প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২২] প্রভা আফরিন

0
333

প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২২]
প্রভা আফরিন

সারারাত না ঘুমিয়ে কাটানোর অভ্যাস মেহযাবীনের নেই। সর্বদা একটা অঘোষিত নিয়মের মাঝে বড়ো হয়েছে বলেই রাতের এগারোটা বাজতেই ওর দেহ বিছানার জন্য চনমন করে ওঠে। তবে মাঝে মাঝে শিল্পী সত্তাকে তুষ্ট করতে আরো বেশিক্ষণ জেগে থাকা হয়। বড়োজোর রাত একটা। এরপর আপনাতেই তার শরীর অবস হয়ে যায়। মন চাইলেও শরীর আর জাগতে পারে না। যাবীনের ভীষণ ইচ্ছে রাত জাগার। একটি তারকাখচিত আকাশের রঙ, রূপ দেখতে দেখতে জাগতিক সকল চিন্তা ভুলে যাওয়ার। ওর মনের মাঝে একটি কল্পলোক আছে। সেই কল্পলোকে বাস করে একটি কাল্পনিক পুরুষ। যাকে ও স্বপ্নে দেখে। ডাকে ‘প্রেমনগরের প্রণয়কুমার’ বলে। ওর কল্পনায় প্রেমনগরের প্রণয়কুমার একজন মারাত্মক প্রেমিক পুরুষ৷ বাস্তবে যার অপেক্ষা সে করে। ক্যানভাস রাঙিয়ে তোলে মনের রঙে। তাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটা রাত উৎসর্গ করা দোষের কিছু নয়। যাবীনের সেই রাত জাগার ইচ্ছেটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আজ পূরণ হয়ে গেল। তবে চিন্তাহীন তারকাখচিত আকাশের নিচে নয়, হসপিটালের ওয়েটিং রুমে। রাতে ভাইয়া-ভাবির রিসেপশন প্রোগ্রামের কার্ডের ডিজাইন শেষ করে বিছানায় গিয়েছে সবে, চোখটা লেগে আসবে আসবে ভাব, তখনই মায়ের ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠল সবাই। ছুটে গিয়ে দেখল বাবা ফ্লোরে পড়ে আছেন।

সুলতান শেখের শরীরটা আজ বিশেষ ভালো ছিল না। সুমা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলেন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। সুলতান শেখ আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন সারাদিন ব্যস্ত ছিলেন তাই ক্লান্ত লাগছে। বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু রাতে ঘুম ভেঙে বাথরুমে যাওয়ার পথে আকস্মিক জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েন। এর প্রতিক্রিয়ায় সদা শান্তশিষ্ট শেখ বাড়ি তার বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে উত্তেজিত হয়ে উঠল। জাওয়াদ পুরো পরিবার নিয়ে মাঝরাতে হাসপাতালে উপস্থিত হয়। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, দেহে ইনসুলিনের ঘাটতি ও উচ্চ রক্তচাপের ফলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সুলতান শেখ। উনার ডায়াবেটিস রোগ বহু পুরোনো। সর্বদা নিয়ম মেনেই চলাফেরা করেন। অসতর্কতা কিংবা অন্যমনস্কতার ফলেই এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা এড়াতে অবজারভেশনে রাখা হবে একদিন।

সুলতান শেখের মানসিক অবস্থা এখন কোন পর্যায়ে সেটা মা কিংবা বোন না জানলেও জাওয়াদ অবগত। তার অনুশোচনা হলো সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বাবাকে অবগত করায়। দুপুরের গোপনীয় ফোনকলের পর জাওয়াদ সবার আগে ছুটে গেছিল বাবার কাছে। যিনি ওর সৎপরামর্শদাতা৷ ডিলের কথা শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। জোর গলায় তা নাকচ করে বলেছিলেন,
“আমরা কোনো প্রমাণ রাখিনি। ওদের এইসব ফাঁকা আওয়াজে ঘাবড়ে গেলেই পেয়ে বসবে। তুমি জার্মানি যাও। ট্যুর সফল করে বিজয়ীর বেশে ফেরো। সেটাই হবে ওদের জন্য মোক্ষম জবাব।”

