#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৩.
অন্তূদের এলাকায় একবার ব্রাক ব্রাঞ্চ পরিচালিত গণশিক্ষার কার্যক্রম এসেছিল। সেখানে বয়স্কদের শিক্ষা দেয়া হয়। সে তখন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিনাজপুরেই টুকটাক কোচিং করছে। শখের বিষয়, বড়ো নিরক্ষর মানুষদের শিক্ষা দেয়া। সেও শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেছিল সেখানে। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল তাসিনের সাথে ওর। তাসিন ওর প্রেমে পড়ল। বাড়ির লোকদের সাথে, বিশেষ করে রাবেয়ার সাথে খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তার। রাবেয়া মানুষটা যুবকদের সাথে খুব তাড়াতাড়ি মিশে যান। ভোলাভালা, সরল নারী যাকে বলে। এক পর্যায়ে তাসিন যখন প্রস্তাব দিলো বিয়ের, সাফ মানা করেছিল অন্তূ। সে বিয়ে করবেনা, এমনকি সে কখনও তাসিনকে প্রমিকের মতো নজরে দেখেনি। তাসিন নিজে থেকেই উতলা হয়ে পড়েছিল। এরপর কিছুদিন কেটে গেল। তাসিন হাল ছাড়ল, মার্জিয়া নিজের বোন বীথির সাথে তাসিনের বিয়ে দিলো। অথচ এখন কেন তাদের সংসারে অশান্তি তা জানার কথা নয় অন্তূর। তাসিনের সাথে কোনোকালেই তার বিশেষ যোগাযোগ ছিল না।
মার্জিয়া কুষ্টিয়ার মেয়ে। তাকে ভাগিয়ে নিয়ে চলে এসেছিল অন্তিক। সেই নিয়ে মাস্টারমশাই আমজাদ সাহেবের নামও খারাপ হয়েছিল বিশেষ। দুটো থাপ্পর মেরেছিলেন আমজাদ সাহেব, ছেলের গালে। আর বিশেষ কিছু বলেননি। এরপর থেকে অন্তিক বদলেছে, মার্জিয়া নিজেকে প্রকাশ করেছে। শিক্ষিত মেয়ে হওয়া সত্বেও আচরণ খুব নিচু মেয়েটার।
অন্তূর আজ আর ভার্সিটিতে না গিয়ে উপায় নেই। আজ আরেকটা পরীক্ষা আছে ক্লাসে। নয়টার দিকে বেরিয়ে পড়ল সে ক্লাসের উদ্দেশ্যে। গেইট দিয়ে বের হবার সময় আমজাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি সকালের ট্রেনে দিনাজপুর ফিরেছেন কুড়িগ্রাম থেকে। অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “এই অসময়ে ফিরলে যে!ʼʼ
-“কাজ শেষ হয়ে গেল, ফিরে এলাম।ʼʼ
অন্তূ থামল, এরপর জিজ্ঞেস করল, “আব্বু! তোমার গ্রামের জমি বিক্রি করার এমন কী বিশেষ দরকার পড়ল, বলো নি কিন্তু এখনও আমায়!ʼʼ
গম্ভীর মুখে বললেন আমজাদ সাহেব, “সব কথাই শুনতে হবে কেন? পড়ালেখায় মনোযোগ নষ্ট হবে এসব সাংসারিক বিষয় মাথায় আনলে, মন দিয়ে পড়। তোদের সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল কবে?ʼʼ
-“ক্লাসটেস্ট চলছে, ডেইট দেবে খুব তাড়াতাড়ি।ʼʼ
আমজাদ সাহেব বললেন, “ভাড়া আছে কাছে?ʼʼ
অন্তূ মাথা নাড়ল, “আছে।ʼʼ
আমজাদ সাহেব শার্টের বুকপকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে অন্তূর হাতে দিলেন, “সাবধানে যাবি। ক্লাসশেষে দেরি করবি না, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি।ʼʼ
অন্তূ একটু সপ্রতিভ হলো, “এ কথা বলছ কেন, আব্বু?ʼʼ
