#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-১২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
কলেজে আজ পরিচয় পর্বটাই হলো৷ বইপত্র কিনার পর দু’দির বাদে ক্লাস শুরু হবে। এবং সেদিন থেকে সবাইকে যথাক্রমে কলেজ ইউনিফর্ম পড়ে আসতে হবে।
আগামীকাল হবে নবীন বরণ অনুষ্ঠান। সেটা নিয়ে অনেক এক্সাইটেড সবাই। রুপান্তর ও তটিনী হেঁটে যাচ্ছিল মাঠ দিয়ে। রুপান্তর প্রশ্ন করলো, ‘বলো তো আমার নামের অর্থ কি?, তখন তো তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে এবার তুমি বলো তো নদীর পানি?’
তটিনী চোখমুখ কুঁচকে বলল, ‘একদম আমাকে নদীর পানি বলবে না।’
রুপান্তর নিজের চোখের চশমা ঠিক করে বললো, ‘ঠিক আছে বলবো না। এবার আমার নামের অর্থ বলো।’
তটিনী রুপান্তরে চোখ ভুলিয়ে নিলো। বলল, ‘যার রুপ বেয়ে বেয়ে পড়ে তাকে-ই রুপান্তর বলে।’
রুপান্তরের চশমা চোখ থেকে নাকের ডগায় চলে আসলো। বেচারি খালি মুখে বিষম খেয়ে বলল, ‘এটা কেমন লজিক?’
তটিনী ভাব নিয়ে বলল, ‘আমার লজিক। আমি তো যা-ও বলতে পেরেছি তুমি তো তা-ও পারোনি। হাহ্ ইস্টুপিট গার্ল!
কথাটা রুপান্তরের ইমেজে লাগলো। বলল, ‘আচ্ছা তুমি আমার সম্পূর্ণ নামের অর্থ বলো তো?’
‘কোন নামটা?’
‘আমার সম্পূর্ণ নাম, ‘রোকেয়া বিনতে রুপান্তর!’
তটিনী ভাবুক স্বরে বলল, ‘ ও আল্লাহ তুমি বেগম রোকেয়া?’ তোমাকে তো দেশের জনগণ খুঁজছে। প্রতিনিয়ত তোমাকে নিয়ে ট্রল হয় জানো? বাংলার ইয়াং জেনারেশন তোমার উপর ক্ষেপে আছে। প্রতিদিন তোমাকে নিয়ে হাজার হাজার পোস্ট হয় ফেসবুক ইনস্টাগামে।’
রুপান্তর কান চেপে ধরে বলল, ‘কিন্তু আমি সে নই। আমি রোকেয়া বিনতে রুপান্তর। নট বেগম রোকেয়া ওকে?’
তটিনী ঠোঁট উল্টে হু বলতেই রুপান্তর পুনরায় বলল, ‘বলো আমার সম্পূর্ণ নামের অর্থ?’
তটিনী কিছু সেকেন্ড মনে মনে কিছু আওড়ালো। তারপর বলতে শুরু করলো,-
‘মুছামমত রোকেয়া বিনতে আক্তার চৌধুরী খানম বেগম মজুমদার খান সরকার বিএমপি আওয়ামী লীগ সেচ্ছাসেবক লীগ জঙ্গি পুলিশ সেনাবাহিনী নৌবাহিনী বিমানবাহিনী শিকদার অর্ফে রুপান্তর!’
রুপান্তর মাথা ঘুরে মাঠের মধ্যে পড়ে গেলো। তটিনী তড়িৎ গতিতে বসে পড়লো মাঠে। রুপান্তর তখন নিভু নিভু চোখে চেয়ে আছে। তটিনী কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, ‘ফাঁসিয়ে দিচ্ছো ভাই, রুদ্র ভাই জানলে আমার খবর করে দিবে। তুমি প্লিজ এখানে অজ্ঞান হইয়ো না রুপান্তর। তোমার বাসাতে সারাদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকো আমি কিছু বলবো না। কিন্তু এখানে না প্লিজ..!
রুপান্তর আস্তে করে বলল, ‘পানি খাওয়াবে প্লিজ?’
তটিনী নিজের ব্যাগ থেকে বোতল বের করলো। ততোক্ষণে কয়েকজন এসে ভীড় করে দাড়িয়ে পড়েছে। পানি খেয়ে রুপান্তর ধীরেসুস্থে উঠে বসলো। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি চাই এখানে তোমাদের? সার্কাস চলছে নাকি?’
