#এক_ফালি_সুখ🌼 |১৩|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
বাসায় এসে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ধুয়ে নিচ্ছে মৌরিন। মারুফা রান্নাঘর থেকে খাবার এনে ছোট টেবিলের উপর রাখছেন। মৌরিন মুখে পানি দিয়ে সামনে থাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষন। এরপর খানিকটা শব্দ করেই হাসলো সে, মারুফা ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকালেন মেয়ের দিকে। মৌরিন এভাবে হাসেনা অনেকদিন, তাও একা একা? আয়নায় মারুফার অবাক মুখশ্রী দেখতে পেয়ে মৌরিন আরেকবার মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বলে,
_”দিনদিন বুঝি আমি সুন্দর হয়ে যাচ্ছি মা? চেহারার উজ্জ্বলতা কি বেশি বেড়ে যাচ্ছে নাকি?”
মারুফা সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
_”এমন কথা বলছিস কেন?”
পাশের চেয়ার থেকে টাওয়াল টা নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মৌরিন বলে,
_”না এমনিই বললাম আরকি। আমার মুখে কি হুট করে একগাদা মায়া এসে ভর করলো নাকি? অনেক মানুষের যে আমায় দেখে মায়া লাগে, দয়া করতে ইচ্ছে করে।”
_”কি হয়েছে রে মৌ? কেউ কিছু বলেছে তোকে?”
_”আমাকে আবার কে কি বলবে? যাকগে,ছাড়ো ওসব। শোনো, নতুন আরেকটা টিউশন পেয়েছি। এবার কলেজের স্টুডেন্ট। সবাই তো তিনদিন পড়ায়,আমি বলেছি চারদিন পড়াবো। একটু পরিচিতি দরকার বুঝলে, আমি কেমন পড়াই সেটা মানুষকে তো জানাতে হবে। তবেই না আরো টিউশন পাবো।”
মারুফা সামান্য হেসে বললেন,
_”ভালো তো,ধীরেধীরে আরো টিউশন পাবি।”
_”পাবোই তো। আমি কেমন পড়াই তা আমি খুব ভালো করেই জানি। আর এক ফালি সুখের জন্য একটু তো ধৈর্য ধরতেই হবে তাইনা?”
স্মিত হাসে মৌরিন,মারুফা তার নজর কেটে বলে,
_”আমার মেয়ে আগে থেকেই খুব সুন্দর,নতুন করে তার আর সুন্দর হতে হবেনা।”
মৌরিন আবারো হেসে খাটে বসে বলে,
_”মাফ করেন আম্মাজান, আমি তো মজা করে বলেছিলাম। তবে হ্যা, আমি যেমন আমি তেমনই সুন্দর। লোকের কাছে না হোক নিজের কাছে আমি ঠিক ফুলের মতো সুন্দর বুঝলে?”
কথাটা বলে নিজের খোলা চুলগুলো খোঁপা করে বলে,
_”চুলের বেহাল অবস্থা হয়ে যাচ্ছে,একটু তেল দিয়ে দিয়োতো মা।”
মারুফা খাবার বেরে দিতে দিতে বললেন,
_”খেয়ে নে আগে, তারপর দিয়ে দিচ্ছি।”
_______
ডিনার শেষ করে বাড়ির ছাঁদে থাকা দোলনায় পা দুলিয়ে বসে আছে তূর্য। হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিনে ফেইসবুকের নিউজফিড এর চিত্র বিদ্যমান। লগ ইন করা আইডির নাম ‘Tirzo Absar’। এক কথায় এটাকে ফেইক আইডিই বলা চলে, তবে সম্পূর্ন ফেইক নয়। ইলহাম আবসার তূর্য নামে তার নিজের পেইজ,আইডি সবই রয়েছে। তবে সেগুলো সবসময়ের জন্য ইউজ করা তার কাছে খুব একটা কমফোর্টেবল না। তাই এই আইডির নাম দিয়েছে তীর্য আবসার, কেবলমাত্র তার ফ্যামিলি মেম্বার এবং কাছের বন্ধুরা ছাড়া কেউ এই আইডি সম্পর্কে জানেনা। এমনকি দিয়াকেও জানায়নি, নাহলে এখানেও জ্বালিয়ে মারতো।
