#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৫২
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
বাইরে রোদ উঠেছে। বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙেছে সেই কাক ডাকা ভোরে। নামাজ কালাম শেষে সবাই কাজে লেগে পড়েছিল । আজকে সুজানার বাপের বাড়ির সবাই আসবে। বাড়িতে মেহমান নেহাত কম নয়।
সকাল সকাল বাড়ি পরিষ্কারের লোকজনও চলে এসেছে। গত দুদিনে বাড়িটা ফুলের পাঁপড়ি আর ধুলোবালিতে যা অবস্থা হয়ে গিয়েছে।
নতুন বউ ঘুম থেকে উঠেছে কিনা তা দেখার জন্য আনিকা বাচ্চা দুটোকে বলেছে ডেকে দিতে। তাদের বলতে দেরী ওই ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে তাদের দেরী নেই।
দুজনেই সর্বশক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কাধাক্কি করতে করতে ডাকলো
সুজান দজজা খুলো। অভি দজজা খুলো। তাতারি খুলো।
তাদের ডাকাডাকির চোটে অভিকের চোখ ছুটে গেল। চোখ ঢলে হাত ঝেড়ে দুচোখ খুলতেই ব্যালকণির ওপাশের মিষ্টি রোদের উপস্থিতি টের পেল সে। দুজনেই ফজরের নামাজ শেষ করে শুয়েছে। তারমধ্যে বেলা গড়িয়ে গেছে। সে ঘড়ি দেখলো। সোয়া আটটা বাজে।
দরজা অনবরত ধাক্কাধাক্কি চলছে।
অভিক উঠে বসবে তখনি টের পেল তার বুকের কাছের শার্ট হাতের মুঠোয় নিয়ে সেখানটায় মুখ গুঁজে চুপচাপ ঘুমোচ্ছে সুজানা।
সে ঘুমন্ত নারীটিকে দেখে হাসলো। এই নারী আগে তার ঘুমের রাজ্যে থাকতো আর আজ বুকের সাথে লেগে ঘুমিয়ে আছে। সে মৃদু হেসে সুজানার হাত থেকে শার্ট ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। দেখলো এভাবে সম্ভব না। এমনি ধরতে চায় না, আর ধরলে ছাড়তে চায় না।
ওদিকে বাচ্চাদের চেঁচামেচিতে অবস্থা তখন তুঙ্গে। এখন দরজা না খুললে পুরো বাড়ির লোকজন জড়ো করতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না।
অনেক্ষণ পর সুজানার নড়েচড়ে উঠলো। অভিক ডাকলো
সু-জা-না।
সুজানা হু শব্দ করলো।
অভিক হেসে বলল
আপনার স্টুডেন্টরা যা তা শুরু করে দিয়েছে। পাজি দুটোকে ঘরে আনি।
হুমম।
অভিক তাকে ব্যঙ্গ করে বলল
হুমম।
ওদিকে আবিদ চেঁচিয়ে বলল
অভি সুজানকে ঘরে বাঁধি রাখছো কেন? তাতাড়ি দজজা খুলো।
অভিক হেসে উঠলো।
কি আজব কথা! আমি সুজানকে বেঁধে রেখেছি? আমার ইজ্জৎ সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে সুজানা।
সুজানা বলল
হু।
অভিক উপায়ান্তর না দেখে নিজে পাশ ফিরে সুজানার উপর ঝুঁকে নাকে নাক মিলিয়ে বলল
ম্যাডাম।
সুজানা নড়েচড়ে উঠে নাক ঘষা দিয়ে হাত পা টানা দিয়ে বলল
উম ।
তারপর চোখ খোলার সাথে সাথে অভিককে এত কাছে দেখে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো। অভিক শাড়ির আঁচল টেনে দিয়ে মিচকে হেসে বলল
আমি নির্দোষ।
সুজানার ঘুম ঘুম চোখে মুখে লাজুক ভাব। সে খামচে ধরা অভিকের শার্টের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিল। অভিক সেখানটাই তাকিয়ে বলল
ওভাবে না ধরলেও কোথাও ছেড়ে যাব না।
সুজানা একটুখানি হেসে কথা ঘুরিয়ে নীচু স্বরে বলল
বাচ্চারা চেঁচামেচি করছে কেন?
