#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৯
Writer #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
ভার্সিটি থেকে ফেরার পরপরেই ঝমঝম বারিধারায় ভিজে উঠলো শহরের এপ্রান্তর থেকে ওপ্রান্তর। দুপুরে ভাতঘুম না দিলে সুজানার মাথা ভার হয়ে থাকে। ঘুম থেকে উঠে চিরুণী চালালো সে মাথায়। সাজিয়া বেগম এসে বলল
এমা ভেজা চুলে বেণুনী পাকাচ্ছিস? চুলগুলো তো এমনি ঝড়ছেনা। এই বয়সে এমন চুল ঝড়ে গেলে কি হবে?
যত্ন করার পরেও তো ঝড়ছে আম্মা। বাদ দাও। আমাকে আগে এক গ্লাস পানি দাও। রোজ দেরী হয় আমার। তাই ফিরতেও দেরী হয়।
সাজিয়া বেগম পানি আনতেই ঢকঢক করে পানি খেয়ে ব্যাগ নিয়ে মাক্সটা পড়ে বেরিয়ে গেল সুজানা। সাজিয়া বেগম তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো।
রিকশাও সঠিক সময়ে পেয়ে গেল। কিন্তু কুটুমবাড়ি রেস্তোরাঁর দিকে যেতে যেতে হঠাৎ ভীড় লক্ষ্য করলো সে। মানুষ জটলা পাকিয়েছে। এমা ছেলেপেলেরা মারামারি টারামারি করছে নাকি?সায়েম নেই তো এখানে?
সুজানা রিকশা থামাতে বলে লাফ দিয়ে নেমে দৌড় দিল সেদিকে। যেতে যেতে সাইফকে দেখতে পেল। চেহারার হিংস্রতা। চোখদুটোই রাগ ঝড়ে পড়ছে। ঘর্মাক্ত মুখ বাম বাহুর শার্টে মুছে হাত নেড়ে কাকে যেন বকাবকি করছে। ভীড় ঠেলে ঢুকতেই সায়েমকে নীচু মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুজানার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। ভীড় ঠেলে সায়েমের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল
ভাই কি হয়েছে?
সায়েম তাকে দেখে চমকে উঠলো। সাইফ স্বাভাবিক গলায় বলল
কিরে তুই? টিউশনিতে যাচ্ছিস?
হ্যা কি হয়েছে? সায়েম কি করেছে?
তুই চলে যাহ। আমি আছি।
কিন্তু কি হয়েছে বলবে তো।
তোর ভাই ক্রিকেট খেলার মাঠে ঝগড়া লাগিয়েছে। আমি না থাকলে আজ লাশ পেতি।
সুজানা গালে হাত দিল। বলল
কার সাথে?
সায়েম বলল
আপা আমার দোষ নেই। জমির সদরের ছেলে আমার সাথে প্রায় সময় অমন করে। আমায় খেলায় নিতে চাই না। আজ আমার গায়ে হাত তুলতে আসছিল তাই আমি।
কি করেছিস তুই?
সাইফ কপাল মুছে বলল
মেরেছে।
সুজানা চোখ বড় বড় করে সায়েমের পানে চাইলো। বলল
ভাই তুই পথেঘাটে মারপিট করছিস? আম্মা জানলে…
আম্মাকে বলিস না।
সাইফ বলল
আচ্ছা! আম্মাকে বলবে না? এই সুজানা একে আর বাড়ি থেকে বের হতে দিবিনা দুপুরবেলা। ওরা ভীষণ ক্ষেপেছে। কোন সময়
সুজানা মুখ চেপে ধরলো হাত দিয়ে।
ওকে মারবে বলছে ওরা?
শুধু মারবে বলেনি লাশ ফেলবে বলেছে।
সুজানা চোখে পানি টলমল করছে। সাইফ তার মাথা চাপড়ে দিয়ে বলল
তুই টিউশনিতে যাহ। আমি দেখে নিচ্ছি ওকে।
সুজানার চোখে টলমলে জল দেখে সায়েম উচ্চস্বরে বলল
আমি মেরেছি বেশ করেছি। ওই কুত্তার বাচ্চা বলছে তোকে নাকি তুলে নিয়ে গিয়ে বরবাদ করে দেবে তাই মুখ বরাবর লাতি দিছি। আরেকবার বললে জিন্দা কবর দেব।
সুজানা মুখ চেপে ধরলো আবারও। সায়েমের গলার শিরা ফুলছে। চোয়াল শক্ত। সাইফ বলল
এত সোজা নাকি? বাড়ি চল। আমি দেখে নেব।
সায়েম ত্যাঁড়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। সুজানার মাথায় হাত রাখলো সাইফ। বলল
আমি আছি তো। যাহ তুই। কোনো অসুবিধা হলে আমাকে জানাবি।
সুজানা সায়েমের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। বলল
তুই গুন্ডা হচ্ছিস দিনদিন। তুই ওখানে না গেলে ওসব হতো? আমাদের মেরে তুই শান্তিতে থাকিস।
আপা আমি
আপা ডাকবি না বেয়াদব। তুই ওখানে খেলতে যাস কেন? কতবার বারণ করছি তোকে?
