অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৭.

0
99

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭.

“শীত ভালোই পড়ে গেল, হবু মেয়র সাহেব! কী বলেন!ʼʼ

মুস্তাকিনের স্বঘোষিত কথায় হামজা হাসল, “মেয়র সম্বোধন করে কি অপমান করতে চাইছেন, নাকি আগাম শুভেচ্ছাবার্তা জানাচ্ছেন, আসলেই বুঝতে চাপ পাচ্ছি!ʼʼ

মুস্তাকিন হাসল, “হাসিমুখে যখন বলেছি, শুভেচ্ছাবার্তাই ধরে নিন। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার সাঁটার কাজ শুরু হয়ে গেছে। শুভকামনা আপনার জন্য!ʼʼ

হাত মেলালো দুজনে। হামজা হাতটা ছাড়িয়ে বুকে রাখল হাসিমুখে। এরপর জয়কে কাধ আগলে নিজের পাশে কাধে কাধ মিলিয়ে দাঁড় করিয়ে বলল, “জয়কে আমার সাথেই নিয়ে ঘুরছি, অফিসার! জয় আমার হবেই, ইনশা-আল্লাহ। আমার এই পুচকো যদ্দিন আমার আছে, আমি আছি।ʼʼ

এরপর তিনজনেই একটু সিরিয়াস হলো। মুস্তাকিন বিনা কাজে শুভেচ্ছা জানাতে তো আর মাঝপথে বয়ে আসেনি! মুস্তাকিন শুরু করল, “হামজা সাহেব, দেখুন! লোকের মুখে যা রটে, তাই নাকি ঘটে। যদিও এসব কথার কথা। তবুও, লোকের এত জোরালো সন্দেহ কেন আপনাদের ওপর? এ ব্যাপারে আগেও কথা হয়েছে, তবুও বারবার আসলে বিষয়টা এসে এখানেই ঠেকে যাচ্ছে।ʼʼ

হামজা সোজা হয়ে দাঁড়াল, “দেখুন অফিসার! আপনি কতটা ঠিক বলছেন, বা একটু বাড়িয়ে জানি না। লোকের কতটা সন্দেহ আমাদের ওপর, তা আসলে মেপে দেখার সময় পাইনি ইলেকশনের ঝামেলায়। তবে ততটাও হবে না জানি, যতটা বোঝাতে চেষ্টা করছেন আপনি। লোক টুকটাক ভালোই বাসে আমাকে। রাজনৈতিক দলে যেহেতু আছি। প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নই! মৃলত, যে জমিজমা সংক্রান্ত ব্যপার ওই পরিবারে ঘটেছিল, তার বিচার আমি আর জয় করেছিলাম। সর্বশেষে সময় দিয়েছিলাম কিছুদিন। মানুষ জমি সমস্যায় পড়ে বিক্রি করতেই পারে, ওরা আবার তা ফেরত নিতে চেয়েছিল, কিন্তু সময় পার হয়ে গেছিল, তবুও আমি আরও কিছুদিন সময় দিয়েছিলাম। এর মানে এটা কীভাবে হয় যে একটা ছোট্ট পনেরো বছর বয়সী মেয়ে, যে হয়ত আমার বোনের সমান! তাকে এমন নৃশংসভাবে..ʼʼ মাথা নাড়ল হামজা, “যুক্তিতে মেলে আসলে?ʼʼ

মুস্তাকিন নিজেও মাথা দোলালো, সে বুঝেছে এমনভাবে। হামজা আবার বলল, “কিন্তু এখন একটা বড়ো কাজে হাত লাগিয়েছি, লোকের চোখে এমনিই পড়ে গেছি। যেমন বিপক্ষ দলগুলোর চোখে, তেমন সাধারণ মানুষ একটা ছুঁতো পেলে ছাড়ছে না। বোঝেন তো, রাজনৈতিক নেতাদের সাধারণ মানুষ কোনোকালেই ভালো চোখে দেখেনি। কারণ তাদের চাহিদা অপূর্ণ রয়ে যায় বহু।ʼʼ

মুস্তাকিন রোদ চশমাটা চোখে আটলো। দারুণ সুদর্শন একজন পুরুষের খেতাব পাওয়ার মতো সবই আছে তার মাঝে। যদিও তিনজনেই নিজস্ব বিশেষত্বে বিশেষায়িত! শীতের দুপুর হলেও রোদের ঝাঁজটা এসে চোখে হানা দিচ্ছে। হামজা যে কথার মাথ-প্যাচে দারুণ দক্ষ, এবং সুবিন্যস্ত কথার কৌশল, তা এড়িয়ে যাবার মতো নয়। আর হবেই না বা কেন? এমনি এমনি নয়, এতো কম সময়ে এত জনপ্রিয়তা এবং পরিচিতি নিয়ে রাজনীতি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! মুস্তাকিন প্রশ্ন করল, “আপনি বিপক্ষ দল বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন, সেই বিষয়টা ক্লিয়ার করুন। এখানে আপনাদের এভাবে বেশিক্ষণ ধরে রাখা ঠিক হবে না, সাথে আমার নিজেরই গা জ্বলছে। দ্রুত কথা সেরে নিই।ʼʼ

হামজা বলল, “আমার চাচাশশুর। মানে সাবেক মেয়র সাহেব। এবার তাকে হারিয়েই আমাকে জিততে হবে। সে কোনোকালেই আমাকে ভালো চোখে দেখেনি, দেখছে না।ʼʼ

মুস্তাকিন প্রশ্ন করল, “তা কীসের ভিত্তিতে বলছেন?ʼʼ

হামজা হাসল, “সেদিন জয়কে ডেকেছিলেন তিনি নিজেই। এরপর হঠাৎ-ই জয়ের গাড়ির সামনে বিপদজনকভাবে একটা বোঝাই ট্রাক চলে এসে মেরে দিতে দিতে বাঁচিয়ে চলে গেছে। এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব? এসব আমাদের সাথে হতেই থাকে, তবে এটা কাকতালীয় ছিল না, অফিসার!ʼʼ