জাওয়াদ ঘাবড়াবে না বলেই স্থির করেছিল। কিন্তু বাড়ি ফিরে বোনের কাছে আকস্মিক ফুল আসাটা ওর অস্থিরতা বাড়িয়ে দিলো। বোধহয় বাবাও কিছু টের পেয়েছেন। পরিবার, অফিস সবটায় জাওয়াদের চেয়েও সুলতান শেখের ভালোবাসা ও যত্ন বেশি। শরীর বোধহয় সেই চিন্তার বেগ সামলাতে পারেনি। বাবার অসুস্থতায় জাওয়াদেরও একটি উপলব্ধি জাগল, সে ডিল করতে অসম্মত হয়ে জার্মানি গেলে তার পরিবারটি সম্পূর্ণ অনিরাপদ হয়ে যাবে। কে কোন দিক থেকে ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তার কোনো ঠিক নেই। আর যদি ডিলে সম্মত হয়েও যায় তবে সে নিজের কাছেই হেরে যাবে। শত্রুপক্ষের কাছেও তখন আরো বেশি করে জিম্মি হয়ে পড়বে। দুই দিক দিয়েই নিজের ক্ষতি। মানসিক টানাপোড়েনে জাওয়াদের মন সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। পাশে তাকিয়ে দেখল বোনটা মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ঝিমাচ্ছে। ও আস্তে করে বলল,
“তোমরা বাড়ি ফিরে যাও, আম্মু। আমি যাবতীয় চেক-আপ সম্পন্ন করে বাবাকে নিয়েই ফিরব।”

সুমা নাকচ করে বললেন, “তোমরা চলে যাও।নাশতা করে ঘুম দিয়ো। জরি ও তানিকে আমি ফোন করে সব কাজ গুছিয়ে রাখতে বলে দেব।”

জাওয়াদ কিছুতেই রাজি নয়। মা-ছেলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবার আগেই শাওন তার ভাইদের সঙ্গে হাসপাতালে এসে উপস্থিত হলো। সে এখন শেখ বাড়ির বউ। শ্বশুরের অসুস্থতা শুনে বাপের বাড়িতে বসে থাকাটা তার জন্য শোভা পায় না। তাই ভোর হতেই সবার জন্য রান্নাবান্না করে নিয়ে চলে এসেছে। বোনকে সঙ্গ দিতে কিংবা পরম আত্মীয়দের পাশে থাকতেই নিশান্ত ও অনন্তও সঙ্গে এসেছে। যাবীন আধো ঘুম আধো জাগরণে ঢুলুঢুলু করছিল। শাওনকে পেয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। স্ফিত চোখের রক্তাভ রং দেখে সহজেই অনুমেয় মেয়েটি ভীষণ কেঁদেছে।

সুলতান সকালে ঘুম ভেঙে এতজনকে দেখে দুর্বল কণ্ঠে বললেন, “তোমরা দেখি হসপিটালে গেট টুগেদার বসিয়ে দিয়েছো। আমার কিছু হয়নি। ডাক্তার একটু দেখাদেখি করে ছেড়ে দেবে।”

অনন্ত জবাব দিলো, “আমরাও একটু দেখাদেখি করতে এসেছি আঙ্কেল।”

মেহযাবীন বাবার শিয়রে বসে উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, “তোমার এখন কেমন লাগছে, বাবা?”

“ভালো। বেশ ভালো। তোমাদের চোখ-মুখের কী অবস্থা! ঘুমাওনি একটুও? যাও যাও, বাড়ি ফিরে ঘুম দাও। সবাই মিলে অসুস্থ হতে চাও নাকি!”

সুমা যাবীনকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তোমার আজ ভার্সিটিতে প্রেজেন্টেশন আছে না?”

“আছে, এটেন্ড করব না ভাবছি। টিমকে বুঝিয়ে দেব।”

সুলতান শেখ তা শুনে প্রতিবাদ করে বললেন, “কেন করবে না? অবশ্যই করবে। প্রেজেন্টেশন কখন?”

