#প্রণয়ের_বন্ধন
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৭
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
হাশেম চাচার দিকে তাকিয়ে বলল – আপনার স্যার বাসে না গিয়ে নিজের গাড়িতে যাবে কেন?
– কে জানে? স্যরের মতিগতি বোঝা দায়।
হাশেম চাচা চলে গেলেন। মন খারাপ হয়ে গেল মেঘার। কত করে ভেবেছিল সে গৌরব আর তনুর সাথে বাসে যাবে তা আর হলো না। কাল কত রাত অবধি গৌরব আর তনুর সাথে ক্যাম্পিং এ যাওয়া, সেখানে গিয়ে কি কি করবে তার প্ল্যানিং করেছে। শেষ পর্যন্ত গৌরব বিরক্ত হয়ে এটাও বলেছে – তোরা কি ক্যাম্পিং এ যাচ্ছিস নাকি বেড়াতে?
সেখানে আজ কিছুই হলো না। তার এখন একা একা ঐ অভদ্র ডাক্তারটার সাথে যেতে হবে। তার সব আশায় জল ঢেলে দিল তাহসিন। মেঘা নিজের হাতের বিশালাকার সাইড ব্যাগটা নিয়ে তাহসিনের গাড়ির সামনে গেল। ততক্ষণে তাহসিন গাড়ির মধ্যে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়েছে। মেঘা গাড়ির সামনের দরজা খুলে ব্যাগটা নিয়ে ভিতরে বসতে গেল। ভ্রু কুঁচকালো তাহসিন, বলল – এটা কি?
মেঘা বিরক্তি নিয়ে বলল – দেখছেন না ব্যাগ?
– দেখছি তো। কিন্তু এত বড় ব্যাগ নিয়ে আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
– ক্যাম্পিং এ
অবাক হলো তাহসিন। অবাক চোখেই একবার ব্যাগটার দিকে তাকালো আর একবার মেঘার মুখের দিকে অতঃপর বিরক্তি নিয়ে বলল – আমরা ক্যাম্পিং এ যাচ্ছি , বেড়াতে না।
– তাতে কি হয়েছে? এর মধ্যে বেশি কিছু নেই। শুধু অনেক বোতল পানি আছে আর চিপস, চকলেট, আচার। আমি আবার যেকোনো জায়গার পানি খেতে পারি না।
– তার জন্য আমি মিনারেল ওয়াটার এনে রেখেছি।
– তা আমি জানতাম নাকি?
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো তাহসিন , বলল – ব্যাগটা দয়া করে পিছনে রেখে আসুন।
মেঘা সিটের উপর থেকে ব্যাগটা রাখলো পিছনে। অতঃপর নিজ দায়িত্বে সিট বেল্ট বেঁধে সামনের দিকে তাকালো সে। গাড়ি স্টার্ট করল তাহসিন। মেঘা সামনের দিকে তাকিয়েই বলল – আপনার ড্রাইভার কোথায়?
– নেই।
তৎক্ষণাৎ তাহসিনের দিকে ফিরে তাকালো মেঘা, বড় বড় চোখ করে বলল – নেই মানে? তাকে কাজ থেকে বের করে দিয়েছেন?
– না
– তাহলে?
– সে আমার বাড়ির ড্রাইভার। তাকে বেতনও দেওয়া হয় বাড়ি থেকে আমি দেই না। তাই বাড়িতেই পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন থেকে সে বাড়ির গাড়িই চালাবে।
মেঘা ঠোঁট দুটো গোল করে উত্তর দিল – ওওওও
ঘন্টাখানেক পর সবাই ক্যাম্পিং এর জন্য নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছালো। সকাল হওয়ায় রাস্তায় তেমন যানযট ছিল না বিধায় তারা তাড়াতাড়িই পৌঁছে গিয়েছে তারা। ক্যাম্পিং এর নির্ধারিত স্থানে পৌঁছাতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো মেঘা। চলে গেল গৌরব আর তনুর কাছে। তাহসিন বিরক্ত হলো তবে মুখে কিছু প্রকাশ করলো না। বিশাল এক মাঠে ক্যাম্পিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপরে তাবু টানিয়ে ছোট ছোট টেবিল চেয়ারে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তাহসিন নিজের ব্যাগ নিয়ে বসলো নিজের জন্য নির্ধারিত স্থানে। অন্য অন্য ডাক্তাররাও বসে পড়েছে ইতমধ্যে। ছাত্র ছাত্রী যাদের আনা হয়েছে তাদের কয়েকজনকে কাজ দেওয়া হয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার আর কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্যারদের সাহায্য করার জন্য। তারা