#প্রণয়ের_বন্ধন
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_২
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
অতঃপর আফজাল তালুকদার শান্ত কন্ঠেই বলল – তা হঠাৎ আমার ডিপার্টমেন্টে এলে যে? এদিকটায় সহজে তো দেখা পাওয়া যায় না তোমার।
– আপনার স্ত্রী ফোনে পাচ্ছে না আপনাকে , কল করেছিল আমাকে তাই আস্তে হলো।
কথাটা বলে আর দন্ড সময়ও অতিবাহিত করলো না তাহসিন। এক পলক মেঘার দিকে তাকিয়ে দ্রুত প্রস্থান করলো সে। মেঘা রাগে ফোঁস ফোঁস করছে, ওকে কতগুলো অপমান করে গেল এই অভদ্র লোক, একটা বাজে ডাক্তার।
মেঘার চিন্তা ভাবনার মাঝেই আফজাল তালুকদার এগিয়ে এলেন, মেঘার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন – কি সমস্যা?
মেঘা চোখ তুলে তাকালো আফজাল সাহেবের দিকে, বলল – পেট ব্যথা করছে ভীষণ।
আফজাল তালুকদার ঠোঁটে হাসি বজায় রেখেই বললেন – আমি কিন্তু সবটা শুনেছি। তোমার কিন্তু রাস্তার পাশের ঐ সব অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার খাওয়া একদম ঠিক হয়নি।
মেঘা ঠোঁট বাঁকালো, বিরবিরিয়ে বলল – তাই বলে আমি ফুচকা ছেড়ে দেব নাকি, অসম্ভব।
মেঘার বিরবিরিয়ে বলা কথাটা কানে পৌঁছায়নি আফজাল তালুকদারের, সে ফিরে তাকালেন সুফিয়া বেগমের দিকে, বললেন – কিছু টেস্ট দিচ্ছি করিয়ে নিয়ে আসুন।
মেঘা নাক মুখ কুঁচকালো, কিন্তু ভালোও লাগলো। এই ডাক্তারটা কি সুন্দর করে কথা বলছে। মুখ থেকে যেন হাসি সরছেই না। ডাক্তারের ব্যবহার হতে হবে এমন যেন রোগী ডাক্তারের কাছে আসলে ডাক্তারের কথা শুনেই মন প্রান জুড়িয়ে যায়। কিন্তু ঐ ডাক্তারটা, ইস কি কর্কশ কন্ঠস্বর। মনে হলো কাক এসে কতক্ষন কা কা করে গেল। এই লোককে ডাক্তার কে বানিয়েছে ,কে জানে? পাজি, অভদ্র ডাক্তার একটা।
________________________________________
রাত বেড়েছে, ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২ টা ছুঁই ছুঁই। ব্যস্ত শহরা নীরবতায় নিমজ্জিত হয়েছে। রাস্তার পাশের লাইট গুলো একা একা জ্বলে যাচ্ছে। তাহসিন বাড়ি ফিরেছে মাত্রই। হাসপাতালে আজ কাজ ছিল অনেক, রোগীরও বেশ চাপ ছিল। তাই ফিরতে ফিরতে দেরী হয়ে গেছে। নিজের রুমে ঢুকতেই আগে ওয়াশ রুমে গেল তাহসিন। শরীর থেকে ঘামের দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। একদম সহ্য হচ্ছে না তার। বরাবরই ভীষন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, গোছালো লোক সে। এখন আগে তাকে ভালো করে একটা শাওয়ার নিতে হবে নয়তো শান্তি পাবে না। রাতের খাবারটা সে হাসপাতালেই খেয়ে এসেছে। ওয়াশ রুমে ঢুকে শরীরে জড়ানো ঘর্মাক্ত শার্টটা খুলে ফেললো। উদম বেশীবহুল শরীর, হঠাৎ তার চোখ পড়লো নিজের বুকে, সেখানে খামচির দাগ স্পষ্ট। সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো তাহসিন। চোখের সামনে ভেসে উঠলো আজ বাসের ঘটনা। পরক্ষনেই মনে পড়লো হাসপাতালের মেয়েটার কথা। তাহসিনের জানা নেই যে দুটো মেয়ে একই কিন্তু সে বিরক্ত হলো দুজনের উপরেই। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার, বিরবিরিয়ে বলল – অভদ্র মেয়ে।
