প্রিয়_রুদ্র_ভাই #পর্ব-১০ #তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

0
158

#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-১০
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

জাফলং এ দু’দিন থেকে তটিনীরা পথ বদলালো। গাড়িতে করে রওনা হলো সিলেটের অন্য আরেকটি পর্যটন স্থানে। শাহপরান ও শাহজালাল ঘুরে তারা স্টেডিয়ামে গেলো। চারিদিকে বিস্তৃত চা বাগান। সবুজে ঘেরা চারিদিক। একদল চা পাতা সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। কেউ কেউ এসেছে পিকনিকে। এতো এতো মানুষের মুধ্যে নিজেকে অনুভব করে তটিণী-র মন নেচে উঠলো৷

চা বাগান ঘুরে সিলেটের বিখ্যাত পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেলো তারা। তারপর রাতের বাসে করে রওনা দিলো রাজধানীতে।

*
সময় চলে গেলো তীব্রবেগে। তটিনী নবম থেকে দশমে উঠে গেলো। রুদ্র তখন সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করে বাসায় পড়ে আছে। হাতে তার অফুরন্ত সময়। তখন আমাদের তটিণী-র বয়স সতেরোতে গিয়ে ঠেকেছে। এই দীর্ঘ ছুটিতে রুদ্র আবারও বন্ধুদের নিয়ে ট্যুর দিবে বলে ভাবলো। বরাবরের মতো যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলো তটিনী। কিন্তু রুদ্র রাজি হলো না। বলল, ‘এসএসসি পাশ কর, তখন কাশ্মীরে ঘুরতে নিয়ে যাবো।’

তটিণীর চোখের জল নাকের জল এক করেও রুদ্রকে গলাতে পারলো না। রুদ্র বন্ধুদের নিয়েই ট্যুর দিলো দার্জিলিংয়ে।

কিছুটা অভিমান নিয়ে তটিনী পড়াতে মন দিলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো রুদ্রকে আর কখনো ট্যুরে নিতে বলবে না। তটিণী-র সফট হার্টে ব্যাপাক আঘাত লাগলো। জেদের বশে চঞ্চল তটিনী হঠাৎ সিরিয়াস হলো সবকিছুতে। স্কুল কামাই করা মেয়েটি নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত করতে লাগলো। নিজের মেয়ের চেঞ্জ দেখে মনে মনে খুশি হলেও চিন্তা হচ্ছিল ঈশানীর। মেয়ে হঠাৎ করে এভাবে চুপচাপ হলো কেন?’

রুদ্র ট্যুর থেকে আসার এক মাস পর সহ্য করতে না পেরে তটিণী-র অভিমান ভাঙানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে লাগলো। মাথায় হাত রাখতেই তটিনী হুরহর করে কেঁদে অভিযোগ করলো, ‘আপনি আমাকে কেন ট্যুরে নেন নি রুদ্র ভাই?’

রুদ্র কানে ধরে বলল, ‘আমি জীবনে যেখানেই যা-ই না কেন তোকে সাথে নিয়ে যাবো মা! তবুও তুই এরকম সিরিয়াস অভিমান করিস না। কখনো বিয়ে করে বউকে নিয়ে হানিমুনে গেলেও তোর জন্য আলাদা টিকিট নিবো যাতে তুই যেতে পারিস!

বিনিময়ে তটিনী মুখ ভেঙচি কে*টে বললো, ‘আপনাকে কোন মেয়ে বিয়ে করবে রুদ্র ভাই?’

রুদ্র হেসে বলল, ‘সময় হলে দেখবে পাবি কে করে।’

তটিনী আবারও আগের মতো হলো। কিন্তু রুদ্রের সাথে মেশাটা কমিয়ে দিলো। হয়তো বয়স বাড়ছে বলে ম্যাচিউরিটি এসেছে একটু। কিন্তু রুদ্র আগের তটিনীকে মিস করতে লাগলো। পিচ্চি মেয়েটা বড়ো হলো কেন?’

তটিনী আজকাল রুদ্রের আশেপাশে আসে না। কিছু বললেও মাথা নিচু করে বলে। রুদ্র হাত ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘পাল্টে যাচ্ছিস কেন তুই?’