-“আপনাদের গন্তব্য এখন কোথায়?ʼʼ

-“মেয়র সাহেবের সাথেই দেখা করতে যাচ্ছি।ʼʼ

মুস্তাকিন হাসল, “সেদিনের ঘটতে যাওয়া এক্সিডেন্টের দায় মেয়র সাহেবকে দিয়েছেন নাকি? সেই হিসেব চুকাতে যাচ্ছেন?ʼʼ

হামজা হেসে ফেলল নিঃশব্দে। তার তলোয়ারের মতো রাজকীয় অভিজাত গোফের সরু প্রান্ত পাক খেয়ে গেল হাসির দমকে। মুস্তাকিন আবার বলল, “আচ্ছা, পরে-টরে একবার কার্যালয়ে আসুন। এখানে এই রোদে গা পুড়িয়ে কথা জমছে না। অনেক তথ্যের প্রয়োজন। মানছি এখন ব্যস্ত আপনারা, তবে তবুও একটু আসুন সময় করে। চলি!ʼʼ

হাত মিলিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় জয়কে বলল মুস্তাকিন, “গিয়ে আবার মেয়র সাহেবকে খুন-টুন করে আসবেন না যেন!ʼʼ

জয় নিজস্ব ভঙ্গিমায় ঠোঁট একপেশে হাসি হাসল, “আমাদের আগে আপনিই দেখছি সিওর, সেদিনের কাজটা মেয়র করেছে!ʼʼ

মুস্তাকিন আর কিছু বলল না। চলে গেল বিপরীত দিকে গাড়ি ভাগিয়ে।

খাঁড়া দুপুর। বাংলায় অগ্রহায়ন মাস পড়ে গেছে। ঠান্ডা-গরমের কাটাকাটি চলছে। জয় গাড়ি থেকে নামল পরে, হামজা বেরিয়ে গেছে ফোন কানে ধরে। সামনে দোতলা বাড়ি। কবীর জয়কে জিজ্ঞেস করল, “আমি কি যাব ভেতরে?ʼʼ

জয় ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকালো, “আমার বিয়ের বরযাত্রী হয়ে এসেছ, শালা! আমার সাথে গিয়ে আস্ত মুরগীর প্লেটের সামনে বসবি তাড়াহুড়ো করে?ʼʼ

হামজা ফোনে কথা সেড়ে এসে দাঁড়াল। জয় খ্যাকখ্যাক করে উঠল, “তোমার ফোন না ঘণ্টা? বালডা সারাদিন খালি বাজতেই থাকে!ʼʼ

হামজা গম্ভীর মুখে তাকাল। জয় তা উপেক্ষা করে ভেতরের দিকে এগিয়ে যায়। এ বাড়িতে আলাদা বৈঠকখানা নেই, তা জানে দুজনেই। জয়ের চাচাশশুরের বাড়ি ছাড়াও মেয়রের বাড়িতে দুই ঘাঘুর যাতায়াত আগে-পরেই আছে। বসার রুমে বসেই রাজনৈতিক আলোচনা সারেন মেয়র কামরুজ্জামান ঝন্টু। এখন আর ওনার সাথে ওনার সহকারী নেই। ওরা এসেছেই ভর দুপুরে, অসময়ে। এ বাড়ির বাজার করার লোকটা এসে ভেতরে নিয়ে গিয়ে ওদের বসার ঘরের সোফায় বসাল। লোকটা বোধহয় হিন্দু। ওদের বলল, “বসুন আপনেরা। বাবু আসতেছে।ʼʼ

জয় আস্তে করে মুখ বিকৃত করল, “যা পারেনা তা মারাতে হবে কেন? ভদ্র ভাষা ব্যবহার করছে দেখো!ʼʼ

হামজা শক্ত মুখে তাকিয়ে বলল, “তোর খাপছাড়া মুখে লাগাম দে, জয়। নয়ত একটা থাপ্পড় মারব, দুটো দাঁত পড়ে যাবে সামনের পাটি থেকে।ʼʼ

জয় ক্রূর হাসল, “ব্যাপার না। তবে তাতে তোমার হাজারখানেক ভোট কমবে এবার।ʼʼ

হামজা ডানদিক অল্প ঝুঁকলো, নিচু স্বরে বলল, “তুই একাই হাজার ভোট মারবি?ʼʼ

জয় চুইংগাম চিবোতে চিবোতে বলল, “আমার বাচ্চারা মারবে। এখন আবার জিজ্ঞেস করোনা, এতো ছোটো বয়সে এতোগুলা কেমনে জন্মাইছি। আসলে সবই ক্যাপাসিটির ব্যাপার!ʼʼ

হামজা সরু চোখে তাকাল, “বড়ো ভাই আমি তোর!ʼʼ

জয় অবাক হলো, “আঃ! জানতামই না! আগে বলেননি কেন, ভাইজান! আপনি আমার ভাই, অথচ পরিচয়ই ছিলনা! এই সুখ আমি সইব কেমনে?ʼʼ

ঝন্টু সাহেব নিচে নামলেন। এ বাড়ির সিঁড়ি একপেশে ধরণের। একদম কিনারে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠে গেছে। তার বসার রুমে দুটো লম্বা-চওড়া যুবক বসে আছে। পরনে দুটোরই সাদা পাঞ্জাবী, হাতের কালো ঘড়ি দেখা যাচ্ছে এ পাশ থেকে, চুলের কাটিং অভিজাত। গম্ভীর নেতাগিরির ভঙ্গিমায় বসে আছে দুজন। একই চলন যেন কপি হয়েছে দুটোর মাঝে। তবে একটার মুখ গম্ভীর, অপরটার মুখে গাম্ভীর্যের সাথে মিশে আছে শয়তানী এক ছিদ্রক হাসি। অচঞ্চল চোখের চাহনি হামজার। জয়কে যারা চেনে তারা সকলেই জানে, জয়ের দৃষ্টি খুব চঞ্চল। কখনও কোথাও এক বিন্দুতে আটকে থাকেনা একস্থানে। পাখির মতো তাকিতুকি চলতে থাকে চাহনিতে। তিনি এসে সোফায় বসার পর হামজা সালাম দিলো, চাচা শশুর মানুষ। জয় তাও দিলো না, তাকালও না। সে ফোনে খুব ব্যস্ত। এরকম অশিষ্টতা এরা করতে পারে, না করলেই বরং অস্বাভাবিক। মেয়র সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “কী খাবে তোমরা?ʼʼ