অভিক বলল
মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
সুজানা মনোযোগ দিতেই শুনতে পেল দুজনের গলা।
অভি সুজানকে বাঁধি রাখছ কেন? দজজা খুলো।
সুজানা খিক করে হেসে উঠলো। অভিকও হাসলো।
পিঠের নীচে হাত গলিয়ে সুজানার বাম গালের সাথে তার ডান পাশটা মিলিয়ে কানে কানে বলল
আজ আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই চাই।
তারপর মুখ তুলে সুজানার উত্তরের অপেক্ষায় রইলো কপাল কুঁচকে। দু তিন ইঞ্চির দূরত্বে থাকা মায়াবী মুখটা তখনও কিছু ভাবনায় মত্ত।
ভাবা শেষ হতেই মিষ্টি হাসলো সুজানা । বলল
আজ দেব।
সত্যি?
তিনটা।
দুজনেই একসাথে হাসলো।
নরম গালে ছোট ছোট ধারালো দাঁড়িগুলো আরও একবার আঁচড় কাটলো সাথে ঠোঁটের বলিষ্ঠ দংশনে সুজানা শাড়ির আঁচলে মুখ লুকোলো।
অভি উঠে গিয়ে দরজা খুললো।
দরজা খুলতেই দেখলো অনা আবিদ কোমড়ে হাত রেখে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনা ঘরে ঢুকেই সুজানার কাছে ছুটলো। আবিদ শুরুতেই অভিকের পায়ে কামড় দেয়ার চেষ্টা করে বলল
সুজানকে বাধি রাখছো কেন?
অভিক হো হো শব্দে হেসে উঠে দৌড় দিল। চাচা ভাইপোর ছোটাছুটি দেখে কে।
অভিক সুজানার পাশে এসে বসে বললো
সুজানা দেখুন আপনার ছাত্র আমাকে কামড় দিতে চাচ্ছে।
আবিদ বিছানায় উঠে অভিকের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার আগেই সুজানা টেনে এনে কোলে বসালো। বলল
দুষ্টুমি হচ্ছে?
অনা বলল
সুজান সুজান চা খেতে আসো। দাদু ডাকে।
অভিক বলল
নতুন বউয়ের জন্য চা নিয়ে আসুন । যান।
সুজান যাবে।
না যাবে না। সুজান তো নতুন বউ। নতুন বউ ওখানে যায় না। যান।
যাবেনা কেন? সুজান আসো। অভি তুমিও আসো।
নো ওয়ে আম্মিজান। চলুন আমরা যাই। সুজানের জন্য চা নিয়ে আসি।
সুজানা বলল
আমি যাই। না গেলে খারাপ দেখাবে না?
এখন না। জিনিদের পাঠাচ্ছি। ওরা রেডি করে দিক।
সুজানা মাথা নাড়ালো। অভিক বেরিয়েই যাচ্ছিলো দুজনকে নিয়ে। সুজানা ডেকে বলল
আমার ফোনটা দেখি বন্ধ হয়ে আছে। আপনার ফোনটা দেবেন? আম্মাকে ফোন দেব।
বালিশের উপরেই আছে।
সুজানা ওদিকে তাকালো।
খুশিমনে বলল
আনলকড?
হুমম।
সব দেখে নেব আজ।
অভিক হেসে মাথা চুলকে বলল
আমি যে জনেতে আসক্ত সে ছাড়া আর কিচ্ছু নেই ওখানে।
সুজানা মিষ্টি হাসলো।
___
অভিক নীচে এসে দেখলো নাশতার টেবিল সাজানো। তাকে দেখে সবাই চোখ তুলে তাকালো। প্রশ্ন ছুটে এল
বউ উঠেছে?