-“ক্লাস শেষে কোথাও কাজ আছে কোনো?ʼʼ
-“না, নেই।ʼʼ
-“তাহলে আর দেরি করার কী আছে? এমনিতেও ভার্সিটি চত্বর আজকাল ভালো চলছে না।ʼʼ
অন্তূর বুক কাঁপল, আব্বু এখনও কিছু জানে না। এতো অগাধ বিশ্বাস আর আশা, ভরসা অন্তূর ওপর আব্বুর। সৃষ্টিকর্তা না করুন, খারাপ কিছু ঘটলে এই মানুষটা সইতে পারবে তো! মাথা ঝাঁড়া দিলো অন্তূ। ধুর! কীসব অযাচিত কথা ভাবছে সে! কিচ্ছু হবে না, রবের উপর ভরসা আছে অন্তূর।
—
রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে অন্তূ এগিয়ে গেল গেইট দিয়ে। অন্যরকম লাগছে কিছু একটা। জটলা পাকানো লোকজন ক্যাম্পাসে! একস্থানে চেয়ার, ও বেঞ্চি পাতা। জয় বসে আছে, পায়ে পা তুলে। পাশেই হামজা। দুজনের পরনেই সাদা পাঞ্জাবী। নভেম্বরের মাঝের সময়টা। শাল জড়ানো গায়ে। দুজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ছাত্র সংগঠনের ছেলেরা। হামজা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখে বসে আছে। জয় এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। স্থির থাকার স্বভাব নেই বোধহয়!
অজানা শঙ্কায় বুকটা ধুক করে উঠল অন্তূর। শ্বাস ধীর হলো তার। এক স্থানে একটু বেশিই ভিড় দেখা যাচ্ছে। উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে সকলে সেখানে নিচের দিকে। অন্তূ কৌতূহল বুকে নিয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। ভিড় ঠেলেঠুলে একটু ভেতরে ঢুকল। সে সময় কারও সঙ্গে ধাক্কা লাগল ওর, খেয়াল করার সুযোগ পেল না। মুহুর্ত খানিকের জন্য চোখে পড়ল— জীর্ণ একটা ময়লা কাপড়ে ঢাকা কোনো মেয়ের শোয়ানো দেহ মাঠের ঘাসের ওপর পড়ে আছে। অন্তূর রক্ত সঞ্চালন থামল বোধহয় উত্তেজনায়। আড়াল হলো দৃশ্যটি, মানুষের ভিড়ে। বেহুশের মতো সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, উবু হয়ে দাঁড়ানো লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে একদম কাছে গিয়ে দাঁড়াল দেহটার!
কে এই মেয়েটা! অন্তূ কোনো লাশের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আঁখি এটা? বুকের রক্ত ছলকে উঠল অন্তূর! এটা আঁখি নাকি? দু কদম পিছিয়ে গেল সে।
মুখটা বিবর্ণ, খামছির দাগে ভরতি, ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেধে শক্ত হয়ে গেছে, কালশিটে রং ধারণ করেছে। গাছি গাছি চুল ছিড়ে উঠিয়ে ফেলা হয়েছে যেন! বাকি দেহটা এক টুকরো কাপড়ে ঢাকা। নিশ্চয়ই শুধু এই কাপড়টুকুই দেহে! এই কাপড়টুকুর নিচে এতোগুলো মানুষের ভিড়ে কোনো এক মেয়ের নগ্ন দেহ পড়ে আছে। অন্তূর মনে হলো, সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে, যার ফলে শরীরটা ভার ছেড়ে দিতে চাইছে।
কারা করেছে এসব? যে লোকটিকে ধাক্কা দিয়েছিল সে এগিয়ে এলো, ধমকে উঠল অন্তূকে, “পিছনে সরে দাঁড়ান, এত কাছে এসে দাঁড়াবেন না। সরুন, পিছিয়ে যান।ʼʼ
