কাছে তুমি #রোকসানা আক্তার সূচনা পর্ব

0
469

সানা সিড়ি বেয়ে নিচে নামছিলো এমন সময় কেউ একজন তার হাতে হেঁচকা টান মেরে ভেতরের একটা রুমের দিকে নিয়ে যায়!সানা চিৎকার করে উঠবে ওমনি লোকটি তার মুখ চেপে ঝাঁঝ গলায় বলে উঠে,

“বিয়ে করার খুউউব শখ জমেছে,তাই না? এতই যদি শখ জমে থাকে তাহলে এতদিন আমার পেছনে মাছির মতো ভনভন করেছিলি কেন?”

সানা পিটপিট চোখে সামনে তাকায়।সামনে থাকা লোকটি তার রিয়াশ ভাইয়া।শুধু “রিয়াশ ভাইয়া” বললে ভুল হবে।ভালোবাসার মানুষও বলা যায় যাকে সে এতদিন একপাক্ষিক ভালোবেসে এসেছে।আর মানুষ টি কিনা তাকে পাত্তাই দেয়নি।আর আজ যেই সানাকে বরপক্ষ দেখতে এসছে ওমনি তার হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে।সমস্যা কি উনার বিয়েটা তার নিজের হচ্ছে,উনার ত নয়।আরেকজনের বিয়ে দেখে উনার এত্ত পিত্তি জ্বলে কেনো!ভেবেই সানা প্রচন্ড রাগ মনে রিয়াশকে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

“আমার বিয়ে হবে তাতে আপনার সমস্যা কোথায়?”
“এই চুপ!একদম চুপ!আর একটা কথা বলিস তো গাল ফাঁটিয়ে দিব!”
“আমার গাল ফাঁটানোর ওমন দুঃসাহস আপনাকে দিয়েছে টা কে,শুনি?আমার গাল ফাঁটাবে আমার বর আমাকে আদর করবে আমার বর।সব রাইটস শুধুই আমার বরের।আপনার নয়!”

রিয়াশ এবার আরো রেগে যায়।সানাকে আবারো দেওয়ালের সাথে খুব শক্ত করে চেপে বলে,

“খুউব চালাক হয়ে গিয়েছিস?”
“এখানে চালাক হবার কি আছে রিয়াশ ভাইয়া !যা সত্যি তাই বলছি।”
“সানা তুই কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করতেছিস!তুই বুঝতেছিস না তুই আরেকজনের মন নিয়ে খেলতেছিস!”
“আমিতো কারো সাথে প্রেমই করিনি। তাহলে কারো মন নিয়ে খেলার প্রশ্নই আসে না!”
“ওই বটগাছের মতো লম্বা ছেলেটাকে পেয়ে আগের সব ভুলে গেলি!বাহ!”
“ক’দিন বাদে তার অর্ধাঙ্গিনী হবো।তারসাথে জীবনের বাকিটা সময় কাটাবো।অতীতকে টেনে এনে বর্তমান,ভবিষ্যৎকে কেন নষ্ট করবো!তাছাড়া,অতীত আমাকে বড্ড কাদিয়েছে।ওমন অতীত আমি মনে রাখতে চাই না!”
“রাগ উঠাস না আমার!”
“আপনি রাগ করেন বা রাগগুলোকে লাড্ডু বানিয়ে খান তাতে আমার কিছু যায় আসে না।আর আপনি আমাকে এভাবে ধরো রেখেছেন কেন?কেউ এই অবস্থায় দেখে ফেললে আমাকে খারাপ ভাববে।পরে আমার বিয়েটাও হবে না!ছাড়ুন আমায়!”

বলেই সানা রিয়াশকে এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়।তৎক্ষনাৎ রিয়াশ রাগে পাশে থাকা মাটির ফুলদানিটা ফ্লোরের উপর খুব জোরে ছুঁড়ে মারে।রিয়াশের এমন উদ্ভট বিহেভে সানা সতর্ক চোখে রুমের দরজার দিকে তাকায়।কেউ যদি দেখে ফেলে।সে আর দেরী করলো না।গাঁয়ের ওড়নাটা ঠিক করে রিয়াশকে পাশ কেঁটেই রুম থেকে দ্রুতপদে বেরিয়ে এলো।দরজাটা ঠেসে বাইরে দাঁড়াতেই এতক্ষণে
বুকে চাপা তীব্র ব্যথাটা এবার ধু ধু করে উঠে।এই মুহূর্তে খুব কষ্ট হচ্ছে তার!খুব!যেই মানুষটিকে অন্ধের মতো ভালোবাসতো ,সে মানুষটির মুখের উপর এত্তগুলো কথা কীভাবে বলতে পারলো সে?কীভাবে?

