#দমকা_প্রেমের_গল্প
#Ayrah_Rahman
#পর্ব_০২
_________________
ভার্সিটির চত্ত্বরে আজ সাজ সাজ কলরব দেখে ভ্রু জোড়া কুঁ*চকালো অরিত্রা! তার মতে আজ তো কোন ফেস্টিভ্যাল থাকার কথা না তাহলে! আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে সামনের দিকে খানিকটা এগিয়ে গেলো। প্রাপ্তি কেও কোথাও দেখতে পেলো না সে। ক্লাস শেষে সেই যে মেয়েটা বের হলো আর দেখা নেই! বিরক্তি তে ভ্রু কুঁচকালো সে।
হাঁটতে হাঁটতে মাঠের এক সাইডে পুরনো বট গাছের দিকে নজর গেলো তার, বেশ অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে ওখানটায়, তাই সে আর ওদিকটায় পা বাড়ালো না, পা বাড়ালো লাইব্রেরিতে যাওয়ার জন্য।
মাঘ মাসের মাঝামাঝি হলেও শীতটা অনেকাংশেই কমে গেছে তবে শীতল বাতাসের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। অরিত্রা লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে এদিক ওদিক তাকালো, শীত মৌসুমে লাইব্রেরি টায় তার অদ্ভুত শান্তি লাগে, কিছু কিছু ছেলেমেয়েরা গায়ে চাদর জরিয়ে চোখে আঁটসাঁট করে চশমা আটিয়ে উপন্যাস কিংবা কবিতার বইয়ে মুখ গুঁজে রাখে, দেখতে ভালো ই লাগে অরিত্রার।
সময়ের স্বল্পতা হলেও বইয়ের প্রতি আলাদা এক ঝোঁক কাজ করে সবসময়ই তার মাঝে! অরিত্রা হাঁটতে হাঁটতে বুক শেলফ গুলোতে থাকা বই গুলো ঘুরে ঘুরে দেখছে, প্রায় কয়েক হাজার বই আছে এই ভার্সিটির লাইব্রেরিতে।
ঘুরতে ঘুরতে কক্ষের শেষ প্রান্তের বুক শেলফ এর কাছে গিয়ে দাড়ালো সে। আচমকাই তার নজরে এলো বেগুনি রঙের মলাটে আবৃত একটা মোটা বইয়ের দিকে। বোঝাই যাচ্ছে বইটা কেউ আলাদা মলাট লাগিয়ে দিয়েছে কৌতুহল বশত পা উঁচু করে বইটা নামিয়ে আনলো সে। হাত দিয়ে ধুলোর স্তুপ পরিষ্কার করে কভার পৃষ্ঠা উল্টালো,
বইটা রবিঠাকুরের ” গল্প গুচ্ছ “। কিন্তু বইটাতে আলাদা মলাট লাগানোর কারণ টা খুঁজে পেলো না।
বইটার পৃষ্ঠা উলট পালট করে যেইনা তাকের উপর রাখতে যাবে হঠাৎ বইয়ের লাস্ট পেইজ থেকে কিছু একটা নিচে পড়ে গেলো।
অরিত্রা ভ্রু কুঁচকে নিচে তাকালো, কালো রঙের একটা কাগজ নজরে আসতেই ভ্রু জোড়া আরোও কুঁচকে গেলো তার।
বইটা তাকের উপর রেখে খানিকটা ঝুঁকে কাগজটা তুলল, অদ্ভুত ভাবে কাগজ টা কালো আর তার মধ্যে সাদা রঙের কালী দিয়ে কিছু লিখা।
অরিত্রা পাশেই চেয়ার টেনে বসে পড়লো। দেখে মনে হচ্ছে একটা চিঠি, এই অত্যাধুনিক যুগেও কেউ চিঠি লিখে! তাও এমন অদ্ভুত কালো রঙের কাগজে! ভাবতেই হাসি পেলো অরিত্রার ।
_________________
প্রিয় ……,
তোমাকে কি বলে যে সম্বোধন করব বুঝতে পারছি না। তাই প্রিয় শব্দটার পর জায়গাটা খালি রাখলাম। তুমি তোমার ইচ্ছে মত কিছু একটা বসিয়ে নিয়ো।
যাই হোক, ভালো আছো? জানো, আমার চিঠিটা পাওয়ার পর তুমি চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ছ গভীর আগ্রহে। সেই দৃশ্যটা ভেবে আমি চিঠিটা লিখছি। কিন্তু তোমার মুখটা স্পষ্ট না। তাই বুঝতে পারছি না, এই চিঠি পেয়ে তোমার অনুভুতি কেমন। তবে তোমার অনুভূতি দেখার খুব শখ।
আচ্ছা আমাদের কি দেখা হবেনা? আর দেখা হবেই বা কেমন করে বল? তুমিও আমার শহর চেনোনা আর আমিও তোমার শহর চিনি না। এইটা কোন কথা? তাই বলে কি আমাদের দেখা হবে না? হবে হবে।
যদি বলো এই নেটওয়ার্কের যুগে চিঠি লিখার সার্থকতা কোথায়? আমি বলব ওই যে চিঠি টার প্রতিটি লাইন পড়ার সময় তোমার ঠোঁটের কোনে যে মিষ্টি হাসি টা দেখা যায় সেটাই আমার সার্থকতা!
