রাত্রীপ্রিয়া #পর্বঃ১৩ লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

0
316

#রাত্রীপ্রিয়া

#পর্বঃ১৩

লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

গত হলো দু’টো দিন। বিয়ে,বউভাত অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ করে চৌধুরী পরিবার ফিরলো নিজ কুটিরে। তাদের সঙ্গে আনোয়ার সাহেব ও ঢাকায় এসেছেন। মেয়ের বাড়িতে এক রাত থেকেছেন। আরো দু’টো দিন থাকবে বলে নিয়ত করছিলেন। সকালে সবার সঙ্গে এক সাথে নাস্তা করে, উনি বসার ঘরের কেবল বসেছেন। আজকের পত্রিকার পাতা উলোট-পালোট করছিলেন। এমন সময় অফিস থেকে সেক্রেটারির ফোন কল। সেক্রেটারি জানালো,

“স্যার জরুরী মিটিং। আপনাকে এক্ষুণি অফিসে আসতে হবে। মিটিং এ থাকা আবশ্যক।”

“আসছি।” বলে কল কাটলো উনি। কল পেয়েই যাওয়ার জন্য তৈরী লোকটা। কাজ পাগল লোক কি-না! নিজের দায়িত্বকে কখনো অবহেলা করে না।

কেবলই সানাম চৌধুরী ও রাত্রীপ্রিয়া একই সঙ্গে দোতলা থেকে নেমেছে। সানাম চৌধুরী ফর্মাল ড্রেসআপে, এক্ষুণি নিজের অফিসে যাবে। অনেক কাজ জমা হয়েছে হাতে। তাকে এগিয়ে দিতে এসেছে রাত্রীপ্রিয়া। এরিমধ্যে বসার ঘরে বাবা’কে অফিসিয়াল ড্রেসআপে দেখা গেলো। রাত্রীপ্রিয়া বাবা’র নিকটে গেলো, পিছনে পিছনে সানাম চৌধুরী। রাত্রী বাবা’কে জিজ্ঞেস করলো,

“বাবা? কোথাও যাবে তুমি?”

“অফিসে যেতে হবে, আম্মা। জরুরী মিটিং।”

যা শুনে রাত্রীপ্রিয়ার মন খারাপ হলো। সে মুখ ফুলিয়ে বললো,

“আজই চলে যাবে, বাবা? আজ না গেলে হয় না? আর একটা দিন থাকো।”

“খুব আর্জেন্ট। আবার আসবো, আম্মা।”

“যাবেই তাহলে। আচ্ছা বাবা, তুমি আরেকটু বোসো আমার সামনে। তোমায় একটু মন ভরে দেখি, আবার কবে না কবে দেখা হয় আমাদের।”

আনোয়ার সাহেব আলতো হাসলেন। মেয়ের এহেন মায়াবী আবদার কি ফেলা যায়? যায় না, বাবারা মেয়ের আবদার অগ্রাহ্য করতে পারে না। যদিও আনোয়ার সাহেবের হাতে একদমই সময় নেই। তবুও উনি বিনাবাক্যে বসলেন, সোফায়। মৃদু কণ্ঠে বললেন,

“পা’গ’লী মেয়ে আমার। আয় কাছে আয়। বোস আমার পাশে।”

রাত্রীপ্রিয়া ততক্ষণাৎ বাবা’র গা ঘেঁসে বসলো। নিশ্বাস বন্ধ করে, বাবা’র গায়ের অদৃশ্য এক বাবা-বাবা মিষ্টি গন্ধ নাকে নিলো। বাবা স্নেহময়ী হাত রাখলো মেয়ের মাথায়। বাবা-মেয়ের ভালোবাসা, মায়াবী এক বন্ধন প্রতিফলিত হলো সারা রুম জুড়ে।
কি সুন্দর দৃশ্য! খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সে-সব চুপচাপ লক্ষ্য করছে, সানাম চৌধুরী। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনোয়ার সাহেব বললো,

“আব্বা তুমি দূরে দাঁড়িয়ে, কেনো? এসো, বসো আমার কাছে।”