স্পষ্ট, বিন্যস্ত ভাষা, ভরাট আদেশমূলক কণ্ঠস্বর। নজর তুলে তাকাল অন্তূ, কালচে খয়েরী ইন-শার্টে একটা ফর্সা মতো পুরুষ! অন্তূকে উপেক্ষা করে হাতা গোটাতে গোটাতে গিয়ে লাশের মাথার কাছে বসল। ইন্সপেক্টর রশিদ ডাকল তাকে, “মুস্তাকিন! আপনার ফোন বাজছে।ʼʼ
মুস্তাকিন ভিক্টিমের দেহ থেকে চোখ না তুলেই বলল, “পরে এটেন্ড করছি, রেখে দিন।ʼʼ
অন্তূর চোখ ভিজে উঠেছে, না আর নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ওই যে ক্ষতবিক্ষত মেয়েটার মুখ! হিচড়ানো আছড়ের দাগ, চোখের নিচটা ফ্যাকাশে কালো বর্ণের হয়ে উঠেছে। সম্মান লুটিয়ে দেবেনা বলে নিশ্চয়ই খুব হাচড়পাচড় করেছিল মেয়েটা! অন্তূ ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলো। তার বুকের তোলপাড়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আব্বু রোজ পত্রিকা পড়ে রেখে দেয়, সেখানে এমন ঘটনাগুলো চোখে পড়ে। আজ সেই পত্রিকা ভেদ করে প্রথমবার কোনো খুবলে খাওয়া মেয়ের মরদেহ সম্মুখে এসে পড়েছে! এগুলো আসলেই হয়! কান্নার তোড় সামলানো মুশকিল হচ্ছে, উতলে ওঠা দুধের মতো বলক দিয়ে আসছে বুক ভাঙা কান্না! অবাক হলো সে, সে কোনোদিন এভাবে কাঁদেনি। এরকম দূর্বল তো তার হৃদয় নয়! লোকের মুখে বহু শুনেছে, অন্তূর মাঝে নারীসুলভতা নেই, সে কঠিন! আজ সেসব মিথ্যে প্রমাণিত হতে চাইছে কেন? কীসের ভয় আড়ষ্ট করে তুলতে চাইছে অন্তূকে আঁখির ওই কাটাছেঁড়া দেহের প্রতীকে? আরও দূরে চলে এলো। মুখের নেকাবটা খুলে ফেলল, ব্যাগের সাইড থেকে পানির বোতল বের করে পানির ছিটা দিলো মুখে-চোখে। টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে, দুটো শ্বাস নিলো জোরে জোরে।
ধমকাল নিজেকে, আশ্চর্য! এতো ভঙ্গুর হয়ে পড়ছ কেন তুমি, অন্তূ? তুমি তো এমন নও!
কোথা থেকে যেন পাগলের মতো ছটতে ছুটতে এলেন সালমা খালা। বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে ছুটে এসে ধপ করে বসে পড়লেন মেয়ের লাশের পাশে মাটিতে। তার করুণ কান্নার সুর আকাশ-বাতাসে আলোড়নের মিছিল তুলেছে। কী হৃদয় ছিদ্রক সেই অসহায় মায়ের আহাজারী! অন্তূর চোখ বোধহয় আবার ভরে উঠেছে। নিজের ওপর রেগে উঠল অন্তূ! কী মুসিবত! এভাবে ভেঙে পড়লে জীবনকে মোকাবেলা করবে কী করে? কীসের মোকাবেলা? ওই তো একটা মেয়ের ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে আছে মাঠের ওপর। অন্তূও তো মেয়ে! জঙ্গলের জানোয়ারেরা কবে যে মানুষের মতো রূপ ধরে মানুষের সমাজে বাস করতে লেগে পড়েছে, তাদের মোকাবেলা করতে ভঙ্গুর হলে চলবে কেন?
একটা মেয়ে দৌড়ে এসে সালমা খালাকে ধরল। খালার বোধহয় দাঁত লেগে গেছে। কান্না থেমে গেছে, মেয়েটার বুকে নিথর পড়ে আছেন। এটাই বোধহয় আঁখির ভাবি! অন্তূর চোখের সামনে অপরিকল্পিতভাবে একটা ভয়ংকর দৃশ্য ভেসে উঠল, আখির স্থলে সে পড়ে আছে, রাবেয়া বেগম কাঁদছেন। আচ্ছা! মার্জিয়া এসে কি ওভাবে এসে ধরবে রাবেয়াকে, বুকে জড়িয়ে নেবে?
