গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায় #পর্বঃ_০৫ #লেখাঃ_আফসানা_মিমি

0
214

#গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#পর্বঃ_০৫
#লেখাঃ_আফসানা_মিমি
——–
গাজীপুরের সরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নুরুজ্জামানকে রাখা হয়েছে। হার্ট বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান মাহবুব শিকদার নুরুজ্জামানের কেস দেখছেন। তূর্য সহকারী ডাক্তার, মাহবুব শিকদারের আশেপাশে থেকে রোগীর প্রতি মিনিটের আপডেট জানাচ্ছেন। জন্ম মৃত্যু সব উপরওয়ালার হাতে। নুরুজ্জামান কী জানতো! পরদিনের সূর্য অস্ত সে দেখতে পাবে না! কার কখন মৃত্যু নির্ধারণ করা হয়েছে কেউ জানে না। আইসিইউর রুম থেকে কিছু দূরে নয়না বসে আছে। আত্মীয় স্বজন কেউ নেই তার আশেপাশে। আকলিমাকে সে ফোন করেছিল, ‘নুরুজ্জামান হাসপাতালে ভর্তি’ এই খবর শুনে নানান অজুহাত দিয়ে ফোন কে’টে দেন তিনি। হাসপাতালের এতো খরচ নয়না কীভাবে পূরণ করবে তাই ভাবছে বসে।

ভাবনা এই পথেই আসছিল, নয়নার সাথে তার কাজ আছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টসে নয়নার স্বাক্ষর লাগবে। নয়নাকে নির্বিঘ্নে বসে থাকতে দেখে ভবনা বলল,” কাঁদছো?”
” না, ভাবছি ফুফু ফোন কেটে দিল কেন? উনার কী ভাইয়ের অসুখের কথা শুনে খারাপ লাগেনি?”

ভাবনা নিরুত্তর। সে কাছ থেকে নয়নার মতো অনেক দেখেছে, যাদের আসল রূপ দুঃসময়ে দেখতে পাওয়া যায়। নয়নার দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয়,” দুঃখ পেয়ো না,নয়না। এই দুঃসময়ে তোমার পাশে উপরওয়ালা আছেন। তিনি সব ঠিক করে দিবেন।”

নয়না লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বাহিরে দৃষ্টিনিপাত করে। বাবার চিকিৎসার খরচের জন্য মিছিলের কাছে হাত পেতেছে সে। মেয়েটা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে রাজিও হয়ে গেল। মিছিলের ভাইকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ভাবনার ডাকে নয়না চিন্তা থেকে বের হয়ে আসলো।

” তোমাকে স্যার ডেকেছে, কিছু ফর্মালিটি বাকী আছে সেগুলোর মধ্যে স্বাক্ষর লাগবে।”

নয়না কথা না বাড়িয়ে ভাবনার সাথে ডাক্তারের চেম্বারের দিকে অগ্রসর হয়।
মাহবুব শিকদার তখন নুরুজ্জামানের রিপোর্ট দেখছিল। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সেদিকে তাকালে নয়নার ফোলা চোখের দিকে নজর যায়। নয়নাকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে সে। রিপোর্টগুলো কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে কিছু কাগজপত্র নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ” সাইন ইট।”

” আমি কী জানতে পারি বাবার কী হয়েছে?”

নয়নার কথায় দুঃখের আভাস। মাহবুব বলল,” তোমার বাবা স্ট্রোক করেছেন। এছাড়াও উনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এখন পর্যন্ত ভালো কোনো রেসপন্স পাচ্ছি না। কতক্ষণ সময় উনি যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করতে পারবেন, জানি না।”

ডুকরে কাঁদতে থাকে নয়না। বাবার অসুস্থতা তাকে খুব পুড়াচ্ছে। সে ভাবছে, তার ভাগ্যটাই কী এমন! কী পাপ করেছিল সে? সব যন্ত্রণা কেন তারই হয়! নয়না এবার বলল, ” হাসপাতালের খরচ বাবদ কতক্ষণের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে?”

এমন পরিস্থিতিতে খরচের খাতার কথা ভুলেনি, নয়না। মাহবুব মনে মনে মেয়েটার প্রশংসা করলো। প্রথমে মাহবুব নয়নাকে চিনতে পারেনি কিন্ত পরক্ষণে নয়নার ডাগরডোগর চোখ জোড়া দেখে চিনে ফেলে সে। মেয়েটার মায়াভরা মুখখানা দেখে বড্ড মায়া হয় তার! মাহবুব সময় নিয়ে উত্তর দেয়, ” হাসপাতালের কমিটির পক্ষ থেকে তোমার বাবার চিকিৎসার খরচ বহন করা হয়েছে।”

নয়না অবাক হয়ে যায়। তার জন্য এতো সুবিধা কেন জিজ্ঞেস করে, ” কারণ কী, স্যার? ”