তটিনী লজ্জা পেয়ে বলেছিল, ‘বড়ো হচ্ছি রুদ্র ভাই।’

তটিণী-র বড়ো হওয়াটা রুদ্র মানতে পারলো না। আগের তটিনীকে মিস করতে লাগলো প্রতিনিয়ত। তটিনী এসএসসি পাশ করলো। রুদ্র অনার্স লাস্ট ইয়ারে তখন। তটিণী-র বয়স হলো আঠারো। এডমিশন নিয়ে কলেজেও চান্স হয়ে গেলো তার।

বেচারা রুদ্র ভাই শুধু অসহায় চোখে চেয়ে চেয়ে তটিণী-র বড়ো হওয়া দেখতে লাগলো। আগের তটিনী আর এই তটিণী-র মধ্যে বিস্তর ফারাক। এই তটিনী লজ্জা পায়। আগের তটিনী ছিল মুখ পাতলা। রুদ্র নিজের এই অনুভুতির কোনো নাম দিতে পারে না। সে অনেক কিছু বুঝেও চুপ করে যায়। মা বাবা চাচা চাচির একমাত্র আদরের মেয়ে তটিনী। সে যদি ভাগ বসায় তো পুরো গোষ্ঠী তাকে কি করবে কে জানে! রুদ্র নিজের অনুভূতি চেপে যেতে লাগলো। চুপ হয়ে দেখতে লাগলো তটিণী-র বড়ো হওয়া।’

রুদ্র যখন গ্রেজুয়েট হলো তখন তটিনী ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য সব ব্যবস্থা করা হলো। রুদ্র নিজের অনুভূতি চেপে রেখে ছয়মাসের মধ্যে বিদেশে পাড়ি জমালো।

তটিনী কলেজ লাইফের ইতি টানলো। যে মেয়েটির পড়াশোনা ভালো লাগতো না সে মেডিকলে চান্স পেতে পুরোদমে পড়তে লাগলো। এবং ফলাফলও পেলো ভালো। সিলেট ওসমানীতে চান্স পেয়ে তটিনী রাজধানী ত্যাগ করলো। রুদ্র যা-ও একটু আধটু খুঁজ নিতে পারতো, এখন তাও পারে না। একজন যুবতী মেয়েকে তো প্রতিদিন ফোন দেওয়া যায় না। সপ্তাহে একবার পাঁচ মিনিটের মতো কথোপকথন এই তো। তাও কাজিন ভাই হিসেবে। রুদ্র পুরোটা সময় গম্ভীর থাকে। তুই থেকে তুমিতে এসেছে তার সম্মোধন। তাদের সম্পর্কের এই দেয়ালটা ঠিক কিভাবে উঠলো সেটা রুদ্র ভেবেও বের করতে পারে না। কারণ শুধু একটাই হতে পারে তটিণী-র বড়ো হওয়া। কিন্তু একটা মানুষ কি এতো দ্রুত বড়ো হয়ে যেতে পারে? এতো দ্রুত কিভাবে পাল্টে যেতে পারে?’

এভাবেই চলতে লাগলো। তটিণী-র পড়াশোনা চলতে লাগলো পুরোদমে। ডাক্তারি পড়া, ছুটিতে হোস্টেল বান্ধবীদের সাথে একটু আধটু ঘোরাঘুরি। ঈদে বাবা মাকে দেখতে যাওয়া এইতো।

*
এইযে এই চেঞ্জটা! এই পরিবর্তনটা হয়েছে কোনো কারণে। আমাদের জীবনে একটা ধাক্কা খেতে হয়। যার জন্য আমাদের পরিবর্তন হতে হয়। জীবনে ধাক্কা না খেলে আমরা ঠিক বড়ো হই না। আমাদের আত্নসম্মান বা ম্যাচিউরিটি বাড়াতে একটা ধাক্কাই যথেষ্ট। চঞ্চল তটিনী সবার আড়ালে কোনো একটা ধাক্কা পেয়েছে। ওই ধাক্কাটাই থাকে আত্নসম্মান বুঝদার একটি মেয়ে বানিয়ে দিয়েছে।

