ফুলকৌড়ি (৪২) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

1
1614

#ফুলকৌড়ি
(৪২)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সময়টা মধ্যহ্ণ।শহুরে পিচঢালা রাস্তা।নিভানের গাড়ী চলেছে শাশা শব্দ তুলে তার গন্তব্যে।গাড়ির গতিবেগ খুব অস্বাভাবিক নাহলেও স্বাভাবিক নয়।অথচ ছেলেটা সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করে নিয়মমাফিক গাড়ি চালাতে পছন্দ করে, অভস্ত্য।অনার্স লেবেলে গিয়ে নিভান যখন গাড়ি চালানো শিখলো,অল্প সময়ের মধ্যে দক্ষ হয়ে উঠলো।তারপর থেকে তার গাড়ীতে যতবার নীহারিকা বেগম চড়েছেন,নিপুণহাতে ছেলেটার দক্ষভাবে গাড়ী চালানো উপলব্ধি করেছেন।কোলাহল রাস্তায় বরাবর ছেলেটা নর্মাল গতিবেগে কি সুন্দর দক্ষতার সহিত নিপুণহাতে গাড়ী চালায়,তার গাড়িতে চড়লে আল্লাহর ভরসা করে তিনি নিশ্চিন্তে থাকেন।শান্তি পান,তৃপ্তি অনুভব করেন।সেই ছেলেটা প্রথম এক্সিডেন্ট করলো সেদিন।তবে নিজ দোষে নয়।বেখেয়ালিতে চলতে গিয়ে একজন মায়ের সঙ্গে তার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলো।তবে আজ!নিভানের হাত কেনো অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে!গাড়ির গতিবেগ কেনো স্বাভাবিকের তুলনায় অস্বাভাবিক চলছে।কেনো ছেলেটার নির্বিকার চাহুনি উনার কাছে এলোমেলো ঠিকছে!নিভান ক্লান্ত বলে!কতোটা পথ জার্নি করে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই আবার জার্নি।সেই ক্লান্ততায়?নাকি অন্যকিছু?আচ্ছা কৌড়ির অসুস্থতার সংবাদ নয়তো!হ্যা আজ নিজ চোখে ছেলের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন নীহারিকা বেগম।যখন নিভানকে জানালেন কৌড়ির অসুস্থতার খবর।হঠাৎই ছেলেটার স্বাভাবিক মুখের শান্ত আদল পাল্টে গেলো।কুঞ্চিত কপাল মূহুর্তেই মিলিয়ে গিয়ে, চোখের আকার হলো স্থির,ঠান্ডা।যেনো ভয়ংকর কোনো দুঃসংবাদ শোনানো হয়েছে তাকে।অদ্ভুত চোখে চেয়ে চেয়ে ছেলের পরিবর্তিত রূপ দেখলেন তিনি।তখনও খেয়ালে ছিলোনা,কৌড়ির প্রতি নিভানের আলাদা নজরভঙ্গি।কিছুসময় নীরবতায় কেটে গেলেও,যখন নিভান খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,চলো।তখন যেনো উনার হুঁশ ফিরলো।তারপর থেকে নিভানকে সুক্ষ নজরে থেকেথেকে দেখছেন তিনি।আর অনুভব করছেন ছেলের অস্বাভাবিক পরিবর্তন!কৌড়ির প্রতি তার দূর্বলতা!এটাতো নিশ্চয় একদিনে হয়নি!তবে এতোটা দূর্বল কৌড়ির প্রতি উনার ছেলে হলো কবে থেকে? কখন?যা উনার নজর এড়িয়ে গেছে!নজরে পড়েনি!আশ্চর্য!গাড়ির গতিবেগ আগের চেয়েও আরও অস্বাভাবিক হতেই,নীহারিকা বেগমের ভাবনার ছেদ ঘটলো।তড়িৎ বললেন।

‘নিভান,গাড়ি থামা।

মায়ের মৃদু আতঙ্কিত গলার শব্দে হুশে ফিরলো এমন ভাবে মায়ের দিকে তাকালো সে।ফের অমায়িক হাসল।
সে হাসি এলোমেলো ঠেকলো,নীহারিকা বেগমের কাছে।আরেকধাপ আশ্চর্য হলেন তিনি।নিভান এমনটা করছে?এই ছেলে উনার!ততক্ষণে নিভান নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বললো

