#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৩৭
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
সুজানা দ্রুত শোয়া থেকে উঠে পড়লো। ট্র্যাকস্যুটটা পেছনে লুকিয়ে বলল
করিম?
সাজিয়া বেগম সরু চোখে চেয়ে বললেন
হ্যা।
সুজানা ট্র্যাকস্যুটটা নিয়ে ওয়ারড্রবে খুলতে খুলতে বলল
অতকিছু ভেবে সেভ করিনি আম্মা। মাঝেমাঝে অদ্ভুত প্রশ্ন করো তুমি।
করিমের বাড়ি তো ষোল শহরেই। তাহলে ও বাকিদের সাথে থাকে না কেন?
কাদের সাথে?
আহিরদের সাথে?
ওদের সাথে তোমার দেখা হয়েছে?
হ্যা। সাথে ওই স্যারটাও ছিল।
কোন স্যার?
নামটা ভুলে গিয়েছি। যেই বাড়িতে পড়াতে যেতি।
অভিক স্যার?
হ্যা হ্যা।
সুজানা ঢোক গিলে বলল
তুমি কথা বলার সময় উনিও পাশে ছিল?
থাকলে কি হবে?
না আম্মা এমনি জিজ্ঞেস করছি। আচ্ছা আমি চা বসায় গিয়ে।
সুজানা চলে গেল। সাজিয়া বেগম বালিশের উপর থেকে ফোন নিয়ে ‘এ’ দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা ঠুকে নিলেন নিজের ফোনে।
_____________
নবকুঠিরের গেইট পার হয়ে উঠোনে প্রবেশ করলো গাড়িটা। সদর দরজার বাইরে ইতোমধ্যে বাড়ির সব সদস্য দাঁড়ানো। মালী গামছা কাঁধে দৌড় দিল গাড়ির কাছে। বাচ্চারাও উনার পিছু। মমতাজ বেগম খুশিতে আত্মহারা। অনেকগুলো বছর পর একমাত্র বাপের ভিটায় পা রাখছে উনার মেয়েটা । অভিক আর আহনাফ গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে । গাড়ির দরজা খুলতেই বেরিয়ে এল একজন পৌঢ় মহিলা। একজনের কোলে বাচ্চা। অন্যজন যুবতী। অন্য দুজন পুরুষ মানুষ। একজন অভিকের ফুপা অন্যজন ফুপাতো ভাই সিজান।
বাচ্চার মায়ের কোল থেকে বাচ্চাটা কেড়ে নিয়ে ইতোমধ্যে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছে মর্জিনা। সবাই সবাইকে দেখে খুশিতে আত্মহারা। একে অপরের সাথে বহুদিনের এই দূরত্ব কাটিয়ে কয়েক মিনিটের গল্পসল্প সেই দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় চুকে গেল।
সবার সাথে ভালো কুশলাদি বিনিময় করা শেষে অভিকের চোখ গেল গাড়ির ভেতর। সেখানে বসা যুবতী মেয়েটা মাথা এলিয়ে বসে আছে। অভিক দরজা খুলে মাথা নামিয়ে বলল
গাড়িতে আরও চড়ার শখ?
মেয়েটা ফিরে চাইলো। চোখমুখ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অবসন্ন গলায় বলল
এখানে যে কেউ বসে আছে সেটা এতক্ষণ পর কারো চোখে পড়লো।
অভিক হেসে বলল
ইঁদুরের মতো ঘাপটি মেরে বসে থাকলে সবাই দেখবে কি করে?
আমি ইঁদুর? হাউ ডেয়ার ইউ? তুমি আমাকে ইঁদুর বললে?
সবাই তাদের দিকে ফিরে তাকালো।
কি হচ্ছে জিনি? আসামাত্রই ঝগড়া। বড়জনদের যে সালাম করতে হয় সেটা জানোনা? আজব!
মায়ের ডাকে জিনিয়া জবুথুবু হয়ে গেল।
সালমা বেগম বললেন
অভি মেয়েটাকে আসামাত্রই পঁচানো শুরু করে দিয়েছিস?