রাত বারোটা। হোস্টেলের বারান্দায় অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে তটিনী। মন খারাপের মেঘেরা তাকে চেপে ধরেছে। চোখে টলমল করছে নোনাজল। বুকে চেপে আছে এক সমুদ্র কষ্ট। যা কাউকে বলা হয়নি। তটিনী জানেনা সে কখনো বলতে পারবে কি না। শুধুু সে জানে সে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। এমন ভুলের কারণে তাকে অভিনয় করে যেতে হচ্ছে। সে জানেনা সে আবারও আগের মতো হতে পারবে কি না। সে জানেনা আগের মতো রুদ্রকে রুদ্র ভাই বলে জড়িয়ে ধরতে পারবে কি না, হাজারটা বায়না ধরতে না পারার আফসোসে তার বুকে পাহাড় জমা হলো। সেই পাহাড় সাগড়ে পরিণত হয়ে তটিণী-র চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

অন্ধকার মন খারাপি আকাশের দিকে তাকিয়ে তটিনী অভিযোগ করে ফেললো সম্পূর্ণ বেখেয়ালে।

প্রিয় রুদ্র ভাই?

আপনি কি দুঃখ চিনেন? মন খারাপ বুঝেন? চিনলে কেন বুঝেন না প্রেয়সীর হৃদয়ের ব্যকুলতা। আপনার জন্য ব্যাকুল থাকে যার মন। কেউ একজন আপনাকে নিরবে মন দিয়ে বসে আছে বুঝতে পারেন না কেন? আপনার কি কিছুই যায় আসে না? একটু বুঝুন না। মেয়ে মানুষের মন বুঝতে না পারলে কেমন পুরুষ আপনি? তটিণী-র চঞ্চল মন গুমরে ম*রছে, আপনার একটি ইশারা পাওয়ার আশায়! আপনি সব বুঝলেন সব জানলেন, জানলেন না শুধু তটিণী-র মনের কথা। আপনার অগোচরে যে-ই কষ্ট আমি বয়ে চলেছি, সে-ই কষ্টটা যেন আপনি কখনো অনুভব না করেন। আপনাকে যেন আপনার ভাগ্য ভালো রাখে। তটিণী-র ভাগ্যে কয়লা থাক। যা পুড়িয়ে ছাড় খাঁড় করে দিবে তটিণী-র লুকোনো চঞ্চল হৃদয়কে।’

*
বিদেশের মাটিতে বরফ ঢাকা বিস্তর প্রান্তরে হুডি পড়ে দাড়িয়ে আছে এক যুবক। বরফ দিয়ে বানিয়ে চলেছে এক চঞ্চল হরিনীর কিশোরী রুপ। বরফ গলতে গলতে সেটা না-ই হয়ে যেতেই যুবকটির চোখ থেকে টুপ করে পড়লো একফোঁটা নোনাজল। বরফ ধীরে ধীরে যুবকটিকে গ্রাস করে নিতে শুরু করতেই ভেসে এলো কারো চিৎকার।

‘হেই রুদ্র কি করছো তুমি ওখানে? কুইকলি চলে আসো। তুমি চাপা পড়ে যাবে।’

রুদ্রের যেনো দ্যান ফিরলো। তড়িৎ গতিতে চলে গেলো হোস্টেলের ভেতরে। হাত পা জমে বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। হুডি খুলে রুদ্র ব্লাংকেটের তলে ঢুকলো৷ হট এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে রইলো কিছুসময়। বুকে ব্যথা ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো। চিৎকার করা যুবকটি গরম কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কি করছিলে তুমি তখন? কতোটা ক্ষতিকর ওটা জানো?’

রুদ্র কিঞ্চিৎ হেসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তাকে ভাবতে লাগলে আমি দুনিয়া ভুলে যাই হ্যারি।

হ্যারি কাঁধ চাপড়ে বলল, ‘লাভ সাবজেক্ট? ওয়াও।’

রুদ্র চোখ বন্ধ করে কফিতে চুমুক দিতে লাগলো। বুকে তখনো চিনচিন করছে তার। কাউকে মনে পড়ছে তীব্র ভাবে।

(চলবে)

(নিজে জ্বরে পু*ড়ে যাচ্ছি তাই আপনাদেরও একটু পু*ড়িয়ে দেওয়ার চোখে করলাম।🥱)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here