‘ভয় পাচ্ছো কেনো,মা।আমাদের একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিত,তাই গতিবেগ একটু বাড়িয়ে দিয়েছি।ভয় পেও না।

আশ্বাস!আজ কেনো যেনো,নিভানের কথার আশ্বাসে ভরসা পেলেন না তিনি।নিভানের হাতের দিকে তাকালেন তিনি।স্ট্রিংয়ের রাখা শক্তপোক্ত হাতদুটো সাবলীল নয়।কেমন অ-সাবলীল কাজ করছে।এর আগেও তো নিভানকে গাড়ি চালাতে দেখেছেন তিনি।অদ্ভুত চোখে চেয়ে চেয়ে ছেলের অস্বাভাবিক কান্ড দেখলেন আর বিস্মিত হলেন।কৌড়ির অসুস্থতায় সংবাদে এতো অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে ছেলেটা।যার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চাইছেনা কিন্তু ভিতরের অস্বাভাবিকতায় বহিঃপ্রকাশ ঘটে যাচ্ছে ছেলেটার।কি আশ্চর্য!গলায়ও আশ্চর্যতা ঢেলে তিনি ফের বললেন।

‘নিভান গাড়ি থামা।

কেমন যেনো ক্লান্ত মনেহলো নিজেকে।অনেকটা সময় যুদ্ধ চালিয়ে বিরতি নেওয়ার পালা এমনভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের কথা মানলো নিভান।ফাঁকা দেখে রাস্তার সাইডে গাড়ি দাঁড় করালো।মূহুর্তেই মাথা এলিয়ে দিলো সিটে।গতকাল তার আগের দিন পরিক্ষা শেষ হওয়ার পর মেয়েটার সাথে কথা হয়েছে। তারপর আর কথা হয়নি।প্রচুর ব্যস্ত ছিলো নিভান।আর তার থেকেও ব্যস্ত ছিলো মন।কখন কাজ কমপ্লিট করে বাড়িতে ফিরবে সে।জাহিদ সাহেব তো আগে থেকেই কৌড়ির সম্পর্কে জানেন।এবার মা’কে জানিয়ে,সবাইকে নিয়ে কৌড়ির কাছে যাবে সেই তাড়ায়!অথচ তাড়া নিয়ে যাচ্ছে সে।কিন্তু কিভাবে! নিজেকে এলোমেলো করে নিয়ে।কৌড়ি এতো অসুস্থ জানায়নি কোনো তাকে?

‘পিছনে গিয়ে বোস।

ততক্ষণে গাড়ির পিছন সিট থেকে নেমে এসেছে তন্ময়ী আর ইভান।ভাইয়ের অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ইভান অবাক নাহলেও তন্ময়ী হয়েছে।একটু নয় বেশ অবাক হয়েছে। কেননা নিভান-নামক শ্রদ্ধাভাজন মানুষটাকে তার জানা আছে।তাই সহসা প্রশ্নও করলো সে, ইভানকে।

‘নিভান ভাইয়াকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে না?

‘ভাসুরের নাম ধরতে নেই।তওবা পড়ো।

সিরিয়াস বিষয়েও কেমন ফাজলামো।কপাল কুঁচকে অদ্ভুত নজরে ইভানের দিকে তাকালো তন্ময়ী।সেটা দেখে একগাল হেসে দিলো ইভান।চমৎকার সে হাসি।তবুও সে হাসিতে মোটেই গললোনা তন্ময়ী।সেভাবেই চেয়ে রইলো।সেটা দেখে তড়িৎ ইভান বললো।

‘তোমার ভাসুরকে শুধু এখনো অস্বাভাবিক লাগছে এটাই শুকরিয়া করো প্রভুর কাছে।কৌড়ি বলতে সে যে অন্ধ,মেয়েটা অসুস্থ তাতে আবার হসপিটালাইজড্
এটা শুনে তোমার ভাসুর এখনো উদভ্রান্ত পাগল হয়নি।এখনো সুস্থ মানুষের মতো আচারণ করছে।প্রভুর শুকরিয়া করো।