সবাই চলে যেতে লাগলো। রুপান্তর তটিণী-র কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আব্বে তটিনী উঠা আমাকে।’
তটিনী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কথার সুর চেঞ্জ হলো কেন? তুই বলছো কেন? আপনি বলবা, বাপ মা সম্মান করতে শিখায়নি তোমাকে?’
রুপান্তর হেসে বলল, ‘আর একটা কথা বলবি তো লাথি মে রে তোকে উগান্ডা পাঠাবো তটিনী। কিসের আপনি হ্যাঁ? আমরা আজ থেকে বন্ধু ওকে?’
তটিনী অবাক হয়ে বলল, ‘মাথা ঘুরে পড়ে তুমি স্মৃতি হারালে নাকি গো?’ তোমার নাম তোমার মনে আছে তো?’ বলো তো তোমার নাম কি বাচা?’
রুপান্তর শরীর দুলিয়ে হাসলো। বলল, ‘আমি হলাম বাংলার বিখ্যাত বেগম রোকেয়া। যাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত সব জায়গায় কথাবার্তা হয়। আমি একজন সেলিব্রিটি উইমেন্স। তাছাড়াও আমি আওয়ামী লীগ, বিএমপি সেচ্ছাসেবক লীগ। সাথে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী।’ আমি রুপান্তর যার রুপ বেয়ে বেয়ে পড়ে।’
তটিণী-র এবার নিজেরই মাথা ঘুরাতে লাগলো। রুপান্তরের মুখ চেপে ধরে বলল, ‘ক্ষেমা দে মা, আর না।
রুপান্তর কিটকিটিয়ে হেসে বলল, ‘এবার তো টেনে তুল?
তটিনী উঠে দাড়ালো। বললো, ‘তোমার দাঁত খুব সুন্দর। কি দিয়ে ব্রাশ করো? মানে কি টুথপেষ্ট?’
রুপান্তর প্রথমে একটা লাফ দিলো। তারপর বলল, ‘যেটা দিয়ে ব্রাশ করলে কাছে আসা যায় সেটা।’
তটিনী কোমড়ে হাত রেখে বলল, ‘তুমি এমন করছো কেন?
রুপান্তর হেসে বলল, ‘জানি না, তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। তুমি কি আমার বন্ধু হবে?
‘কিন্তু আমি তো পা*গল!’
রুপান্তর শরীর দুলিয়ে হাসলো, বলল, ‘পা*গল কখনোই নিজেকে পা*গল বলে না। তুমি পা*গর হও বা ভালো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমি শুধু তোমাকে বন্ধু বানাতে চাই। জন্ম-জন্মান্তের বন্ধু। তুমি ‘আমার বন্ধু রাশেদ পড়েছো?’
তটিনী মাথা নাড়িয়ে না করলো।
তুই আমার বন্ধু হবি?একেবারে সারাজীবনের বন্ধু।মরে গেলেও যে বন্ধু থেকে যায় সেই বন্ধু।জানিস আমার কোনো প্রাণের বন্ধু নাই।জীবনে একজন বন্ধু থাকা দরকার যাকে প্রাণ খুলে সব বলা যায়।
বলো তো এটা কোন বইয়ের উক্তি?
তটিনী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, ‘জানি না।’
রুপান্তর নিজের ব্যাগ থেকে একটি বই বের করলো। সেটা তটিণী-র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই বইটা আমি তোকে দিলাম। তুই এটা পড়বি। তারপর তোর যদি ইচ্ছে হয় আমার বন্ধু হতে তো তুই এটা তোর কাছে রেখে দিবি। যদি না হতে ইচ্ছে হয় তো দিয়ে দিস।’
তটিনী অবাক চোখে তাকালো। বলল, ‘কি আছে এই বইয়?’
রুপান্তর চোখে হেসে তাকালো, বলল, ‘পড়লে বুঝতে পারবি। জাফর ইকবাল স্যারের বই।’
তটিনী আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘হুমায়ূন আহমেদের ভাই যে?’
রুপান্তর মাথা নাড়ালো, হ্যাঁ তিনিই।’
তটিনী বইটা ব্যাগে রেখে বলল, ‘ঠিক আচে পড়বো।’
রুপান্তর আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আগামীকাল নবীন বরণ। কি পড়ে আসবি?’
