#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_১৪
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
বিশ্ববিদ্যালয় রোড ধরে তাল মিলিয়ে হাঁটছে তারা। গায়ের সবার লাল সাদা জামা। ছেলেদের গায়ে লাল সাদা পাঞ্জাবি। মেয়েটা তিনটার গায়ে লাল সেলোয়ার-ওড়না আর সাদা কামিজ। তাতেও বাহারি রঙের কাজ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় সড়ক ধরে এগোতে এগোতে দু একটা হাসি ঠাট্টা চলছে তাদের মাঝে। দূরে কোথাও মাইকে বেজে চলেছে শহীদ দিবসের গান…
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি।
আজকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস। জাতির বীর সন্তানদের মনে প্রাণে স্মরণ করার দিন। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে এবং তাদেরকে স্মরণ করতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবি চত্বরে বিশাল জনসভার আয়োজন হয়েছে।
যদিও ওদিকে এখনো পা মাড়ায়নি তারা কেউই। বাদামের ঠোঙায় দু আঙুল ঢুকিয়ে তারপর সেই বাদামের খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুরে দিয়ে পায়ে পায়ে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনীয় কিংবা উজবুক গল্পে মেতে উঠেছে তারা।
যেতে যেতে হঠাৎ মনে হলো পেছনে একজন নেই। সুজানা চমক গলায় বলল
এরেহ মেহুল কই গেল?
শান্তাও ঘাড় ঘুরালো। আহির নিখিল এদিকওদিক তাকাতেই জায়িন আঙুল দেখিয়ে বলল
ওই যে।
তার আঙুলের ইশারায় সবাই তাকাতেই দেখলো মেহুল থেমে থেমে পা ফেলে এগোচ্ছে বড় গাছতলাটির কাছে। তারা থাকাতেই আঙুলের কাছে ঠোঁট রেখে চুপ থাকতে বলল। আর এগোতে বললো।
গাছতলায় পেছনে ফিরে থাকা চেইক শার্ট পরিহিত ছেলেটাকে দেখে সবাই হেসে আবারও হাঁটা ধরলো। শান্তা বলল
এই মেয়ে ওর মাস্টার বাপের মাথা পাগল করেই ছাড়বে দেখছি।
আহির কথা কেড়ে নিয়ে উপরে বাদাম ছুঁড়ে মেরে গালের ভেতর নিতে নিতে বলল
সাইফ ওয়াহিদের মতো ছেলে তুই সাতবার জন্ম নিলেও পাবিনা। চুপ থাক একদম। ফটরফটর করবিনা।
শান্তা ভুরু উঁচিয়ে বলল
কিন্তু তোর মতো শয়তানকে তো কেউ জন্ম নিতে বলেনাই তারপরও যুগের পর যুগ তুই শয়তানের মানুষের পেছনে কাম কি?
আহির হা হয়ে চাইলো। এই মেয়ের সাথে কথায় পারা যায় না।
শান্তা সামনের চুল পেছনে ফিরিয়ে নাকের নিচে এক আঙুল টেনে ভাব দেখিয়ে বলল
হাহ হাহ আর লাগতে আসবে বাবুসোনা?
সুজানা, নিখিল আর জায়িন হো হো করে হেসে উঠে বলল
তোরা পারিস বটে।
….
গাছতলার কাছাকাছি যেতে না যেতেই পিঠে ব্যাগ চেপে দাঁড়ানো তরুণগুলো সাইফকে পেছনে ইশারা করতেই সাইফ ঘাড় ঘুরালো। মেহুল দূরে দাঁড়িয়েছে। শোল্ডার ব্যাগটা এপাশ ওপাশ দুলাতে দুলাতে অপ্রস্তুত হাসার চেষ্টা করলো সে। সাইফ ঘাড় ঘুরিয়ে নিল। ছেলেগুলোকে বলল
ওকে তোমরা এসো। প্রয়োজনে কল করো কেমন?
ওকে ভাইয়া। আসসালামু আলাইকুম।
সাইফ সালামের জবাব দিয়ে মাথা দুলিয়ে চলে এল মেহুলের কাছে। মেহুল লজ্জিত মুখে একবার তাকিয়ে আবারও মাথা নামিয়ে নিল।
সাইফ তাকে একপলক দেখে কপালের ঘাম মুছে বলল
প্রোগ্রামে এসেছ?
