হিয়ার_মাঝে ১৬. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
189

#হিয়ার_মাঝে ১৬.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

প্রভাতের শুরুতেই একগাদা মেসেজের শব্দে ঘুম ভাঙল নুবাহর। এত মেসেজের বহর। অবাকের চরম পর্যায়ে সে। দু’য়েকটা পড়ে নিল। এখন নিজেকে চরম বেকুব মনে হচ্ছে। এভাবে ইমদাদ ভুল বুঝল তাকে। প্রায় প্রত্যেক মেসেজে ছিল তার ‘সর‍্যিই’ লিখা। কিন্তু একটা মেসেজ ছিল বিশাল আকারের।

‘দুঃখিত, এমনকি ভীষণভাবে লজ্জিতও! আমি আসলে কি বলতে কি বলে ফেলেছি, নিজেও জানি না। তার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। প্লিজ, ক্ষমা করে দাও। বিশ্বাস কর, আমি সত্যিই মানসিক ভাবে ভীষণ হতাশ ছিলাম। তাই আনমনে এসব বলে দিয়েছে। তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করে কখনও শান্তি পাব না। এরপর কখনও এমন ভুল হবে না। প্লিজ ক্ষমা করে দাও। তা না হলে যে, আমি মর্মদহনে দগ্ধ হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাব। ক্ষমা করবে তো, বোকা পাখি।’

আনমনে হেসে উঠল সে। এই ছেলে নিজেই জানে না, তাকে কখন কি সম্মোধন করে। আবার তার কাছে ক্ষমা চাইছে। নিজেই একটা বোকা ছেলে। আবার তাকে বলে বোকা মেয়ে! এই ছেলেকে একদমই ক্ষমা করবে না সে। কিন্তু এখন কি জবাব দিবে সে। তাই ছোট্ট করে সেও মেসেজের জবাব দিল।

‘ক্ষমা করব এক শর্তে, যদি আপনি আর সর‍্যিই না বলেন। বুঝলেন বোকা স্যার।’

ওপাশ থেকে দ্রুত জবাব এল ইমদাদের।

‘যথা আজ্ঞা, আমার প্রিয় ছাত্রী’টা। কিন্তু তুমি আমাকে বোকা স্যার বললে কেন? আমি কি সত্যিই বোকা!’

নুবাহ ফের হেসে উঠল। জবাবে কিছুই বলল না। থাক না এভাবে কিছু কথা হিয়ার মাঝে।
__________

বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির রূপে বিমুগ্ধ নুবাহ। অন্তঃকরণে আজ বিষাদ যেন উঁকি দিচ্ছে। আজকের দিন পেরুলে আগামীকাল স্কুল জীবনের বিদায় ঘন্টা। দশ বছরের দীর্ঘ প্রাতিষ্ঠানিক জীবনের অবশেষে সমাপ্তি। সেই চিরচেনা স্কুল আর মানুষগুলো হারিয়ে যাবে। আর কি খুঁজে পাব এই কৈশোর জীবন? বয়স বাড়বে, বাড়বে ব্যস্ততা, কমবে সময়। কিন্তু হারিয়ে যাবে প্রিয় মানুষগুলোর সাথে কাটানো প্রিয় মূহুর্তগুলো। বক্ষস্থল থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। এদিকে ওবায়দুল স্যার তার ওপর অনেক বড় দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। ভাগ্য ভালো বিদায় সম্ভাষণ পড়েছে জেবাদের উপর। আর থিম সংয়ের দায়িত্ব তাদের উপর। তার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতিও নিতে হচ্ছে। দম ফেলারও জো নেয়। গানের রিয়ার্সাল নিয়েই আছে সে আর তমা। স্কুলের যাওয়ার জন্য ব্যাগ গুছালো মাত্রই। তার আগেই আধো আধো বুলির এক কন্ঠস্বর ভেসে এল পিছন থেকে।

‘নিতাত তুমি ইস্কুলে দাবে।’

নিভানের কথা শুনে নুবাহ পিছনে তাকাল। কিঞ্চিৎ হাসল। মৃদু গলায় বলল,
‘যাব তো, কেন?’
নিভান আরও কয়েক পা এগুলো। ফের বলে উঠল, ‘আমাত দন্য একতা বন্দুক আনবা?’