শক্ত হলো অন্তূর চোয়াল, মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল। কে করেছে এসব? জয়? হামজা? সেদিন তানিয়া যে কথাগুলো বলছিল, তার কতটুকু বাস্তব! যা তানিয়া বলেছে, সেটুকুই নাকি আরও কিছু আছে? ওই তো দুজন বসে আছে আরাম করে গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা নিয়ে চেয়ারের ওপরে। গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, কেন করেছিস এসব? ব্যথা লাগেনি বুকে, আঁখি যখন চিৎকার করে বাঁধা দিয়েছিল তোদের? কোন ভিত্তিতে এই প্রশ্ন করবে অন্তূ জয়কে গিয়ে? প্রমাণ তো নেই! দুজনে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী! যে ছেলেগুলো ঘিরে দাঁড়িয়ে ভাই ভাই করে ডাকছে দুজনকে, ওরা কি ছাড়বে অন্তূকে?
চোখের পানিতে নেকাবের ওড়না ভিজে উঠেল। মুখের ওপর, থুতনিতে পানি জমেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে নেকাব খুলে চোখ দুটো মুছে নিলো শক্ত হাতে। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ওদিকে। ছাত্রছাত্রীরা নিস্তেছ চোখে দাঁড়িয়ে দেখছে এই রঙ্গ-তামাশার খেলা।
মুস্তাকিন আঁখির ভাবী চাঁদনীকে বলল, “আপনারা ওনাকে ভিক্টিমের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যান। আমাদের কাজ করতে দিন, এই স্পটে আপনারা না ঢুকলে সুবিধা হয়।ʼʼ
সালমা বেগম কিছুক্ষণ পর পর চিৎকার করে উঠে বসে বুকে হাত ঘষছেন, আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ছে উনার শরীরটা। অন্তূর মনে হলো, মুস্তাকিন লোকটা কসাই টাইপের। এমনিতেও সরকারী কর্মকর্তারা তা-ই হয়। মুস্তাকিন একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আঁখির ভাই সোহেলকে ডাকল। সোহেল একদৃষ্টে বোনের লা শে র দিকে চেয়ে আছে, তার চোখে পানি নেই। বোনের বয়স কত? সতেরো? নাহ! সতেরো পড়েছিল না, চারমাস বাকি এখনও। মুস্তাকিনের ডাকে এগিয়ে গেল একটু। মুস্তাকিন কোনোরকম শিরোনাম ছাড়া প্রশ্ন করল, “কবে এসেছেন দেশে?ʼʼ
সোহেলের দৃষ্টি এখনও আঁখির লাশের দিকে। সে আনমনে জবাব দিলো, “চারদিন হলো।ʼʼ
-“কোন দেশে থাকতেন?ʼʼ
-“দুবাই।ʼʼ
-“কী কাজ করতেন সেখানে?ʼʼ
-“রাজমিস্ত্রি আদ সাটারিংয়ের কাজ করতাম।ʼʼ
-“আঁখিকে লাস্ট কবে দেখা গেছিল বাড়িতে?ʼʼ
-“চাদনী বলে, সপ্তাহখানেক আগে।ʼʼ
-“নিজেদের সামলান। এবং আমাদের সাহায্য করুন তদন্তের কাজে। এভাবে কান্নাকাটি করে কোনোরকম বিচার পাবেন বলে মনে হয়। শক্ত করুন নিজেদের।ʼʼ
এক প্রকার ভয় খেলে গেল সোহেলের চেহারায়, “না স্যার! কোনো বিচার লাগবে না তো। আমরা কোনো বিচার চাইনা, আপনে খালি আমার বোনের লাশ দেন, বাড়ি নিয়ে যাই। কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ নাই আমাদের।ʼʼ