হঠাৎ ফ্রেন্ড সাজেশন এ এসে চোখ আটকে যায় তূর্যর। তাসনিম জাহান নামক একটি আইডি, ওয়ান মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আর সেটা রাতুল। প্রোফাইল পিকচার এ কেবল মেয়েটাকে পিছন থেকে দেখা যাচ্ছে, কোনো এক পাহাড়ে হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে সে,ছবিটা পিছন থেকে তোলা। বিনুনি টা কোমড়ের একটু উপর অবধি, আর তাতে অনেকগুলো মৌরিফুল গুঁজে রাখা। সেই ফুলের দিকে চোখ যেতেই কিছু একটা সন্দেহ হয় তূর্যর, প্রোফাইল এ ঢুকতেই দেখে নিকনেইম এ দেওয়া, ‘মৌরিন’।
সঙ্গে চোখ যায় প্রোফাইল এর বায়োর দিকে,
“মানব জীবন সবচেয়ে সুন্দর
শুধু প্রয়োজন প্রত্যাশা সরিয়ে আনা
সঙ্গে নিজের প্রতি আস্থা”
প্রোফাইল লক করা নেই দেখে নিচে যায় তূর্য। তবে পাচবছর আগের একটা কভার ফটো আর একমাস আগের চেঞ্জ করা প্রোফাইল পিক ছাড়া আর কিছুই খুজে পায়না। বোঝাই যাচ্ছে বাকি পোস্ট হয়তো অনলি ফ্রেন্ডস করা আছে। একমাস আগের চেঞ্জ করা প্রোফাইল পিকচার টাতে ক্যাপশন এ দেওয়া “The only place I will miss, because it never underestimated me”
সেই পোস্ট এ ১৭৮ টি রিয়েক্ট এর মধ্যে অধিকাংশই স্যাড রিয়েক্ট। কৌতূহল নিয়ে কমেন্ট বক্স এ প্রবেশ করলো তূর্য।
কমেন্টগুলো দেখে আরো অবাক হয় তূর্য।
“যাসনা মৌপাখি”, “ইউ আর মাই ইন্সপিরেশন মৌরি”, “না গেলে হয়না মৌ?”, “আর আমি তোমায় মিস করবো আপু”
এমনই আরো অনেক কমেন্টস। দুদিন আগেই একজন সেই প্রথম কমেন্টদাতা রিমি আরেকটা কমেন্ট করেছে, “ফিরে আয়না মৌপাখি,ভালো লাগেনা তোকে ছাড়া।”
আরেকজন লিখেছে, “ডোন্ট ইউ রিমেম্বার আস মৌরিন?”
মৌরিন তাতে রিপ্লাই দিয়েছে,”সময় নেই যে মনে করার।”
তাতে সেই ছেলেটি কেবল একটি স্যাড রিয়েক্ট দিয়েছে।
ভিতরে পুষে রাখা কৌতূহল যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো এগুলো দেখে। তূর্য এইটুকুই জানে, মৌরিন আগে সিলেট থাকতো। তবে সেখান থেকে কেন চলে এসেছে তা জানা নেই। জানার ইচ্ছেও ছিলো না, তবে এই কৌতূহল নামক বস্তু একবার মনে ঢুকে গেলে তা থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন।
ছবিটির দিকে আরো কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো তূর্য। মনে হচ্ছে এটা সিলেটের কালাপাহাড়,তূর্য গিয়েছিল দুবছর আগে। সেখানে মৌরিন এর পরনে একটা হলুদ রঙের থ্রি পিস। ওড়নাটা এক সাইডে খুলে দেওয়া। হাটু ভাজ করে তাতে মুখ গুঁজে রাখা, মুখ না দেখেই কেমন যেন উদাসীন মনে হচ্ছে ছবিটাতে। যেমনটা তাকে কখনো লাগে না, অন্তত তূর্য তো দেখেনি। মৌরিন কে দেখে বোঝাই যায়না, সে এখন খুশিতে আছে নাকি দুঃখে। যেন সে একজন যন্ত্রমানব। মাঝেমধ্যে হাসে,তবে কখনো মন খারাপ মনে হয়না।
এই আইডি টা আরো ঘুরে দেখার ইচ্ছে হলো তূর্যের নিজের অজান্তেই এড ফ্রেন্ড এ ক্লিক করলো সে। একমিনিট না কাটতেই সে যেন নিজের মধ্যে ফিরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে ক্যানসেল করে দেয় ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট। কি করছিল সে? একটা মেয়েকে নিজে থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিচ্ছে? যা তূর্য জীবনেও করেনি। একটা মেয়ে সম্পর্কে জানার জন্য তার এত কৌতূহল?