সাইফ বলল
সুজু ও আর খেলতে যাবেনা। তুই কাঁদিস না। চিন্তা করিস না আমি আছি।
আম্মাকে গিয়ে বলবে ওকে যেন পিঠ লাল করে আজ। আমি ভাগিয়ে ভাগিয়ে রাখি বলে এত সাহস পেয়েছে।
আপা
চুপ। আপা ডাকতে বারণ করছি না।
পাশ থেকে সায়েমের বন্ধু রাকিব বলল
সায়েমের দোষ নেই আপা। গত ম্যাচের পর থেকে ওই ছেলেটা সায়েমের পেছনে লেগেছে। ওকে নাকি খেলতে দেবেনা।
সুজানা বলল
তো খেলবে না। না খেললে কি হয়েছে? খেলা ওকে ভাত দেবে? আমাদের ভালো চাস তো তুই আর খেলার মাঠে যাওয়ার নাম ধরবি না ভাই।
সায়েমের চোখে লাল টকটকে রক্তপানি। সুজানার চোখেও তার কম নয়।
ওটা বাপের ক্ষমতা দেখাচ্ছে। তোর কি বাপ আছে যে পথেঘাটে গরম দেখাস?
তাই বলে চুপচাপ সব মেনে নেব?
সুজানা ঠাস করে চড় বসিয়ে দিতেই সাইফ টেনে নিয়ে গেল সুজানাকে। বলল
কি করছিস? তুই টিউশনিতে চলে যাহ। আমি আছি বললাম না।
সুজানা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে গাল মুছলো।
সাইফের ঘাড়ে ধরে কেউ ডাকতেই সে ঝাড়া মেরে বলল
আরেহ গায়ে হাত দেন কেন? মুখে কথা বলতে পারেন না। যত্তসব।
সুজানার দু ঠোঁট অজান্তেই ফাঁক হয়ে এল ক্যান্টেন্টমেন্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনিরুল মুফতি সাহেবকে দেখে।
সাইফ চোখ ছোট ছোট করে চাইলো।
সুজানা বিড়বিড় করে বলল
মেহুলের বাবা।
মনিরুল সাহেব বললেন
কি হয়েছে সায়েম?
সায়েমের চোখের চাহনি নরম হয়ে এল। বলল
কিছু হয়নি স্যার।
সাইফ তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। তারা যেতেই সুজানা ওড়না দিয়ে মুখটা মুছে নিল। মনিরুল সাহেব বললেন
তুমি কোথায় যাচ্ছ সুজানা?
দুই নাম্বার গেইট যাব আঙ্কেল। টিউশনি নিয়েছি তো।
ওহহ।
সুজানা মাথা দুলালো।
পড়ালেখার কি অবস্থা চলছে? মেহুল তো দেখছি সারাক্ষণ ফোন টিপছে। কিছু বলতেও পারিনা। বলে আমি কি হাই স্কুলের বাচ্চা?
সুজানা হাসলো।
তোমার মা ভালো আছে?
জ্বি আঙ্কেল।
আচ্ছা রিকশাটা বোধহয় তোমার জন্য দাঁড়িয়েছে। বাড়িতে এসো না।
যাব আঙ্কেল।
আচ্ছা মা। সাবধানে।
সুজানা রিকশায় চড়ে বসলো আবার। মাথা থেকে চিন্তা নামলো না। এক ঘাড়ত্যাঁড়া ভাই তার। সারাক্ষণ খেলা আর খেলা। এই খেলা সব শেষের মূল হয়ে দাঁড়ায়।
নবকুঠিরের গেইটের সামনে আসতেই রিকশা থামলো। সুজানা বরাবরের মতো গেইট ঠেলে বাড়িতে ঢুকতেই মালিকে দেখতে পেল। তবে মালির সাথে বাগান পরিচর্যায় একজন নতুন মানুষকে দেখে খানিকটা বিস্মিত হলেও তা চোখেমুখে প্রকাশ পেল না তা। ভারী গম্ভীর মুখে বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখলো অনা আর আবিদ ফ্লোরে বসে লুডু খেলছে। সুজানাকে দেখে দুজনেই সালাম দিয়ে উঠলো
আসসালামু আলাইকুম টিচার।
সুজানা ছোট করে সালামের উত্তর দিল। বলল
পড়ার ঘরে চলুন।
দুজনেই তার আগে আগে দৌড়ে পড়ার ঘরে দৌড় দিল। বারবার সুজানার মুখের দিকে তাকালো। টিচার আজ এমন কেন?