তটিনী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কি আবার? যা পড়ে আসি তা-ই পড়বো।’
রুপান্তর তটিণী-র হাত ধরলো। বলল, ‘তোকে আমার বন্ধু বানাতে ইচ্ছে করছে। আমার মনে হচ্ছে তোকে বন্ধু বানালে আমি ঠকবো না। জীবনে একজন সত্যি কারের বন্ধুর সত্যিই দরকার রে তটিনী। আমি তোর উত্তরের অপেক্ষা করবো। আগামীকাল দেখা হবে। আসছি।
রুপান্তর গেইট দিয়ে বের হয়ে গেলো। তটিনী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। তার বন্ধু বলতে ললিতা, যার সাথে সে স্কুলে যেতো। কিন্তু ললিতা কখনো তাকে এতো ইমপোর্টেন্স দেয়নি৷ কখনো হাত ধরে এভাবে বলেনি, ‘তুই আমার প্রানের বন্ধু হবি তটিনী? কখনো বলেনি ললিতা। বরং তটিনীকে মাঝে মধ্যে অন্য সব ক্লাসমেইটের সাথে মিলে কথা শুনাতো। একেক সময় একেক জনের দলে থাকতো।’
জীবনের এ পর্যায়ে এসে তটিণী-র মনে হলো সে হয়তো এবার সত্যি কারের বন্ধুর স্বাদ পেতে চলেছে। যে হবে তার জীবন-ম*রণের বন্ধু!
*
রিকশাতে চেপে বসলো তটিনী। তার পেট ঘুরঘুর শব্দ করছে মাঝে মধ্যে। ক্ষিধে পেয়েছে অনেক। রিকশাওয়ালাকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চালান কাকু, আমার পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।
রিকশাওয়ালা বিরক্ত হলেন। কারণ এই নিয়ে তটিনী পাঁচ বারের মতো একই কথা বলেছে। তার ঠিক দুই মিনিট পর তটিণী বলল, ‘আর কতক্ষণ কাকু?’
রিকশাওয়ালা নিজের পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হেসে বললেন, ‘মা কি শুধু হাতে-পায়েই বড়ো হইছেন নি? বাপ মা একা ছাড়লো কেন তাইলে?’
তটিনী ক্ষিধে ভুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রাগ হলো প্রচন্ড। বলল, ‘বাপ মা একা ছাড়ছে কারণ তারা জানে আমি একা চলতে পারি। আন্নেরে ভালা মানুষ মনে কইরা মনের কথা কইছিলাম, এর লাইগা আপনে এমনে আমারে কইবেন?’
রিকশাওয়ালা হয়তো দুঃখীত হলেন। বললেন, ‘ওহ আচ্ছা স্যরি গো মা। তোমার বাসাতে আইয়া পড়ছি নামো।
তটিনী রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে দৌড়ে গেইট দিয়ে প্রবেশ করলো। সুনামির বেগে কলিং বেল চাপতে লাগলো। ঈশানী দরজা খুলে দিয়ে হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘এভাবে ষাঁড়ের মতো বেল বাজাচ্ছিস কেন? মানুষ ভাববে দিন দুপুরে ডাকাতি হচ্ছে।
তটিনী নিজের মা’র ভুল শুধরে দিতে বলল, ‘ষাঁড় তো চেচায় মা, কলিং বেল বাজায় না।
ঈশানী রেগেমেগে চলে গেলেন। তটিনী দরজা বন্ধ করে সোফাতে ব্যাগ ফেলে দিলো। হাত পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে বলল, ‘বিশ্বজয় করে এসেছি গো মা, খেতে দাও।’
ঈশানী টেবিলে খাবার দিয়ে বললেন, ‘হাত পা ধুয়ে টেবিলে এসে খেতে বস। মেঝেতে কি তোর?’
তটিনী তার দুই-কাধে ফু দিয়ে বলল, ‘এটাই তো বাঙালিয়ানা মা। তুমি কি এর মর্ম বুঝবে?’ নানাজান তো ইন্ডিয়ার ছিলেন।’
ঈশানী মেয়ের কথায় নাক ফুলিয়ে বললেন, ‘গাধার বাচ্চা, ইন্ডিয়ার মধ্যেও বাঙালিয়ানা আছে। শুধু তোর বাপের দেশে একা না, আমার বাপের দেশেও আছে। বুঝেছিস? এবার খেয়ে উদ্ধার কর, ঘ্যানঘ্যান করবি না কানের কাছে খবরদার। নাহলে তোকে আর তোর বাপকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসবো।’
ঈশানী তার মহামূল্যবান ভাষণ দিয়ে চলে গেলেন। তটিনী ঠোঁট উল্টে ভাবতে লাগলো তার দোষ আসলে কোথায়?’
(চলবে)