#কাছে তুমি
পর্ব-০৫
#রোকসানা আক্তার
রিয়াশ চলে যাওয়ার পর সানা রুম থেকে বেরুতে খুব চেষ্টা চালিয়েছে।কিন্তু রুমটা খুবই বদ্ধ ছিল।দরজার জায়গা টুকু ছাড়া আর কোনো জায়গা ফাঁকা নেই বের হবার।রুমে ছোট্ট ছোট্ট দুটি জানলা যেগুলোর গ্লাস দেয়ালের সাথে এটাস্ট।বেলকনিটাও নেই।অগাত্তা সানা আশা হারিয়ে ফের ফ্লোরের উপর আবার লেপ্টে বসে পড়লো। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুই ছুই সানা এখনো বসে আছে আগের জায়গায় স্থিরভাবে।এক ফাঁকও নড়লো না।তাকিয়ে আছে স্থির চাহনিতে দূরের পূবকাশে।মনের অব্যক্ত কত কথাই না এরমাঝে আকাশের সামনে দাঁড় করালে?আকাশ শুনলো।সেও শুনলো।তবে চুপিচুপি।কিন্তু লাভ আর হলো না।সানা জোরে একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে দরজার দিকে তাকায়।দরজায় খুটুর খুটুর শব্দ হচ্ছে।অনেকটা দরজা খোলার মতো শব্দ।তাকিয়ে পরমুহূর্তে দেখলো তুলি আপা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেছে।
“সানা?তুমি ভেতর থেকে দরজা লক করো নি?”
সানা তুলির একথাটার জবাব না দিয়ে দৃঢ় হাতে পাশ থেকে ওড়না টা তুলে তা গাঁয়ে জড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।তুলির দিকে কিছুটা এগিয়ে ভারাক্রান্ত বুকে বলে উঠে,
“আপু?আমাকে এ’বাসা থেকে বেরুনোর একটু পথ করে দিননা!প্লিজ!” নিঃসংকোচ আবেদন।
তুলি হাতে রাখা শপিং ব্যাগগুলো বিছানার উপর রেখে এবার ক্ষীণ চোখে সানার দিকে তাকায়।মেয়েটা একদিনে কেমন শুকিয়ে গেছে।চোখের পানি শুকিয়ে গালে বলিরেখা পড়েছে। চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে।মুখের কোথাও একটুখানি সজীবতা নেই।একদম নিরস আর নিষ্প্রাণ!তুলি গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।তারপর সানার কাঁধে আলতো হাত রেখে তাকে বিছানায় নিয়ে বসায়।সুদৃঢ় এবং নরম গলায় বলে,
“সানা?সব ঠিক হয়ে যাবে।টেনশন করো না!তোমার রিয়াশ ভাই খুব ভালো। তোমাকে খুব ভালোবাসে।তোমার খুব কেয়ার করবে।তোমাকে সুখে রাখবে।রিয়াশ তোমার জন্যে পারফেক্ট!আজ যার সাথে এনগেজ হতে তার উপরের রূপটা দেখে কি জাস্টিফাই করতে পারতে সে তোমাকে কতটা ভালেবাসবে,খুব সুখে রাখবে?একদমই না।অদেখা,অজানা ছেলেদের নিয়ে অনুমান কখনো সত্যি হয়না।বেশিরভাগই হয় বানেয়াট।রিয়াশকে ছোট্ট থাকতে দেখে এসেছ তার ব্যাপারে জানো সে কেমন।তাহলে কেন রিয়াশকে রিজেক্ট করবে?তাছাড়া তুমিতো রিয়াশকে আগে খুব ভালোবাসতে তাই না?”
“বাসতাম।খুব বাসতাম।এখন আর সেই ভালোবাসাটা আসে না আপু!”
“ভালোবাসা আসে।তুমি আসতে দাও না।তা পাথরের মতো চেপে রেখে নিজেকে কষ্ট দাও।রাইট?”