প্রহসন করে বলা ইভানের কথাগুলো হঠাৎ বিশ্বাস করতে পারলোনা তন্ময়ী।কৌড়ি আর নিভান ভাইয়া!যদি তাই হয়ে থাকে,তবু্ও নিভান ভাইয়ার ব্যক্তিত্ব এমন উতলা উদভ্রান্ত কখনো সে ভাবতে পারেনা।তবে মন থেকে হওয়া,টান মায়ার সম্পর্কগুলো আসলেই অদ্ভুত অন্যরকম হয়।তাতে নিজের স্বভাব, ব্যক্তিত্ব সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।এলোমেলো করে দেয় মন।এটা সে ইভানকে দিয়ে হাড়েহাড়ে অনুভব করছে।যে মানুষটার কর্মকান্ডে রাগ,ক্ষোভ,ঘৃণা জন্মেছিলো মনে।আজ মন তারই বশে।তার ছোঁয়ায়,তার ভালোবাসায় পার হচ্ছে নিজের দিনগুলো।সামনে সিটে গা ছাড়িয়ে বসা মানুষটাকে দেখে,কেমন যেনো তাকে নিয়ে অবিশ্বাস্য ভাবনাগুলো বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো।ফের বোকা নজর ঘুরিয়ে ইভানের মুখের দিকে আনতেই,হেসে মাথা ঝাকলো ইভান।বুঝালো তুমি যেটা ভাবছো,সেটাই।ফের সময় নিয়ে ফিসফিসিয়ে মৃদুস্বরে বললো

‘মনে হচ্ছে গাড়ি আমাকে চাালাতে হবে।

ততক্ষণে মায়ের আদেশ মেনে নেমে পড়লো নিভান।নেমে পড়লেন নীহারিকা বেগমও।তিনি নামতেই ইভানকে উদ্দেশ্য করে বললেন–তন্ময়ীকে নিয়ে সামনে গিয়ে বোস।দাদাভাই ক্লান্ত।গাড়ি তুই চালা।

মায়ের আদেশ মেনে তন্ময়ীকে নিয়ে সামনে বসলো ইভান।জায়গা পরিবর্তন করে নিভান-ও গিয়ে বসলো পিছনের সিটে।সহসা চোখ বুঁজে গা এলিয়ে দিলো সিটে।খুলে ফেললো শার্টের উপরের পরপট কয়েকটা বোতাম।যেনো গায়ে জ্বালা ধরে গিয়েছে তার।অথচ ঠান্ডার মধ্যও এসি চলছে নির্বিকার ভঙ্গিতে।নীহারিকা বেগম সুক্ষ খেয়ালি নজরে সবটা খেয়াল করলেন।ধীরেসুস্থে গিয়ে বসলেন ছেলের পাশে।ফের ইভানকে গাড়ি ছাড়তে বললেেন।সময় গড়ালো।গাড়ী চলছে স্বাভাবিক গতিতে।আর সেই স্বাভাবিকতা বজায় রেখে গাড়ির মধ্যে চলছে পিনপিন নীরবতা।হঠাৎই সেই নিঃশব্দতা ছাড়িয়ে নিভানের শান্ত গলার স্বর শোনা গেলো।ছেলেটা তখনও চোখ বুঁজে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে বসে আছে।নীহারিকা বেগম স্থির নজরে সেদিকে তাকিয়ে। আর সেটা বুঝে মনেহয় নিভান কথা পাড়লো।

‘মা,আমি কৌড়িকে বিয়ে করতে চাই।

নীহারিকা বেগম শুনলেন।কিন্তু কিছু বললেন না।সবটা বুঝেও কেনো যেনো নিভান আর তার কর্মকাণ্ডগুলো বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না।সত্যিই ছেলের পরিবর্তন নজরে পড়ার মতো।অথচ এরআগে উনার নজরে পড়লো না।কিকরে?

