হিয়ার_মাঝে ১৫. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
201

#হিয়ার_মাঝে ১৫.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

গত দু’দিনেও ইমদাদের কোনো খোঁজ নেই। নুবাহ বিচলিত হয়ে পড়ল। এভাবে গায়েব হওয়ার কারণ কি? তার নানুর নাম্বারে একাধিক মেসেজ পাঠিয়েছে সে। শেষে জবাব না পেয়ে লাগাতার কল দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যতবারই কল দেয়, ততবারই মুঠোফোন বন্ধ শোনা যায়। সে আৎকে উঠে। অস্থিরতায় নিজের পড়াশোনায়ও মন বসাতে পারছে না। কিন্তু ঠিক তিনদিন পর আচমকাই এক ক্ষুদে বার্তায় থমকে যায়।

‘নুহাহ, বলতে পারবে ভালোবাসার মানুষগুলো কেনো হারিয়ে যায়? কেন দূর আকাশের তারা হয়ে জ্বলে। কেন আর ফিরে আসে না? তাহলে এত ভালোবাসায় সিক্ত করে কেন? পারবে জবাব দিতে?’

এমন বার্তা কেন দিয়েছে ইমদাদ? কি হয়েছে তার। সে দ্রুতই কল দিল। কিন্তু ওপাশ থেকে কল রিসিভ হল না। নুবাহর মন কু ডাকছে। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে ইমদাদের। নয়ত এমন নিরবতা। উদ্বিগ্নতা বাড়তেই লাগল। হঠাৎই রুকাইয়ার উঁচু স্বর ভেসে এল।

‘নিশাত, খেতে আয়।’

নুবাহ নিজের দুশ্চিন্তাকে একপাশে রেখে খেতে গেল। না খেলে অজস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবে তার মা’। খাবার টেবিলে বসতেই নিজের বাবাকে দেখে চমকে উঠল। তার বাবা আসল কখন। তিনি চট্রগ্রাম থেকে ফিরেছেন। অথচ সে জানেই না। নীলাভও চুপচাপ তার পাশে বসেছে। নিভানকে তার মা’ খাইয়ে দিচ্ছে। রশিদ চেয়ার টেনে বসল। তার তীক্ষ্ণদৃষ্টি নুবাহর উপর। আচমকাই প্রশ্ন করে বসল তাকে।

‘তোমার পড়াশোনার কি অবস্থা? ক্লাসটেস্টে এবারও কি ২০/২৫ পেয়েছো?’

বাবার এমন তাচ্ছিল্য মাখা প্রশ্নে বেশ কষ্ট পেল সে। মেয়ে’রা নাকি বাবাদের অনেক আদুরে হয়। অথচ তার বাবা তার কাছে আতঙ্কের আরেক নাম। জোর করে চাপিয়ে দেয়া বিজ্ঞান বিভাগ নিয়েছিল সে। কিন্তু তাকে কখনও টিউশন পড়তে দেয়নি। নিয়মিত ক্লাস আর ঘরে ঠিকভাবে পড়াশোনা করলেই না’কি ভালো রেজাল্ট করা যায়। তার বাবার এমন যুক্তি তার জীবনে যে বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। সেটা কি তার বাবা জানে। হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল নিশব্দে। বাবার দিকে এক ঝলক তাকাল। মলিন সুরে বলে উঠল,

‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। তবে পরীক্ষায় এবার ২০/২৫ পাইনি আমি। ৫০ শে পুরো ৪৮ পেয়েছি।’

রশিদও মেয়েকে এক পলক দেখল। মুখ নিঃসৃত উচ্ছ্বসিত কোন বাক্যে বের হল না তার। শুধু ছোট্ট করে বলে উঠল, ‘হুমম।’

নুবাহ ফের আরেকবার হতাশায় আচ্ছন্ন হল। তার বাবা একবার কি বলতে পারল না। মাশ’আল্লাহ আমার মেয়ে তো ফাটিয়ে দিয়েছে। আব্বু দোয়া করি তুমি আরও ভালো কর। কিন্তু না, এমন কিছুই তার বাবা করল না। চুপচাপ খাবার খেয়ে যাচ্ছে। সেও দ্রুতই নিজের খাবার শেষ করে রুমের দিকে ছুটল। দু’চোখ থেকে আপনা আপনি জল বের হয়ে এল। নিজের ভারী নিশ্বাসের শব্দই নিজের কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাল। কেন এত কষ্ট লাগছে তার কাছে। কখনও তার বাবা খুশি হয় না। না কোনদিন মাথায় হাত বুলিয়েছে। কেন করে না। তমার বাবাকে দেখলে তার খুব কষ্ট হয়। কত যত্ন করে, আদর করে খাইয়ে দেয়। আম্মু আম্মু বলে ডাকে। অথচ তার বাবা কেন বলে না। বক্ষস্থল ভারী হয়ে গেল। শুধু টুপটাপ দু’চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে তার বইয়ের পাতায়।