নুবাহ কিছুটা সন্দিহান। কিন্তু নিভানকে বুঝতে দিল না। ভাইকে এক পলক দেখে বলল, ‘তুমি বন্দুক দিয়ে কি করবে?’

নিভান দু’ঠোঁট উল্টালো। চোখ পিটপিট করে বোনের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল। উত্তরে কি বলবে সেই জবাব খুঁজে পেল না। সহসাই দু’চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল চোয়াল বেয়ে। নাক টেনে ফ্যাচ ফ্যাচ করে শব্দ করে কেঁদে উঠল। ভাইয়ের এমন কান্ডে নুবাহর ভীষণ হাসি পেল। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজের হাসি দমিয়ে রাখল। ফের বলে উঠল,
‘আচ্ছা, নিচে গিয়ে তুমি রিকের কাছে বন্দুক দেখেছো? এইজন্যই তোমারও একটা বন্দুক লাগবে। ঠিক বলছি না নিভান।

নিভান চোরা চোখে বোনের দিকে তাকাল। ঈষৎ উপর নিচ করে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হুমম।’

‘ঠিক আছে এনে দেব। যাও আম্মু থেকে টাকা নিয়ে আস।’

নিভান ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের কাছে যাওয়ার সাহস নেই। মায়ের কাছে গেলে দমক খাবে সে। ফের করুণ দৃষ্টিতে তাকাল। ফ্যাস ফ্যাস করে বলল, ‘আম্মু তাকা দিবে না তো। আমাকে মাব্বে।’

নুবাহ কিঞ্চিৎ শব্দ করে হেসে উঠল। আসল কাহিনী তাহলে এই’টা। আম্মু কিনে দেবে না এজন্যই তার কাছে আসা। সে নিভানকে কাছে ডাকল। মুখে আলতো করে আদর করল।
‘ঠিক আছে আসার সময় নিয়ে আসব। এবার খুশি তো নিভান বাবু।’

খিলখিল করে হেসে নিভান মাথা দোলালো। তারপর এলোমেলো পায়ের কদম ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নুবাহ ফের হাসল। নিজের মুঠোফোন বের করে ছোট্ট এক মেসেজ দিল তার প্রিয় পুরুষকে। ঘুম থেকে উঠেই মহাশয় মেসেজ দেখে টাস্কি খাবে এখন।

স্কুল থেকে ফিরতেই ঘরভর্তি মেহমান। নানু, ছোটমামা, বড়মামা তাদের পরিবারসহ সাথে খালামনিও এসেছে। মামাত ভাই-বোন, খালাত ভাই-বোনের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে আছে নুবাহ। মনে হচ্ছে তার পরীক্ষার জন্য দেখতে আসেনি তারা, তার বিয়ের দাওয়াত খেতে এসেছে। হৈ-হুল্লোড়, কিচিরমিচির কি একটা হুলুস্থুল কান্ড। কোথাও শান্তিতে বসার জায়গা নেই। রুমভর্তি মেহমানে ঠাসাঠাসি করছে। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে বারান্দায় গিয়ে বসল। ইমদাদের সাথে কথা বলার সুযোগও নেই। নিজমনে দোয়া করছে, কখন যাবে এই মেহমানের দল। উদাস দুপুরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। আনমনে দু’ঠোঁট নাড়িয়ে গেয়ে উঠল,

‘ওগো,
তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা।
এই জীবন ছিল নদীর মত
দিশাহারা গতিহারা…
আগে ছিল শুধু পরিচয়,
পরে হল মন বিনিময়…

আচমকা খেয়াল হল তার মুঠোফোন কম্পিত হচ্ছে। রুমের দিকে চোখ বুলালো, পুরো রুম খালি। হুট করে সবাই কোথায় গায়েব হয়ে গেল। সহসাই বারান্দার ফাঁক দিয়ে নিচের দিকে চোখ গেল। বাড়িওয়ালার বাসায় সবাই। সুযোগ পেয়ে তড়িঘড়ি কল রিসিভ করল। কল ধরেই মিষ্টি হাসি দিয়ে সালাম দিল।

“আসসালামু আলাইকুম, স্যার।”

ওপাশ থেকে দ্রুতই জবাব এল।
‘ওয়াইলাকুম আসসালাম। মনে হচ্ছে, তুমি খুশিতে আছো?