জয় ফোন থেকে চোখ না তুলে বলল, “চা-পানি খাওয়ার হলে দুপুরে আসতাম না, মেয়র কাকা। দুপুরের ভোজে কী কী আছে সেটা বলুন।ʼʼ

মেয়র সাহেব হাসলেন, “খারাপ নেই, পছন্দ হবে তোমাদের। খেলে তো ভালোই, এরকম আন্তরিকভাবে খেতে কয়জন চায়!ʼʼ

জয় বলল, “আলোচনার ক্লাইম্যাক্স ভালো হলে খেয়েই যাব। এখন চা-কফি মার্কা সস্তা খাবার রাখুন।ʼʼ

মেয়র বললেন, “হু, শুরু করো।ʼʼ

কোনোরকম শিরোনাম ছাড়াই শুরু করল জয়, “আপনি বসে যান। আমাদের পরিবার থেকে কেউ মেয়র পদপ্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছে এবার, জানেন তো।ʼʼ

মেয়র হেসে ফেললেন, “কেন, ভয় পাচ্ছ নাকি? যে আমি বিরোধী দলে থাকলে তোমাদের পরিবারে ভোট পড়বে না!ʼʼ

হামজা মাথা নিচু করে বসে শুনছিল আলাপ। এবার মাথা তুলে হাসল, “ভয়? উহু, ভয় নয়। আমার ছেলেরা আপনার সাথে হাঙ্গামা করবে, কাকা। আমি সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছি, তাই আপনি বসে গেলে ঝামেলা থেকে বেঁচে গেলেন। প্রোফিট আপনার, এডভাইস আমার।ʼʼ

মেয়র বললেন, “রাজনীতিতে এতোগুলো বছর কাটিয়েছি, হাঙ্গামার সাথে পরিচিত না হয়েই? বেশিদিন বরং ঝামেলা না হলেই খুব মিস করি ঝয়-ঝামেলাকে। তো এভাবে কি সব প্রার্থীকে হাঙ্গামা থেকে রক্ষা করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুরোধ করে আসবে? তোমার মতো এমন শুভাকাঙ্ক্ষী বিরোধী কয়জনের কপালে জুটেছে রাজনৈতিক জীবনে?ʼʼ

-“অনুরোধ করছি?ʼʼ হাসল হামজা, “কাকা! আমি শুধু ছাত্রলীগ করে যে জনতা আর ফেম জুটিয়েছি, আপনি পাঁচ বছর মেয়র থেকে কেন, আরও দশ বছর সময় নিলেও তার একাংশ নিজের করতে পারবেন না।ʼʼ

উপহাসের সুরে বললেন মেয়র, “আচ্ছা! ক্ষমতাধারী হয়ে গেছ তাহলে! তো সেই হিসেবে এখন তুমি ক্ষমতার জোরে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচন করতে চাও?ʼʼ

-“উহু! তাহলে সেই জিতকে জেতা বলা চলবে নাকি? আমি শুধু আপনাকে বসতে বলছি।ʼʼ

-“তুমি বললে আমি বসে গেলাম। ভয় পেয়েছি খুব তোমাকে, জামাই আব্বা!ʼʼ নাটকীয়তার সুরে বললেন মেয়র।

স্বাভাবিক স্বরে জবাব দিলো হামজা, “কিন্তু আমি তো আপনাকে ভয় পেয়ে বসতে বলিনি। ভালোভাবে বুঝেশুনে বসে পড়ুন। বুঝলে আপনি আপনা থেকেই বসে যাবেন অবশ্য!ʼʼ

-“কী বুঝব আমি?ʼʼ

-“কত কিছুই তো রয়ে গেছে বোঝার!ʼʼ

মেয়র সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, “এমন কী বোঝার রয়েছে, যার জন্য নির্দিষ্ট করে শুধু আমাকেই বসে যেতে হবে? এবং সেটা তোমার বলাতে! আমাকে দূর্বল আর নিজেকে বেশি পাওয়ারফুল ভেবো না। ঝড় কিন্তু আগে পাওয়ার হাউজকেই ড্যামেজ করে, বাপ!ʼʼ হাসলেন মেয়র সাহেব কথাটা বলে।

হামজা হাসিমুখে বলল, “আপনি বসে না গেলে বিশাল তামাশা খাঁড়া হবে, কাকা! যেটা এমনিতেও আপনার নির্বাচন ডাউন করবে।ʼʼ

মেয়র সাহেব প্রত্যুত্তর করলেন, “তামাশা আমরা না করতে শিখেই রাজনীতিতে আটাশ বছর কাটাইনি, এটা ভুলে যাচ্ছ কেন, পাগল ছেলে! তুমি তো সেদিনের ছেলে! যাহোক, বলো কেন বসতে হবে আমাকে?ʼʼ

-“আমি চাইছি, তাই! এটুকুই যথেষ্ট। আপনি আমার প্রতিপক্ষ বলে বলছি— এমনটা ভাবাটা কেমন উদ্ভট হয়ে যাবে না? নির্বাচন কেমন হওয়া চাই জানেন! হাজার কয়েক প্রার্থীর ভিড়ে আমি জিতে বসে থাকব, এমন। ইনফেক্ট, আমি আপনাকে আর নির্বাচন করতে দেব না, ব্যাস! এজন্য আপনি বসে যাবেন। এর চেয়ে বড়ো কারণ দরকার নেই আর।ʼʼ