অভিক মাথা দুলালো। বলল
এদের পাঠিয়েছ? আহ অবস্থা বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। কার মতো এত পাজি হয়েছে?
সবাই হাসলো। মামী বললেন
কিন্তু তুমি বউ ছাড়া এলে কেন? ও কি নাশতা পানি খাবে না। বউ খাবে বলেই তো এত আয়োজন।
জিনি নিয়ে এসো তো।
ফুপী বলে উঠলেন
আরেহ তুই গিয়ে নিয়ে আয়। বউ সাথে নিয়ে খেতে আসবি এটা শিখিয়ে দিতে হয়? আজব ছেলে হয়েছিস তুই।
তাহলে যেতেই হচ্ছে।
__________
সুজানা চুলে তিনবার চিরুনি চালালো। তখনি ফোনটা তুললো ওপাশে কেউ একজন। সাথে সাথেই মায়ের গলা ভেসে এল
ভালো আছিস আমার সোনা? ওদিকে সবকিছু ঠিক আছে? চা নাশতা খেয়েছিস? আমি তোর ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।
সুজানার গলা বুঁজে এল। মিনমিন সুরে জানতে চাইলো
তুমি ভালো আছ আম্মা?
ওপাশ থেকে তৎক্ষনাৎ উত্তর এল না। এল তার কিয়ৎক্ষণ পর।
আছি।
মায়ের গলা কেমন যেন শোনালো। সুজানা জানে এই সামান্য দূরত্বটাও কত দূরত্ব তাদের মা মেয়ের জন্য। তার এই অল্প সময়ের শূণ্যতায় মায়ের কতখানি পুড়ছে।
সে বুঁজে আসা গলায় জানতে চাইলো।
কবে আসবে আম্মা? তাড়াতাড়ি চলে এসো।
হ্যা আসব। জামাই কোথায়?
উনি নীচে। সবাইকে নিয়ে এসো কেমন।
আচ্ছা। কিছু খাসনি এখনো?
খাব এখন। মাত্রই উঠেছি। তুমি খেয়েছ?
হ্যা খেয়েছি। আচ্ছা রাখি এখন। অনেক কাজ পড়ে আছে।
আচ্ছা।
ফোনটা কেটে গেল টুট টুট শব্দে।
ফোনটা রেখে থম মেরে বসে রইলো সে। অভিক দরজা ঠেলে ঘরে পা রাখতেই সুজানাকে ওভাবে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে থাকতে দেখে ভড়কালো।
ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে হেয়ার ড্রায়ারটা খুঁজে নিয়ে সুজানার চুলে দিতেই চুল সব উড়ে মুখের উপর জটলা পাকালো। সে দাঁড়িয়ে পড়ে অভিকের দিকে ফিরলো। অভিক তাকে আয়নার দিকে ফিরিয়ে বলল
এখন দেখি আপনাকে সাজিয়েগুছিয়ে দেয়ার দায়িত্বও আমার।
সুজানা চুল শুকিয়ে আসতেই সে নিজের চুলে শুকোলো। সুজানা এলোমেলো চুলগুলো গুছাতে গুছাতে অভিকের কান্ড দেখে হাসলো।
অভিক ড্রায়ারটা রেখে তার চুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বলল
এখন শুকিয়ে গেছে। পারফেক্ট। বেঁধে দেব?
সুজানা মাথা দুলালো। অভিক খোপা বাঁধার চেষ্টা করলো। হতাশ হয়ে বলল
আমার দ্বারা হবে না মনে হচ্ছে।
সুজানা আয়নায় তাকে দেখে হাসছে।
তখন মুখ গোমড়া করে বসেছিলেন! শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে কথা বলেছিলেন নিশ্চয়ই।
সুজানার ঠোঁট থেকে হাসি সরলো। সামনে ফিরে বলল
হ্যা।
তাই বলে মুখ গোমড়া করতে হবে ম্যাডাম? আপনাকে মুখ গোমড়া করলে একদম মানায় না। একদম আমার বউয়ের মতো লাগে না।
সুজানা দুষ্টু গলায় বলল,
আচ্ছা! কার বউয়ের মতো লাগে?