মুস্তাকিন ঠোঁটে ঠোঁট গুজে নিচে তাকাল, “কেউ হুমকি দিয়েছে আপনাদের?ʼʼ
সোহেল মাথা নাড়ল, “না, না হুমকি দিবে কে?ʼʼ
মুস্তাকিন দূর থেকে জয় ও হামজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাউকে সন্দেহ করছেন?ʼʼ
সোহেল আবারও দ্রুত মাথা নাড়ল, “না।ʼʼ কণ্ঠস্বরে প্রাণ নেই, নিষ্প্রভ গলার স্বর।
মুস্তাকিন বামহাত পকেটে গুজে বলল, “এসে থেকে শুনছি, সকলের ধারণা কাজটা পাটোয়ারী পরিবারের দুই ছেলে করেছে! আপনাদের কী ধারণা?ʼʼ
সোহেল দ্রুত জবাব দিলো, “না না, স্যার! উনারা ক্যান করবেন এইসব? উনারা তো সব ঠিক করে দিতে চাইছিলেন! আমরাই উঠি নাই বাড়ি থেকে। এখন চলে যাব, ঝামেলা মিটে যাবে।ʼʼ
অগোছালো, অযাচিত কথা সোহেলের। বোনের মরদেহ পড়ে আছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। তারা বাড়ি খালি করার স্বীকারক্তি দিচ্ছে! চরম ঘাপলা বিষয়! আবার সহজও বলা চলে। খুব বেশিই ভয় পেয়েছে, অথবা কিছু লুকোনোর চেষ্টা, গা বাঁচানোর চেষ্টা!
আচ্ছা! এরা কি জানে মেয়টাকে গ ণ ধ র্ষ ণ করে মারা হয়েছে? গলায় আটকাচ্ছে খুব তার। এই পেশা জীবনে প্রথমবার বোধহয় সে সংকুচিত হচ্ছে মুস্তাকিন এ বিষয়ে! কেন হচ্ছে? সে আসলে রেপ কেইস হেন্ডেল করেনি আগে সেভাবে। আচ্ছা! ওরা কি বুঝতে পারছে না? এই যে বিবর্ণ চাদরে ঢাকা দেহটার বহিরাগত মুখটা বিভীষিকাময় এক ঘটনা বর্ণনা করছে, তা বুঝছে না বাড়ির লোক? না বুঝলে মা ওভাবে বেহুশ হয়ে পড়ছে বারবার! নাহ! বলতে পারবে না সে বুঝল, এই কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে করাতে হবে।
ভয় পাচ্ছে এরা। সে চাদনীর দিকে এগিয়ে গেল। সালমা খালাকে ছাত্রীরা পানি ঢালছে, চাদনী বসে আছে মাঠের ওপর। মুস্তাকিন গিয়ে হাঁটু ভাজ করে উবু হয়ে বসল চাঁদনীর পাশে। জিজ্ঞেস করল, “আঁখি কবে থেকে নিখোঁজ ছিল?ʼʼ
চাঁদনী চোখটা মুছল মলিন শাড়ির আচল দিয়ে, “সপ্তাহখানেক আগে দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি আসছে, টেস্ট পরীক্ষা চলতেছিল এসএসসির, বিকালে বাইর হয়ে গেল কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য, এই তো ফিরে আসছে, স্যার!ʼʼ
অন্তূর কলিজায় মনে হলো সজোরে এসে একটা তীর তীব্র বেগে গেঁথে গেল। ‘এই তো ফিরে আসছে, স্যার!ʼ চাঁদনীর কথায় মুখ ফিরিয়ে নিলো ঠোঁট কামড়ে। মুস্তাকিন উঠে দাঁড়াল। রশিদকে ডাকল, “এদিকে আসুন!ʼʼ
-“জি, স্যার!ʼʼ রশিদ এগিয়ে এলো।
মুস্তাকিন তার হাত থেকে ফোনটা নিতে নিতে বলল, “যত দ্রুত সম্ভব তদন্তের কাজ শুরু করুন। বডিটাকে ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন, এজ সুন এজ পসিবল!ʼʼ
