মায়ের খোকার সাথে বোনের বিয়ে দিবো না। এরকম ফালতু সম্বন্ধ আনার আগে আব্বারে বলবেন একশোবার চিন্তা করতে। নয়তো মেয়ের বিয়ের দায়িত্ব বা জীবনের দায়িত্ব কোনোটাই যেন না নেয়।”

বলে হনহন করে নিজের ঘরে চলে যায় ইয়াসিফ। পেছনে সবাই বাকরুদ্ধ বাড়ির ভদ্র ছেলের শাসানোর ধরণ দেখে। শামসুল হকের হম্বিতম্বিতে কাজ দেয় না। বড় ভাই সানওয়ার হক গম্ভীর মুখ করে বসেছিলেন এতক্ষণ। শামসুল হকের কান্ডে বিরক্ত হয়ে এবার তিনি বললেন, “এতকথা হচ্ছে কেন? ইয়াসিফ ভুল করলেও যা করেছে বেশ করেছে। কাউকে না জানিয়ে কোথা থেকে এসব সম্বন্ধ
জোগাড় করেছিস? এক একাই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবি? আমরা কেউ না?”

শামসুল হক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন বড় ভাইয়ের সামনে। এরপর তীক্ষ্ণ স্বরে বলেন, “মাফ করেন ভাইজান। কিন্তু কলেজে যাওয়া-আসার পথে ওকে বিরক্ত করে ছেলেরা। তাও ভয়ের ছিলো না। কিন্তু একমাস যাবৎ জেল ফেরত কবিরের নজর পড়েছে ওর ওপর। আপনি চেনেন তো ওরে! মেয়েটা আমার ভয়ে ভয়ে বাইরে যায়।

সানওয়ার সাহেব অবাক হয়ে বলেন, “এসব আগে বলিস নি কেন গর্দভ? আর এইজন্য তুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবি?”

শামসুল হক আরকিছু বলতে পারেন না৷ বড় ভাইকে অধিক সম্মান করেন তিনি, তেমনি ভয়ও পান। ছোট ভাই সাঈদ হকও এ নিয়ে কথা শোনাতে থাকে তাকে। পাখি বেগম আর ছোট জা প্রমিলা একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। বাড়ির অন্য ছেলে-মেয়েরা বয়স্ক দাদী সাজেদা খাতুনের পিছনে দাঁড়িয়ে এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা গিলছে। ঝুমুর পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে। তার চোখে পানি। এসব তো হওয়ার কথা না। বাবাকে বখাটে কবিরের কথা জানিয়ে ভুলই করেছে সে। নাতনির চোখের পানি চোখ এড়ায় না সাজেদার। তিনি একটুক্ষণ চুপ থেকে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “যা হইবার হইসে। তোমরা আর এইডা নিয়া আলোচনা কইরো না৷ আমার নাতনির অত বয়সও হয় নাই যে তার বিয়া হইবো না। ওর এহন পড়ালেহার সময়।”

পাখি বেগম শ্বাশুড়ির কথা শুনে বলেন, “এসব বাদ দিলেও আপনি দেখেন নাই আম্মা; আপনের নাতি আজকে কি কান্ড করছে? ওর বাপের সাথে কেমনে কথা কইলো? আমার সোনার ছেলে অমন বেয়াদ্দব কেমনে হইলো বলেন তো আম্মা? সব দেইখা দেইখা শিখসে।”

ছেলে বৌ খোঁচা মেরে কি বুঝাতে চাচ্ছে তা সাজেদা বেশ ভালোই বুঝেছেন। এরপরেও বললেন,
“বয়স কম, রক্ত গরম। বেয়াদ্দব ভাইবো না। আমার সব নাতি-নাতনি সোনার টুকরা। তোমরা যে যার কাজে যাও।”

পাখি বেগম শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে রান্নাঘরে চলে যান। যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলে, “হুহ! সব নাতি সোনার টুকরা! বড় নাতিই যে ওনার সব তা কি আমি জানি না?”