স্বাভাবিক ভাবে জানতে চাইলেন মেয়র সাহেব, “না চাওয়ার কারণ?ʼʼ

হামজা চুপচাপ কিছুক্ষণ মেঝের দিকে চেয়ে থেকে ঠোঁট কামড়াল। এরপর বলল, “এই যেমন সেদিন আপনি জয়কে ডাকলেন কথা বলার জন্য। এরপর নিজেই আবার বোঝাই করা ট্রাক পাঠালেন জয়ের গাড়ি পিষতে। এতে উদ্দেশ্যটা কী? আপনি ডেকে আপনিই কেন জয়কে মারবেন? এই প্রশ্ন উঠবে মার্ডারের পেছনে! আপনি সন্দেহের তালিকা থেকে মুক্ত হবেন, জয় টপকে যাবে। চ্যাহ! হাজার বছর পুরোনো টেকনিক। এজন্য আমি বলি, রাজনীতি তরুণ জনতাদের জন্য। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের এসব মারপ্যাচের জগৎ থেকে অবসর নেয়া উচিত। এরকম মুর্খ খেলায় মজতে আমি লজ্জা পেয়েছি, জানেন! আমার প্রতিপক্ষ এতো কাঁচা হলে কী করে চলবে?ʼʼ

মেয়র সাহেব শুধু চেয়ে রইলেন হামজার দিকে সূচাল চোখে। হামজা জিজ্ঞেস করল, “কেন মারতে চেয়েছেন জয়কে?ʼʼ

মেয়র সাহেব চাপা স্বরে বললেন, “জয় নিঃসন্দেহে ছাত্রনেতা হিসেবে খুব দায়িত্বশীল ভাইস প্রেসিডেন্ট। অথচ তলে তলে কুকীর্তির অভাব রাখে না সে। তা তো আর অজানা না আমার! তবুও কোনোদিন তোমার গিট্টু খুলতে যাইনি সোসাইটিতে, বাচ্চা মানুষ তুমি। দাপট করে বেড়াচ্ছ, বেড়াও। একাই ঝরে যাবে দিন গেলে। কিন্তু এবার জয় কী করল! একটা মেয়েকে খেয়েদেয়ে ভোগে পাঠিয়ে দিয়েছে! তা করেছে, তাতেও দোষ দিচ্ছি না, পুরুষ মানুষ করতেই পারে। কিন্তু আমার ডাক পড়ল দু’দিন পিবিআই ডিপার্টমেন্টে। বাড়িতে তল্লাশি চলল উল্টে-পাল্টে।ʼʼ এপর্যায়ে মেয়র সাহেব বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন, “আমার রেপুটেশন খেতে উঠেপড়ে লেগেছ দুই ভাই। আমি তোমাদের জান হজম না করে ছেড়ে দিই কী করে? এখন আবার এসেছ হুমকি দিয়ে লাঠি কেঁড়ে নিতে! বাচ্চাদের খেলাঘরের মতো বিবেচনাবোধ তোমার। তোমার নিজেকে কাঁচা খেলোয়ার মনে হয় না, হামজা?ʼʼ

আজও ঝন্টু সাহেবের যে চিন্তাধারা এবং শীতল দাপুটে আচরণ, তাতে হামজা খুব মজা পায় বরাবরই এই লোকের বিরুদ্ধে পলিটিক্যাল ট্রিক্স চালিয়ে। মনের মতো বিরোধী মনে হয় এনাকে। হামজা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। পরে বলল, “জয় এসব করেছে, তা কোন ভিত্তিতে বলছেন আপনি?ʼʼ

মেয়র পান খাওয়া লালচে দাঁত বের করে ক্যাটক্যাটে হেসে উঠলেন “আবার ভিত্তি খুঁজছে, ছেলে! দেখো কাণ্ড!ʼʼ

হামজা জানালো, “জয় এসব করেনি।ʼʼ

-“তা নাহয় প্রসাশন জানে, আমি তুমি তো জানি জয় করেছে।ʼʼ

হামজা জোর দিয়ে বলল এবার, “প্রসাশন যা জানে, আপনার আমারও তা-ই জানার। কারণ, সত্যিটা তা-ই। দুনিয়ার সব অপরাধ তো আর জয় একা করতে পারে না! ওরও তো একটা ক্লান্তি আছে অপরাধ করে! কালুও করতে পারে কাজটা! রাজনের লোকেরা করতে পারে! দিনাজপুরে যে একটা শীর্ষসন্ত্রাস ত্রাসের সাম্রাজ্য গড়ে তাতে বাদশাহী করছে, তা ভুলে যাচ্ছেন আপনি, কাকা!ʼʼ

মেয়র সাহেব চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ হামজার দিকে। শান্ত শীতল, ধূর্ত নেতাকর্মী হামজা। কোনো কিছুতে বিচলিত হবার প্রবণতা দেখা যায়না তার চেহারায়। মেয়র সাহেব বললেন, “রাজন নাও করতে পারে। তুমিও করতে পারো! ব্যাটাছেলে মানুষ বলে কথা! তুমি ভিত্তি খুঁজছিলে না! ভিত্তি দেই তোমাকে। ধরো, যে ঘটনাটা ঘটেছে মেয়েটার সাথে, তা তোমরা করেছ কোনো কারণে, আর এখন তার দায় আমার ওপর চাপিয়ে আমাকে বদনাম করে ডাউন করতে চাইছ। দুটো নিশানা, একটা তীর! হতে পারে না কি এরকম? আমাকে বসিয়ে মেয়র হবে পাটোয়ারী পরিবারের কেউ। এটাই তো বলতে এসেছ। যখন দেখলে নির্বাচন খুব কাছে এসে গেছে, প্রতীক বের হয়ে গেছে। আমাকে জেলে পুরা হলো না, তীর লাগল না আমার গায়ে, তোমরা তিন বাপ-ব্যাটাই জন্মের ফাঁসা ফেঁসে গেছ, আর বাড়ি চলে এসেছে বাড়ির ছেলে দুটো!ʼʼ কথা শেষ করে সোফায় গা এলিয়ে বসলেন ঝন্টু সাহেব।