‘মা।

নীরবতা ভেঙে এবার কথা বললেন নীহারিকা বেগম।গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন। —শুনেছি তো।

মায়ের প্রসন্ন স্বর শুনে নিভান কেনো যেনো আর কথা বাড়ালো-না।তখনও ছেলের শ্যাম শান্ত মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে নীহারিকা বেগম।কি নির্বিকার শান্ত আদল।অথচ তার বিচলিত কর্মকাণ্ড বলে দিচ্ছে,ভিতরে ভিতরে কতোটা অশান্ত সে।সহসা হাত বাড়িয়ে নিভানের শক্ত-পোক্ত রুক্ষ হাতের উপর নিজের কোমল হাতটা রাখলেন।এ স্পর্শ যেনো নীরব আশ্বাস।মাতৃস্পর্শ পেতেই নড়েচড়ে উঠলো নিভান।তবে চোখ খুললো-না।সেভাবে চোখ বুঁজে রেখে মায়ের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বুকে চেপে ধরলো।যেনো ভিতরে বয়ে চলা অস্বাভাবিকতার ঝড়টা ঠান্ডা করতে চাইলো।ছেলের বলিষ্ঠ বুকে হাত পড়তেই মূহুর্তেই চমকে উঠলেন নীহারিকা বেগম।ছেলের হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা টের পেলেন নিগাঢ়ভাবে।বুকের খাঁচার ভিতরের হৃদযন্ত্রটা যেনো ঢিপঢিপ তালে নয় উগ্রবেগে উথাল-পাতাল ঝড় বইছে তালে চলছে।মানেটা কি?এতোটা অস্বাভাবিক আচারন কৌড়ির জন্য!নজর যেনো পিছনের সব বিস্ময়, আশ্চর্যতা ছাড়িয়ে গেলো।ছেলের বুঁজে থাকা মুখের দিকে কেমন আশ্চর্যজনক নজর নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।মনেহলো,উনি উনার গর্ভে ধারণ করা লালিতপালিত এতোদিনের চেনা সুপরিচিত শক্তপোক্ত, কঠিন ব্যাক্তিত্বের ছেলেটাকে নয়,সম্পূর্ণ অজনা অচেনা কাওকে দেখছেন।আর তার অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডগুলো বেজায় অবাক চোখে উপলব্ধি করছেন।নিভান!

হঠাৎই অনেক আগের পুরানো কিছু স্মৃতি মনে পড়লো।সেই মানুষটারই তো ছেলে।ছেলের কর্মকাণ্ড তো বাবার মতোই হবে!হওয়ার কথা!মানুষটার গায়ের রঙটা ছিলো শ্যামকালো।কিন্তু ভিতরের মনটা ছিল অমায়িক। ঝকঝকা পরিচ্ছন্ন,মায়াময়।নিজের মানুষ বলতে তার ভালোবাসা যত্নগুলো ছিলো নজরে লাগার মতো।যেমন ধৈর্যশীল শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন তেমন সহনশীল।আর নীহারিকা বলতে মানুষটা ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছিলেন। একটা সময় কটাক্ষ করে কতো আত্মীয় স্বজন কত কথা বলতো–রঙেচাপা ছেলেদের বউ সুন্দর হলে,সেসব ছেলেরা নাকি বউ যত্নে রাখে।খুব ভালোবাসে।তাই আওসাফ-ও তার বউ বলতে পাগল।আরও কতো কথা।লজ্জা পেতেন।সেই লজ্জায় যেনো দ্বিতীয়বার না পড়তে হয়,তাই মানুষটাকে আড়ালে বকতেন।কথা শুনাতেন।অথচ কে শোনে কার কথা।তার যত্নশীলতা চলতো তার নিয়মে।আর তারইতো ছেলে নিভান!