____________________________________
ষড়ঋতুর দেশে ঋতুচক্রের পরিক্রমায় এখন শরৎকাল। শরতের আগমনে প্রকৃতি থাকে নির্মল, স্নিগ্ধ। তবে শহরে তার রূপ দূরাগত। শহরের আবহাওয়া বরাবরই কোলাহল, যানযট এবং দূষনপূর্ন। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত এই তিনটি ঋতু এখানে বোঝা গেলেও শরৎ, হেমন্ত এবং বসন্ত এই তিনটি ঋতু এখানে বোঝা কষ্টকর। নিজের গাড়িতে বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে আছে তাহসিন। যানযটে পড়েছে সে, এ আর নতুন কি? শহরের পরিবেশে এই যানযট নিত্যদিনের ঘটনা। তবে এভাবে বসে থেকে প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে তাহসিন। এর জন্যই ভেবেছিল হাসপাতালের কাছাকাছি একটা বাসা ভাড়া নিবে। কিন্তু তার বাবা মা শুনেই চেতে গেছে। তারা কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে দিয়েছেন – নিজেদের এত বড় বাড়ি, এত এত টাকা থাকতে সে কেন ভাড়া বাসায় থাকবে।
যদিও মা বাবার কথায় তার কিছুই আসে যায় না। সে নিজের ইচ্ছাধীন, অন্যের ইচ্ছেতে কখনওই চলেনি। বিশেষ করে বাবা মায়ের কথা তো নাই। ” বাবা মা” শব্দ দুটো মনে আসতেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো তাহসিন। শেষ কবে বাবা মায়ের মুখটা দেখেছিল মনে পড়ছে না তার। পড়বে কিভাবে তার বাবা মা তো আর তার দেখা পাওয়া বা দেখা দেওয়ার জন্য বসে থাকে না। তাদের শুধু টাকা চাই, অনেক টাকা। তবে হাসপাতালের কাছাকাছি বাসা খুঁজেছিল সে, কিন্তু তার মনের মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাসা পায়নি। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তাহসিন। ঘাড় ঘুরিয়ে বাহিরের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো ক্ষানিক দূরে একটা ফুচকার দোকানে, রাস্তার পাশে। ছেলে মেয়েরা ফুচকা খাচ্ছে সেখানে। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ের দিকে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো। পড়নে কলেজ ড্রেস। এই ড্রেস খুব ভালোভাবেই চেনে তাহসিন। সেও ঐ একই কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেই বেরিয়েছিল। চোখ ছোট ছোট করে তাকালো তাহসিন। মেয়েটাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছে, কোথায় দেখেছে? মস্তিষ্কে চাপ দিতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক কিশোরীর ক্রন্ধনরত মুখশ্রী। হ্যা এই তো সেই মেয়ে যে দিন দুই আগে হাসপাতালে পেট ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদছিল, তাকে অনেক কথাও শুনিয়েছিল। সেই অভদ্র মেয়েটা। আজ কিনা এই মেয়ে আবার ফুচকা খাচ্ছে তাও এই রাস্তার পাশে এত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে? নাক মুখ কুঁচকে নিল তাহসিন, বিরবিরিয়ে বলল – এদের পেট ব্যাথা হবে না তো কার পেট ব্যথা হবে আমার?