বিভিন্ন ঔষধ, স্যারদের প্রয়োজনীয় কাগজ এগিয়ে গুছিয়ে দিচ্ছে। সবার সাথে সাথে মেঘাও দৌড়ে ঝাঁপিয়ে কাজ করছে। আবার মাঝে মাঝে তনুর সাথে দুষ্টামীতে মেতে উঠছে। গৌরব তো বরাবারই চুপচাপ। সে চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে আবার মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। তাহসিনের চোখও এড়াচ্ছে না কিছুই। তবে সে বাঁধা দিচ্ছে না, আজ কেমন যেন মেঘার হাস্যজ্জ্বৌল চেহারাটাই ভালো লাগছে তার। শুধু শুধু কিছু বলে ঐ হাস্যজ্জ্বৌল চেহারার হাসিটা এই মুহূর্তে সে কেড়ে নিতে চাইছে না। তনুর সাথে হাসি ঠাট্টা করতে করতেই মেঘার পায়ে একটা ইটের অর্ধ টুকরো বেঁধে গেল । মেঘা হুমড়ি খেয়ে পড়লো, তালমাতাল সামলাতে না পেরে সোজা গিয়ে বসে পড়লো তাহসিনের কোলের উপরে। আকস্মিক ঘটনায় হকচকিয়ে উঠলো তাহসিন। বড় বড় চোখ করে তাকালো মেঘার দিকে। মেঘা নিজেও হতবম্ব। হঠাৎ এটা কি হয়ে গেল? মেঘা যেন কথা বলতেই ভুলে গেছে, তার যে তাহসিনের কোল থেকেও উঠতে হবে তাও ভুলে গেছে। শুধু ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে তাহসিনের মুখের দিকে। তাহসিন পড়ে গেছে মহা অসস্তিতে। এত মানুষের মধ্যে মেয়েটা কেমন তার কোলের উপর এসেই পড়লো। আশেপাশে এত জায়গা থাকতে তার কোলের উপর এসেই পড়তে হলো? তা না হয় ভুলবশত পড়ে গেছে এখন উঠবে তো। এই মেয়ে তো ওর কোলে থেকে ওঠারও কোনো নামই নিচ্ছে না। তাহসিন কন্ঠটা একটু খাদে নামালো, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল – কি উঠতে ইচ্ছে করছে না? এখানে বসে দুনিয়াদি ভুলে গেছেন নাকি? কিন্তু বলছি কি এটা আমার কোল চেয়ার নয়।
ধ্যান ভাঙতেই চট করে উঠে দাঁড়ালো মেঘা। লজ্জায় তার কান দুটো ঝা ঝা করে উঠলো। চারদিকের সবাই কেমন করে তার দিকে তাকিয়ে আছে আবার কেউ কেউ ঠোঁট টিপে হাসছে। মেঘার লজ্জা যেন বেড়ে গেল আরও। এখন কারও দিকে তাকাতেই তার লজ্জা লাগছে ভীষণ। লজ্জায় মাথা নুইয়ে ওখান থেকে কেটে পড়লো মেঘা।
ঘন্টাখানেক কেটে গেল, মেঘাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। তাহসিনা রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে আড় চোখে খুঁজেছে মেঘাকে, মাঝে মাঝে চোখে পড়েছে তবে তার থেকে দূরে রয়েছে মেয়েটা। সেই কাহিনীর পর ভুলেও মেঘা তাহসিনের সামনে পড়েনি। হয়তো লজ্জায়, তাহসিন বুঝেছে মেঘার লজ্জা। তাই এতক্ষন সেও আর বেশি ঘাটায়নি মেঘাকে। আসলে ব্যাপারটায় যে মেঘা একা লজ্জায় পড়েছে তা নয় তাহসিনও তখন বেশ লজ্জায় পড়েছে। এত লোক এখানে রোগী, সিনিয়র জুনিয়র ডাক্তাররা রয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরাও রয়েছে। তার মধ্যে এমন একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি।
এখন রোগী দেখার চাপ কম। কিন্তু মেঘাকে দেখা যাচ্ছে না এখনও। তাহসিন প্যান্টের পকেট হাতরে তার মুঠোফোনটি বের করলো। মোবাইল ঘেঁটে একটা নাম্বার বের করলো। নাম্বারটা বেশ সুন্দর করে ” অভদ্র মেয়ে ” দিয়ে সেইভ করা। তাহসিন কল লাগালো নাম্বারটিতে। নাম্বারটা কলেজ থেকে অনেক আগেই নিজের কাছে নিয়ে রেখেছিল সে তবে এখনও কল দেওয়া হয়ে ওঠেনি মেঘাকে। হঠাৎ করে সেদিন তার সামনে মেঘার নাম্বারটা পড়তেই মোবাইলে তুলে নিয়েছিল সেটা। কিন্তু কেন তুলেছিল জানা নেই তার। সেকেন্ড কয়েক রিং হতেই কলটা ধরলো মেঘা, ওপাশ থেকে ভদ্র কন্ঠেই বলল – আসসালামুয়ালাইকুম! কে বলছেন?
– ওয়ালাইকুমুস সালাম। কোথায় আপনি?