“এগারোটায়।”

“অনেক সময়। বাড়ি গিয়ে ঘণ্টা দুই ঘুমিয়ে ভার্সিটি চলে যেয়ো।”

যাবীন প্রতিবাদ করার ভাষা পেল না। বের হবার আগে জাওয়াদ অনন্তকে ডেকে বলল, “তুই ভার্সিটি যাবি তো?”
“যাব।”
“যাবীনকে নিয়ে যাস। ফেরার পথে সঙ্গে নিয়ে ফিরবি। দেখিস কেউ যেন বিরক্ত না করে।”

শেষ কথাটা বেশ জোর দিয়ে বলল সে। নিশান্ত ভ্রুকুটি করে সে কথা শুনে। অনন্ত বুক ফুলিয়ে বলল, “চিন্তা নট বড়ো ভাই। আমি থাকতে কেউ বিরক্ত করার সাহস তো দূরে থাক, কল্পনাও করবে না। নয়তো মেরে…”
নিশান্তের দিকে চেয়ে বাকি কথা টুপ করে গিলে ফেলল সে। ভাইকে সে পুরোদস্তুর এড়িয়ে চলছে দুদিন ধরে।

নিশান্ত জাওয়াদের কাঁধে হাত রেখে বলল, “সব ঠিক আছে?”

“ঠিক করতে চেষ্টা করছি, ভাই।” জাওয়াদ শুষ্ক হাসল।

“হেল্প লাগলে সংকোচ করিস না।”

“অবশ্যই।”

জাওয়াদ বাবার সঙ্গে হসপিটালে রয়ে গেল। তার সঙ্গে শাওনও রইলো। নিশান্ত নিজ গাড়িতে করে অনন্ত, যাবীন ও সুমাকে শেখ বাড়িতে নিয়ে গেল। গন্তব্যে পৌঁছে সুমা ও অনন্ত আগে নেমে গেলে যাবীন সিটে বসে রইল। নিশান্ত চোখ থেকে কালো চশমা খুলে ওর দিকে ফিরতেই যাবীন বলল,
“আমিনের ব্যাপারে কোনো আপডেট? ক্যাটারিং সার্ভিসে খোঁজ নিয়েছিলেন?”

নিশান্ত মাথা দুলিয়ে বলল, “নিয়েছি।”

“কিছু জানতে পারলেন?”

যাবীনের জানার আগ্রহকে অগ্রাহ্য করতে পারল না নিশান্ত। বলল,
“আমিন তার এক শেফ বন্ধুর সাহায্যে ঢুকেছিল। বন্ধুকে আটক করা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। তবে তাতে সুবিধা হবে না। আমিনের সব ডিটেইলস আমার কাছে আছে। শুধু কোথায় পালিয়েছে সেটুকু বাদে। ওর পাস্ট কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি।”

যাবীন কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল, “নেশার জগতে জড়ানোর আগে অবধি ও ভালোই ছিল জানেন। এরপর ভার্সিটির বাজে ছেলেদের পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়ে গেল৷ আর এখন তো ক্রিমিনাল। অথচ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল পড়াশোনা করতে। মানুষের জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল।”

নিশান্ত চুপ করে শুনল। মেয়েটির নেতিয়ে পড়া পুষ্প পল্লবের মতো ক্লান্তিভরা মুখখানিতে চোখ বুলিয়ে বলল, “এখন এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। ঘরে গিয়ে রেস্ট করো।”

যাবীনের নামতে দেরি হচ্ছে বলে অনন্ত আবার ফিরে এসে গাড়ির দরজা খুলল। বলল, “কীরে, ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি? ঘরে গিয়ে ঘুমা। রাত জেগে দেখতে একদম চোরের মতো লাগছে। ঘুমিয়ে চেহারা-সুরত ঠিক কর। নয়তো আজ ফ্যাশনের প্রেজেন্টেশন না দিয়ে ঘুমের প্রেজেন্টেশন দিতে হবে।”

চলবে…
(এক পর্ব দুইভাগে দিয়ে হলেও নিয়মিত হতে চেষ্টা করছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here