সানাম চৌধুরী একবার আলগোছে হাত ঘড়িতে সময় লক্ষ্য করে, বসলো। হাতে একটু সময় আছে তার। সেইটুকু সময় আজ না-হয় শ্বশুরকে দেওয়া যাক। বাবা-মেয়ের কথার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথা বলছে, সানাম চৌধুরী। এরিমধ্যে বাড়ির বড়রা একে একে উপস্থিত হলো, এখানে। তারা একসাথে বসে প্রয়োজনীয় কথা বলছে। তাদের মাঝখানে রাত্রীপ্রিয়া বাবা’কে জিজ্ঞেস করলো,

“বাবা চা খাবে? চা করে দেই তোমায়। চা খেয়ে যাও এক কাপ।”

“আচ্ছা দেও।”

পাশ থেকে সালাম চৌধুরী বললো, আমার জন্যও এক কাপ করিস মা।”

যা শুনে রায়হান চৌধুরী ফোঁড়ন কে’টে বললো, আমি তাহলে বাদ যাবো কেন? আমি কি গাঙের জলে ভাইসা আইছি!আমার জন্যও এক নিয়ে আসিস, মা।”

উনার কথায় উপস্থিত হাসলো সবাই। রাত্রীপ্রিয়া হেসে বললো,

“আচ্ছা বাবা, আমি সবার জন্য চা নিয়ে আসছি।তোমরা বসো, আমি আসছি।”

এরা টুকটাক কথা বলছে, সবার সমস্ত ব্যস্ততা ভুলে একসাথে আড্ডায় মেতছে সকলে। এদের আড্ডার মাঝেখানে চা নিয়ে ফিরে এলো, রাত্রীপ্রিয়া।
নিজেই একে একে সবার হাতেও তুলে দিলো, চা। পরম তৃপ্তি সহকারে মেয়ের হাতে চা খেয়ে বাবা বললো,

“আজকের চা-টা দারুণ হয়েছে! আহ্, স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো!”

পাশ থেকে ততক্ষণাৎ সানাম চৌধুরী গর্ব করে বললো,

“শ্বশুর মশাই, দেখতে হবে না এটা কার বউ! সানাম চৌধুরীর একমাত্র অর্ধাঙ্গিনীর হাতে করা, চা। টেষ্ট তো হবেই!”

এর কথায় পুনরায় হাসলো সবাই। পরমুহূর্তে আনোয়ার সাহেব সালাম চৌধুরী’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

“ভাইজান এখন উঠি, তাহলে।”

“আচ্ছা। সাবধানে যেও।”

“হ্যাঁ তা-তো যাবোই। তার আগে আপনারা কথা দিন, আমার বাসায় বেড়াতে যাবেন কবে? আমার ঘরে এখন আপনার বোন জীবিত নেই, তাই বলে কি আর ওদিকে যাওয়া যাবে না? আপনারা এখন আমার নতুন আত্মিয়। সেই হিসেবে হলেও তো আসা-যাওয়া করবেন।”

“আরেহ্, ভাইজান তেমনটা নয়। আসলে সেভাবে কারোই সময় হয় না। তবুও, এবার একবার সময় করেই যাবো আমরা। রাত্রী-পরশের পরিক্ষাটা শেষ হলেই যাবো।”

বললো, তানিয়া চৌধুরী। আনোয়ার সাহেব এদের কথায় সম্মতি দিয়ে বললো,

“তাহলে এই কথাই রইলো।”

পরমুহূর্তে উনি সনাম চৌধুরীকে বললো,

“এই যে আব্বাজান। আমার মেয়েটাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে আমার বাড়ি থেকে ঘুরে এসো। তোমাদের অনেকজন থাকলেও, তোমরা ছাড়া আমার কেউ নেই। আমি বুড়ো মানুষ, সারাক্ষণ তোমাদের অপেক্ষায় থাকি। এই বুঝি তোমরা আসলে, আমার শূন্য ঘরের শূন্যতা কাটিয়ে হাসিতে ভরে উঠলো। কিন্তু সেসব কিচ্ছুটিই হচ্ছে না।
ভয় নেই, আব্বা। তোমার শ্বাশুড়ি নেই, তাই বলে শ্বশুর বাড়িতে তোমার কোনো অযত্ন হবে না। আমি যতদিন আছি, ততোদিনে তোমাদের ভালো রাখবো।”