আমি এখন ভিডিও কলে নেই ছোট মামী। চুল ছিঁড়ে নেব একটা একটা।
সবাই হেসে উঠলো। জিনিয়া গাড়ি থেকে নেমে বলল
কোমরটা ব্যাথা হয়ে গেল বসতে বসতে। নীচু হতেই সালমা বেগম আটকে বলল
থাক নীচু হয়ে সালাম করতে হবে না। অনেকদিন বেঁচে থাকো।
মমতাজ বেগম বললেন
এই দেখ আমার বোনটাও বড় হয়ে গেল চোখের পলকে।
হাহ, বাদ দাও আমার কথা । তোমার ছোট নাতির চুল সাদা হতে যাচ্ছে এখনো বিয়ে করাতে পারোনি আবার আমাকে নিয়ে টানাটানি লাগিয়েছ?
অভিক চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল
আমার চুল সাদা?
ভাগ্যিস সাদা হয়েছে টাক হয়নি এই বেশি।
সবাই হেসে উঠলো। অভিক চুলে হাত বুলাতে বুলাতে হেসে আওড়ালো।
সো স্যাড। সুজানা শেষমেশ বুড়ো বর পাবে।
******
সবাই জার্নি করে আসায় বিশ্রাম নিচ্ছে। কিছুপরেই অভিকের বন্ধু নাহিদের পরিবার এল নতুন বউ নিয়ে দাওয়াত খেতে। পুরো বাড়িটা জমে উঠেছে। অভিক কিছুক্ষণ পর পর ফোন চেক করছে। যদি হুট করে একটা মেসেজ এসে বসে যেখানে লেখা থাকবে কাল সেগুনবাগিচায় সে আসছে। মেয়েটা তাকে ভীষণ জ্বালায় রেখেছে।
ওদিকে গালের লাল-কালো ব্রণের দাগ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সুজানার এখনো নীল শাড়ি যোগাড় করা হয়নি। সে কিভাবে ওই পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে ভেবে পেল না। তাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে নাকানিচুবানি না খাওয়ালে লোকটার শান্তি হচ্ছে না। এদিকে আম্মাকে কি বলে ম্যানেজ করাবে?
*****
সবার খাওয়াদাওয়া আর গল্পে অনেক সময় কেটে গেল। আনজুমা বেগম সবাইকে খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিল। অনা আবিদ নতুন ছোট একটা বেবি পেয়ে মহাখুশি।
জিনিয়া ভাইয়ের বউ তানিয়া আর নাহিদের বউ আছমার সাথে গল্প জুড়েছে সেই আসার পর থেকে। গল্পের এক ফাঁকে অভিককে ডেকে বলল
ব্রো এইখানে আরও একটা বউয়ের অভাব। আরেকটা হলে খাপে খাপ।
অভিক বলল,
আরেহ রাখো । সারাক্ষণ বউ আর বউ। এমনিতে যন্ত্রণার শেষ নেই।
কে জ্বালাচ্ছে তোমাকে? তোমার কপালে বজ্জাত বউ জুটবে। দেখো। হুম।
অভিক হেসে অন্যপথে হাঁটা ধরলো। মোটেওনা। সুজানা তো ভারী মিষ্টি!
সালমা বেগম এসে বলল
তোমরা থাকতেই ওর বউ নিয়ে আসব।
জিনিয়া চোখ কপালে তুলে চাইলো। বলল
সত্যি?
হুম।
আনিকা এসে সেখানে যোগ দিয়ে বলল
ছোটমা এত কনফিডেন্স কি করে?
জেনে যাবে।
কি লুকচ্ছ জানিনা বাপু।
কিছু লুকচ্ছি না। সময়মতো সব জেনে যাবে বউ।
নিজের ছেলের বউ পেলে আমাকে আদরের ভাগ কম দেবে না তো?
