#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৩৫
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
ক’দিনের বাজার করে আনলি আজকে?
সুজানা কপালের পাশে চুল গুঁজতে গুঁজতে উত্তর দিল
যতদিন খেতে পারো।
রুইমাছ কত নিল? টাকা আর ফেরত আসেনি?
রুইমাছ তোমার ওই করিম আব্বাজান কিনে দিয়েছে। তুমি নাকি বাপ ডেকেছ তাই। আমি তাই অল্পস্বল্প সবজি কিনে দিয়েছি। কিছু না দিলে কেমন দেখায় না।
হায় হায় কি বলিস! ছেলেটা দিল আর তুই নিয়ে নিলি?
সুজানা হাসলো। বলল
তুমি বাপ ডেকেছ তাই দিয়েছে আমি অতকিছু জানিনা।
আহা ছেলেটা কি কামাই করে? কেন অত টাকা খরচা করলো শুধু শুধু।
মোটা টাকা কামাই করে আম্মা। এক জায়গা না দু তিন জায়গা থেকে।
ধুরর মজা করিস না। পড়ালেখা করছে অত টাকা কোথা থেকে কামাবে?
সুজানা হেসে ওয়াশরুমে চলে গেল হাত-মুখ ধুঁতে। আম্মার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে দেখা যাবে সত্যিটা সে বলে ফেলছে। সত্যি বলা যাবে না। করিম সাহেব কখন না জানি রেগে বলে বসে জরিনা আপনি মস্তবড় অপরাধ করেছেন সেই সুবাধে সেগুন-বাগিচায় আসুন। সুজানা তো ওখানে ভুলেও কভু যাবে না। একবার গিয়ে যা ধরা খেল।
__________________
ফ্রেশ হয়ে নীচে আসতেই অভিক বাবাকে দেখলো। উনি বাড়িতে প্রবেশ করেই ছেলেকে দেখে বললেন
তুমি তো ফাটিয়ে দিয়েছ অভি। তোমার মা ফোনে ছেলের এমন প্রশংসা করছে আমি না এসে থাকতে পারলাম না।
অভিক হাসলো। টি টেবিলে রাখা জগ গ্লাস হাতে নিয়ে পানি ঢালতে ঢালতে বলল
মায়েদের প্রথম কাজ এটাই।
কিন্তু আমার একটা কনফিউশান মাই সান।
বলে ফেলো।
তুমি আজ হঠাৎ বাজারে কেন গিয়েছ?
ইচ্ছে হলো তাই।
ইচ্ছেটা দারুণ। গুড জব।
থ্যাংকস বাবা।
ছেলের পিঠ চাপড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন আজীম সাহেব।
অভিক দাদুর পাশে সোফায় গা এলিয়ে বসলো। উনি নাতিকে দেখে ছেলে বউকে ডাক দিয়ে বললেন
ছোট বৌমা আমার ভাইকে কিছু খেতে দাও। কত কস্ট করে বাজার করে আনলো।
বলেই বৃদ্ধা হাসলেন। অভিকও হাসলো। ভুরু কুঁচকে বৃদ্ধার চুলে বিচরণ করে বলল
সাদা দেখা যাচ্ছে কয়েকটা।
মেহেদী লাগিয়ে নেব ভাই। আজ তো রোজায় ছিলাম। তাই দেয়নি।
গুড।
মর্জিনা চা কপি নিয়ে আসলো। টি টেবিলে রাখতে রাখতে বলল
চায়ের লগে কফি বানানোটা আমার বহুত ঝামেলা লাগে বাবু। বউ কখন আনবা? তোমার বউ আইলে কফি বানোনটা তার উপর চাপায় দিমু।
অভিক কফির মগে হাতে তুলে চুমুক বসিয়ে বলল
কফি তো মা বানিয়েছে।
মর্জিনা চোখ কপালে তুলে চাইলো।
ত-ত-তো কিতা হয়ছে? সব তো আমি যোগাড় কইরা দিছি। শুধু দুধ ঢালি নাড়া ছাড়া কিছু করেনাই আপনার মা।
সালমা বেগম নাশতা নিয়ে হাজির হলেন। বললেন
হ্যা সব কাজ তুমিই করো। আমরা সবাই বসে বসে খাই। মা নাশতা খেতে পারেন । ইফতার তো অল্প খেলেন। অভি খেয়ে নে।
সালমা বেগম চলেই যাচ্ছিলেন। অভিক ডেকে বলল
মা!