ঠিক কতোটা সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে কৌড়ির জানা নেই।তবে ঘুমের ঔষধের প্রভাব কাটতেই গভীর ঘুমটা কেটে গিয়ে সকল ইন্দ্রিয় যেনো সচল সজাগ অনুভব হলো।ঘুমের প্রভাব পুরোপুরি না কাটায় আর শারীরিক দূর্বলতায় চোখ যেনো ডুবে রইলো।কিছুতেই মেলাতে ইচ্ছে করলো না।তবে ঘুমের রেশটা কেটে সকল ইন্দ্রিয় যখন সচল হলো সুপরিচিত তীব্র একটা সুগন্ধ নাকে এসে বাড়ি খেয়ে মস্তিষ্কে হানা দিলো।অনুভবে নাকি সত্যি?আচ্ছা মানুষটার তো আসার কথা ছিলো।তবে কখন আসার কথা ছিলো?আজ না গতকাল!ঘুমের ঔষধের ঘোরে খেয়াল করতে পারলো-না।গভীরভেবেও
সময়টা দিন চলছে নাকি রাত, সেটা-ও আন্দাজে করতে পারলোনা।তবে কি মানুষটা নিজের কথা রাখতে সত্যিই চলে এসেছে?হঠাৎ ডাক্টারের বলা নিজের অসুস্থতা কারনগুলো কানে বেজে উঠলো।মূহুর্তেই মনটা তিতকুটে অনুভূতিতে ডুব দিলো।কেনো এসেছে মানুষটা?তার জীবনটা অভিশপ্ত!আর সেই জীবনে যাকে জড়াবে সেও তো অভিশপ্ত হবে।নিশ্চয় মানুষটা শুনেছে,সে অসুস্থ।কারনটাও এতোসময় জেনে নিয়েছে।তবে এখনো কেনো এখানে মানুষটা!কৌড়ি শিওর,মানুষটা এসেছে।এবং তিনি তার অতি সন্নিকটে বসা।এতোসময় যে সুগন্ধটা মৃদুমৃদু নাক লাগছিলো এখন সেটা তীব্র,গাঢ় রূপ নিয়েছে।চোখ মেলতে চেয়েও মেললোনা কৌড়ি।পেশেন্ট বেডের পাশে,স্টিলের টুলে বসা মানুষটা তখনও তীক্ষ্ণ নজরে কৌড়ির ঘুমন্ত মুখের পানে চেয়ে।গভীর নজরে কৌড়ির ঘুমন্ত মুখের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সে।পুরো ঘন্টাখানেকের অপেক্ষার প্রহর বুঝি শেষ হলো এবার।তবে সজাগ হয়েও কৌড়ি যখন চোখ মেললো না,কারনটা বুঝি অনুধাবন করতে পারলো।সময় নিয়ে
ঝুকলো নিভান।কৌড়ির মুখের সন্নিকটে মুখটা নিয়ে খুব শান্তকন্ঠে বললো।

‘ডক্টর কি বলেছে জানো?বলেছে,বিয়ের আগে বাচ্চা হওয়ার প্রসেসিংটা কমপ্লিট করে নিতে।তুমি কি বলো?ডক্টরের পরামর্শটা কিন্তু আমার বেশ মনে ধরেছে।

সর্বাঙ্গের কম্পিত শিরশিরানিটা জানান দিলো সামনের মানুষটার শীতল গলার কথার ওজন, ভার।ফাজলামো করে বলা কথাটার গলার স্বর মোটেও সুবিধার ঠিকলো না কৌড়ির কাছে।তারউপর রেগে গেছে মানুষটা!গলার স্বরটা তেমনই জানান দিলো।ভিষণ কান্না পেলো কৌড়ির।ভুলেও চোখ মেললোনা।আর চোখ না মেলেও আন্দাজ করতে পারলো,সামনে বসা মানুষটার কঠিন করে রাখা মুখাবয়ব।শান্ত অথচ রাগান্বিত দুটো চোখ।
নিভান,কৌড়ির গতিবিধি খেয়ালি নজরে দেখলো।আরও ঝুকলো সে।ফের রাগ সামলাতে না পেরে বলেই বসলো।

‘তোমাকে কি বলে ছিলাম!বলো?বলেছিলাম না,কঠিন অসুখ বাঁধালে তোমাকে কিন্তু নিভান ছেড়ে কথা বলবে না।আস্ত রাখ…

‘মেরে ফেলুন-না আমাকে!এরকম অভিশপ্ত জীবন আমার চাইনা।যার সদ্য জীবন বাঁচাতে মা চলে গেলেন, যার চিন্তায় বাবাও গত হলেন।এখন আপনি!মেরে ফেলুন!সত্যিই এই অভিশপ্ত জীবন আমার চাই-না।