মেহুল ছোট্ট করে জবাব দিল।
হুমম। তুমি এখানে কখন এসেছ?
প্রায় সময় তো আসি।
মেহুল গালফুলিয়ে বলল
আমি দেখিনা।
সাইফ হেসে উঠলো। বলল
আমি দেখি।
মেহুল চোখ বড়বড় করে তাকালো।
সত্যি? কিন্তু ডাকো না কেন?
তোমার বন্ধুরা থাকে। সুজু থাকে। আমি ওর সামনে তোমাকে ডাকব?
তাতে কি? ওরা তো জানে। সুজু আমাকে বলেছে ইউ আর গুড ওয়ান ফর মি।
সাইফ মাথা দুলাতে দুলাতে বলল
আচ্ছা।
মেহুল তার সাথে মৃদুপায়ে হেঁটে যেতে যেতে বলল
আচ্ছা তুমি কতক্ষণ থাকবে এখানে? কত মিনিট কিংবা কত ঘন্টা?
সাইফ মাথা নাড়লো। ছোট্ট করে জবাব দিল।
আমি আছি।
মেহুল মিষ্টি হেসে মাথা নোয়ালো। বলল
আমিও আছি।
____________
শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে সম্মান প্রদর্শনের পরেই দেখা গেল সমাবেশে এক একটি আসন দখল করে বসেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ। তারমধ্যেই একটি আসন দখল করেছে নতুন প্রভাষক । মাথার উপর কড়া রোদের প্রকোপে বিধ্বস্ত প্রায় সকল ছাত্রছাত্রী। তাদের এমন অস্বস্তি আর ফিসফিসানি বেশ ভাবুক দৃষ্টিতে পরখ করছে অভিক। কপালের ভাঁজে জমে উঠা চকচকে ঘামের কণা মুছে নিল ভাঁজ করা টিস্যু দিয়ে।
সাদা অর্ধলিখিত পেপারটাতে কলম চালানোর ফাঁকে চোখ বুলিয়ে নিল ছাত্রছাত্রীদের সারি সারি আসনে। চোখের দৃষ্টি একটাসময় থামলো ঠিক মানুষীর কাছে গিয়ে। লক্ষ্যভেদ করতে পেরে সগর্বে মৃদু হাসলো তার চোখদুটো। ঠোঁটের নড়াচড়া অবিচল, অনঢ়। কিছুটা সময় পার হতেই পাশ থেকে প্রশ্ন করলো সহকর্মী।
ফারদিন সাহেব।
জ্বি।
কি দেখছেন?
দেখছি আগুন।
হেসে উঠলেন সহকর্মী। শুধালেন..
আগুনটা কিসের?
রোদের যা তেজ আগুন বললে বেশি হবে না।
আবারও হেসে উঠলেন নেওয়াজ আহমেদ। বললেন
আমি অন্য কিছু ভেবেছিলাম।
খুব একটা ভুল করেননি।
চোখ পাকিয়ে চাইলেন নেওয়াজ আহমেদ। বললেন
আরেহ আপনি কি ফারদিন সাহেব?