সানা ড্যাবড্যাব চোখে তুলির দিকে তাকায়।তুলি বলে,
“রিয়াশকে ভালোবাসো।কিন্তু ফ্যামিলির কথা ভাবলে রিয়াশকে ভুলে যাবার চেষ্টা করো।আবার রিয়াশকে চাইলে আবার ফ্যামিলির কথা চিন্তা তুমি দোটানা রোগে ভোগতেছো! ”
সানা মনে মনে অবাক হয়ে যায়।ইনি ত আমার মনের কথাগুলোই বলে দিলেন!কিন্তু কীভাবে!?সানার ভাবনার মাঝেই তুলি আবার বলে,
“সানা?আমি মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেছি।সো মানুষের মনোঃজাগতিক ব্যাপারগুলো কিছুটা হলেও বুঝি। আমি বুঝতে পারছি তুমি খুব চাপা কষ্টে আছো।যেটা তুমি রিয়াশকে ও বলতে পারছো না।এবং নিজেকেও বুঝাতে পারছো না।তুমি রিয়াশের ফ্যামিলির ব্যাকগ্রাউন্ড এবং তোমার ফ্যামিলির ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা ভেবে নিজেকে রিয়াশের লাইফ থেকে সরাতে চাচ্ছ।যখন তুমি রিয়াশকে ভালোবাসতে শুরু করো তখন তুমি ছিলে কিশোরী।এখন তুমি কিশোরী নও। ম্যাচিউরড।আমি বলবো না তখন রিয়াশের প্রতি তোমার শুধুই আবেগ ছিল।ভালোবাসাটাও কম ছিল না।ডিফারেন্স তখন নবপল্লবে কিশোরী মনে ভালোবাসাটাকে আটস্থ করেছো আর এখন বড় হওয়ার সহিত ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছো তাই ফ্যামিলির কথা ভেবে ভালোবেসেও ভালোবাসাটা চাপা রেখেছ!ঠিক বলেছি সানা?”
সানা কি জবাব দিবে তা নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না।এই মেয়ে ত পুরোই জ্যোতিষী!তার মনের কথা কীভাবে পড়তে পারলো সে?তার অব্যক্ত কথাগুলো কিভাবে প্রকাশ করলো সে?মাই গড!
“সানা?জাস্ট কুল!আমি তোমার দিকগুলো পুরোপুরি আটস্থ করতে না পারলেও অনেকগুলো পয়েন্ট ধরিয়ে দিয়েছি তোমাকে।মেইন কথায় আসি।তুমি রিয়াশকে এসব রিজনে যদি দূরে ঠেলে দাও তাহলে তুমি ভুল করছো!ভেবেছো অন্যজায়গায় বিয়ে হলে সব ঠিকঠাক মতো চলবে।আত্মীয়তার মাঝে আত্মীয়তার কোনো ঝগড়াবিবাদ থাকবে না ইত্যাদি।তবে কয় যুগ ধরে ঝগড়াবিবাদ লেগে থাকবে,বলো?একদিন,দুইদিন,তিনদিন।পরে দেখবে ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যামিলি একদিন ঠিকই সব মেনে নিবে।আর সেখানে রিয়াশ!ওর ব্যাপারে ত তুমি জানো ত!ও কতটা স্ট্রং!”
বলেই তুলি একটা হাঁক ছাড়ে।সানা চুপচাপ বসে থাকে।তার চুপচাপতার মাঝে ভাবনারতুরের চিত্র স্পষ্ট!তুলি সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে খানিকটা দূরে এসে রিয়াশকে কল করে।কল রিসিভ হতেই প্যাকপ্যাক গলায় বলে,
“হ্যালো,রিয়াশ?”
“হ্যাঁ,দোস্ত বল….।”
“তোরা কখন আসবি?”
“আমার এখনো দুলা সাঁজ সম্পূর্ণ হয়নি।দুলা সাঁজটা শেষ করেই আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবো।সানাকে সাজাচ্ছিস?”
“আরেহ গর্দভ ওটাই ত পারতেছি না।”
“কেন?ও শাড়ি পড়তে চাচ্ছে না?”
” ওকে যে শাড়ি পড়িয়ে তোর গলায় ঝুঁলিয়ে দিব ওটাই ত বলার মতো ওয়ে পাচ্ছি না।ও যদি মুখের উপর
উল্টো কথা শুনিয়ে দেয়!”
” ভীতুর ডিম একটা! ছোট্ট একটা মেয়েকে শাড়ি পড়াতে পারিস না!”
“তুই আইসা তোর বউরে পড়া।রাখলাম আমি!”
তুলি কল রাখতেই সানা পেছন থেকে তুলিকে ডেকে উঠে।
“আপু?শপিং ব্যাগ গুলোতে কি?”
“তোমার জন্যে একটা শাড়ি এনেছি।আর কিছু সাজগোজ।”
” কেন?”