নিভান চোখবুঁজে দাঁতে দাঁত চেপে কৌড়ির বকে চলা প্রলাপ শুনলো।কৌড়িকে প্রেশার দিয়ে এমন কথাগুলাে সে বলতে চায়নি।কিন্তু মেয়েটাকে এরকম হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে নিজেকেও ঠিক রাখতে পারিনি, পারছে না।পাতলা শরীরটা কিভাবে বেডের সাথে লেপ্টে আছে!একটু আগে রক্তের একটা সেলাইন শেষ হয়েছে।নিজ হাতে সেলাইনের লাইনের সুচটা টেনে খুলেছে সে।ফর্সা হাতটা ফুলে জায়গাটা লাল হয়ে আছে।কি অবস্থায় নিয়ে গেছে নিজেকে!ডক্টর বলেছে, সমস্যাটা শুরু হওয়ার কিছুমাস বা বছরের মধ্যে ডাক্তারের শরাণাপন্ন হওয়া উচিত ছিলো আপনাদের।অথচ বোকা মেয়েটা মাত্রাধিক পর্যায়ে যাওয়ার পর ব্যাপার সবাইকে জানিয়েছে।জানিয়েছেতো না জেনেছে সবাই।রাগ কি তবে সহজে কন্ট্রোলে রাখা যায়!সেই অসুস্থ মেয়েটাকে,না পারছে কাছে টানতে আর না পারছে তারউপর জমা রাগ ক্ষোভের কথাগুলো ভিতরে চেপে রাখতে।কৌড়ি কথা শেষ করতেই অনিমেষ গলায় বললো।

‘কিন্তু আমার যে এই অভিশপ্ত নারীটাকেই চাই।চাই মানে চাই।তুমি অভিশপ্ত হও বা কলঙ্কিনী তবুও তোমাকে চাই আমার।

দৃঢ়কণ্ঠের বার্তায় এবার চোখ মেললো কৌড়ি।মূহুর্তেই দুপাশের কার্নিশ বেয়ে হড়হড় করে নামল নোনাজলের স্রোত।ভাসমান নোনাজলের ঝাপসা চোখে নজরে পড়লো,ক্লান্ত শুষ্ক একটা কঠিন মুখাবয়ব ।শ্যামবর্ণ রঙটা আজ আরও চাপা দেখাচ্ছে। সবসময় পরিপাটি রূপটা নেই।কেমন উদভ্রান্ত!অথচ মায়াময়।গায়ের সাদা শার্টটার এলোমেলো অবস্থান!এরকম উদভ্রান্ত অগোছালো কখনো দেখেছে মানুষটাকে?কখনো দেখেনি কৌড়ি!সবসময় তার পরিপাটি রূপ দেখেছে।অথচ আজ এই রূপ।ফের চোখ বুঁজে নিলো কৌড়ি।কারজন্য এমন উদভ্রান্ত,পাগল পাগল অবস্থা মানুষটা?তারজন্য!কঠিন চোখে কৌড়ির কান্না দেখে গেলো নিভান।কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে চলা নোনাজলের দিকে কিছু সময় চেয়ে ধপ করে উঠে দাঁড়ালো সে।গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললো।

‘আজ মঙ্গলবার, এখান থেকে তিনদিন পর শুক্রবার।আর সেদিনই আমাদের বিয়ে।এখন সন্ধ্যা, একটু পরেই তোমাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরছি।

কৌড়ির বিস্মিত মুখের দিকে না চেয়ে বাহিরের পানে পা বাড়ালো নিভান।সেটা লক্ষ্য করেই আশ্চর্য গলায় কৌড়ি বলে উঠলো।

‘এটা হতে পারেনা।

থেমে গেলো নিভান।পিছে মুড়ে বললো–কি হতে পারে না?তুমি ওবাড়িতে যেতে চাইছো না নাকি বিয়েটা করতে চাইছো না?

‘বিয়েটা!

‘কেনো হতে পারেনা?

কেনোর উত্তর দিতে গিয়েই থমকে গেলো কৌড়ি।সেদিকে কেমন অদ্ভুত নজরে চেয়ে রইলো নিভান।সেই নজরে বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে পারলোনা কৌড়ি।নজর ফিরিয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকিয়ে কেমন করুণ গলায় বললো–কেনো বুঝছেন না আপনি!

আবারও কৌড়ির দিকে এগোলো নিভান।বেডের পাশে দাড়িয়ে শান্ত নির্বিকার গলায় শুধালো—কি বুঝবো?কি বোঝাতে চাইছো তুমি?

নিভানের দিকে ফিরলো কৌড়ি।শান্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ দুটোতে চোখ রাখলো।কথাটা বলতে গলায় বিঁধলেও,ঢোক গিলে কথাটা কাটাছেঁড়ার মতো ভেদ করে মুখে আনলো।–যদি আমি কখনো মা না হতে পারি!