রশিদ মাথা নাড়ল, আবার বলল, “কিন্তু স্যার! গার্জিয়ানরা তো লাশ বাড়ি নিতে চাচ্ছে। খুব জিদ ধরে আছে। কোনোভাবেই তারা লা শ কাটাছেঁড়া করতে দেয়া রাজী না। আপনি একটু কথা বলুন ওদের সঙ্গে।ʼʼ
মুস্তাকিন মাথা নাড়ল, “আচ্ছা, কথা বলছি। দ্রুত করুন। ক্যাম্পাসে লোক জড়ো হচ্ছে, একাট হাঙ্গামা হবার চান্স আছে। তার আগেই বডি ট্রান্সফার করুন মর্গে। কখন কে জানে জনতার মাঝে বিক্ষোভ জেগে ওঠে!ʼʼ
রশিদ মাথা নেড়ে চলে গেল। মুস্তাকিন মোবাইল হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। রশিদ এসে পাশে দাঁড়াল। তখনই প্রিন্সিপাল স্যার এগিয়ে এলেন ওদের দিকে। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন মুস্তাকিনের সঙ্গে, “আমি প্রিন্সিপাল ইউসুফ সিরাজীʼʼ
মুস্তাকিন মাথা নাড়ল সামান্য, “সৈয়দ মুস্তাকিন মহান। ইনভেস্টিগেটর— পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ডিপার্টমেন্ট।ʼʼ
প্রিন্সিপাল স্যার রশিদের সঙ্গে হাত মেলালেন। রশিদ নিজের পরিচয় দিলো, “রশিদ আলম। ইন্সপেক্টর অব থানা পুলিশ।ʼʼ
প্রিন্সিপাল দুঃখ প্রকাশ করলেন, কী যে হচ্ছে ভার্সিটিতে আজকাল! ছেলেমেয়েরা আতঙ্কিত, কারা এসব করেছে কে জানে..
মুস্তাকিন কথার মাঝখানেই ফোন কানে ধরে অন্যদিকে চলে গেল। রশিদ প্রিন্সিপালের কথায় অনিচ্ছাকৃত ‘হুʼ, ‘হ্যাঁʼ ঘাঁড় নাড়াতে থাকল।
এড-আইজি স্যারের কল এসেছে কমপক্ষে দশবার। মুস্তাকিন বিরক্ত হলো বেশ। প্রথমত এরা হুকুম করেই খালাস, এরপর আবার তথাকথিত তাগাদার নামে বিরক্ত করে ছাড়ে। কল ব্যাক বা রিসিভ না করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। এগিয়ে গেল মাঠের অপর প্রান্তে।
হামজা উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। জয় ফোন থেকে মাথা তুলল, “গুড জব, অফিসার!ʼʼ
মুস্তাকিন সামান্য হাসল অদ্ভুত ভঙ্গিতে, “থ্যাংক ইউ!ʼʼ এরপর হুট করেই বলল, “লোকে আপনাদের দিকে আঙুল তুলছে, আপনাদের কী খেয়াল!ʼʼ
হামজা হাসল, “আপনি তুলছেন না আঙুল?ʼʼ
-“আমি আম জনতার থেকে খানিক আলাদা, বলা চলে নিজের পেশার খাতিরেই! প্রমাণ ছাড়া আঙুল তুললে চাকরি থাকবে না।ʼʼ
হামজা ছেলেদের চলে যেতে ইশারা করল। তারা একে একে জায়গা ছাড়ল। ওই তো খানিক দূর থেকে মেয়ে হারা মায়ের কান্নার ধ্বনি ভেসে আসছে, লোকের চাপা গুঞ্জন, আর পরিবেশে অভিশাপের কালশিটে ধোঁয়া ছড়িয়েছে যেন। জয় জবাব দিলো মুস্তাকিনের, “আপনার চাকরি ধরুন আমি রক্ষা করব, তাহলে আঙুল তুলে জেলে ভরবেন তো?ʼʼ