এমন সময় নিচ থেকে ফুপীর ডাক পড়ে।
“এই সানা?নিচে আয় তো দিকি একটু?”
সানা তরহর করে চোখের পানি মুছে নিচে নামে।তার ফুপী (মিসেস রিমা বেগম) তাকে টেনে নিয়ে সোফায় বসান।নিচে আরো অনেকেই ছিল তার মা-বাবা,রিধি(বোন),সফি(ভাই),সাফা(কাজিন) সবাই।
মিসেস রিমা বেগম হাসি হাসি মুখ করে বলেন,

“সানা?ছেলেপক্ষদের তোকে খুব পছন্দ হয়েছে।তারা চায় আগামী পরশুই তোর এনগেজমেন্ট সেরে ফেলতে।আমরাও ভাবছি দেরী করবো না।শুভ কাজ দেরী করতে নেই।”
“তোর ফুপী ঠিক বলছে সানা।আমরাও তোর ফুপীর সাথে একমত।আর ছেলে যেহেতু ভালো চাকরি করে।ফ্যামিলি ভালো।তাহলে দেরী করা ঠিক হবে না।”

ঠিক তখন রিয়াশ এসে সিঙ্গেল সোফাটায় ধপাস করে বসে পড়ে।বাঁজখাই গলায় বলে,

“বিদেয় করো ।আপোদ তাড়াতাড়ি বিদেয় করো।বাসায় এমন উটকো ঝাঁমেলা কাঁধে চড়িয়ে রাখার মানে হয়না।বাসাটা একটু ফাঁকা হবে।শান্তিতে থাকতে পারবো।কী ঠিক বলছি না মিসেস সানা?ওহ ছরি ছরি তোমার ত এখনো বিয়েই হয়নি।মিসেস ত ক’দিন পর ট্যাগ হবে।”
“তুই একদম বেশি কথা বলিস রিয়াশ!চুপ থাকতে পারিস না?”(মিসেস রিমা বেগম)
“চুপ আর কেমনে থাকি বলো মা।সানার বিয়ের দাওয়াত খেতে দাঁতগুলো কেমন কিড়মিড় করছে।লোভ সামলাতে পারছি না।”

রিয়াশের কথায় সানা জবাব দেয়নি।রিয়াশের দৃষ্টিটা একপ্রকারে উপেক্ষা করে সামনে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,

“তোমাদের যেটা ভালো মনে হয়।তোমরা তাই করো মা,ফুপী,বাবা।এখানে আমার আর কিছু বলার নেই।”

সানা নিজরুমে চলে আসে।দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে সোঁজা হয়ে শুয়ে চোখবুঁজে।চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠে কষ্টের মুহূর্তগুলো।সামান্য মাইনে পায় তার বাবা।একটা সাধারণ স্কুলের কেরানী পদে বর্তমানে কার্যরত।ঢাকার শহরে থাকার খরচ,খাবার খরচ,পড়াশুনার খরচ সব ক্যারী করতে খুবই হিমসিম অবস্থা।তাই বাধ্য হয়ে লিয়াকত আলী(সানার বাবা) তার বোনের বাড়িতেই পাড়ি জমান তার পুরো পরিবার নিয়ে।বোন কম খরচেই থাকার সম্মতি দেয়।নতুনভাবে শুরু করেন বোনের বাড়িতে বসবাস।তারথেকে কিছুটা বেতনের টাকাও সঞ্চয় করতে সক্ষম হোন।তখন সানার বয়স ছিল পনেরো বছর,সফির সাত বছর,আর রিধির ছয় বছর।লিয়াকত আলীর বোন,অর্থাৎ মিসেস রিমা বেগম প্রচুর সম্পদের মালিক।ঢাকার দুই তিন জায়গায় তাদের নিজেদের বাড়ি আছে।গাড়ি আছে।মিসেস রিমা বেগমের স্বামী অনেক বড় বিজনেসম্যান। এখন সেখানেই তাদের একমাত্র ছেলে রিয়াশ বিজনেস দেখাশুনা করে।সানা সেই কৈশোর থেকে রিয়াশকে দেখে আসছে।দেখতে দেখতে তারমাঝে একধরনের ভালোলাগা শুরু হয়।অবচেতন মনে ভালোবাসতে থাকে রিয়াশকে।মনে মনে ভালোবাসাটার থলি একসময় দীর্ঘ হয়ে যায়।ভার্সিটিতে ভর্তি হলেই সিদ্ধান্ত নেয় রিয়াশকে তার মনের কথাগুলো বলবে।তাই একদিন চৈত্রের ঝলমল বিকেলে সে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরেই ছাদে যায়।ছাদে প্রতিদিন বিকেলে রিয়াশ টাইম পাস করে।সবুজ প্রকৃতি দেখে।গান শোনো।বই পড়ে ইত্যাদি।সানা সেদিন টিপটিপ পায়ে রিয়াশের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