সালমা বেগম ওর থুঁতনি ছুঁয়ে বলল
আমার দুটো ছেলে। দুটো বউ। তোর আদরে কোনোদিনও কম পড়বে না। তুই বড় তাই তোর আদর আরও বেশি।
আনিকা হাসলো।
*******
ঠিক তার পরের দিন। রোদে পুড়ে গেল আর বৃষ্টি ভিজে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরলো সুজানা। গতরাতেই মেহুলকে ফোন করে বলে দিয়েছে যাতে ভার্সিটিতে আসার সময় নীল শাড়িটা নিয়ে আসে। সে ব্যাগে করে শাড়ি নিয়ে এসেছে। শান্তা সাদা ফুল। বান্ধবীদের সাথে সবকিছু শেয়ার না করলে নিজেই সাহস পায় না সুজানা। তার বন্ধুগুলোর সাথে আত্মিক সম্পর্কটা খুবই মজবুত।
মাস্টারমশাইকে ও আজ আশেপাশে কোথাও দেখতে পায়নি। ভালো হয়েছে আসেনি। সুজানা তে দূর থেকে দেখলে লজ্জা ম*রতে ম*রতে বাঁচে। উফ কি করে যে সামনে গিয়ে দাঁড়াবে!
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে বসে বসে হাত রাঙিয়েছে সে কলমের ঝুড়িতে পড়ে থাকা মেহেদীটা দিয়ে। গত বছর ঈদের সময় কিনেছে। আরেক ঈদ এসেই পড়লো সামনে। এত ছোটাছুটির ভীড়ে নিজের জন্য সময় খুঁজে বের করাটা দারুণ কঠিন।
মা তখন থেকেই সবকিছু সূক্ষ্ম নজরে পরখ করে যাচ্ছে। একটা প্রশ্নও করেনি। মেয়ে বড় হওয়ার পর থেকে মেয়েকে জেরা করার ধরণটা বদলেছেন শুধু, জেরা করাটা কমাননি তাই ইনিয়েবিনিয়ে জানতে চাইলেন,
আজ অফিসে কোনো অনুষ্ঠান?
সুজানা বাম হাত মেহেদীতে রাঙিয়ে বললেন
হুমম। আজ বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাব। একটা দিন।
কখন ফিরবি?
বেরোবোই তো সন্ধ্যায়।
সন্ধ্যায় কেউ ঘুরতে যায়?
খুব তাড়াতাড়ি ফিরব আম্মা।
ঠিক আছে।
_________
বৃষ্টিভেজা শেষ বিকেলে লাল দিঘীর পাড়ে গিয়ে অভিক দেখলো সেগুন কাঠের টুলে অসংখ্য ভেজা পাতা লেপ্টে আছে। শেষ বিকেলের পাখিরা ক্লান্তদেহে নীড়ে ফিরছে। বৃষ্টি থামার পরেই আবার রোদ উঠেছে। সেই রোদ বিসর্জনের পূর্বেই পুব আকাশটাকে থমথমে গাঢ় লাল রঙে ছেয়ে দিয়েছে। অভিক টুলের পাতাগুলো ঝেড়ে বসলো চুপচাপ। এক সেকেন্ড এক মিনিট এক ঘন্টা তারপর দু ঘন্টা পার হওয়ার পর নীল শাড়িতে মুড়িয়ে এল সুজানা চুপিসারে হেঁটে । সে দেখলো সেগুন কাঠের টুলে চুপচাপ বসে দিঘীর পানিতে ঢিল ছুঁড়ছে অভিক।
কাছাকাছি যেতেই আপাদমস্তক কেঁপে উঠলো তার সারা শরীর। বুকের ভেতর অদ্ভুত দুন্দুভিধ্বনি টের পেল। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে এল তার। অভিক ফিরছে মনে হতেই পিছু ফিরে গেল সে। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইলো শাঁড়ির আঁচল চেপে ধরে। পেছন থেকে গলা খাঁকারি ভেসে এল। তারপর গলার স্বরটি আরও নিকটে এল। কানে এল
আজও কি কারো বিয়ে ভাঙতে এসেছেন ?
চলবে…….