মুস্তাকিন বসল দুজনের সামনে একটা চেয়ারে। সূর্যের তেজ ও আলো কমে উত্তরে হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। কাধে ঝুলিয়ে রাখা ডেনিম জ্যাকেটটা গায়ে চড়িয়ে বলল, “আপনার শখ অথবা শাস্তি সহ্য করার কনফিডেন্স– কোনটা ধরব?ʼʼ
হামজা একবার ঘাঁড় ফিরিয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে আবার মুস্তাকিনের দিকে ফিরে প্রসঙ্গ বদলালো, “কিছু জিজ্ঞেস করতে চান, অফিসার?ʼʼ
মুস্তাকিন সরাসরি কথায় এলো, “আপনারা আমাদের ডেকেছেন সকাল আটটার দিকে। তাহলে এখানে লাশ ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল ঠিক কখন, সে ব্যাপারে কোনো ধারণা আছে?ʼʼ
হামজা মাথা নাড়ল, “তা জানেনা কেউ-ই। আমাকে কল করা হয়েছে, তখনও আমি ঘুমে ছিলাম। ছেলেরা কল করে জানালো।ʼʼ
জয়ের দিকে ফিরল মুস্তাকিন। জয় মাথা ঝাঁকালো, “ভাই আমাকে জাগিয়ে নিয়ে এসেছে। আমি ঘুমাচ্ছিলাম।ʼʼ
মুস্তাকিন জিজ্ঞেস করল, “আপনারা একসঙ্গে থাকেন?ʼʼ
জয় নাড়ল, “উহু! এক বাড়িতে।ʼʼ
হেসে ফেলল মুস্তাকিন। ক্ষণকাল পেরোতে তার মুখভঙ্গি সিরিয়াস হলো, ফের শুধাল, “লাশ এক্সাক্টলি কোথায় ফেলা হয়েছিল সেই জায়গাটি দেখান আমাদের। সেটা তো দেখেছেন?ʼʼ
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন প্রাঙ্গনের পেছন দিকটা নির্জন, এবং গাছগাছালিতে ছাওয়া। সেখানে সচরাচর লোকের যাতায়াত অতটাও নেই। দিনের বেলা ছেলে-মেয়েরা আড্ডা দিতে নির্জন জায়গাটি বেছে নেয়। রাতে একদম সুনশান। ক্যাম্পাসের অফ-সাইড বলা চলে। সর্ব প্রথম লাশ দেখেছে ঝাড়ুদার। সে প্রথমে বুঝতে পেরেছিল না, ওটা লা শ। কোনোমতো ওড়নাটা জড়ানো ছিল লাশের দেহে। পরে কে বা কারা যেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এনেছে। এটা সকালে এসে থানা পুলিশের কাছ থেকেই শুনেছে সে।
মুস্তাকিন একবার নজর ঘুরিয়ে দেখল পুরো আশপাশটা। জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার চোখে প্রচুর ঘুম, দেখছি! লালচে হয়ে আছে, রাতে ঘুমাননি মনে হচ্ছে! এখন একটু বিশ্রাম প্রয়োজন!ʼʼ
কথাটা কোন দিকে নির্দেশ করে বলল মুস্তাকিন, বোঝা গেল না যেন! জয় চাদরটা গা থেকে খুলে গলায় পেঁচালো ওড়নার মতো করে। এরপর চমৎকার হাসল, “রাতে ঘুমানোর অভ্যাস এমনিতেও নেই আমার, ঘুম আসলে সকালে হয়নি বললে সঠিক হতো আমার জন্য! সকালে টেনে তুলে আনা হয়েছে। আসলে আমাদের মতো নেতাকর্মীদের দুঃখ আর পরিশ্রম আপনারা কোনোদিন বুঝবেন না। জনতার মন রাখতে কত যে লোক দেখানো ঢং করতে হয়! যেমন ধরুন, আমার আসতে ইচ্ছে করছিল না, কষ্ট হচ্ছেনা বিশেষ, মেয়েটা বা তার পরিবারের জন্য। তবুও আসতে হলো, ইভেন ধর্না ধরে বসে থাকতে হচ্ছে হুদাই এখানে নিরস মুখে। কেন? কারণ, তথাকথিত সমাজসেবক আমি।ʼʼ