সাথে সাথেই তাহসিনের পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। ভ্রু কুঁচকালো সে, পরক্ষনেই মনে পড়লো সে সকাল থেকে কিছু খায়নি তাই এমন হচ্ছে। তাহসিন ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার তাকালো মেয়েটির দিকে। মেয়েটি খাচ্ছে না রীতিমতো গিলছে। জ্যাম ছুটে গেল, পিছন থেকে একের পর এক গাড়ির হর্নের শব্দ কানে ভেসে আসছে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলো। মুহুর্তেই তাহসিনের চোখের আড়াল হলো মেয়েটি। তাহসিন নিজের উপর বেশ বিরক্ত বোধ করলো। সে কিনা এতক্ষন একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। নাহ এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে তার সময় নষ্ট করলে হবে না। হাসপাতালে যেতে হবে, অনেক কাজ আছে তার।
পরের দিন আবার একই কান্ড। অবশ্য এই এলাকায় এই সময় একটু যানযট থাকে। আজও তাহসিন জ্যামে আটকে গাড়িতে বসে আছে। কৌতুহলবশত বাহিরে উকি দিল সে, আজও কি সেই মেয়েটা আছে ফুচকার দোকানে? ফুচকার দোকানের দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে থ হয়ে গেল তাহসিন, আজও সেই মেয়েটা ঐ দোকানে ফুচকা খাচ্ছে। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাহসিনের। ইচ্ছে হলো এখনই গিয়ে মেয়েটাকে দুই চারটা ধমক দিতে, ফুচকা খাওয়া একদম বের করে দিতে। রোজ রোজ এভাবে ছাই পাশ খেয়ে গ্যাস্টিক বাধাবে তারপর ছুটবে ডাক্তারের কাছে। সেদিন এই টুকু মেয়ে ওকে কত কথাই না শোনালো। তবে নিজেকে দমিয়ে নিল তাহসিন, কোনো দরকার নেই ওই মেয়ের কাছে গিয়ে ফুচকা খাওয়া আটকানোর। ঐ মেয়ের কিছু হলে ওই মেয়েই বুঝে নিবে তাছাড়া ঐ মেয়ে তো আর তাহসিনের রোগী না যে তাকে নিয়ে এত ভাববে, সে মিস্টার আফজাল তালুকদারের রোগী যার রোগী সে বুঝুক। পরক্ষনেই আবার ভাবলো না ঐ মেয়েটাকে ওর আটকানো দরকার। এদের মতো মানুষদের জন্যই ডাক্তারদের বদনাম হয়। এরা পৃথিবীর কিছু মেনে চলে না, ঠিকভাবে ঔষধ পর্যন্ত খায় না আর বলে ” ডাক্তার ভালো না, কি ঔষধ দিয়েছে তাতে আমার রোগ সারেনি । ” ডাক্তারের বদনাম মানে তারও বদনাম কারন সেও তো একজন ডাক্তার। আর সাত পাঁচ না ভেবে গাড়িতে ড্রাইভারকে রেখেই বেরিয়ে পড়লো তাহসিন।
মেঘা একে একে ফুচকা মুখে দিচ্ছিলো। তার কাছে এখানকার ফুচকা না যেন অমৃত। একবার খেলে জ্বীহ্বে লেগে থাকে তাই তো সে প্রায় প্রতিদিনই কলেজ ছুটির পর বা আগে এখানে ফুচকা খেতে আসে। প্রতিদিন এখানে আসতে আসতে ফুচকাওয়ালার সাথেও তার দারুন সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ফুচকার প্লেটে একটা ফুচকা বাকি আছে কেবল। মেঘা ফুচকাটা দুই আঙ্গুলের মাথায় ধরলো, বড় করে হা করে মুখের মধ্যে পুরবে তখনই কেউ এসে হাতটা ধরে নিল তার। মেঘা বিরক্ত হলো বেশ। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল – কে রে?