দাঁড়িয়ে থেকেই নিভান ঝুকলো কৌড়ির পানে।শার্টের বোতাম খোলা থাকায় উঁকিঝুঁকি দিলো লোশমের আস্তরণে আকর্ষণীয় বলিষ্ঠ বুক।পলকে নজর সরিয়ে নিভানের চোখ চোখ রাখলো কৌড়ি।সেই নজরে নজর স্থির রেখে দৃঢ়কণ্ঠে বললো নিভান।

‘যদিও ডাক্তার তেমন কিছু বলেননি।তবে তুমি যদি কখনো মা না হতে পারো।আমিও কখনো বাবা হতে চাই না কৌড়ি।

থামলো নিভান।কৌড়ির নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা চোখের দিকে বেশ কিছুসময় তাকিয়ে থেকে এবার কন্ঠ কোমল করে বললো–সেদিন ঝড়বর্ষার দিনে যখন তোমাকে ওই অবস্থায় দেখলাম।আমার কলিজার মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করেছিলো তোমাকে।আজও সেই ইচ্ছেটার তীব্র তেষ্টা পেয়েছে।তৃষ্ণায় পাগল পাগল অনুভব হচ্ছে ভিতরটা।কিন্তু আমি পারছি না তোমাকে কাছে টানতে।আর আমি চাইছিওনা সম্পর্কের বহির্ভূত তোমাকে ছুঁতে।প্লিজ কৌড়ি,এই তৃষ্ণাটুকু মেটাতে সাহায্য করো আমাকে।ঠুনকো অসুস্থতা বা অযৌক্তিক কোনো বাঁধা আমাদের দুরত্বের কারণ হতে পারেনা।তাই এসব কারণ উল্লেখ করে আমার তৃষ্ণাটা দমবন্ধ করা অনুভূতিতে পরিণত হতে দিওনা।প্লিজ।

এমন মানুষকে স্বামীরূপে পাওয়া ভাগ্য। শুধু ভাগ্য নয় সৌভাগ্যতো বটেই।অথচ সেই মানুষটাকে নিজের দূর্ভাগ্যের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বঞ্চিত করবে কত পাওয়া থেকে!যা মানুষটার প্রাপ্য।কিন্তু মানুষটা তো বুঝতেই চাইছেন না।আর বুঝবে এ আশা করেনা কৌড়ি।তবুও মানুষটার ভালো তো সে চায়।কৌড়ির ভাবনার মাঝেই নিভান সরে দাঁড়ালো।ওই ভারাক্রান্ত অবুঝ চোখ, কান্নায় রক্তিম আভা ছড়ানো লাল নাক,শুষ্ক ঠোঁট। মলিন মুখ তাঁকে টানছে।একটু নয় গভীরভাবে টানছে।যখন তখন কিছু একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে।এজন্য হয়তো হারাম নারী থেকে দূরে থাকার নিষেধাজ্ঞা,জরুরি। নিভান আর দাঁড়ালোনা।আর না কৌড়ির উত্তরের আশা করলো।সহসা পা বাড়িয়ে কেবিনের বাহিরের দিকে অগ্রসর হলো।সেটা লক্ষ্য করেই কৌড়ি দূর্বল গলায় কয়েকবার ডাকলো তাকে।তবুও পিছু ফিরলো নিভান।এই ডাকের অর্থ তার জানা আছে।খুব ভালো করে জানা আছে।এবার শেষ দূর্বল অস্ত্র ব্যবহার করলো কৌড়ি।মৃদু চঞ্চল গলায় ডাক দিলো।

‘নিভান।

থামকালো পা।সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ফের পা বাড়ালো সামনের দিকে।এই ডাক উপেক্ষা করার নয়!তবুও উপেক্ষা করতে হবে তাকে।ভিতর থেকে দূর্বল
করে দেওয়া এই ডাকের অর্থ কৌড়ি জানে।তাই দূর্বল করতে এই ডাক।তবে কৌড়ির চাওয়া আবদার পূরণ করা তারজন্য কখনো সম্ভব নয়।আবদার তো নয় অনর্থকর অনাবদার।যা নিভানের দ্বারা পূর্ণ করা আদৌ সম্ভব্য নয়।