মাহবুব শিকদার মুচকি হেসে বলল,” কারণ তুমি আমার মেয়ের মতো। আরো একটা কারণ আছে, তোমার বাবা সুস্থ হলে তাকে বলবো। আপাতত তোমার বাবার চিকিৎসা করতে দাও।”

নয়না নির্বিকার। কী বলবে সে? কতো বছর পর তার ভাগ্য উলটো দিকে ঘুরলো, জানে না সে। এত বছর ধরে তার সাথে খারাপই হয়ে আসছে কিন্তু আজ! ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে নয়না মিছিল ও তার ভাই মারুফকে এসেছে। নয়না দৌড়ে মিছিলকে জড়িয়ে ধরে, কান্নার স্বরে বলতে থাকলো, ” বাবা, বাবা আইসিইউতে মিছিল! ফুফু আসলো না। ডাক্তার বলল, বাবার অবস্থা ভালো না। কি করবো আমি, আমি তো এতিম হয়ে যাবো রে, মিছিল।”

মিছিল নয়নাকে স্বান্তনার দেয়ার জন্য বলল, ” শান্ত হো। আঙ্কেল ঠিক হয়ে যাবে।”

ঠিক হয়ে যাবে বললেও নুরুজ্জামান ঠিক হলো না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন। ভাবনা আইসিইউতে মাহবুব শিকদারের সাথে ছিল। সে দ্রুত বের হয়ে এসে নয়নাকে ডেকে বলল, ” মনকে শক্ত করো,নয়না। তোমার বাবা আর নেই।”

বাবা বলে আর্তচিৎকার দিয়ে নয়না জমিনে লুটিয়ে পড়লো। শরীরের দুর্বলতা, অতিরিক্ত চিন্তা, চাপ নেওয়াতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে নয়না। তূর্য এতক্ষণ আইসিইউতে ছিল, তার মেজার প্রচন্ড রকমের খারাপ। আইসিইউর ভেতর এমন কিছু ঘটেছে যা ঘটার উচিত ছিল না। নয়নাকে কটু কথা শোনাতেই সে এগিয়ে আসছিল কিন্তু মেয়েটার জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া দেখে দৌড়ে আসে। সাথে সাথেই বাহ্যিক জীবনের কথা ভুলে ডাক্তারের কর্তব্য পালন করতে থাকে। নয়নার হাতের পালস পরীক্ষা করে দ্রুত পাঁজা কোলে তুলে নেয় তূর্য। মেয়েটার ওজন এতো কম, ভেবে অবাক হয় সে। ইমার্জেন্সি রুমে প্রবেশ করে সাময়িক চিকিৎসা দিতে থাকে নয়নাকে। শরীরের দুর্বলতা, না খেয়ে থাকার কারণে সেলাইন দিতে হয় নয়নাকে। মিছিল বান্ধবীর করুণ অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। তূর্যের উদ্দেশে বলল, ” এমন পোড়া কপাল যেন আর কারো না হয়, ডাক্তার। নয়নাকে এমন ঔষধ দিয়ে রাখুন, যেন সে আজীবন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। কেননা মেয়েটা চোখ খোলা অবস্থায় ভালো কিছুর সম্মুখীন হয় না, কষ্টে থাকে।”

তূর্য অবাক হয়ে মিছিলের কথা শুনে। তার কৌতূহল জাগে নয়নার সম্পর্কে জানার জন্য। কালবিলম্ব না করে মিছিলকে প্রশ্ন করলো, ” নয়নার সম্পর্কে জানতে চাই।”

মিছিল হতভম্ব হয়, পরবর্তীতে তূর্যের দ্বিতীয় বাক্য শুনে নয়নার সম্পর্কে এক এক করে জানাতে থাকে তূর্যকে।

—————————–

নুরুজ্জামানের জানাজা সম্পন্ন হয় তার মেয়ের অনুপস্থিতিতে। নয়নার জ্ঞান ফিরেনি, শারীরিক দিক বিবেচনা করে তূর্য তাকে কড়া ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। নয়নার শারীরিক অবস্থা ভাল না। স্ট্রোকের পর্যায়ে চলে গেছে, এতো অল্প বয়সে স্ট্রোক করলে জীবন শংকাজনক।

প্রায় বারো ঘণ্টা পর নয়নার জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ বন্ধ অবস্থায় সে মনে করতে চেষ্টা করে তার সাথে ঠিক কী ঘটেছিল। যখন বাবার কথা মনে পড়ে তখন চোখ খুলে সে। তূর্য কেবিনের কোণার চেয়ারে বসে ফোন টিপছে। নয়নার দিকে তার ধ্যান নেই। নয়না ধীরে উঠে বসে। দুর্বল শরীরে বিছানা থেকে উঠতে নিলে হাতে টান অনুভব করে সে। সাথে সাথেই আহ করে শব্দ করে। তূর্য ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে নয়নাকে বসিয়ে হাত উঁচু করে বলল, ” বাচ্চা নাকি? আমাকে ডাকলে হতো না! দেখি, হাত উঁচু করে ধরুন। র’ক্ত উঠে গেছে দেখেছেন?”