সালমা বেগম ফিরে চাইলেন। অভিক মগ দেখিয়ে বলল
লাভ।
বউ আন আগে। তারপর লাভ ডাভ বলিস। এসব বলে আমাকে খুশি করাতে পারবি না অভি।
অভিক হেসে উঠলো। বৃদ্ধা ও যোগ দিলেন। হাসতে হাসতে বললেন
মা ঠিকই বলেছে ভাই। বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। কবে বিয়ে করবে?
কে জানে?
যখন ছোট ছিলাম তখন মা বলতো অভি পড় পড়। যখন একটু বড় হলাম বাবা বলতো অভি এব্রোড স্টাডি । যখন এব্রোডে গেলাম ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার। আর যখন ক্যারিয়ারের ঝামেলা চুকলো এখন আবার বউ বউ বিয়ে বিয়ে। মনে হচ্ছে অন্যসব ঝামেলা থেকে এটার ঝামেলা বেশি। মানে বিয়ে যাকে করব তাকে তো থাকতে হবে নাকি?
কি বলো দাদুভাই? সে নেই?
অভিক ফিসফিস করে বলল
আছে আছে। ঘুমাচ্ছে। জাগিয়ে তুলতে হবে।
সে আর কখন দাদুভাই? কবরে যাওয়ার আগে তার মুখখানা দেখে যেতে চায়।
ভাববার বিষয়। বলছি যে বিয়ের পর আবার কি নিয়ে সবাই ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করবে? প্রস্তুত থাকতাম এই আর কি?
বৃদ্ধা হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন
বিয়ের পর সবাই বলবে বাচ্চা নাও বাচ্চা নাও।
ও মাই আল্লাহ! ডেঞ্জারাস ব্যাপার স্যাপার। এটা তো রীতিমতো একটা আতঙ্কের বিষয়। এখন আমাকে ফেস করতে হচ্ছে তখন জরিনাকেও ফেস করতে হবে।
বৃদ্ধা হাসার জন্য কথা বলতে পারলেন না। শাড়ির আঁচলে চোখ চেপে বললেন
জরিনাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না দাদুভাই। আগে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দাও।
আমার সাথেই তো পরিচিত হয়নি।
কি বলো?
হুমম।
যাহ বিশ্বাস হচ্ছে না।
পরিচিত হয়নি ওইভাবে। কারণ সেগুন বাগিচায় আর দেখা হয়নি। অন্যভাবে পরিচিত হওয়ার একটা ব্যাপার স্যাপার তো আছে নাকি।
আচ্ছা! বুঝেছি। তার নামটা যদি একটু বলে দিতে।
জরিনা।
আসল নামটা বলো দাদু ভাই। নাকি আমি বলব?
অভিক মৃদু হাসলো। বৃদ্ধাও হাসলো। বললো, আমি ইন্ডিয়া থেকে আসার প্রথম দিন বুঝেছিলাম আমার ভাই ফেঁসে গিয়েছে।
হাহ এটা মোটেও খুশির খবর নয়। এটা খুব যাতনার বিষয়।
আহারে! আমার তাকে দেখার খুব ইচ্ছে জেগেছে। কোনো কারণ দেখিয়ে নিয়ে আসতে পারো কিনা দেখো তো। এবার নাতবউ হিসেবে একটু মনভরে দেখব। আহ দেখলেই কলিজা জুড়িয়ে যায়।
কার?
আমার। সাথে অন্য কারো কিছু জুড়িয়ে গেলে আমার কি করার?
অভিক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কবে যে একটু বড়সড় হবে সুজানা। ধরে ধরে পড়া শেখাতে ভালো লাগে। প্রেম নয়।
কিছুক্ষণের মধ্যে আজীম সাহেবও যোগ দিলেন সেখানে। বাচ্চারাও চলে এল টিচার চলে যাওয়ায়। অভিকের কোলে গিয়ে উঠলো একজন। অন্যজন অভিকের পিঠের পেছনে। পিঠ কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল
অভি অভি চা খাইচো?
অভিক হেসে টুপটাপ আদর বসিয়ে বলল
ইয়েসসস। আপনাদের চা আসছে।
অনা গলা জড়িয়ে ধরে বলল
অভি অভি সুজান কেক খাবো।
সুজানের পরীক্ষা সামনে। এখন ডিস্টার্ব করা যাবে না।
বৃদ্ধা বললেন
এটা কিসের পরীক্ষা ভাই?
ফাইনাল।
আজীম সাহেব বললেন
ফাইনাল? তারমানে সুজানা ফাইনাল ইয়ারে যাচ্ছে। আশিকের কি ওরজন্য আরও একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে?
অভিক নির্মল চোখে তাকালো। বৃদ্ধা হালকা ধমকে
বললেন
বাবা হয়ে মশকরা করছিস ছোট খোকা?