আচমকা বসার ঘর থেকে রুকাইয়ার ডাক শুনা গেল। ‘নিশাত, তোর মোবাইলে টাকা আছে। থাকলে তোর ছোট মামাকে একটা কল দেয় তো। কালকে বাসায় আসতে বল তোর নানুসহ।

নুবাহ আৎকে উঠল। মাত্র দু’টাকা আছে তার মুঠোফোনে। এ টাকা একদমই খরচ করা যাবে না। ইমদাদকে কল দিতে হবে। লোকটা তার কল রিসিভ করবে না। কিন্তু তাকে অন্তত এই টাকা রাখতেই হবে। তবে তার মুঠোফোনে অজস্র মেসেজ কিনে রাখা আছে। ইমদাদকে মেসেজ পাঠানোর জন্য। চাইলে সেগুলো তার মা’ কাজে লাগাতে পারে। নিজমনে বিড়বিড় করল, লাগবে নাকি আম্মু? তার বিড়বিড় করা শব্দ তার মায়ের কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাল না। সে নরম সুরে বলে উঠল, ‘ব্যালেন্স নাই আম্মু।’

রুকাইয়ার আর কোন ডাক শোনা গেল না। নুবাহ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। তবে চৌকাঠে দন্ডায়মান এক নারী মূর্তি দেখে চমকাল। হুট করে তার রুমে নীলাভ প্রবেশ করল। চোখমুখ ভীষণ থমথমে। করুণসুরে বলে উঠল,

‘আপু, রাফি খালি আমারে বিরক্ত করে। আমারে দেখলেই ব্যঙ্গ করে। বলে আমি না’কি ডরাই ওরে। তার লাইগা আমার বোনে’রে নিয়া গেছি ওরে ভয় দেখাইতে।’

নুবাহ তিরিক্ষি মেজাজে তার দিকে তাকাল। গলার স্বর রুক্ষ করে বলল, ‘তুই খালি ঘরেই খবরদারি করতে পারছ। প্রতিদিন কি আমি তোরে বাঁচামু। তোর কি মুখ নাই। আল্লাহ তোরে মুখ দিছে কি জন্য? ও তোরে একটা বললে, তুই তাকে দশটা বলবি। নিজের রক্ষা নিজেই করবি। অন্যের সাহায্য নিবি কেন সব সময়। রাফি তো ঠিকই বলছে, তুই তারে ডরাস। যা এখন, এখান থেকে ভাগ।’

নীলাভ ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। আশাহত হল বোনের এমন আচরণে। নিশব্দে রুম থেকে বের হয়ে কিছুদূর গিয়ে বলল, ‘তুই খারাপ, খুব খারাপ। খবিশনির বাচ্চা খবিশনি।’
এ কথা বলেই এক দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেল।

নীলাভের কথা শুনে কষ্টের মধ্যেও খুব হাসি পেল তার। নিজমনে আওড়াল, ড্রামা কুইন।

কিছু সময় অতিক্রম হতেই ফের মনটা বিষাদে নিমজ্জিত হল। মানসপটে ভেসে এল ইমদাদের অস্পষ্ট হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী। খুব বেশি মনে পড়ল তার অদেখা প্রিয় পুরুষকে।
____________________

নিশুতি রাত। আকাশ মাঝে ঝলমল আলোয় আলোকিত থালার মত চন্দ্রিমা। অথচ মনের কোণে মেঘ জমে আছে ইমদাদের। কাঠের বারান্দায় বসে আকাশ পানে চেয়ে আছে নিষ্পলক। গত তিনদিন নিজেকে একরকম আড়ালেই রেখেছে। চোখের কোণ বেয়ে এখনও জল গড়িয়ে পড়ছে। মুঠোফোন বন্ধ করে রেখেছিল। আজ মনের ভুলে কিছু সময়ের জন্য খুলেছে। তার মানসপটে সেই অদেখা মানবীকে মনে পড়ল। তাই তো অজান্তেই ছোট্ট এক বার্তা পাঠিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে সেই মানবীর অজস্র ক্ষুদে বার্তা জমা হয়ে আছে ইনবক্সে। তবে এই অজস্র ক্ষুদে বার্তার ভীড়ে এক বার্তায় তার চোখ আটকে গেল। এই বার্তা গত তিনদিন আগের দুপুর বেলায় তাকে পাঠানো হয়েছে।

❝পুব গগনে ঊষার দ্যুতি
সন্ধ্যো সাঁঝের বাতি,
সুধাময় নিশিত ভাতি,
দিশাহীন পথিকের সাথী।
অভিবাদন হে’ ভাস্কর
রাঙিয়ে রাতের শহর।
জ্বালিয়ে আলোর মশাল
দিয়েছো নতুন সকাল।❞
~মেঘা সুবাশ্রী~

চোখদুটো ঝাপসা হয়ে গেল সহসাই। এত সুন্দর কবিতা তাকে উদ্দেশ্য করে লিখা। সত্যিই কি সে তার যোগ্য। কথা বলার জন্য মন’টা বড্ড বেপরোয়া হয়ে উঠল। কোন দ্বিধাবোধ ছাড়াই ফোনকল দিল তার অদেখা প্রেয়সীকে। অথচ তার জানা নেই, আদৌও রিসিভ হবে কি’না। কিন্তু মাত্র দু’সেকেন্ড মাঝেই ওপাশে থাকা মানবী তার কল রিসিভ করল। সে কিঞ্চিৎ অবাক হল। তার মলিন ভেজানো গলা।

‘কেমন আছ নুহাহ?’