______________

বাড়ির নাম “নিরিবিলি।” পুরাতন আমলের বাড়ি। তবে চাকচিক্যে, গৌরবে কম নয়। সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য যে এ বাড়ির মানুষের রুচিবোধ ভালো, তাদের আভিজাত্য নেহাতই মিছে নয়। বাড়ির তিন ছেলে আর দুই মেয়ে ঘরের ছেলে-মেয়েরাই এখন বংশের হাল ধরবে, এগিয়ে নিয়ে যাবে বংশের ধারা। বড় ছেলে সানওয়ার হক বিপত্নীক। তার একমাত্র পুত্র তাখলিফ হাসান তূর্য। মেজো ছেলে শামসুল হকের এক পুত্র, তার দুই কন্যা। বড় কন্যা ঝিনুকের বিয়ে হয়েছে তিনমাস। পুত্র ইয়াসিফ সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র। ছোট কন্যা মাশফিয়া জান্নাত ঝুমুর এবার এইচএসসি দিয়েছে। বাড়ির ছোটছেলে সাঈদ হকের দুই কন্যা নিশি, তিথি। জমজ। দু’জনেই দশম শ্রেণির ছাত্রী। তাখলিফ স্বভাবে অন্যরকম ও রগচটা বিধায় সকলের বারণ শুনেও সানওয়ার হক ছেলেকে নিয়ে তিনতলায় বাস করেন। বাবা-ছেলের সংসার তাদের। বাকি দুই ভাই পরিবার সহ মা সাজেদা বেগমকে নিয়ে দোতলায় যৌথ পরিবারে থাকেন। নিচতলাটা ভাড়া দেওয়া, সেখানে এক পরিবার মাসখানেক ধরে থাকছে। ঝিনুক এ বাড়ির কন্যা। তার বিয়ের পর পালা আসে ঝুমুরেরই, তাই শামসুল হক ব্যাপারটা নিয়ে আগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এর জন্য যে সবাই তাকে কথা শোনাবে সেটা কল্পনাতেও আনেনি। নিজের মেয়ের বিয়ে নিয়েও আজকাল কথা শুনতে হয়, হাহ! এসবই ভাবছিলেন শামসুল হক। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় পাখি বেগম চা খেতে ডাকতে এসে দেখলেন চিন্তিত স্বামীকে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে তিনি এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হলো আপনার?”

শামসুল হক চোখ খুলে তাকালেন। স্ত্রীর মুখভঙ্গি দেখে তিনি আরকিছু বললেন না। পাখি বেগম বরাবরই বোকা মহিলা, সরল এবং স্বামীভক্তও বটে! পান থেকে চুন খসলেই এই মহিলা চিন্তা করে করে অসুখ বাঁধিয়ে বসে থাকেন। শামসুল হক হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “ঝুমুর কই? নিশ্চয়ই রাগ করে আছে আমার ওপর? ওর মতামত না জেনে এভাবে পাত্রপক্ষ ডাকা আসলেই ঠিক হয়নি!”

পাখি বেগম মাথা দোলালেন। বললেন, “ছাদে গেছে। ডাকমু?”

শামসুল হক একটুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলেন,
“না একলা থাকুক। পরে কথা বলবো। মেয়েটা আমার কষ্ট পেয়েছে। যাইহোক, চা করেছো?”

পাখি বেগম বললেন,
“হুম। এইজন্যই তো আপনারে ডাকতে আসছি। চলেন।”

“আসছি।”

বসার ঘরে বাড়ির অন্যান্য সব সদস্যদের সাথে সানওয়ার হকও বসে চায়ের আড্ডা জমিয়েছেন। ঝুমুর তখন ছাদে। আর তাখলিফ কখনোই এই আড্ডায় অংশ নেয় না। শামসুল হককে আসতে দেখে ইয়াসিফ নিজের চা টুকু খেয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। পুত্রের কান্ড দেখে শামসুল হক
হতবাক হয়ে গেলেন। এই ছেলে ক্ষেপে আছে নাকি তার ওপর? বাড়িতে দুটো ছেলে, দু’জনই এভাবে ক্ষ্যাপা হয়ে গেলে আচ্ছা মুশকিল হবে তো!

_____________

ঝুমুর ছাদে দাঁড়িয়ে। মুখভার হয়ে আছে। এতক্ষণ কাঁদছিলো সে। লাল হয়ে গেছে ফর্সা মুখ। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না তবে ফোঁপানি থামেনি। বাবা-মা’র কাছে কি ও বোঝা হয়ে গেছে যে এত তাড়াতাড়ি ওকে বিয়ে দিতে চাইছে? কিভাবে পারলো ওর মতামত না জেনে পাত্রপক্ষকে বাড়িতে ডাকার? ঝুমুরের ভীষণ রাগ হচ্ছে।

“ইতালি প্রবাসী পাত্র। বয়স-২৮। বাড়ি- পুরান ঢাকা। একমাসের ছুটিতে দেশে এসেছে বিয়ে করতে। বিয়ের পর বউকে ইতালি নিয়ে যাবে। দু’জনে সংসার সাজাবে। বউকে পড়াশোনা করতে হবে না, কাজও না। আহা! কোনো কষ্ট নেই জীবনে। শুধু বউকে আগুন সুন্দরী হতে হবে। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ, লম্বা চুল, মিষ্টভাষী। যার কাজ হবে শুধুমাত্র স্বামীর মনোরঞ্জন করা। ঠিক তো?”