হামজা ডানে-বাঁয়ে ঘাঁড় ঘুরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, “বেশি বুঝছেন আপনি, কাকা! জয় কিছুই করেনি। আর না এরকম সস্তা কাজ করার কোনো প্রয়োজন আছে আমার। আপনি নিজেও জানেন, আমি যা কামিয়েছে এই লাইনে, এবার চাইলে সংসদ নির্বাচন করলে সংসদের একটা সিট আমার ঘাঁড়ে পড়ে যেত নির্ভেজাল ভাবে। তবে এতো তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে কলা খাওয়ার নয় আমার। মোরঅভার, এবার নির্বাচন করছেন না আপনি, সোজা কথা। ধরে নিন এটা আপনার পাওনা শাস্তি অথবা আমার জোর, হতে পারে সেই জোরের জেরে শুধুই আমার ইচ্ছে। আপনার শাস্তি এই যে, প্রতীক বের হবার পরে আপনি নিজে গিয়ে নির্বাচন অফিসে নিজের নামটা কেটে আসবেন লাল কালিতে। ভোট কেন্দ্রে আপনার নাম এবং প্রতীকের কোনোরকম ব্যালট পেপার থাকবে না। আপনি যা করেছেন তা তো ভারী পড়বেই আপনার ওপর।ʼʼ

নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে হেসে জবাব দিলেন মেয়র, “ও তুমি চিন্তা কোরো না, বাপ! আমি ভার বয়ে নেব।ʼʼ

জয় এতক্ষণে হেসে ফেলল, “একটু বেশিই ভার, কাকা! আপনার শক্তিতে নাও কুলাতে পারে! এই বয়সে ঘাঁড় বেঁকে গেলে মুশকিল, মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গুড়ো হবার চান্সও আছে।ʼʼ

মেয়র সাহেব শুধালেন, “তাই নাকি?ʼʼ

জয় ফোনটা হাতের মধ্যেই ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, “আপনার ইট-বালুর বিশাল ব্যবসা আছে না? কার নামে যেন চলে! আপনার বউ থুক্কু চাচির নামে, নাকি মেয়ে! ঝিরি এন্টারপ্রাইজ। ঝিরি কার নাম, কাকা?ʼʼ

মেয়র সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। জয় ফোনের স্ক্রিনটা ঘুরিয়ে ধরল। সেখানে দেখা যাচ্ছে– লণ্ডভণ্ড অবস্থায় সন্ধ্যার আকাশের নিচে গাড়ির ফ্রন্ট গ্লাস ভেদ করে খুব কাঁপাকাঁপির সাথে তোলা এক ভিডিও। কয়েক সেকেন্ড পর তার এঙ্গেল চলে গেল
গাড়ির ভেতর থেকে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে পেছন দিকের দৃশ্যকে শ্যুট করা কোনো ভিডিও ফুটেজ। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে ট্রাকটা এতক্ষণে এইগাড়ির সামনে ছিল, তা গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে এখন পেছনে চলে গেছে। ট্রাকের পেছনে বেশ বড়ো করে রঙ দিয়ে লেখা ‘ঝিরি এন্টারপ্রাইজʼ।

ভিডিওটা তৈরী হয়ে গেছিল জয়ের ফোনের ব্যাক ক্যামেরাতে, সেদিন যখন সে কবীরের ভেটকানো ছবি তুলতে ক্যামেরা অন করেছিল। ঝন্টু সাহেবের মুখভঙ্গিমা দেখে বোঝা গেল না, তিনি কী করবেন! খুব খাঁটি রাজনীতিবিদ, বহুবছরের চলাচল এই পথে তার।

দুজনে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। পাশেরটাই হামজার শশুরবাড়ি। জয় খোঁচা মারল, “যাও শশুর বাড়ি, মধুর হাড়ি ভেঙে পেট ফুলিয়ে এসো। মানে আমি আবার গেলে প্রেগনেন্ট হয়ে পেট ফুলবে, তা বলছি না। গিলবে, গিলে পেট ফুলাবে। তোমাদেরই তো দিন, আমরা বাল সিঙ্গেল মানুষ। না আছে বউ, না শশুরবাড়ি!ʼʼ

হামজা কনুই দিয়ে গলা আকড়ে ধরল জয়ের। রাস্তার মাঝেই দুজনের কুস্তি বেধে গেল এক চোট। কবীর একটু দূরে দাঁড়িয়ে খালি হাসে। জয় একসময় নিজেকে ছাড়িয়ে হাঁপায়, “তোমার ওই পাণ্ডবের মতো হাত দিয়ে আমার গলা চাপলে, রুহু ব্যথায় না হোক, বিরক্তিতেই বেরিয়ে আসবে। এই গায়ে ডিও-মিও কিছু মারো না? ছেহ! কী গন্ধ! ভাবী কাছে আসে তো?ʼʼ

হামজা আবার তেড়ে গেল রাস্তার ওপরেই। জয় ঝেরে দৌড়, সাথে গালাগাল দিচ্ছে। একটু দূরে গিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে হাঁটুতে হাত রেখে দম ফেলে বলল, তুমি থানায় না কোথায় যাবে যাও, আমাকে এখন আর পাবে না। কবীর চলে আয়, আমরা আজ পিকনিক করব। রাতে ব্যাডমিন্টন ম্যাচ আছে আমার।ʼʼ

হামজা খিচতে খিচতে গিয়ে গাড়িতে উঠল, “উলাম্বারে, বেওড়া কোথাকার! বখাটেপনা ছাড়, কাজকামে হাত লাগা! রাজার ভাণ্ডার বসে খেলে গুড়িয়ে যায়!ʼʼ

জয় খেঁকিয়ে উঠল, “যাও তো! আলগা জ্ঞান দিতে আসবে না। কানে ব্যথা হয় আমার।ʼʼ


সকাল সাতটার বাস। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে সাতটা বাজল অন্তূদের। মিনিট কয়েকের মাঝে বাস ছাড়বে। আমজাদ সাহেব বাসে উঠে রাবেয়া এবং অন্তূর সিট খুঁজে ওদের বসিয়ে দিয়ে পাশের দোকান থেকে একটা পানির বোতল কিনতে নামলেন। পানির বোতল তুলতে ভুলে গেছেন রাবেয়া। অন্তূ আর রাবেয়া পাশাপাশি সিটে বসেছেন। আমজাদ সাহেবের সিটটা আলাদা। কিন্তু দেখা গেল সেখানে এক সিটে একটি মহিলার জায়গা। অন্তূ উঠে দাঁড়াল, “আব্বু, তুমি আম্মার পাশে বসো। আমি ওই আন্টির কাছে বসছি।ʼʼ