নুবাহর দু’চোখ নিদ্রাহীন। গত তিনদিন ধরে যেন নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল। তাই আজও মুঠোফোন হাতে অপেক্ষা করছিল। তার প্রিয় পুরুষের একটা মেসেজ বা কল যদি আসে। তবেই শান্তিতে ঘুমাবে। কিন্তু সত্যিই আজ তার প্রিয় পুরুষ তাকে স্বরণ করেছে। এজন্যই তড়িঘড়ি কল রিসিভ করল। কিন্তু ওপাশের এমন মলিন কথায় সে আৎকে উঠল। প্রতিত্তোরে বলল,

‘কি হয়েছে আপনার? মন খারাপ কেন?’

জবাবে ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাসের করুণ শব্দ এল। কিছু সময় পর ইমদাদ বলে উঠল, ‘তুমি ঘুমাওনি নুহাহ। আজ এত জলদি কল রিসিভ করলে। তুমি কি জানতে আমি তোমাকে কল দেব।’

নুবাহর বেশ রাগ হল। লোকটা এভাবে কথার প্রসঙ্গ পালটে দিল। কিন্তু তাকে তো জানতেই হবে ইমদাদের কি হয়েছে? সে ফের বলে উঠল,
‘এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর নয়, স্যার। সত্যি করে বলুন না আপনার কি হয়েছে?’

ইমদাদের দু’চোখ বেয়ে আবারও জল গড়াল। কথাগুলো দলা পাকিয়ে আছে তার। বেশকিছু সময় পর জবাব এল। ‘জানো নুহাহ, আমার নানু নেই। সে আকাশের তারা হয়ে গেছে। আমাকে আর কেউ বলবে না, আমার ইমু’টা কোথায়? আমার ভাই’টা এসেছে। এই ইমদাদ নামটা আমার নানুর দেয়া নাম ছিল। কত আদরের নাতী ছিলাম আমি। দিনের ভালো মানুষ’টা রাতের আঁধারেই হারিয়ে গেল। এভাবে এক মূহুর্তে আমাদের ছেড়ে ওপারে চলে গেছে। আর কখনই ফিরবে না।’

ইমদাদ কান্নায় নাক টানছিল বার বার। কান্নার জন্য কথাগুলো ভাঙা ভাঙা শোনা যাচ্ছিল।

নুবাহ নিস্তব্ধ। ইমদাদের নানু নেই। লোকটা এজন্যই এত চুপসে গিয়েছে। সান্ত্বনার বাণী খুঁজে পেল না সে। শুধু নিজমনে দোয়া পড়ল। সময় এভাবেই পার হল। দু’পাশে দুজনেই নিরব। একজন হারানোর ব্যথায়, অন্যজন তার পাশে না থাকতে পারার ব্যথায়। ইমদাদ হুট করে বলে উঠল,

‘তুমিও কি এভাবে একদিন আমার থেকে হারিয়ে যাবে, নুহাহ?’

নুবাহ পুরাই নির্বাক। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল কিছু সময়। ফের কাঁপা কাঁপা ভেজানো গলায় বলল,

‘আমি কোথায় হারাব? আমি আছি তো আপনার পাশে।’

‘এভাবে সবসময় থাকবে।’

নুবাহ ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘হুমম।’

ইমদাদ আনমনে বলে উঠল, ‘তুমি সামনে থাকলে এখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বলতাম। আরামে তোমার কোলে আমি মাথা রাখতাম। আর তুমি আমার চুলে হাত বুলাতে। আচ্ছা, আমার এই স্বপ্ন’টা কি আদৌ পূরণ হবে?’

নুবাহ কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। কি বলছে এসব আজব গজব। হুট করে বলে উঠল, ‘স্যার, আপনি ঘুমান এখন। আমি রাখছি।’

‘রেখে দিবা, কতদিন পর কথা বলছি। আরেকটু কথা বলি।’

নুবাহ ভয়ে থরথর করছে। তার জল্লাদ বাপ আজকে বাসায়। যদি জানতে পারে, তার কি হবে এখন। হতাশার সুর তুলল মুখে।
‘আজকে আব্বু বাসায় আছে। এখন রাখি। কাল কথা বলব।’

নুবাহ দ্রুতই কল কাটল। ইমদাদের মুখ শুকনো হয়ে গেল মূহুর্তে। বক্ষস্থলে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। ভালোবাসি বলতে না পারার যন্ত্রণা যে বড্ড ভারী হয়। কবে মন খুলে বলতে পারবে।

‘ভালোবাসি প্রিয় বোকাপাখি।’

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here