“হুমম,।’

‘কি করছো?’

‘আকাশ দেখছি।’

‘কেন?

‘এমনিই।’

‘খেয়েছো?’

‘হুমম।’

‘ঘুমাচ্ছো না।’

‘হুমম।’

‘এই তোমাকে হুমমের ভূতে ধরছে। আর ঘুমালে আমার সাথে কিভাবে কথা বলতেছে।’

‘বুঝতেই তো পারছেন ঘুমাচ্ছি না। তাও জিজ্ঞেস করছেন, সেজন্য বললাম ঘুমাচ্ছি।’

‘অহহ, এত ধীরে ধীরে কথা বলছো। কোনো সমস্যা?’

‘ঘরভর্তি মেহমান। দম ফেলার জায়গাও নাই রুমের মধ্যে। তাই বারান্দায় বসে আছি।’

‘এত মেহমান কেনো?’

‘নানুর বংশের মধ্যে সবার বড় আমি। প্রথম আমিই এস.এস.সি পরীক্ষা দিচ্ছি। তাই আম্মুর পুরো গুষ্টি এসেছে আমাকে দোয়া করতে। তবে নানু আর খালামনি থাকবে বাকিরা চলে যাবে। জানেন, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে পরীক্ষার জন্য আমাকে দোয়া করতে আসে নি কেউ। আমার বিয়ে খেতে আসছে সবাই।’
এটা বলে নুবাহ কিঞ্চিৎ শব্দ করে হাসল।

সহসাই ওপাশ থেকে ইমদাদের মলিন স্বর ভেসে এল। ‘তোমার এমন মনে হচ্ছে কেন? সত্যিই কি তোমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে?’

ইমদাদের এমন কথায় নুবাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেল। হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারল না। কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে বলল,
‘স্যার, কিসব প্রলাপ বকছেন। আমার বিয়ে হতে যাবে কেন? আ’রে মেহমান দেখে আমার এমন অনুভূতি হচ্ছিল। কিন্তু কোন বিয়ে-টিয়ে হচ্ছে না। বুঝলেন।’

‘সত্যিই! বলছো?’

‘হুমম। কিন্তু স্যার, আমার বিয়ে নিয়ে আপনি কেন এত সিরিয়াস?’

‘তুমি এখনো কত ছোট। এত তাড়াতাড়ি কিসের বিয়ে। অন্তত ১৮ এর আগে বিয়ে, একদমই না।’

নুবাহ টিপ্পনী মেরে বলল, ‘ওহহ, এটাই মূল কারণ।’

‘কেন তুমি কি ভেবেছিলে?’

নুবাহ মুখ টিপে হাসল।
‘কিছু ভাবিনি তো। আচ্ছা স্যার, এখন রাখি। আল্লাহ হাফেজ।’

কল কেটে মিটমিট করে হেসে উঠল নুবাহ। নিজমনে বিড়বিড় করল।
‘ডুবে ডুবে জল খায়।
বলতে পারে না লজ্জায়।’

সন্ধ্যায় বাসা পুরোদস্তুর খালি। তার নানু আর খালামনি আছে। পড়ার ব্যাঘাত হবে বিধায় তার নানু আর খালামনিকে রুমে আসা বারণ করে দিয়েছে। হঠাৎই বিছানায় পরে থাকা কিছু শপিং ব্যাগের দিকে নজর গেল নুবাহর। বড়মামা, ছোটমামা, আর খালামনি’রা আসার সময় তার জন্য জামা নিয়ে এসেছে। একদিকে তার লাভই হয়েছে।

রাতে খাবার টেবিলে বসে খেয়াল করল, তার বাবা ভীষণ চিন্তিত। কিন্তু কীসের জন্য? তার নানু আর খালামনিও কেমন উদাসীন হয়ে আছে। রুবি হুট করে নুবাহকে বলল, ‘কীরে খাওয়া বন্ধ করলি কেন?’