-“আপনি মানছেন আপনি তথাকথিত সমাজসেবক?ʼʼ মুস্তাকিন কথাটা বলে ভ্রু উঁচায়।
জয় চাদরটা গলা থেকে হাতে কব্জিতে জড়াতে জড়াতে বলল, “না মানার কী আছে? আমি ভালো না, তা লোক জানে, আমি জানার আগেই? আমি জেনে লোককে জানিয়েছি, এরপর লোক জেনেছে।ʼʼ সোজা কথাকে পেচিয়ে জটিল বানালো জয়।
মুস্তাকিন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে, অথচ তার ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য হাসি। হামজা ও জয়ের ঠিক বিপরীত পার্শে অবস্থানকারী হিসেবে যেন আজ পেশাগতভাবে তার অভিষেক হয়ে গেল। জয়কে জিজ্ঞেস করে মুস্তাকিন, “তাহলে আপনাকে সন্দেহের তালিকায় রাখব?ʼʼ
এই শীতল কথোপকথনগুলো আর কেউ শুনলে নির্ঘাত তাদের কাছে অগোছালো, পাগলের প্রলাপ মনে হতো। অথচ তিনজনে বেশ সাচ্ছ্যন্দে নিজেদের আলোচনা সম্পন্ন করে উঠল। জয় তাকাল মুস্তাকিনের দিকে, কপট কৃত্রিম চিন্তার ছাপ ফুটলো তার মুখে, “উহু! এই কেইসে সাসপেক্ট হিসেবে থাকতে থাকতে উল্টাপাল্টা কিছু প্রমাণ হয়ে গেলে, ফাঁসি হয়ে যাবে, যেহেতু মেয়েটা মরে গেছে। এতো তাড়াতাড়ি মরে কী লাভ? মরব এরকম কোনো কেইসের দায়েই, তবে একটু বয়সকালে। এটা থেকে বাদ রাখুন আমায়।ʼʼ
অকপট পাগলাটে অভিব্যক্তি। অথচ মুস্তাকিনও এতে কোনো বিশেষ চমকিত প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
জয় উঠে গেল চেয়ার ছেড়ে। মুস্তাকিন হামজাকে বলল, “কাউন্সিলর সাহেবকে একবার থানায় আসতে বলবেন বিকেলে। আপনি আসলেও পারেন।ʼʼ
হামজা অস্বীকার করে নিজে আসতে, “আমি আসতে পারব না, বাবা যাবে। আমার কাজ আছে পৌরসভায়। বুঝতেই পারছেন, নির্বাচন এগিয়ে আসছে সামনে।ʼʼ
মুস্তাকিন হাঁটতে হাঁটতে আবার পেছন ফিরে দেখল হামজাকে। পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে চেয়ারটায়। মুখে চাপ-দাড়ি, পুরু ঠোঁটের ওপর ঘন গোফ, গায়ে জড়ানো চাদরের প্রান্ত ঝুলছে একপাশে। তার একটু দূরেই দাঁড়িয়ে সিগারেটে লম্বা টান দিচ্ছে জয়। তার নজর অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখল, ভিক্টিমের দেহের অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা বোরকা পরিহিত মেয়েটির দিকে বক্র দৃষ্টিকোণে চেয়ে আছে জয়। এই মেয়েটিই তখন ধাক্কা দিয়েছিল তাকে! পরিবেশ আর সকলের কাছে নারকীয়, অথচ দুই ভাই নির্লিপ্ত! তবে এ থেকে এটা প্রমাণ করার উপায় নেই, এরা অপরাধে যুক্ত!
জিপে উঠে বসল মুস্তাকিন। নজর পড়ল আবারও মেয়েটির ওপর। বিমূঢ় মূর্তির ন্যায় চেয়ে আছে
লা শের দিকে। লা শ কে ফ্রিজিং গাড়িতে তোলার ব্যবস্থা চলছে, মর্গ থেকে লোক এসেছে। অথচ
লা শটিকে ল্যাবে নেয়ার কথা।
চলবে…