“ইয়ে মানে আজকে ত গোসল করো নি সেজন্যে রিয়াশ শাড়ি কিনে আমাকে দিয়েছে তোমাকে পড়ানোর জন্যে।বাথরুম থেকে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।আমি আজ নিজহাতে তোমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিব!”বলেই মিষ্টি হাসলো তুলি।
“ক-কিন্তু…!”
“আরেহ কোনো কিন্তু না!যাও !”
সানা নিজের দিকে তাকিয়ে গাঁয়ের গন্ধ শুকে।য়ু গাঁ থেকে বটকা বটকা গন্ধ নাঁকে আসছে।আসলেই ফ্রেশ হয়ে আসলে একটু হালকা হওয়া যাবে।টেনশনটাও কমবে।ভেবেই সানা তুলির মুখের উপর আর কিছু বললো না।বাধ্যমেয়ের মতো বাথরুম ঢুকে গেলো।সানা বাথরুমে গেলে সানা খুশিতে শব্দহীন একটা লাফ মেরে উঠে।আর ওমনি রিয়াশকে মেসেজ করে দেয়,”দোস্ত,শাড়ি পড়াতে পারবো মনে হয়!”
সানা গোসল সেরে গাঁয়ে ব্লাউজ এবং পেটিকোট পড়ে বের হওয়ার পর তুলি সানাকে সাজাতে বসে যায়।মুখের সাঁজটা যখন প্রায় শেষ হয়ে আসে তখন সানা কিছুটা চমকে যায়।মুখে এত্ত সাঁজ লাগিয়েছে যেন বউ সাজাচ্ছে!তার পরপরই আবার যেই তুলি লালরঙ্গা শাড়িটা বের করে ওমনি সানা বিস্ময় মাখা মুখ আকাশ ছুই ছুই!এত ভারী শাড়ি!মানুষ শখ করে বুঝি এত্ত ভারী শাড়ি পড়ে।শখ করে ত মানুষ পাতলা শাড়ি পড়ে!ভাবছিলো ব্যাপারটা তুলিকে বলবে।পরে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে বিধায় সানা মুখ চেপে নেয়।সাঁজানো শেষ হলে তুলি বলে,
“আয়নাতে দেখো নিজেকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে!ঠিক যেন বউ!”
“বউ” শব্দটা শুনে সানা আরেকটা ধাক্কা খায়।মাথায় বারবার কতগুলো শব্দই বারি খায় তা হলো-“রিয়াশ ভাইয়ার সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার ধান্দায় আছে নাতো?”
ঠিক তখন দরজার ওপাশে রিয়াশের কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
“তুলি?এই তুলি?”
তুলি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।রিয়াশ চৌকাঠ বরাবর পা রাখতেই সানার মাথাটা টুং করে ঘুরে উঠে।রিয়াশ ভাইয়া ত বর বেশে এসেছে!তারমানে সে যা ভাবছে তাই ঠিক।সানা আর এক মুহূর্তও দেরী না করে এক লাফ দিয়ে বলে উঠে,
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না!”
“কেন বিয়ে করবি না তুই?নাকি আমি দেখতে খারাপ?আমার মতো এমন হ্যান্ডসাম ছেলে আর কোথাও পাবি?তোর বটগাছ ত আমার নখটুকুর মতোও সুন্দর না!”
“সুন্দর /অসুন্দর কিছু না!আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না ব্যাস্।প্রয়োজন হলে চিরকুমারী হয়ে থাকবো।”
আবেদ এবং রাহুল পেছন থেকে টপাটপ সামনে এসে বলে,
“ভাবী কেন বিয়ে করবেন না!কারণ বলুন!”
“উনি সবার সামনে আমার মানসম্মান খেয়ে ফেলেছে।আমি লজ্জায় মা-বাবা,ফুপী, ফুপ সার সামনে কোন মুখে গিয়ে দাড়াবো!”
“এখন দাঁড়াবি আমার বউ হিসেবে!”
বলেই রিয়াশ সানাকে এক সপাটে কোলে তুলে নেয়।আর বলে,
“কাজী অফিসে তোর হেঁটে যেতে কষ্ট হচ্ছে তাই কোলে নিলাম।তারপরও আজ তোকে আমি বিয়ে করবো এবং করবোই!”
বলেই সানাকে নিয়ে সিড়ি বেয়ে লাগায় এক ছুট!আর তা দেখে রাহুল,আবেদ এবং তুলি হাসিতে গদগদ….।।।।
চলবে….