অভিক প্রশ্নটা ভালো করে বুঝার চেষ্টা করলো। তারপর চোখ বড় বড় করে তাকাতেই সুজানা হেসে উঠে তার বুকে মাথা ঠেকালো। অভিক মাথাটা টেনে নিয়ে হেসে উঠে বলল
ওহ নো। শুধু এবং শুধুই আমার বউয়ের মতো লাগে।
________________
সুজানা নীচে যেতেই সবাই তার দিকে তাকালো। সে হালকা সেজেছে। সাজগোছ করে খাওয়াদাওয়া করতে আগ্রহ লাগেনা তার। সালমা বেগম, আনজুমা বেগম এসে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। দাদু ফিসফিস করে জানতে চাইলো
কি দিল?
সুজানা লজ্জিত হেসে মাথা নামিয়ে নিল।
এমা কিছুই দেয়নি? কত করে বললাম তাকে। দাঁড়াও একা পাই তাকে।
সুজানা নীচু গলায় বলল,
উনি দিতে চেয়েছিলেন আমি বারণ করেছি।
বারণ করেছ কেন?
আর কত উপহার নেব আমি? বেশি পেলে আবার হারিয়ে ফেলার ভয় হয়।
দাদু হাসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
আরেহ ওসব বর বউকে ভালোবেসে আদর করে দেয় ওই রাতে। আমার ভাইটা একদম বেকুব। যাইহোক আমার মিষ্টি নাতবৌ, মুখটা দেখলেই শান্তি লাগে আমার। চলো খেতে বসি।
সুজানা উনাকে ধরলো। বলল
আমি নিয়ে যাই আপনাকে।
সবাই একে একে চেয়ারে বসলো। জিনিয়া বলল
নতুন ভাবি ভাইয়াকে বলবেন আমাদের টাকা নিয়ে দিয়ে দিতে। কালকে ভয়ের চোটে আমরা চুপ ছিলাম। ওইতো এসেছে। বলেন।
সবাই অভিকের দিকে তাকালো। অভিক এসে চেয়ার টেনে বসলো।
কিসের টাকা? এত টাকা নিয়ে নেশা করবে নাকি?
জিনিয়া বলল
মামী দেখেছ?
সালমা বেগম বললেন
এসব কেমন কথা অভি? টাকা চায়ছে দিয়ে দিবি। ওরা পাঁচ ছয়জন। সবাইকে হিসেব করে টাকা দিয়ে দিবি। তোর বিয়েতে অনেক কাজ করেছে ওরা।
তরী সুজানাকে বলল
আপু তুমি তো কিছু বলো।
সুজানা কি বলবে বুঝে পেল না। অভিক আহনাফকে বলল
ভাই সবার জন্য ওই বুড়ো মতিন সাহেবকে ধরে আনলে হয় না? এদের শক্তি আছে। আছাড় মারলেই টাকা ঝড়বে।
আহনাফ বলল
একদম।
সিজানও সমর্থন জানালো।
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
জিনিয়া বলল
ছিঃ ছিঃ ওই বুড়ো মতিনের কথা বলছ?
হ্যা। সমস্যা কি? প্রচুর টাকা আছে। একসাথে সবাইকে পেলে খুশি হয়ে যাবে ও। ও বউ পাচ্ছে আর তোমরা টাকার গাছ। ভালো না?
সবাই আরেকদফা হেসে উঠলো।
দাদু বললেন
তোমরা রাগ করোনা তো বোন। আমার ভাই মজা করছে।
ওরা সবাই রেগেমেগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো। সুজানা অভিকের কথা শুনছিল মনোযোগ দিয়ে। ইশশ প্রথম দিন কত বেকুব না ভেবেছিল সে এই লোকটাকে।
অভিকও তাকাতেই সুজানা লজ্জা পেল। অভিক ভুরু নাচাতেই সুজানা দু’পাশে মাথা দুলালো।
কিছু না।
আজীম সাহেব বললেন
কি আজব ব্যাপার। সবাই মজা করছে। আর নতুন বউ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এত আয়োজন তার জন্যই তো নাকি?