তুমি তো আমার কাছে একটা চকলেট পাওনা রইলে, আবার জিজ্ঞেস করো না কেন? আমি বলব না। যেদিন দেখা হবে সেদিনই চকলেট দিবো। ভেবো না যে ফাঁকি দিবো। চকলেটের সাথে আরো কিছু দিবো। অপেক্ষায় থেকো ততদিনের।
চিঠির অপেক্ষাতে রইলাম। কখনো যদি ইচ্ছে হয় ফিরতি চিঠি লিখো।
ইতি তোমার অচেনা
শ্যামপুরুষ (০৩-০৫-২০২২)
__________________
অরিত্রা থমকালো! বুকের মাঝে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ ঠিক ই টের পেলো সে। আসলেই তো এই ফেসবুকের যুগে আদৌও কেউ চিঠি লিখে নাকি! তবুও আবার তারিখ উল্লেখ করা। আজ থেকে বছর দুয়েক আগের! চিঠি টা তার হাতে না পড়ে একটা ছেলের হাতেও তো পড়তে পারতো! আনমনে ই আবারো হাসলো, কি ব্যাপার হাসির রোগে ধরলো না কি!
অরিত্রা কিছু একটা ভেবে ব্যাগ থেকে খাতা কলম বের করে কলম টা দুই ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরে ভাবতে লাগলো সে লিখবে টা কি! কিছু একটা ভেবেই লেখা শুরু করলো। সাদা কাগজে কালো রঙের কালি দিয়ে বেশ কিছু শব্দ লিখে আনমনে ই হাসলো আবারো।
লেখা শেষ করে কাগজটা চার ভাজ করে পুনরায় গল্প গুচ্ছ বইটার শেষ পাতার ভাজে স্ব যত্নে রেখে দিলো আর কালো রঙের কাগজের চিঠি টায় এক পলক তাকিয়ে ব্যাগে ভরতে ভরতে উঠে দাঁড়ালো, আচ্ছা সে কি বোকামি করলো নাকি বাচ্চামি? এমন ম্যাচিউর মেয়ের এমন বেনামি চিঠি দেওয়ার কোন মানে হয়! চিঠি কেন লিখলো কিংবা এই অজ্ঞাত চিঠি ই বা কেন নিলো জানা নেই তার তবে ভালো লাগলো!
বইটা পুনরায় আগের জায়গায় রেখে বেরিয়ে এলো লাইব্রেরি থেকে আজ আর উপন্যাস পড়া হলো না!
লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে আশেপাশে এক পলক প্রাপ্তির সন্ধান করে হাত ঘড়িতে এক পলক সময় দেখে নিলো, বেলা তখন আড়াইটা গড়িয়ে তিনটার পথে চলছে। অরিত্রা পা চালালো, তিনটায় একটা টিউশনি আছে, ক্লাস ফাইভে পড়ে ছাত্রী, ভীষণ মেধাবী আর লক্ষি মেয়ে হলেও মেয়ের মা অতটা সুবিধা জনক না, মহিলা পারলে শুক্রবার ও পড়াতো কিন্তু আফসোস পারে না! মাঝে মাঝে অরিত্রার বিরক্ত লাগে। তিনটার টিউশনি শেষ করে আরোও দুটো আছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাত’টা। সব মিলিয়ে মাসে হাজার সাতেক টাকা হয়ে যায়। নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে সংসারে টুকটাক জিনিস আনা যায়!
এসব কথা চিন্তা করতে করতে ই ভার্সিটির গেইট পার হতেই চোখের সামনে অনেক মানুষের ভীড় ভেসে উঠলো। বেশ শোরগোল শোনা যাচ্ছে হয়তো মারামারি হচ্ছে! অরিত্রার যদিও এসব মারামারিতে ইন্টারেস্ট নেই তবুও মানুষের মন তো! কৌতুহলে ভরপুর!