বলতে বলতে বাবা’র চোখ, জলে চিকচিক করে উঠলো। সানাম চৌধুরী বড়ই লজ্জা পেলো। সত্যিই, বিয়ের পর নানাবিধ ব্যস্ততায় সেভাবে যাওয়া হয়নি শ্বশুর বাড়িতে। ততক্ষণাৎ উনি বিনয়ী ভঙ্গিতে শ্বশুর’কে বললো,

“আরেহ্, বাবা! ব্যাপারটা এমন নয়। নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে সময় হয়ে উঠেনি। প্লিজ, বাবা! আপনি কিছু মনে করবেন না। এরপর সময় পেলেই যাবো, দেখে আসবো আপনাকে। আপনারও যখনই মনে পড়বে আমাদের, যখন-তখন চলে আসবেন।”

আনোয়ার সাহেব আর জবাব দিলো না। কথাও বাড়ালেন না, এই বিষয়ে। উনি উঠে দাঁড়ালো। তার সাথে সাথে গেইটের কাছে আসলো সকলে।
আনোয়ার সাহেব, আরেকবার একে একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে, ভেজা চোখে বেরিয়ে পড়লো নিজ গন্তব্যে। নিজের চোখের জল আড়াল করতে, এরপর আর পিছনে তাকায়নি বাবা। তাকালেই দেখা যেতো, ছলছলে একজোড়া চোখ তার যাওয়ার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে।
_________________

দুপুর বারোটা। হসপিটালের করিডরে বিষন্ন মনে একা-একা দাঁড়িয়ে আছে, পরশ। নিজেকে বড় অসহায় লাগছে, এলোমেলো লাগছে। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা!
দুর্বল হাতটায় তার চেকআপের রিপোর্ট। এতোদিন যে ভয়টাই পেয়েছিলো সে, সেটাই হলো।
তার প্রেগনেন্সির রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। তিন মাসের একটি ভ্রু’ণ বেড়ে উঠছে তার গর্ভে। এটা তাদের, তার ভালোবাসার উৎস। কিন্তু, বিপরীত মানুষটা যে বদলে গেলো। সমাজের কাছে সে অসহায়, অবিবাহিত এক কন্যা। অবিবাহিতা মেয়ের বাচ্চা, বড়ই লজ্জা জনক ব্যাপার।
কি করবে এখন, পরশ? কি করে বাঁচাবে এই বাচ্চাটাকে? আদৌও কি বাঁচবে এই প্রাণটা? না-কি তার জায়গা হবে কোনো এক ডাস্টবিনে? না আর ভাবা গেলো না। মাথা চিনচিন করছে, বড্ড য’ন্ত্র’ণা হচ্ছে মাথায়।
পরমুহূর্তেই, মাথায় হাত চেপে ধপাস করে মেজেতে বসে পড়লো, পরশ। তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অজস্র লোনাজল। মনের সাথে নিরব-নিস্তব্ধতার এক যু’দ্ধে পরাজয় হয়ে, হঠাৎ করেই চিৎকার দিয়ে উঠলো মেয়েটা। পরাজয় এক সৈনিকের ন্যায় বললো,

“ইয়া, রব!
ভালোবাসা এতো তিক্ত কেনো, এতো বি’ষা’ক্ত কেনো? শুরুটা যেমন মধুর হয়, শেষটা কেনো সেভাবে থাকে না? এভাবে, সেভাবে কেনো ভালোবাসা হেরে যায়, প্রেমিকের কাছে?”

চলবে……

[পাঠক মহল! পর্বের ভিতর যে গ্যাপ দিয়েছি, এরপর আর স্যরি বলার মুখ নেই আমার। শুধু বলবো, এতো দেরী আর কখনো হবে না। সবাই রেসপন্স করবেন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here