আমজাদ সাহেব একটু ভাবলেন, পরে গিয়ে বসলেন রাবেয়ার পাশে। অন্তূকে বললেন, অসুবিধা হলে ডাকতে।
অন্তিক আমজাদ সাহেবের ছেলে আইনতভাবে, তবে বহু আগেই খারিজ হয়ে গিয়েছে বোধহয় মন থেকে। যেদিন বিয়ে করে আনলো, আমজাদ সাহেবের সম্মান মাঠে মাঠে হয়েছিল। অন্তিক বললে আমজাদ সাহেব ঘটা করে বউ বানিয়ে আনতেন মার্জিয়াকে। কিন্তু অন্তিক জানতো, মার্জিয়ার পারিবারিক পরিবেশ খুব নিচু এবং নোংরা। সে বাবাকে বলার সাহস পায়নি, নিজেই বিয়ে করে নিয়ে চলে এসেছিল। তবুও সবাই মেনে নিয়েছিল, কেউ অন্তিককে কোনো কটুক্তি করেনি, ঝামেলা বাধেনি এ নিয়ে। পাড়ার লোকে ইচ্ছেমতো মাস্টারমশাইয়ের নামে খিস্তি ঝেরেছে। আমজাদ সাহেব তথাপি ছেলেকে কিছু বলেননি। অথচ মার্জিয়ার স্বভাব এবং আচরণ দিনকেদিন মাস্টারমশাইয়ের বাড়িটাকে বস্তিঘরে পরিণত করেছে। অবাক করা বিষয় হলো, অন্তিক তাতে কোনো প্রতিবাদ করে না কোনোকালে। বিয়ের আগের হাস্যজ্জল অন্তিক এক লহমায় বদলে কাপুরুষ বনে গেল কবে জানি। দূরত্ব বেড়েছে তার বোনের সাথে, বাবার সাথে। রাবেয়া মা, তিনি মানিয়ে চলতে চেষ্টা করেন। তবে অন্তূর রুচিতে বাধে, আমজাদ সাহেব মনের দুঃখে কথা বলতে যান না। আজও রাবেয়া বেগম ডেকেছিলেন অন্তিককে শালিসে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য। অন্তিক বলল, “মার্জিয়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।ʼʼ

অন্তূ টেনে হিচরে নিয়ে চলে এসেছে রাবেয়াকে। ঘেন্নায় এক বুক পাথর হয়ে এসেছে অন্তিকের কথায়। জোয়ান চাচাতো ভাইয়েরা এসে নিজেদের বাপের পাশে দাঁড়াবে, আমজাদ সাহেবের সেই কপাল নেই। ছেলে বলছে, বউকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। বাপ যাচ্ছে জমি-জমার শালিসে। কী থেকে কী হবে জানা নেই। অন্তূর একটা বড়ো ভাই আছে, এ কথা স্বীকার করতেও বাঁধে তার আজকাল। অন্তূকে নিতে চাইছিলেন না আমজাদ সাহেব। মেয়ে মানুষ শালিসে গিয়ে অত লোকের মাঝে দাঁড়াবে, লোকে ভালো চোখে দেখবে না ব্যাপারটা। অন্তূ দৃঢ় গলায় বলেছে, “আব্বু, আমি কোনোদিন যেন তোমার দূর্বলতা না হয়ে উঠি! আর তার কারণ যদি শুধু হয়–আমি মেয়ে। তবে আমার মেয়ে হওয়ার প্রতি আজ ধিক্কার। আমি যাব তোমার সঙ্গে। আর কিছু না হোক, তোমার সন্তান হিসেবে তোমার পাশে গিয়ে তোমার অবলম্বন হিসেবে দাঁড়ানো আমার কর্তব্য। আর তোমার কাছে আমি এমন চিন্তা-ধারা আশা করিনা–সমাজ কী বলবে? সমাজকে এড়িয়ে, পায়ে পিষে, আগে পা বাড়াতে তোমার কাছেই শিখেছি। তুমিই বলো– সমাজের মুখ আছে বলবে, খারাপও বলবে, ভালো খুব কমই বলবে। এই সমাজকে তোয়াক্কা করা মূর্খতা এবং আত্মনির্ভরশীলতাহীন কাজ। এই সমাজ প্রতিবাদী চেতনাধারীদের নিকট চিরদিন পদদলিত। সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে যারা কিছু করে মরেছে, তারাই কেবল অমর হয়ে রয়ে গেছে যুগে যুগে।ʼʼ

আমজাদ সাহেব স্নেহভরে তাকালেন মেয়ের দিকে। বাসের সিটের সাথে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আছে। নেকাবের আড়ালে মুখটা দেখা যাচ্ছে না। অথচ চোখদুটো বুজে থাকার পরেও হালকা কুঁচকে আছে। তিনি গম্ভীর স্বভাবে মানুষ, সামনে ভালোবাসা দেখাতে অক্ষম, তাই হয়ত অন্তূ কোনোদিন বুঝতে পারবে না–বাবার কলিজার এক টুকরো মাংসপিণ্ডের নাম অন্তূ। আজ মার্জিয়ার চাচার বাড়ির লোক অন্তূকে দেখতে আসার কথা ছিল। আমজাদ সাহেব মানা করে দিয়েছেন। মার্জিয়া গড়গড় করতে করতে রুমে ঢুকে গেছে, আর কথা বলেনি।

কুড়িগ্রাম পৌঁছাতে প্রায় বেলা খাঁড়া হলো।
গ্রামের রাস্তাঘাট পেরিয়ে হেঁটে আসার সময় অন্তূর খুব ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছিল। আব্বুর হাত ধরে অন্তিক আর সে আসতো দাদুর বাড়িতে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আব্বুকে পাশ কাটিয়ে ওর চুলের ঝুটিতে টান মেরে আবার অপরপাশে হাঁটা শুরু করতো। অন্তূ চিৎকার করলে অন্তিক আব্বুকে বলতো, “এই প্যাপুকে কোথা থেকে তুলে এনেছ আব্বু? খালি সারাদিন ম্যা ম্যা করে। কিছু হয়েছে ওর, কোনো সমস্যাই নেই, তবুও ক্যা ক্যা করে উঠছে। যেখান থেকে এনেছিলে, সেখানেই ফেলে দিয়ে আসবে। আমার এসব প্যাপু লাগবেনা। শুধু শুধু ভাগ বসাতে এসেছে।ʼʼ