কন্ঠস্বর শুনেই মেঘা বুঝলো এটা তাহসিন। সে ভালোভাবেই পরিচিত এই কন্ঠস্বরের সাথে। দিন রাত যার কন্ঠ শোনে তার কন্ঠ কি আর ভোলা যায়? জ্বীহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো মেঘা, বলল – এইতো স্যার আপনার থেকে একটু দূরে , পিছনের দিকেই আছি।
– কাছে আসুন।
থতমত খেয়ে গেল মেঘা, বলল – জ্বী স্যার!
নিজের কথা নিজের মনে পড়তেই বিব্রতবোধ করলো তাহসিন। একটু সময় নিয়ে বলল – আমার এখানে আসুন।
– আচ্ছা স্যার আসছি।
খট করে কলটা কেটে দিল তাহসিন। মেঘা এতক্ষন গৌরব আর তনুর সাথেই ছিল । তাহসিনের কল পেয়ে তখনকার লজ্জার কথা ভুলেই ছুটলো তাহসিনের কাছে। তাহসিন রোগী দেখছিল মেঘা গিয়ে দাঁড়ালো তার পাশে, বলল – স্যার কিছু বলবেন?
তাহসিন তাকালো না মেঘার দিকে, রোগী দেখতে দেখতেই বলল – গাড়িতে পানি আছে নিয়ে আসুন তো। খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।
মেঘা ছুটলো গাড়ির দিকে। গাড়ির দরজা খুলে চার বোতল মিনারের ওয়াটার নিল। যদি আবার প্রয়োজন পড়ে? তাছাড়া আজ যা গরম। মেঘার দুই হাত ভর্তি পানির বোতল। বেশ ধীরে সুস্থেই আসছিল সে। হঠাৎ কোনো কিছুতে বেঁধে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো মাটিতে। হাতের পানির বোতলগুলো নিচে পড়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে হাতের কব্জিতে ব্যাথা পেল সে। তবুও পানির বোতলগুলো তো বাঁচাতে পেরেছে। নয়তো বোতলে ময়লা দেখে আবার ঝামেলা শুরু করতো তাহসিন। সে তো আবার পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় পিএইচডি করেছে। কিন্তু পড়লো কিভাবে মেঘা? মেঘার স্পষ্ট খেয়াল আছে সে কিছুতে বেঁধে পড়েছে। উঠে দাঁড়ালো মেঘা, গায়ের ময়লাগুলো ঝেড়ে আশেপাশে খুঁজলো, এভাবে পড়ে যাওয়ার মতো কোনো কিছুই তো নেই আশেপাশে তাহলে? হঠাৎ কিছু হাসির ধ্বনি শুনে সামনে তাকালো মেঘা। কতগুলো মেয়ে তার দিকে তাকিয়েই হাসছিলো। তাকে দেখিয়ে কি কি যেন বলছিলো। সে পড়ে গেছে বলে হাসছে নাকি? লজ্জা লাগলো মেঘার। আজ কি তার রাশিতে পড়ে যাওয়া গ্রহের আনাগোনা বেড়েছে নাকি? একবার পড়লো সোজা স্যারের কোলে। আরেকবার বাচ্চাদের মতো মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়লো এতগুলো মানুষের সামনে। মেঘা ভালোভাবে খেয়াল করলো, ওদের মধ্যে একটি মেয়ে মাত্রই এখানে ছিল? তবে কি কেউ ইচ্ছে করে ওকে ফেলেছে? নিজের ভাবনার উপর নিজেরই বিরক্ত হলো মেঘা। কার সাথে তার শত্রুতা রয়েছে যে তাকে ইচ্ছে করে ফেলে দিবে? কারোর তো আর কাজ নেই ওর পিছনে পড়ে থাকবে। এসব শুধু নাটক সিনেমাতেই হয় বাস্তাবে নয়। মেঘা আর বেশি ভাবলো না। পানির বোতলগুলো নিয়ে চললো তাহসিনের কাছে। তাহসিন একজন রোগীকে বিদায় দিয়ে কেবলই বসেছিল। মেঘা তিনটা পানির বোতল টেবিলে রাখলো আর একটা বাড়িয়ে দিল তাহসিনের দিকে, বলল – স্যার আপনার পানি।
পানি নিতে গিয়ে মেঘার হাতের কব্জির দিকে চোখ পড়লো তাহসিনের। পানি নিতে নিতে সে প্রশ্ন করলো – কব্জিতে কি হয়েছে?
মেঘা তড়িৎ গতিতে হাতটা লুকিয়ে ফেললো পিছনে, বলল – কই কিছু না তো।
তাহসিন শীতল দৃষ্টিতে তাকালো মেঘার দিকে, শান্ত কন্ঠেই বলল – লুকাতে হবে না দেখে নিয়েছি আমি।
মেঘা মিনমিনিয়ে উত্তর দিল – পড়ে গিয়েছিলাম।
তাহসিন শান্ত অথচ গম্ভীর কন্ঠে বলল – আপনি কি ঠিকভাবে হাঁটতেও জানেন না? একবার আমার কোলে পড়েন তো একবার মাটিতে।
চলবে….
পরের পর্বটি পেতে পেইজে ফলো দিয়ে রাখুন। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
ধন্যবাদ