দু’জনেই চেয়ারে বসলো আজ। টেবিলের উপর বসে পড়ার ইচ্ছে মাথায় এল না। সুজানা কোনো বাড়তি কথা না বলে পড়ায় মনোযোগ দিল। দুজনেই বর্ণমালা শিখতে শিখতে সুজানার মুখের দিকে তাকালো। সুজানা চোখ তুলে বলল
এদিকে কি? পড়ো চুপচাপ।
দুজনেই পিটপিট করে তাকালো। ঠোঁট বাঁকিয়ে পড়া থামিয়ে দিল। সুজানা ভড়কে গেল।
কি হলো? পড়ুন। নইলে খুব মার দেব। এতদিন দেইনি। পড়ুন।
আবিদ কলম ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে।
টিচার বোকা দিচো।
তো কি দেব? না পড়ে মুখের দিকে কি?
দুজনেই ফুঁপিয়ে উঠলো একসাথে। চেয়ার থেকে উঠে কেঁদেকেঁদে দৌড় দিল। সেকেন্ডের ভেতর ঘটনাটি ঘটে যাওয়ায় সুজানা কিছুই বুঝতে পারলো না। মানে টা কি? এদের একটুও বকা যাবেনা?
সুজানা ওদের পেছন পেছন ছুটলো। দুজনেই কেঁদেকেঁদে ড্রয়িংরুমে চলে গেল। বাড়িভর্তি লোক তাদের কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে এল। আনিকা বলল
এই এই কি হলো?
আনজুমা বেগম বলল
কি হলো দাদু? দুজনেই মারপিঠ করেছেন নাকি?
সুজান বোকা দিচে।
অনা বলল
চুখ লাল কচচে সুজান।
আনিকা কপাল চাপড়ে বলল
হায় আল্লাহ।
সুজানা এসে বলল
আচ্ছা চলেন। আর বকা দেব না।
আবিদ বলল
সুজানের সাথি আড়ি। কথা বুলবো না।
সুজানা জোরপূর্বক হেসে বলল
কি করলে মাফ করবেন? সরি আমি।
অভিক সদর দরজা পার হয়ে বাড়িতে পা রাখলো। তার হাতে মাটি। হাতদুটো আলগা করে রেখে শার্টে মুখ ঘষে মুছে বলল
কি হলো আবার?
পরে সুজানার দিকে চোখ পড়তেই ভুরু কুঞ্চন করে চাইলো। অনা আর আবিদ তাকে দেখে সেদিকে ছুটে গেল। তার পা ধরে লুকিয়ে থাকলো। আনিকা বলল
দেখেছিস অভি সুজানা একটু বকতে না বকতেই এখানে চলে এসেছে। এ দুটোকে নিয়ে আমি কি করব?
টিচার ওদের কেন বকা দিয়েছে? বকা দেওয়ার কথা তো নয়। আমি ওদের ভালো করে পড়া শিখিয়েছি এন্ড হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করিয়েছি।
সুজানা চুপ করে থাকলো।
আনিকা বলল
তো কি আজ আর পড়বেন না?