“ভাইয়া বিজি?”
রিয়াশ ফোন থেকে মুখ তুলে বলে,
“কিছু বলবি?”
“হুম।”
“কি বলবি তাড়াতাড়ি বল!”বলেই আবারো মোবাইলে মুখ গুঁজে।
“ইয়ে মানে ভাইয়া….!”
সানা ইতস্ততায় পড়ে।কীভাবে তার কথাটা শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না তা দেখে রিয়াশের রাগ উঠে যায়।মোবাইলে গেমস খেলছে আর এই মেয়েটা আসছে নাটক করতে।নাটক পাটক শেষ করে বিদেয় ত হবে।বিরক্তি যত্তসব!
“আজিব!”
“ভাইয়া আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি!”
“হোয়াট?”
“আমি সত্যি বলছি আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।কেন এতটা ভালোবাসি আমি নিজেও জানি না।”

রিয়াশ কিছুক্ষণ মৌন হয়ে থাকে।সে হয়তো এমনটি আশাও করেনি।তারপর ফস করে একটা শ্বাস ছেড়ে সানাকে বলে,

“ভার্সিটি থেকে আসছিস মনে হয়।খুব ক্লান্ত তুই।ফ্রেশ হয়ে খাবারটা খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দে যা!”

বলেই আবারো মোবাইল গুটাতে থাকে।সানার দুইচোখের কোল বেয়ে দুই ফোঁটা পানি বেরিয়ে আসে।রিয়াশ দেখার আগ আগেই পানিটুকু আবার মুছে নেয়।কিন্তু রিয়াশ আর সানার দিকে তাকায় নি।তাকানোর প্রয়োজন বোধও করেনি। সানার খুব বুকফাঁটা কান্না পায়।কিন্তু সে কাঁদতে পারে নি।হৃদয়ভাঙ্গা মন নিয়ে ছাদ থেকে নেমে আসে।তাকে ছাদ থেকে নেমে আসতে দেখে তার ফুপী মিসেস রিমা বেগম বেশ অবাক হোন।কারণ তার ছেলে এখন ছাদে,এই মেয়ে আবার এই সময় ছাদে গিয়েছে কেন!সেই রাতেই তিনি সানাকে ডেকে পাঠান।সানা উনার সামনে এসে দাড়াতেই বলেন,

“এই বাড়িতে তোদের কম খরচে থাকতে দিই।খেতে দিই।সবকিছুইতেই তোদের সুবিধা দিই।ইদানীং দেখতেছি তুই আমার ছেলের আশপাশে ঘুরঘুর করতেছিস।আমার একটা মাত্র ছেলে।কত্ত আদরের তা তো তুই জানিস।তাকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন,কত আশা।তোর কাছে আমার অনুরোধ আমার ছেলের থেকে দূরে দূরে থাকবি।”

সেদিন সানা তার ফুপীর কথার পিঠে কোনো জবাব দিতে পারলো না।কথাগুলো সত্যি। আসলেই ত সে উনার ছেলের পেছনে ঘুরঘুর করে।সেদিন উনার কথাগুলো এবং রিয়াশের প্রপোজাল রিজেক্ট সানাকে খুব পীড়া দেয়।সেদিনই মত পরিবর্তন করে ফেলে।তার ফুপীদের অর্ধেক ভরসায় তার পরিবার মাথা গুঁজে আছে।বেঁচে আছে।যদি তাকে নিয়ে তার ফুপী উল্টাপাল্টা কিছু উঠায় তাহলে তার পরিবারের প্রতিটি মানুষের জীবন কতটা সংকটাপন্নে।তার পরে তার দুই দুটো ভাইবোন আছে।তাদের ও ত একটা গতি করতে হবে।নাহ আর কিছু ভাবতে পারলো না।ডিসিশন ফাইনাল করলো রিয়াশ নামের ওই লোকটাকে কষ্ট হলেও ভুলে যাবে।ভুলে যাবে বলেছে বলেই কি নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে?না! সেই রাত তার সে কি কান্না!দলা বেঁধে বেঁধে চাপা কান্নাগুলো বেরিয়ে আসতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে যায়।তারপর আবার কাঁদে।বলা যায় পুরোটা রাত এভাবেই শেষ হয় সানার।তারপর সানা খুব শক্ত হয়।তার পাঁচদিনের মাথায়ই সে মা-বাবাকে বলে তারজন্যে ছেলে দেখতে। বিয়ে করবে।আর পড়াটা স্বামীর ঘরে থেকেই চালিয়ে নিবে।মা-বাবা প্রথমে একটু অবাক হয়।কিন্তু অবাকের সীমাটা বেশিক্ষণ না নিয়ে মেয়ের কথা খুশিমণে মেনে নেয়।আর সাথে সাথে তা মিসেস রিমা বেগমকে জানায়।মিসেস রিমা বেগম ত সেই খুশি একটা আপদ বিদেয় হবে!

ভাবতে ভাবতে সানার চোখজোড়া বসে আসে!লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঝাপসা চোখ মেলে উপরের দিকে তাকায়!

#কাছে তুমি
#রোকসানা আক্তার
সূচনা পর্ব

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here