অভিক হেসে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল
এক্ষুণি আসছি। তারপর হিসাব বুঝিয়ে দিচ্ছি।
বেশ জটিল মনে হচ্ছে।
অভিক হেসে হাঁটা ধরলো।
_________________
কাট পাহাড়ের রাস্তা আর ঝুপড়িগুলো জনপদের কোলাহল আর বেকার বন্ধুমহলের আড্ডায় জমে উঠেছে। মাথার উপর খাঁ খাঁ করা রোদ্দুরের তেজ কমেছে হালকা সাথে পশ্চিমে হালকা মেঘের হাতছানি । ঘেমে ভিজে উঠেছে সবাই। গরমে অসহ্য হয়ে উঠছে মানুষ।
শহীদ দিবসের অনুষ্ঠান উপলক্ষে গায়ে শাড়ি জড়িয়েছিল নিহাত আর দলবলের মেয়েরা। রিকশায় চড়ে ওয়াটারফলে যাবে। তাই জায়িনকে বলেই দিয়েছে সে আজ শাটলে করে বাড়ি ফিরবে না। বাসে করে যাবে। জায়িন আর কোনো দ্বিরুক্তি করেনি।
সুজানা নিখিলরা সবাই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আইসক্রিমে খাচ্ছিল। সুজানাও ভেবেছিল যাবে যেহেতু যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে সাথে আকাশের অবস্থা কেমন সন্দেহজনক তাই সে যাওয়ার কথা মাথা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে।
নিহাত রিকশায় উঠে রিকশা ছাড়ার আদেশ দেবে। তখনি চোখ পড়লো রিকশার চাকার খুবই নিকটে তার শাড়ির আঁচল। আঁড়চোখে তাকিয়ে আবারও চোখ সরিয়ে নিল নিখিল। আইসক্রিম খেতে খেতে রিকশার নিকটে গিয়ে হ্যাঁচকা টান মেরে নামিয়ে আনলো নিহাতকে। তারপর ছুঁড়ে ফেলার মতো ছেড়ে দিল হাতটা। নিজের হাতটা গায়ের পাঞ্জাবিতে মুছতে মুছতে অন্যদিকে চোখঘুরিয়ে বলল
চাকার তালে তালে নাচতে হলে এমনি নাচা যায়। চাকার সাথে শাড়ি পেঁচিয়ে না। যত্তসব। কে পড়তে বলে এসব ছাইপাঁশ?
আকস্মিক এমন ঘটনায় নিহাত আর দলবল যেমন বিস্মিত তেমন সুজানারাও সবাই। নিহাতের পেছনের মেয়েগুলো বলল
দেখলি কেমন গোঁয়ারের মতো কথা বলে গেল। দূর থেকে বললেই তো হতো যে শাড়ির আঁচল সামলাও। আজব!
অন্যজন বলল
ভাব দেখালো। হাতটা কিভাবে মুছলো দেখেছিস?
নিহাত ধমকে বলল
চুপ করবি তোরা? কোথাও যাব না আর। মুড ভালো নেই। তোরা যাহ। আমি শাটলে করে বাড়ি ফিরব।
কিন্তু।
আমি যাব না বললাম তো।
ওর বন্ধুরা চলে গেল।
শাটলে চলে এলে সবার পিছু পিছু সেও উঠে পড়লো। সুজানাদের সামনের পাশাপাশিই বসলো। চুপচাপ, ফ্যাকাশে মুখে। জায়িন এসে তার পাশে বসলো।
কোনো সমস্যা?
নিহাত তার দিকে ফিরলো। চোখে অপমানের টলমলে জল।
হাত বাড়িয়ে বলল জায়িনকে বলল
ধর।
জায়িন হাতটা ধরলো। বলল
কি হয়ছে?
নাকে শুঁকে বল গন্ধ আছে কিনা।
জায়িন হতাশ হয়ে গলা কাত করলো। বলল
কি হয়েছে বলবি তো।
নিহাত ডান চোখটা মুছে বলল
আমি এই অপমানের যোগ্য জবাব দেব তোর বন্ধুকে।
জায়িন এবার যা বুঝার বুঝে নিল। বলল
আচ্ছা।
_______________
টেবিলের উপর ছোট ল্যাপটপের ভেতর মনোযোগ দিয়ে মাউসটি নড়াতেচড়াতে গিয়ে বিরক্ত মুখ দিয়ে ‘চ’ কারান্ত শব্দ বের করলো সুজানা। সাইফ পেছনে দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখে বলল
ওটা কাল রিপেয়ারিংয়ে নিয়ে যাব। সমস্যা দিচ্ছে।
ধুরর এরকম করলে কাজ হয়? তুমি আরেকটা কিনে নাও। এটা দিয়ে কাজ করো কিভাবে?
টুকটাক করি।
আরেকটা কিনে নাও না?
সাইফ হাসলো।
চাকরি হোক।
হুহ শুধু চাকরি হোক। ওসব মেহুলকে বলো আমাকে না।
চাকরি হলে তোকে বিয়েও দেব।
বসে নেই আমি।
কাজে মনোযোগ দে। চাকরিটা পেতে গেলে আমার মতো কাজ দিতে হবে তোকে।
তুমি চাকরিটা ছাড়ছ কেন তাহলে?