সত্যি সেলাইনের পাইপ বেয়ে অনেকটুকু র’ক্ত উঠে গেছে, নয়না ভয় পেয়ে যায়। পাইপে র’ক্ত উঠে যাওয়া স্বাভাবিক এই বিষয় তার অজানা। তবে এই মুহূর্তে এসব মাথায় না এনে সে তূর্যের উদ্দেশে বলল,” আমার বাবা!”

” জানাজা সম্পন্ন হয়ে গেছে। আপনি অসুস্থ ছিলেন, ঘুমের মেডিসিন দেয়া আবশ্যক ছিল। এখন মোটামুটি সুস্থ আপনি।”

তূর্যের স্বাভাবিক উত্তরে নয়না অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকলো। সে চিৎকার করে বলল, ” আমার বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে দিলেন না! আমার যা ইচ্ছে হোক, বাবাকে একবার দেখতে দিতেন!”

” আমি একজন ডাক্তার। ইচ্ছে করে কারো জীবন সংকটে ফেলতে পারি না। ঘুমের ইনজেকশন না দিলে আপনার ক্ষতি হতো।”

নয়না কাঁদছে, বাবার শেষযাত্রায়ও সে থাকতে পারেনি। কতোটা খারাপ ভাগ্য তার! দুঃখে মাথার চুল টানতে থাকলো, বিড়বিড় করে বলল, ” আমি এতিম, আজ থেকে আমি এতিম!”

তূর্য দুইটা কাগজ নয়নার দিকে এগিয়ে দেয়। তূর্য জানে, এখন কাগজগুলো দেয়ার সঠিক সময় নয়, কিন্তু নয়নাকে শান্ত করার জন্য এই পদক্ষেপ নিতে হলো তূর্যকে।

” আপনার বাবার জানাজা শেষে রিহান নামক একজন ছেলে আপনার বান্ধবীকে দিয়েছিল। সে কিছুক্ষণ আগে বের হয়ে গেছে, যাওয়ার আগে কাগজ দুটো আমার হাতে তুলে দিয়েছে। বলেছে, এগুলো নাকি আপনার বাবা মৃত্যুর আগে রিহানকে দিয়েছিল।”

নয়না চোখের পানি মুছে কাগজ দুটো হাতে তুলে নেয়। একটা তার লেখা চিঠি অপরটি নুরুজ্জামানের। সে চোখের সামনে নুরুজ্জামানের চিঠি মেলে ধরে পড়তে শুরু করলো,

মা রে!
আমাকে ক্ষমা করিস। তোর ভালো চাইতে গিয়ে পৃথিবীর নিকৃষ্টতর পিতা হয়ে গেছি। আজ বুঝলাম রে মা! মানুষের বাহিরের রূপ দেখে ভেতরের সত্তা বিচার করতে নেই। তোকে আর কষ্ট পেতে দিব না। কাল সকালেই চলে আসবি। আমরা ময়মনসিংহ চলে যাব। কুঁড়েঘর বানিয়ে সেখানেই থাকব।

নয়না কাগজের উপর চুমু খেয়ে কাঁদতে থাকে। তার বাবাকে সে এতোদিন ভুল বুঝে আসছিল। সত্যি কথা হলো, আকলিমা এতোদিন নয়নার বাবাকে উলটা পালটা যা বুঝিয়েছে নুরুজ্জামান তাই বুঝেছে।ছোট্ট মেয়েটার কথা কানে নেয়নি। আকলিমা নয়নার বিরুদ্ধে প্রতিটি কথা এমনভাবে নুরুজ্জামানের কানে ঢুকিয়েছে যা সত্য মনে হয়েছে।

তূর্য নয়নার কান্না সহ্য করতে পারছে না। সে মিনতির স্বরে বলল, ” কান্না থামান, প্লিজ!”

নয়না শুনছে না। তার এই মুহূর্তে একটা শান্তির নীড় প্রয়োজন, একটি কাঁধ প্রয়োজন যেখানে সে মাথা রেখে মনের দুঃখ ভুলতে পারবে। তূর্য নয়নার পাশে বসে ইতঃস্তত বোধ করে তার হাত ধরলো নয়নার তখন কি যেন হলো! সে তূর্যের কাঁধে মাথা রেখে পুনরায় কান্না করতে থাকলো। তার আর্তনাদ শুনে তূর্যের চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে যায়, মুষ্টিবদ্ধ হাতে সে শক্ত হয়ে বসে থাকলো। তখনই নয়না বিড়বিড় আওয়াজ তার কানে আসলো, ” মনভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। এতো কষ্ট আর সইতে পারছি না। আমাকে বাঁচান, ডাক্তার!”

চলবে……….

[ #নয়নে_বাঁধিব_তোমায় গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে কেউ মিলাবেন না,দয়া করে। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন, আমি পরবর্তীতে সংশোধন করতে চেষ্টা করব। ভালো থাকবেন সবাই। আসসালামু আলাইকুম।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here