নুবাহ সুযোগ বুঝে বলে উঠল, ‘তুমি আর নানু উদাস হয়ে আছ কেন? আম্মুও কেমন চিন্তিত। কি হয়েছে সবার?’

সহসাই রশিদ নুবাহকে কঠিন গলায় ধমক দিয়ে উঠল। ‘খেয়ে জলদি পড়তে যা। বসে বসে তোর গল্প শোনার সময় নয় এখন। মুরুব্বির মত সবকিছু তোকে জানতে হবে না।’

দু’চোখ জলে ভিজে উঠল নুবাহর। বাকী খাবারটা কোনভাবে খেয়ে উঠে দাঁড়াল। এলোমেলো কদমে নিজের রুমে আসল। দপ করে বিছানায় গিয়ে বসল। অক্ষিযুগল থেকে ধেয়ে আসা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার কোলের মধ্যে। দৃষ্টি নিচের দিকে নিবদ্ধ। তার খুব জানতে ইচ্ছে করল। ‘আব্বু, আমি কি খুব খারাপ? একটু কি বুঝিয়ে বলা যায় না। সব সময় এভাবে কেন কথা বলেন। বিষন্ন মনে ফের পড়তে বসল। সে যে কারও কাছে ওয়াদাবদ্ধ। অন্তত তার জন্য হলেও ভালো রেজাল্ট করতে হবে। অন্যের ঋণের বোঝা যে বড্ড ভারী। এ বোঝা হালকা করতে হবে তাকে।

মধ্যরাতের সুনশান নিরবতা ভেঙে আচমকা মুঠোফোন কম্পিত হল। আৎকে উঠল নুবাহ। নাম্বার দেখে তার চক্ষু ছানাবড়া। এতরাতে কল। কিন্তু কেন? আবার কোন বিপদ হয়নি তো! দ্রুত কল রিসিভ করল। সালাম দেয়ার সাথে সাথে অপর পাশ থেকে ভেজানো এক মলিন গলা ভেসে এল।

‘নুহাহ, আমি কি ছেলে হিসেবে খুব খারাপ?’

এহেন বাক্য শুনে নুবাহ থমকাল।
‘কি হয়েছে আপনার? মন খারাপ।’

‘সত্যি করে বল না নুহাহ, আমি ছেলে হিসেবে কেমন?’

মধ্যরাতে এমন কথার কি জবাব দেয়া উচিৎ তার নিজেরই জানা নেই। তবু দোটানায় পড়ে বলল, ‘স্যার, আপনাকে কেউ কিছু বলেছে? আপনি টিচার হিসেবে যেমন ভালো, তেমনি ছেলে হিসেবেও অনেক ভালো। একদম আমাদের মফিজ আঙ্কেলের মত। তিনিও ঠিক আপনার মত।’

‘মফিজ আঙ্কেলের মত মানে? তুমি আমাকে পরোক্ষভাবে অপমান করছো। ইনিয়েবিনিয়ে গর্দভ বলছো। আমাকে ইডিয়ট ভাবও। তোমার কথার মানে বুঝব না। এভাবে ঘুরিয়ে বলার কি দরকার ছিল? ডাইরেক্টলি বলতে পার। আই ডোন্ট মাইন্ড।’

‘আরে স্যার, আপনি ভুল বুঝছেন। মফিজ আঙ্কেল আমাদের পাশের..

নুবাহর পুরো বাক্যে শেষ হওয়ার আগেই ইমদাদ তাকে থামিয়ে দিল।
‘সর‍্যিই! তোমাকে এত রাতে বিরক্ত করার জন্য। ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ।’

নুবাহ স্তব্ধ। পুরো কথা না শুনেই কল কেটে দিল। আচানক রাগল কেন তার বোধগম্য হল না। এখন নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে। কি করে রাগ ভাঙাবে? কিন্তু মফিজ আঙ্কেলের কথা শুনে রাগ করল কেন?

চলবে,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here