বিসিএস পরীক্ষা না?
আমার ভয় হচ্ছে। তোমার মতো আমি পারব? দেখো আমি কিন্তু ডাটা এন্ট্রির সব পারব। কিন্তু ফটোশপটা কঠিন লাগছে কিন্তু ইলাস্ট্রেটর ভালো পারব।
টুলস জানাটা বড় বিষয় নয়। ডিজাইনে ক্রিয়েটিভিটি দেখানোটা বড় বিষয়।
ডেইলী অতগুলো ডিজাইন রেডি করতে পারব আমি?
কেন পারবি না? পাঁচঘন্টা কি কম সময়? দেখ কাজটা আমি ছাড়ছি কিন্তু কাজটা নেয়ার জন্য অনেকে বসে আছে। তোকে সবটা দিয়ে কাজটা পারতে হবে। আমি এজন্যই তোকে এতকিছু শেখালাম। না পারলে এখন আমার ব্যর্থতা। আর তুই ওখানকার পিসিতে কাজ করবি। কোনো সমস্যা না। আমার বন্ধুকে সব বলে রেখেছি। ওখানে কোনো সমস্যা হবেনা তোর। মাসে দশ হাজার টাকা তোর জন্য এনাফ।
হুহ কিন্তু আমার কাজ যদি ভালো না লাগে তাহলে তো বের করে দেবে।
দেবে না। তুই আগে কাজে মনোযোগ দে। অতকিছু চিন্তা করতে হবেনা তোকে।
সুজানা ল্যাপটপের স্ক্রীনে মনোযোগ দিল। রাহেলা বেগম এসে চা বিস্কুট রাখলেন টেবিলে। বললেন
চাকরি নিলে তোকে তো টিউশনি ছাড়তে হবে। ওখানে বলে রেখেছিস?
সুজানা সটান হয়ে বসলো। সাইফের দিকে তাকাতেই সাইফ অভয় দিয়ে বলল
আমি ম্যানেজ করে নেব। অন্য কাউকে দেব।
সুজানা বলল
কিন্তু।
কোনো কিন্তু না।
তুই চার হাজার টাকার টিউশনির জন্য দশ হাজার টাকার চাকরি ছাড়বি?
আমাকে আর না যেতে বলছ?
মাসের আর ক’দিন বা আছে। মাসটা শেষ হোক। আগামী মাসের এক তারিখ থেকে তোর জয়ন।
আচ্ছা।
রাহেলা বেগম তাড়া দিলেন।
চা টা খাহ। ঠান্ডা হয়ে গেল তো।
সুজানা চা টা একটানে খেয়ে তিনতলায় চলে এল। নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আজ সে টিউশনিতে যায়নি। কিভাবে উনাদেরকে চাকরির কথাটা বলে ম্যানেজ করবে সে জানেনা। অন্যজন কি তার মতো করে অত আন্তরিকতার সাথে পড়াবে? মানুষগুলো যে খুব ভালো।
ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা নেমে এল চোখে।
কিছুক্ষণ পর মাথা তুলতেই দেখলো বুকে হাত ভাঁজ করে স্বয়ং অভিক স্যার দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুজানার চোখ কপালে উঠলো। বড় বড় চোখে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললো। দেখলো স্যার সরু চোখে তাকিয়ে আছে।
সুজানা বিড়বিড়িয়ে বলল
আমি কি করেছি?
আজকে আসেননি কেন?
আজকে খুব ঝড়। আম্মা বেরোতে দেইনি।
আপনি ঝড়কে ভয় পান। আজব!
পাই।
আমি যে আপনি আসবেন বলে বসে থাকি!
সুজানার কান গরম হয়ে উঠলো লজ্জায়। বালিশে মুখ গুঁজলো সে।
পরক্ষণে মায়ের ডাকে ঘুম ছুটে গেল চোখ থেকে। চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো কেউ নেই। আজব! দিনদুপুরে রাতবিরেতে তার শয়নেস্বপনে লোকটা সারাক্ষণ কি করে?
চলবে….…