আনিকা তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে অভিকের পাশে বসিয়ে দিল। বলল
নতুন বউ ঠিক আছে। এই বাড়িতে তো নতুন না। এত লজ্জা পান কেন বুঝিনা।
আজাদ সাহেব বললেন
তোরা কথা বলছিস। আর ও একা দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ভাবা উচিত নতুন মানুষ আছে আমাদের সাথে। এখন পুরো মনোযোগ তার উপর হওয়া উচিত না।
আনজুমা বেগম সুজানার প্লেটে নাশতা তুলে দিতে দিতে বললেন
ও কিছু মনে করবে না। ও চেনে জানে বুঝে এই বাড়ির সবাইকে। তাই না বৌমা?
সুজানা মাথা দুলালো। সে এই বাড়ির মেলবন্ধনগুলো দূরে দাঁড়িয়ে দেখতো তখন। এখন কাছে বসে দেখছে । এখন সেও তাদের একজন। এই মানুষগুলোর আপন হতে না পারলে অনেক বড় একটা অপূর্ণতা থেকে যেত তার জীবনে। আর পাশে বসা মানুষটাকে পেত না কথাটা ভাবতেও এখন দম বন্ধ বন্ধ লাগে। সব শান্তি যেন তার কাছে। সে আশেপাশে থাকলেই আনন্দগুলো ঘিরে ধরে রাখে তাকে।
এত হাসিখুশীর মাঝে মা ভাইকে মনে পড়লো তার। বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো। মাকে এখন সব কাজ নিজের হাতে করে খেতে হবে। এক কাপ চা করে খাওয়ানোর জন্যও মেয়েকে পাবে না।
তার খাবার উঠলো না মুখে।
যাও তুুললো চোখের টলমল জলগুলো নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা। ওপাশ থেকে দ্রুত পায়ে ছুটে আসলেন আনজুমা বেগম। কন্যাস্নেহে সুজানার মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন
আহা মেয়ে খাওয়ার সময় এরকম করে কেউ ?
সুজানার ফোঁপানি দেখে সালমা বেগমও উৎসুক হয়ে তাকালেন। বাকি সবাইও নীরব হয়ে গেল।
দাদু বললেন
এমা কি হলো?
আনজুমা বেগম সুজানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন
আর কি হবে? মা ভাইয়ের জন্য হয়ত মন কেমন করছে। অভি তোর শ্বাশুড়িকে ফোন দে দ্রুত। বল তার মেয়ে এখানে খেতে বসতে কান্নাকাটি করছে।
অভিক বলল
অলরেডি বলে দিয়েছি সুজানার চোখের পানিতে নবকুঠিরে বন্যা নেমেছে।
সবাই তার কথায় হেসে উঠলো। আনজুমা বেগম কান টেনে দিয়ে বললেন
ওর বউ কাঁদছে। আর ও মজা নিচ্ছে। পাজি ছেলে।
কাঁদার সুযোগ দেয়া যাবে না জেম্মা। নইলে তো বন্যার পানিতে ভাসতে হবে।
সবাই তার কথায় হাসছে। আর সুজানা অনুভব করলো তার ডান পা’টা নিজের দু পায়ের দখলে নিয়ে দোল খাচ্ছে অভিক। পুরো শরীর শিরশির করে কেঁপে উঠলো তার। সুজানা অদ্ভুত চোখে তাকালো। অভিক চুপচাপ খেতে খেতে মিচকে হাসলো।