অন্তূ আরও জোরে চেঁচাতে থাকলে অন্তিক হেসে লুটোলুটি খেতো রাস্তার মাঝে। বুকটা বিষিয়ে ওঠে অন্তূর। সেসব দিন ফুরিয়েছে, কিন্ত ফুরোনোটা কি খুব জরুরী ছিল? সম্পর্কে যখন এতো মায়া, তবে সেই সম্পর্কের সমীকরণের মান ধ্রুব নয় কেন, জীবনের মোড়ে মোড়ে বদলে কেন যায়? আজ অন্তূ একা একপাশে আব্বুর কাধে কাধ মিলিয়ে হাঁটছে, অপর পাশে অন্তিকের থাকার কথা ছিল। নেই! সেই রাস্তা আছে, আব্বু আছে, অন্তূ আছে, অন্তিক কেন বদলেছে? কবে বদলেছে? যেদিন আব্বু দুটো থাপ্পড় মেরেছিল মার্জিয়াকে ওভাবে ভাগিয়ে নিয়ে আসায়, সেদিন বদলেছে? অন্তূ বলেছিল, “ভাই, তুই মার্জিয়ার চেয়ে উন্নত মানসিকতার মেয়ে ডিভার্জ করিস।ʼʼ

এই কথায় বদলেছে? বুকে জমা প্রেম-ভালোবাসায় টান লেগেছিল নিশ্চয়ই! কিন্তু কতদিনের ভালোবাসা? বছর দুয়েক, আচ্ছা তিন বছর? অন্তূর সাথে না সম্পর্ক বিশ বছরের! আব্বুর সাথে তারও বেশি! সম্পর্ক এবং ভালোবাসায় বোধহয় সময় কোনো প্রভাব রাখেনা। ভালোবাসা একদিনেও প্রগাঢ় হয়, এক হাজার বছরেরটার চেয়েও। সেটাই হবে হয়ত! তবেই তো অন্তিক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে পরিবার থেকে। সে সব বোঝে, মুখ খোলেনা। অন্তূ বোঝেনা, অন্তিক এতো বদলে কেন গেল? হুট করেই বলা চলে। রাতারাতি কোটিপতি হবার মতো করে বদলে গেছে ছেলেটা!

অন্তূ অবাক হলো। সে তো এতো আবেগী নয়, কেউ তাকে ত্যাগ করার সুযোগ পায়, তার বহু আগে সে নিজেকে ততটা গুটিয়ে নিতে পারে, যতটায় সামনের মানুষটা ত্যাগের আকাঙ্ক্ষা ভুলে বসবে। আজ কেন ভাইয়ের জন্য মন কেমন করছে, সেই ভাই, যে অমানুষ, বিবেচনাবোধহীন পশু হয়ে উঠেছে!

অন্তূর মেজো ফুপুর বাড়ি দাদা বাড়ির পাশে। এই ফুপুকে দাদাভাই নাকি বেশি ভালোবাসতেন। এজন্য নিজের ভাতিজার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কাছেই রেখেছিলেন। তার বাড়িতেই দুপুরে খাবার খেল তিনজন। বোনকে ডাকলেন আমজাদ সাহেব, “মাজেদা! তোর কী মনে হয়, ওই জায়গা আমার প্রাপ্য না? এটা আসলেই কোনো যুক্তি–যে আমি এখানে থাকিনা বলে জায়গা পাব না? জায়গা পরিস্কার না হলে ক্রেতা জায়গা কিনবে না, ঋণে ভরে আছি। লোকজন দুবেলা বাড়ি বয়ে আসছে। মেজো ভাই এতো মূর্খ আর স্বার্থপর হলো কবে?ʼʼ

মাজেদা দুঃখ প্রকাশ করলেন, “ছিল নাই বা কবে? আমি আর কী কইতাম, ভাই! আমার মেয়েডারে খোজার সাথে বিয়ে দিছে, পুকুরটায় মাছ চাষ করে খায়, আমার কোনো অধিকার নাই সেইখানে। আমি নিজে মরতেছি এই দুঃখে, তোরে আর কী কই!মেজো ভাইয়ের ধর্ম-ঈমান নাই!ʼʼ

অন্তূ শুনল। কিছু বলল না। তার মাথায় আব্বুর শুকনো, অস্থির মুখখানা চক্রাকারে আবর্তন করছে।

শালিস বসল আছরের নামাজের পর। সেখানে আফজাল সাহেব পুঁথি তুলে আনলেন সেই মোঘল আমলের। কবে আমজাদ এখান থেকে চলে গিয়েছিল, আর আসেনি, তার জমি চাষবাস করে সে ঠিকঠাক রেখেছে, দিনাজপুরে জমি পেয়েছে, সেখানে থাকছে, আবার এখানে ভাগ নিতে আসবে কেন?

অন্তূ বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারল না এসব যুক্তিহীন কথা শুনে। আমজাদ সাহেব চুপ করানোর চেষ্টা করলেন মেয়েকে। অন্তূ রুখে দাঁড়াল। মাতব্বর মশাইকে বলল, “চাচাজান! আমার দুটো কথা আছে। এখন এটা বলবেন না, আমি ছোটো মানুষ, মেয়ে মানুষ। বড়ো এবং পুরুষ যখন সস্তা আলাপ জুড়েছে এখানে, তখন ছোটো এবং মেয়েলোককে তো দাঁড়াতেই হবে সঠিক কথা বলতে! তাই নয় কি?ʼʼ