নিভানের চলে যাওয়ার পানে কেমন করুন চোখে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।নজরের আড়াল হতেই চোখ বুঁজে নিলো সে।আশা করেছিলো,এই ডাকেও কাজ হবেনা।তবে শেষ চেষ্টা করতে আপত্তি কোথায়, মানুষটাকে থামাতে।তাই ভিতরের বিড়ম্বনা অস্বস্তি ঠেলে দিয়ে তার বয়সের কতোবড় মানুষটাকে নাম ধরে ডেকেছে!অথচ ফলাফল শূন্য।ফলাফল শূন্যইতো আশা করেছিলো সে।তবুও চেষ্টা বিফলতা আনতেই মনটা হতাশ হলো।ভিতরটা হুহু করে উঠলো তীব্র যাতনায়।

গতকাল বিকাল থেকে অতিমাত্রায় পেটব্যথা আর স্বাভাবিকের চেয়ে প্রচন্ড রক্তক্ষরণে পাগলপ্রায় অবস্থা ছিলো তার।শরীরের এই অবনতির কথা বাড়ির মানুষ জানতে পারলো রাতে।তখন ডক্টরের শরণাপন্ন হওয়ার মতো অবস্থা ছিলো-না।সময়টা ছিলো গভীর রাত।তাই সারাটা রাত প্রচন্ড ব্যথায় কাটাতে হয়েছে তাকে।সকাল হতেই শারিরীক অবনতির কারণে আর দেরী করা হয়নি।হসপিটালে আনতেই ইমার্জেন্সিতে ডক্টর দেখানো হয়েছে।সবটা করেছে নাহিদ আর কৌড়ির ছোটো চাচা।তারপর ডক্টর রোগীর বক্তব্য অনুযায়ী বিভিন্ন টেস্টসহ নিজেও পরিক্ষানিরিক্ষা করলেন। রিপোর্ট দেখার আগে যেটা ধারনা করলেন,অবলীলায় রোগীর সামনে সেটা উপস্থাপন করলেন।তবে রিপোর্ট অনুযায়ী ঔষধ দেওয়ার আগে,কৌড়ির অতিমাত্রায় পেটব্যথা আর বিল্ডিং বন্ধের ঔষধসহ ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছিলেন।যার রেশ কেটে গিয়ে ভর করেছে এখন অনেক চিন্তা।নিজের অসুস্থতার ভাবনা বাদ দিয়ে ভর হয়েছে ওই মানুষটার চিন্তা।

‘সত্যিই কি মানুষটা বিয়ের চিন্তা ভাবনা করে ফেলেছে!

ভাবনাটা আর এগোতো পারলোনা।তন্মধ্যে কেবিনে ঢুকে পড়লো প্রিয় কিছু মুখ।নীহারিকা বেগমকে দেখেই কেমন যেনো মন আবেগপ্রবণ হলো।সহসা কেদে ও ফেললো।তা দেখে তড়িঘড়ি করে কৌড়ির কাছে গিয়ে বসলেন তিনি।স্নেহময় হাতে কৌড়িকে বেড থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদুরে বুঝদারী কতো কথা বলতে থাকলেন।মাথায় ঘনোঘনো মাতৃত্ব স্পর্শে আদর ছোয়াতেও ভুললেন না।একপর্যায়ে গিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললেন।

‘আমার নিভানের বউ হবি কৌড়ি?চল-না তোকে একেবার নিয়ে রেখে দেই আমার কাছে।এই কৌড়ি জানিস,তোরজন্য আমার ছেলেটা ভালো নেই।আমার নিভান সমগ্র পৃথিবীর মেয়ে রেখে এই ফুলকৌড়িতে এতো পাগল হলো!কিকরে রে?বিশ্বাস কর,তোরজন্য ছটফট করতে দেখে আমারই বিশ্বাস হচ্ছিলোনা,ও আমার সেই নিভান।যার নিজের ইচ্ছে,আকাঙ্ক্ষা,শখ, চাওয়া পাওয়া বলতে মুখ ফোটেনি কখনো।অথচ আজ আমার কাছে কি নির্দ্বিধায় সে চেয়ে বসলো তোকে!চল-না কৌড়ি, আমার বাচ্চাটাকে ভালো রাখতে।

চলবে…

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here