কৌতুহল বশত এগিয়ে গেলো সামনে, ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। সামনে একটা ছেলের র*ক্তা*ক্ত দেহ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে তার সামনেই মুনতাসিম মাহমুদ হাত ঝাড়তে ঝাড়তে রাগে ফোপাচ্ছে। ঘামে ভিজে সামনে থাকা চুল গুলো কপালে সেঁটে আছে। হাত থেকে টপটপ করে র*ক্ত ঝড়ছে! মাটিতে পড়ে থাকা ছেলেটা ব্যথায় কাতরাচ্ছে কিন্তু আশ্চর্য কেউ তাকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে না।
মুনতাসিম আরেকটা লা*থি দেওয়ার জন্য সামনে এগুতেই পিছন থেকে কেউ ওর হাতে টান দিতেই পা দুটো থেমে যায় তার। রাগী দৃষ্টি তে পিছনে ফিরতেই অপরিচিত একটা মুখ সামনে ভেসে উঠলো। একটা মেয়ে তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েটার চোখে মুখে ক্রোধ, রাগে লাল হয়ে আছে। কিন্তু রাগ করার মতো কিছু কি সে করেছে! এই মুখটা কোথাও গিয়ে মুনতাসিমের পরিচিত মনে হচ্ছে, কিন্তু কার সাথে মিল সেটাই বুঝার চেষ্টা করছে।
” এই আপনি কি মানুষ! একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে এভাবে কুকুরের মতো মারছেন! দয়া মায়া নেই! রাস্তা ঘাটে মারামারি আর গুন্ডামী করলেই ক্ষমতাবান হওয়া যায় না। আগে ভালো মানুষ হন তারপর না হয় ক্ষমতা দেখাবেন। ভালো ছাত্র হলেই জীবনের সব কিছু পাওয়া হয় না তাতে মানুষের দোয়া লাগে, এসব মারামারি করে কখনো বদদোয়া ছাড়া আর কিছু কপালে জুটবে না”
মুনতাসিম ভ্রু কুঁচকালো। এই মেয়ে কোথা থেকে টপকালো সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে। দেখতে যেমন মিষ্টি কথা গুলো তেমনি নিমপাতার মতো তেঁতো। ঠান্ডা মাথায় বোমা ফাটানোর অসীম ক্ষমতায় নিয়ে জন্মানো এই মেয়ে।
পিছন থেকে গোটা কয়েকজন ছেলে আসতে নিলেই মুনতাসিম হাত দিয়ে ইশারা করতেই থেমে যায় ওরা।
” সাব্বির এই মাল টাকে হসপিটালে এডমিট করার ব্যবস্থা কর, উইথ প্রোপার ট্রিটমেন্ট”
আশেপাশে এক পলক তাকিয়ে পুনরায় পূর্ণ দৃষ্টি তে অরিত্রার দিকে তাকালো সে।
” তো কি যেন বলছিলে? মানুষ নই আমি? ডো ইউ নোও দ্যাট, আই এম ইউর সিনিয়র? ”
অরিত্রা স্বাভাবিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মুনতাসিমের দিকে,
” হুম ”
মুনতাসিম শার্টের হাত পুনরায় ফোল্ড করতে করতে আড় চোখে তাকিয়ে বলল,
” বয়স কত? ”
অরিত্রা চমকে তাকালো, এই মূহুর্তে এমন উদ্ভট প্রশ্ন সে একদম ই আশা করে নি।
” জি?”
মুনতাসীম দাঁতে দাঁত চাপলো,
” হাউ ওল্ড আর ইউ, গর্ধব? বাংলা বোঝো না? ”
” এমন ভরা রাস্তায় একটা মেয়ে কে তার বয়স জিজ্ঞেস করা কোন ধরনের ভদ্রতা সিনিয়র ভাইয়া? ”
মুনতাসিম ভ্রু উঁচু করে শাহাদাত আঙুল দিয়ে ভ্রু চুলকাতে চুলকাতে বাঁকা হেসে বলল,
” ওহ আই সিই! ভদ্রতা শেখাচ্ছেন আমাকে? তাহলে আমিও বলতে পারি এমন ভরা রাস্তায় সিনিয়র একটা ছেলেকে পুরো ঘটনা না জেনে জাজ করা কোন ধরনের ভদ্রতা! মিস ভদ্রতা! ”
অরিত্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সামনে থাকা অপরিচিত ছেলেটার দিকে তাকালো, কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি তার!
” আপনার সাথে ঝগড়া করার কোন মুড ই আমার নেই, আর রাস্তা ঘাটে গু*ন্ডামী করা টা ছেড়ে দেন ”
কন্ঠ নালী শক্ত করে কথা টা বলেই পিছনে ফিরে ভীড়ের মাঝে ই অদৃশ্য হয়ে গেলো অরিত্রা, একবার পিছনে ফিরে তাকালো না সেই মানবী, তাকালে হয়তো দেখতে পেতো এক তাগড়া যুবকের অদ্ভুত দৃষ্টি!
চলবে…
[ গল্প টা আপনাদের কেমন লাগছে জানাবেন কিন্তু ]