এরপর আর কেউ অবশ্য কিছু বললেন না। অথচ বিরূপ দৃষ্টি আটকে রইল কিছু কিছু ভাইরাস টাইপের মানুষগুলোর। অন্তূ চাচাকে বলল, “আপনি খুব যুক্তিসঙ্গত কথা বলেছেন, কাকা! আব্বু এখানে থাকেনা সুতরাং এখানকার জায়গা তার প্রাপ্য নয়। সেই সূত্রানুসারে, আপনি দিনাজপুর থাকেন না। ওখানে আপনার যে পুকুর হিসেবে জায়গা পড়ে আছে, ওটা আপনার পাওনা নয়। উত্তম বিচার। এক কাজ করুন, আগামীকাল কোর্টে চলুন, আপনার ওই জায়গা আব্বুর নামে, এবং আব্বুর এই জায়গা আপনার নামে রেজিস্টার করার দুটো দলিলে দুজন সই করবেন। এবং তা স্বয়ং আমি তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে করাবো। কোনো গড়মিল হবেনা, আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। তো ওই কথাই রইল, কাকা! কাল কোর্টে আসুন!ʼʼ

আর সকলে একদম থ মেরে গেল। ক্ষেপে উঠে দাঁড়ালেন আফজাল সাহেব, “চড়ায়া দাঁত ফালায়া দিমু, বেয়াদ্দপ মেয়েলোক! তোর মতোন কুলাঙ্গার মাইয়া জন্ম দিয়া আবার এই পাড়ায় জমি নিতে আইছে তোর বাপ! একঘরে করতো এই সমাজ তো মতো মাইয়ারে এই পাড়ায়!ʼʼ

অন্তূ হেসে ফেলল, “জি জি! কেন নয়! এই পাড়ার এই সুবিচারের ভয়েই তো এই পাড়ায় আসিনা জীবনে! অতি উত্তম বিচার হয় এই এলাকাতে। আর এমন সুসমাজে আমার মতো মেয়ে থাকলে প্রতিক্ষণে রক্ত ফুটবে, তামাশা হবে। এজন্যই দূরে আছি, লেখাপড়া করছি, ভালোই চলছে। তো আজ আব্বুর বাপের ওয়ারিস সূত্রে পাওনা জায়গা বিনা নোটিশে আপনার হয়ে গেছে! এত চমৎকার বিচার যে এলাকায় হয়, সে এলাকার পা রাখার যোগ্যতা আমার নেই। সেই যোগ্যতা অর্জন করতে অনেক নিচে নামতে হবে, কাকা! অত নিচে আমি নামতে পারব না। এই বিচার দেখতে আসব এই পাড়ায়, সাহস আছে নাকি আমার!ʼʼ

অন্তূর তাচ্ছিল্যের অপমান বোধহয় এবার মাতব্বরের গায়েসহ সকলের গায়ে ছিটে লাগল। সকলৈ চোখ ফেঁড়ে তাকিয়ে আছে। অন্তূর মুখে নেকাবের আড়ালে শুধু গাঢ় চোখদুটো স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, সেই চোখে প্রতিবাদ, সেই চোখের তারায় তারায় সাম্যবাদ! সকলের বলার মতো কথা খুব বাজেভাবে ফুরিয়ে গেল। শেষমেষ তবুও আফজাল সাহেব অনেক রকমের বাহানা করলেন, এটা-ওটা তুলে নিজের কীর্তন গাইতে লাগলেন। কিন্তু কাটিয়ে দিলো অন্তূ। এক পর্যায়ে এক বুড়ো মাতব্বর গোষ্ঠির লোক আমজাদ সাহেবকে বললেন, “ও আমজাদ মাইয়ারে উকিল বানাইলেও তো পারো গো! মাইয়া তো সোন্দর, ভালা কতা কইতে পারে দেখতিছি। মাইয়াডারে পড়াইও, বহুদূর যাইব হে।ʼʼ

আমজাদ সাহেব হাসলেন, “দোয়া করবেন, চাচা। সেই আশাই আছে।ʼʼ

শেষ অবধি অন্তূর যুক্তির সামনে এবং যেহেতু আমজাদ সাহেবের ন্যায্য ওয়ারিসসূত্রে বাপের সম্পত্তি প্রাপ্য জায়গা। কিছু করার নেই এখানে জালভাবে। টাকা খেয়েই এসেছেন মাতব্বর আফজাল সাহেবের। কিন্তু জনগণের সম্মুখে নিখিল বিচার না করে উপায় রইল না। শেষ অবধি মুখে মুখে একটা ফয়সালা এলো, আফজাল সাহেবের গোয়ালের যে অংশ আমজাদ সাহেবের জায়গায় চড়ে গিয়েছে, সেটুকু ভেঙে জায়গা বের করে দিতে হবে। এবং যেহেতু গোয়াল ইট-পাথরে গড়াও নয় ওই অংশ! সুতরাং যথাসম্ভব জলদি ভেঙে ঝামেলা মিটিয়ে দিতে হবে, যাতে আমজাদ সাহেব দ্রুত বিক্রি অথবা যা খুশি করতে পারেন।

অন্তূ কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হতে পারল না। কারণ, মুখের এই কথা ঘুরে যেতে চোখের পলকও ঠিকমতো ফেলতে হবেনা। কোনো ডকুমেন্ট- স্ট্যাম্প পেপার ছাড়া এই কথাগুলো কত আনা সুষ্ঠুভাবে মানবে তার কাক, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেল। এ নিয়ে এখানে এসে আবার বিবাদে জড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। আমজাদ সাহেবকে বলল অন্তূ ভাবনাটা। তিনি নিজেও সহমত পোষন করলেন। তবে ভুল এক কথায় তারাই করেছেন। যেহেতু এসেছেন চূড়ান্ত একটা ফয়সালা করতে, একটা শত টাকার স্ট্যাম্প পেপার তুলে আনার কথা ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি।

সন্ধ্যা মাথায় নিয়ে বাসে উঠল তিনজনে। দিনাজপুর পৌঁছাতে জ্যাম-ট্যাম পেরিয়ে রাত দশটা, বড়োজোর এগারোটা বাজবে।

চলবে..

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। মন্তব্য করবেন সকলে। এত বিস্তৃত উপন্যাসে আমার ভালোবাসার পাঠকদের বড় বড় মন্তব্য না পেলে খুব মন খারাপ হয় আমার..☹️❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here