গমগমে, গম্ভীর কণ্ঠের কথা গুলো শুনে ফোঁপানি থেমে গেলো ঝুমুরের। পেছন ফিরে দেখলো সানওয়ার হকের একমাত্র পুত্র তাখলিফ হাসান তূর্য ওর থেকে কয়েক কদম পেছনে দাঁড়িয়ে। যার মুখটা দেখলেই ঝুমুরের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে, বসন্ত বাতাসের মতো হৃদয়ে শান্ত বাতাসের ঢেউ তোলে। অথচ মানুষটা কখনোই এসব টের পায় না। ঝুমুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজের ভাবনাকে একপাশে সরিয়ে রেখে মাথা নেড়ে বলে, “ঠিক।”

“আবার মায়ের বাধ্য ছেলেও। তাইতো?”

“হুম।”

“কেমন বাধ্য ছেলে, বল তো একটু শুনি?”

“যতটা বাধ্য হলে মায়ের কথায় বউকে ছেড়ে দিতে দু’বার ভাববেনা ততটা।”

ঝুমুর মুখ শক্ত করে কথাটা বলতেই সামনে দাঁড়ানো মানুষটি হেসে ওঠলো। বলল, “মাম্মাস বয়! পাপা কি পারির সাথে মাম্মাস বয়ে’র বিয়ে হলে জুটিটা দারুণ জমতো। এখন তো আফসোস হচ্ছে রে ঝুমু ; ভুল করে ফেললাম না তো?”

তাখলিফের কথা শুনে ঝুমুর বিস্মিত হলো। পরক্ষণেই যা বোঝার বুঝে গেলো সে। তার মানে ওর কথাতেই ইয়াসিফ এই কান্ড ঘটিয়েছে! ঝুমুর কাট কাট স্বরে বলল, “তাহলে আপনার কথায়ই দাদাভাই ছেলেটাকে মেরেছে তাইনা? নয়তো দাদাভাইয়ের একটু সাহসও হতো না এসব করতে।”

তাখলিফ রেলিঙের ওপর বসেছিলো। ঝুমুরের কথা শুনে বলে, “বেশ করেছি। নিশি, তিথিরও যদি কোনো আজেবাজে স্বমন্ধ আসে তাহলেও এরকম করেই বিদেয় করবো। বুঝলি?”

ঝুমুরের ভ্রু কুঁচকে যায়। সেটা বুঝতে পেরেই ও রেলিঙ থেকে নেমে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। এরপর আপাদমস্তক ওকে দেখে নিয়ে বলে, “খুব পছন্দ হয়েছিলো না? পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি ছেলেটাকে খুব পছন্দ হয়েছিলো ঝুমুর বেগমের? নাক ভেঙে তিন ফুট উচ্চতার ছেলের সাথে বিয়ে দেবো তোর। উল্টাপাল্টা কাজ করলে।”

হুমকি শুনে রাগ হলো ঝুমুরের। বিয়ে দেবে মানে কি? তাখলিফ কীভাবে এই কথাটা বলতে পারে? ও কি ভুলে গেছে সবকিছু! তাছাড়া ওই বেঁটে পাত্রকে পছন্দ করতে বয়েই গেছে ওর। তাখলিফ ওর মুখভঙ্গি লক্ষ্য করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো ঠাস করে। এরপর হনহন করে চলে যেতে লাগলো। গেইটের কাছে গিয়ে ফিরে তাকালো একবার। ঝুমুরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “যা যা গিয়ে ঘুমা। স্বপ্নটপ্ন দেখ। এই বেঁটের জন্য মন খারাপ করিস না। অন্য একটা মাম্মাস বয় এনে দেব!”

পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার ঝুমুরের মুখ ছোট হয়ে গেলো। ওর কেন মন খারাপ হবে? এত অপমান? মানুষটা ওর মন বোঝে না একটুও। আচ্ছা, প্রেমের বাতাস কি নির্মল? সে কি বোঝে না প্রেমিকার মনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো? ঝুমুর মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল। নাহ! আকাশের চাঁদকে নিয়ে ভেবে ভেবে মন খারাপ করবে না সে! তবু তাখলিফের যাওয়ার পানে তাকিয়ে সে বললো, “এই পৃথিবীর কাউকে চাইনা আমি, কাউকে লাগবে না আমার, আপনাকে
ছাড়া। আপনি শুধু আমার হয়ে যান।”

তাখলিফ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে
বিড়বিড় করে বলল, “তুই একটা বোকা ঝুমুর,
খুব বোকা।”

__________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here