পাশ ফিরে তাকালো মেঘা। চোখের সামনে এক সুদর্শন পুরুষের মুখশ্রী ভেসে উঠলো তার। ফর্সা গায়ের রং, শরীরের সাথে আটশাট বেঁধে রয়েছে একটা ধূসর রঙা শার্ট। জিম করে বোধহয়। আচ্ছা লম্বায় কত ফুট হবে এই লোক নিশ্চই ৬ ফুট। দেখতে তো খাম্বার মতো, মেঘা যেন তার কাঁধের নিচে পড়ে আছে। মুখে চাপ দাঁড়ি, অন্য কোনো মেয়ে হলে এতক্ষনে এই সুদর্শন পুরুষের দর্শনে তার প্রেমে পড়ে যেত, কিন্তু মেঘা পড়লো না। এই মুহূর্তে এই সুদর্শন পুরুষকে তার কাছে কুৎসিত মনে হচ্ছে ভীষণ কুৎসিত যে তার এবং তার ফুচকার মধ্যে এই পৃথিবীর সবথেকে বড় বাধা। কথা একবার তাকালো তার অসহায় ফুচকাটার দিকে যাকে সে এই মাত্রই খেতে যাচ্ছিলো কিন্তু এই বদ লোকের জন্য পারলো না, আরেকবার তাকালো ঐ সুদর্শন পুরুষের হাতের দিকে মে হাত দিয়ে ধরে রেখেছিল ওর হাত, তারপরে ঝাঁঝালো কন্ঠে শুধালো – সমস্যা কি এভাবে হাত ধরে রেখেছেন কেন?
হাতটা ছেড়ে দিল তাহসিন, বলল – আপনি আবার এই ছাই পাশ খাচ্ছিলেন?
চোখ বড় বড় করে তাকালো মেঘা, বলল – ছাই পাশ, কোনটা ছাই পাশ এটা ফুচকা। আর আপনি কে বলুন তো মশাই? চেনা নেই জানা নেই দুম করে এসেই আমার ফুচকা খাওয়ায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন।
মেঘা চিনতে পারেনি তাহসিনকে। এর আগে তাহসিনকে সে দুই বার দেখেছে দুই বারই মাস্ক পড়া ছিল, আজ মাস্কহীন। গাড়ি থেকে নামার সময় ভুলবশত মাস্কটা আনা হয়নি তার। তাহসিন ভাবলেশহীন ভাবে বলল – আমাকে আপনার না চিনলেও হবে। আগে আপনি নিজের কথা চিন্তা করুন, রোজ রোজ এইসব ছাই পাশ খেয়ে হাসপাতালে গিয়ে পেট ব্যথায় কান্না কাটি করেন। আপনাদের মতো মানুষদের জন্যই ডাক্তারদের বদনাম হয়।
মেঘা সরু চোখে তাকালো তাহসিনের দিকে, বলল – আপনি কে বলুন তো। আপনি কিভাবে জানলেন আমার পেট ব্যথা হয়েছিল?
একটু থামলো মেঘা, ঘুরে ঘুরে তাহসিনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলো, অতঃপর চোখ বড় বড় করে বলল – আপনি সেই অভদ্র ডাক্তার ট না তো, যে হৃদপিন্ডের ডাক্তার হয়ে আমার পেটে হাত দিয়েছিল।
চোয়াল ঝুলে গেল তাহসিনের, ক্ষ্যাপাটে কন্ঠে বলল – আমি অভদ্র?
– আলবাত আপনি অভদ্র।
– মুখ সামলে কথা বলুন বলছি, অভদ্র, বাচাল মেয়ে।
– কি আমি অভদ্র বাচাল? আপনি তো কাক, সারাক্ষন কাকের মতো কা কা করেন। সেদিন হাসপাতালে কা কা করে হয়নি আজ রাস্তায় চলে এসেছেন?
– ইউ ইডিয়েট গার্ল। কি বললেন আমাকে আমি কাক?
– এই একদম ইংরেজিতে গালাগালি করবেন না বলে দিলাম। তাহলে কিন্তু আমিও ছেড়ে দেব না বলে দিলাম।
– কি করবেন আমাকে?
– দেখবেন কি করবো?
– হ্যা
তাহসিন হা করতেই মেঘা হাতে থাকা ফুচকাটা পুরে দিল তাহসিনের মুখে।
চলবে….
পরের পর্বটি পেতে পেইজে ফলো দিয়ে রাখুন। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
ধন্যবাদ
প্রথম পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=286280083899456&id=100075524000647&mibextid=Nif5oz