সালমা বেগম এসে সামনে চায়ের ট্রে রাখতেই উনি বেশ গম্ভীরমুখে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিলেন। অভিককে লক্ষ্য করে বললেন,
তোমার উচিত একটা দিনও অপেক্ষা না করা।
সালমা বেগম কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন। আজীম সাহেব বলে উঠলেন
যদি না সুজানার অমত না থাকে।
সালমা বেগম বললেন
অমত? অমত থাকবে কেন? আমার ছেলে কি ফেলনা? সুজানার অত স্পর্ধা হয়নি যে আমার ছেলেকে ফেরাবে।
আস্তে বলো সালমা। বড় আপাদের কানে গেলে কি হবে?
কি আর হবে?
কি হবে না সেটা বলো।
অভিক উঠে গেল।
বৃদ্ধা বললেন,
দিলি তো ভাইটার মন খারাপ করে।
আজীম সাহেবে ছেলেকে ডেকে বললেন,
অভি মন খারাপ হয়েছে?
অভিক যেতে যেতে মাথা দুলালো এপাশ-ওপাশ।
সালমা বেগম বললেন
অভি দাঁড়া। কথা আছে।
পেছনে ফিরে বললেন
সুজানা যদি “না” বলে ওকে আমি ছাড়ব না কিন্তু।
অভিক ঘরের দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপ খুলে বসলো। সালমা বেগম ধুপধাপ দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল
অভি অভি দরজা খোল। তুই এরকম করলে আমার ভালো লাগেনা বাবা। অভি?
অভিক সাথে সাথেই দরজা খুললো। বলল,
কাজ আছে মা। নাথিং সিরিয়াস।
তুই তোর বাবার কথায় কষ্ট পেয়েছিস? সত্যিই তো বলেছে কেন তুই সুজানাকে কিছু বলছিস না। আমাদেরও বলতে দিচ্ছিস না।
মা আমার কারো সাথে কম্পিটিশন করতে ভালো লাগে না। তাও নিজের একান্ত ব্যাপার স্যাপার নিয়ে। বিষয়টা এতটাও হালকা না যে যাকে আমি পছন্দ করলাম তার অন্য দিকে ঝোঁক আছে। তার ঝোঁক-রোগ সব আমাকে ঘিরে। আমি এটাই বিশ্বাস করি।
সালমা বেগম হাসলেন ঠোঁট ছড়িয়ে। বললেন,
তাহলে, সুজানার মাকে আমি বলি?
বলা হয়ে যাবে মা।
কবে অভি?
সুজানার পরীক্ষার পর। পরীক্ষাটা শেষ হোক। আমি চাই না সুজানার সবকিছুতে আমার প্রভাব পড়ুক। সবার নিজের একান্ত একটা পৃথিবী থাকা উচিত যেখানে নিজের ইচ্ছের মূল্য আছে। সুজানা এখন পড়াশোনা আর ফ্যামিলি নিয়ে লড়াই করছে। আমার উচিত পেছন থেকে তাকে সাপোর্ট করা। যে হবে সে একযুগ পর হলেও আমার কাছে আসবে। সবশেষে আমি সুজানাকে হ্যাপী দেখতে চাই। দ্যাটস ইট।
তুই আমার সোনা ছেলে। সুজানা নিজেই জানেনা ও কতটা ভাগ্যবতী।
এবার বলো বাপের মতো হয়েছি।
সালমা বেগম লজ্জামুখে হাসলেন। বললেন,
হুহ, একদম বাপের মতো।
আমিও বাবার মতো হতে চাই মা। যাতে সুজানাও একদিন এই হাসিটা হাসতে পারে।
পাঁচ আঙুলের মাথায় চুমু খেয়ে ছেলের মুখে ছুঁয়ে দিয়ে উনি বললেন,
তুই ভালো থাক সোনা। তোর একটা সোনার সংসার হোক।
অভিক হাসলো।
কিছুদিন পূর্বেই যে স্বপ্নটা দেখেছিল অভিক। সেগুন বাগিচার পাশেই লালদিঘিটা। সেই লালদিঘিতে সোনার নৌকা আর রূপোর বৈঠায় করে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে সে আর সুজানা। এটা তো সুজানাকে বলা হয়নি।
সোনার নৌকা আর রূপোর বৈঠা না হোক ছোটখাটো ছইয়ের নৌকো আর সেগুন কাঠের বৈঠা না হয় তাদের প্রিয় প্রহরের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে। ক্ষতি কি?
অতঃপর…
সুজানার পরীক্ষা শেষ হতে হতে তিনটা মাস লেগে গেল !!!!
বাকি গল্পটা সেই তিনটা মাস পর।
চলবে………