সুজান পঁচা। আর পববো না। সুজান চুখ লাল কচচে।
অভিক বলল
গুড ডিসিশন। আসুন বাগানের গাছে পানি দেন। পড়া কাল পড়বেন।
সুজানা অবাক চোখে তাকালো। বলল
কেন পড়বেনা। অনা আবিদ এসো আমার সাথে। এসো।
দুজনেই অভিকের পিছু লুকিয়ে পড়লো। সুজানা হতাশ চোখে আনিকার দিকে তাকালো। আনিকা বলল
আচ্ছা থাক গে। আপনি আমাদের সাথে আসুন। আম্মা আর কাকীর নাকি আপনার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লেগেছে। গল্পগুঁজব করুন। মাত্রই তো এলেন।
সুজানা নাকচ করলো। তার মুড ভালো নেই আজ।
অভিক বলল
নো ওয়ে। উনি গুলুমুলুদের রাগিয়ে দিয়েছেন। রাগ ভাঙাতে হবে। সুজানা বাইরে চলে আসুন। রাগ ভাঙাতে হবে। খুব কঠিন কাজ।
সুজানা ভুরু কুঞ্চন করে চাইলো।
অভিক বলল
না আসলে বাড়ি থেকে বেরুতে পারবেন না কিন্তু।
আবিদ মাথা দুলিয়ে বলল
হ্যা। দজজা বনদো করে দিবো।
সবাই ঠোঁট টিপে হাসলো। সুজানা বলল
ফাঁকিবাজ।
আনিকা হাসলো। বলল
তাও অনেকদিন পর। আপনার আগে যাকে রেখেছিলাম তার সাথে প্রথমদিন থেকে দুষ্টুমি।
সুজানা বাড়ির বাইরে বাগানের দিকে বেরুলো। মালি তাকে দেখে বলল
বাবুরা তোমাদের মাস্টার আইছে।
দুজনেই সুজানাকে দেখে অভিককে ফিসফিস করে বলল
সুজান মন খারাপ কেন?
অভিক বলল
হুমম। ভাবার বিষয়।
সুজানা চারপাশটাই চোখ বুলিয়ে দেখলো
কদম, স্পাইডার লিলি, দোলনচাঁপা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী, গুলনার্গিস, দোপাটি ও অলকানন্দ প্রভৃতির গাছ। সাথে ফুলও ফুটেছে। আর বর্ষা মানেই তে কদম। কি সুগন্ধ ছড়িয়েছে।
সুজানাকে হাত দিয়ে ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো। অভিক তাদের বলল
টিচারের মন খারাপ। আপনারা তো ক্রাইম করেছেন। এখন টিচারকে সরি বলে আসেন।
দুজনেই ড্যাবড্যাব করে তাকালো। বলল
টিচার বোকা দিবে।
বোকা দিবেনা।
অভিক দুটো সন্ধ্যামালতি ছিঁড়ে বলল
টিচারকে দিয়ে সরি বলবেন। ব্যস।
দুজনেই ফুল কেড়ে নিয়ে ছুটলো। সুজানা তাদের ছুটে আসতে দেখে বলল
এমা দৌড়াচ্ছেন কেন? পড়ে যাবেন তো।
দুজনেই ফুল এগিয়ে দিয়ে বলল
সুজান চরি চরি।
সুজানা তাদের দেখে হেসে উঠলো। হাঁটু মুড়ে বসে ফুলগুলো নিয়ে গাল টেনে দিয়ে বলল
থ্যাংকিউ।
অনা বলল…
আলাভিউ সুজান।
সুজানা আওয়াজ করে হেসে উঠলো। বলল
পাকা বুড়ি।
অভিক হাতের ধুলো ঝেড়ে গাছ টপকে এসে বলল
সুজানা আগামীকাল ওদের বার্থডে। আপনি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবেন।
আমি?
অভিক চোখ নিভিয়ে বলল
হুম।
সুজানা বিড়বিড় করলো।
এমা আবারও একটা খরচা।
অভিক বলল
কি ভাবছেন?
সুজানা চমকে উঠে বলল
আমাকে আসতেই হবে?
অফকোর্স। আপনি ওদের টিচার। ওহহ গিফট দেয়ার কথা ভাববেন না। আপনার স্টুডেন্টরা ছোট। ওরা দুটো ফুল দিলেই খুশি।
সুজানা মিনমিন করে বলল
হাহ ঠোঁটকাটা ভীষণ।
আপনি বেঁচে গেলেন স্টুডেন্টরা ছোট হওয়াতে। আমাকে তো পুরো বাগান দিতে হবে।
কাকে?
আপনাকে। আপনি আমার স্টুডেন্ট না?
আমি বার্থডে পালন করিনা।
বিয়ের সময় দেব।
আমার?
অভিক পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
ইয়েস।
সুজানা মাথা নামিয়ে পায়ের নখ দিয়ে খোঁটাখুঁটি করতে করতে বলল
বাগান কাউকে গিফট দিতে পারে নাকি?
পারে।
তাহলে তো বাগান সাথে করে নিয়ে যেতে হবে। সেটা সম্ভব নাকি?
সব সম্ভব। আপনি বাগানের কাছাকাছি থাকবেন। ব্যস হয়ে গেল। আপনি দাঁড়ান। আমি কফি আনছি।
সুজানা ভুরু কুঁচকে তার যাওয়া দেখলো।
চলবে….
রিচেক করা হয়নি