প্রোফাইল থেকে বেরিয়ে এলো তূর্য,এমনকি সেই আইডি থেকেই বেরিয়ে এলো। যার তার সম্পর্কে এতো বেশি ভেবে ফেলাটা ঠিক হচ্ছেনা,মোটেই ঠিক হচ্ছেনা।
______
সকাল সকাল আবারো সকলে শুটিং সেট এ এসে পৌঁছেছে। রাতুল ও নাকি কাল রাতেই ফিরেছে ঢাকায়, তাই ও কিছুক্ষন এর মধ্যেই চলে আসবে। শুটিং শুরু হতে এখনো কিছুটা সময় বাকি। তাই তূর্য,তন্নি আর কো আর্টিস্ট রা স্ক্রিপ্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মৌরিন ও দাঁড়িয়ে আছে সামনেই,আপাতত তার কোনো কাজ নেই।
কিছুক্ষন বাদেই রিক্সা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো রাতুল। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে আসতেই তন্নি কপাল কুঁচকে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়, রাতুল তো সবসময় বাইক নিয়েই আসে। আজ তাহলে রিক্সায় এলো কেন?
_”একটু লেইট হয়ে গেলো না? মৌরিন এদিকে..”
মৌরিনকে ডাকতে ডান হাতটা উঁচু করতেই রাতুলের মুখ থেকে “আহ” শব্দ আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। চোখ মুখ কুঁচকে হাতটা সোজা করে সে। তন্নি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় তার কাছে,রাতুল সামনেই ছিলো। তন্নি শঙ্কিত কণ্ঠে তাকে বলে,
_”কি হলো ভাইয়া? আপনি বসুন, বসুন তো এখানে।”
_”আরে তেমন কিছু হয়নি..”
তন্নি কোনো কথা শুনলো না, রাতুলকে ধরে নিয়ে বসালো চেয়ারে। রাতুল একটা হাফহাতার নীল রঙের টিশার্ট পড়ে থাকায় হাত সম্পূর্ন দৃশ্যমান ছিলো। সেদিকে তাকাতেই চোখ বড়বড় হয়ে যায় তন্নির। হাতের কনুই বরাবর সামনের দিকে ব্যান্ডেজ দেওয়া, তার উপরে মাসলস এর দিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে লাল হয়ে আছে, থেকেথেকে রক্ত জমাট বেধে আছে এমন।
চোখ চিকচিক করে ওঠে তন্নির। হাতের সেই জায়গায় নিজের হাত রেখে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলে,
_”হাতে কি হয়েছে এগুলো? এমন লাল হয়ে আছে কেন?”
তন্নিকে এমন ভয় পেতে দেখে রাতুল বা হাত উচিয়ে তাকে শান্ত করার জন্য সামান্য হেসে বলে,
_”কিছু হয়নি বলছি তো। তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? আসলে কাল ব্লাড দিয়ে হয়েছিল তাই..”
_”ব্লাড দিলে কারো হাতের এমন বাজে অবস্থা হয়? মজা করছেন আমার সঙ্গে?”
_”রিল্যাক্স তন্নি,আহামরি কিছুতো হয়নি। আসলে একবারে হয়নি, কয়েকবার ট্রাই করতে হয়েছিল তাই এমন অবস্থা?”
তন্নি হঠাৎ রেগে গিয়ে বলে,
_”কোন ফালতু লোকে ব্লাড নিতে আসছিলো? কাজ না পারলে করতে আসে কেন? আমি সামনে পেলে তাকে..”
রুবেল ভাই তখন পাশে এসে বলে,
_”তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? ব্লাড দিলে অনেক সময় হয় এমন,অভিজ্ঞ না হলে এই সমস্যাটা হয়।”
রাতুল ও সম্মতি জানিয়ে বলে,
_”ঠিক বলেছেন ভাই। ইন্টার্নি স্টুডেন্ট ছিলো মেবি, তাই এই অবস্থা। চারবারের বেলায় গিয়ে ব্লাড পেয়েছে।”
কথাটা বলে তন্নির দিকে তাকায় রাতুল। তন্নি এমনভাবে সেই হাতের দিকে তাকিয়ে আছে যেন এখনি তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরবে।
_”তন্নি? আমি ঠিক আছি কিন্তু।”
রাতুল এর দিকে তাকিয়ে তন্নি করুন সুরে বলে,
_”খুব ব্যাথা হচ্ছে তাইনা?”
রাতুল কয়েক সেকেন্ড তন্নির দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে না সূচক মত জানায়।
তন্নি এবার রাতুল এর কপালে গালে হাত দিয়ে বলে,
_”বললেই হলো ব্যাথা করছে না? গা টাও তাও বেশ গরম মনে হচ্ছে,নিশ্চই এই ব্যাথার জন্যই জ্বর এসেছে? আপনি আসতে গেলেন কেন বলুন তো এই অবস্থায়? আপনাকে থাকতে হবেনা এখানে, বাসায় গিয়ে রেস্ট করুন। এদিকটা মৌরিন সামলে নেবে।”
#চলবে?
[আজকে ছোট বলিও না পিলিজ। কেমন লাগলো জানিয়ে যাও,রাতুল কে মিস করেছো কে কে?
হ্যাপি রিডিং।]