সুজানার মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়াটা তার জন্য দু সেকেন্ডের ব্যাপার। সে মেয়েটাকে গত এক বছর ধরে আগাগোড়া চিনে নিয়েছে। এতটা চিনেছে যতটা চিনলে মেয়েটা দুঃখ পেলে তার মন কেমন করে। এই মন কেমন করাটাকে প্রথম দিকে সে স্নেহ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিল তারপর বুঝেছিল এটা শুধু ছাত্রীর প্রতি স্নেহ নয় বরং এটা খুব ভয়ংকর মায়া। যে মায়ায় আঁটকে গিয়েছিল সে। তারপর আর কভু মনে হয়নি এই মায়ার জাল থেকে তার নিস্তার পাওয়া উচিত। সে আঁটকে থেকেছে এবং আঁটকেছে সুজানাকেও।
____
বারোটার দিকে সুজানাদের বাড়ির সবাই এল। ওর চাচীরা চাচাতো ভাইবোন, ফুপু, আর ফুপাতো ভাইবোন, খালাতো ভাইবোন। দাদুও এল। যদিও উনি তেমন হাঁটাচলা করতে পারেন না। সরিষাবাড়ি থেকে নবকুঠির বেশিদূর নয় তাই উনাকেও নিয়ে এসেছেন সাজিয়া বেগম। সুজানা তখন ওর ঘরে ছিল। পার্লারের মেয়েগুলো তখন তার চুল বাঁধছিল। মা এসেছে শুনে তার ছটফটানি বেড়ে গিয়েছিল। পরে আনিকা সাজিয়া বেগমকে ওর ঘরে নিয়ে এসেছে। মা মেয়ের এক আবেগঘন মুহূর্ত কাটলো সেখানে। মেয়ের ঘর, নতুন সংসার দেখে মন ভরে গেল মায়ের। যাক এবার মরেও যেন শান্তি। অন্তত তিনি শান্তিতে থাকবেন এই ভেবে যে, এই বাড়িতে কোনোদিন ভাতের অভাব হলেও শান্তির অভাব হবেনা। উনার মেয়েকে ভালোবেসে আগলে রাখার মানুষের অভাব হবে না।
সাজিয়া বেগমের ডাক পড়ায় উনি ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পথে অভিকের সাথে দেখা মিললো। অভিক উনার সাথে দেখা করার জন্য ছুটে আসছিল। দেখা হয়ে যাওয়ায় সালাম করে বলল
মেয়েকে দেখার পর মন নিশ্চয়ই ভালো?
খুব। আমার জামাইরাজাটা ভালো আছে তো?
বন্যার পানি সেঁচে সেঁচে বেঁচে আছি।
আহারে আমি জানলে কলার ভেলা দিয়ে নৌকা বানিয়ে আনতাম। কত কষ্ট মাস্টারমশাইয়ের!
অভিক হাসলো মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে। বলল
মেয়ের কুঁড়েঘরটা দেখা হয়েছে?
দেখে নিয়েছি। সোনা ছেলের হাতে মেয়ে দিয়েছি না, তার কুঁড়েঘরটাও সোনার ঘর। সোনাই বাঁধা।
অভিক চমৎকার হাসলো। বলল
শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে আমার অদ্ভুত একটা কানেকশন আছে। এত ভাবের মিল হয় কি করে?
একদম। ওই যে বললাম আমার বাবা। করিমুল্লাহ সর্দার। আমি যেন আমার বাবাকেই দেখছি। যাকে আমি দুচোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারি। আস্থা রাখতে পারি। আমি জানি আমার পর সুজানা একদম সঠিক একজন অভিভাবক পেয়েছে। যে তাকে আগলে রাখবে।
এমন নিখাঁদ মনের মাতৃসম মানুষটার বিশ্বস্ত আর ভরসাস্থল হতে পেরে অভিকের গর্ব হলো। আনন্দ হলো।
সাজিয়া বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন।
আমার জামাই-রাজার হাজার বছর আয়ু হোক। নাতির ঘরে পুতি, আর পুতির ঘরের নাতি দেখার সৌভাগ্য হোক।
অভিক সশব্দে হেসে উঠলো। সাজিয়া বেগমও হাসলেন।
চলবে..
আর তিন চার পর্বে সুন্দর সমাপ্তি টানবো।