#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৫৪
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
বোনাস পর্ব ১
সুজানা লাইব্রেরিতে বসে বইয়ে মুখ গুঁজে বসেছিল। শান্তা আর মেহুল দপদপিয়ে দৌড়ে এসে পাশ ঘেঁষে বসলো। হাতের বোতলটা ধপ করে সুজানার সামনে রেখে বলল
সুজু আমাগো দুলাভাই সেরা একডা ছবি ফেসবুক আপলোড দিছে। দেখ দেখ।
সুজানা বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে মাথা তুললো। সামনের চুল কানে গুঁজে জানতে চাইলো,
কোন দুলাভাই?
মেহুল ফিক করে হেসে বলল
স্যারের কথা বলছে। স্যারের সামনে দুলাভাই ডাকতে পারবি?গাঁধী।
শান্তা বলল
কেন নয়?
সুজানা দু’পাশে মাথা নেড়ে বইয়ে মুখ গুঁজলো। সে দেখেছে ছবিগুলো।
শান্তা বলল
আরেহ দেখ। আমি কমেন্টও করে দিছি।
সুজানা উত্তর দিল।
তুই দেখ। আমি দেখেছি।
কচু দেখছোস। মাত্রই তো আপলোড দিল। চা বাগানে।
সুজানা উৎসুক হয়ে তাকালো। পরক্ষণেই কৌতূহল চাপিয়ে বলল
সিলেটের চা বাগানে।
মেহুল জানতে চাইলো।
সিলেটে? স্যার সত্যি সত্যি সাস্টে চলে গেল?
সুজানা মাথা দুলালো।
শান্তা কপাল চাপড়ে বলল
হায় আল্লাহ! আমরা তো কাল মজা হিসেবে নিয়েছিলাম। সত্যি সত্যি?
আজব! আমি মিথ্যে বলব তোদের?
আর কখনো এখানে আসবে না?
আমি জানিনা।
তুই এভাবে কথা বলছিস কেন? স্যারের উপর রাগটাগ করেছিস নাকি? শ্বশুরবাড়ি যাবি কখন?
এখনো জানিনা।
শান্তা কমেন্ট দেখতে দেখতে মাথা চাপড়ে বলল
সুজু দেখ লুচু মাইয়্যাগুলো কি কি কমেন্ট করতাছে।
ফোনটা সুজানার মুখের সামনে এনে ধরলো। বলল
স্যার নাকি বিয়ার পর গ্লো করতাছে।
সুজানা ফোনটা নীচে নামিয়ে রেখে বলল
এসব কি কথা! আস্তে বল। মানুষে শুনলে কি বলবে?
শান্তা ভেঙচি কেটে বলল
মানুষে শুধু আমার কথা শোনে। আর কারো কথা শুনতে পায় না।
মেহুল হেসে বলল
পাগল একটা। সুজু জানিস গতকালকে স্যার যে মেহেদীর হাত আপলোড দিল না ওইটার কমেন্ট বক্সে শান্ত পুরো ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে একটা মেয়ের সাথে। ওখানে আহির আর নিখিল গিয়ে আরও জোরে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিল মেয়েটার সাথে। মেয়েটা সম্ভবত একাউন্টটিং ডিপার্টমেন্টের হবে। হায় আল্লাহ যদি শান্তর আইডি চিনতে পারে তবে কি হবে আমি সেটাই ভাবছি।
শান্তা মুখ বেঁকিয়ে বলল
হারামি কি বলে জানিস। বলে আমাকে নাকি দেখে নেবে। আমি বললাম তোর চৌদ্দ গুষ্টিরে সহ সাথে নিয়ে আসিস আমারে দেখার জন্য।
সুজানা কপালে হাত দিল।
মেহুল হাসতে হাসতে বলল
স্যার একটু হলেও তো এসব নোটিশ করবে।
সুজানা বলল
হায় আল্লাহ! শান্তর আইডি উনি চেনে।
শান্তা বড়বড় চোখ করে তাকালো। ভয়াতুর গলায় বলল
যাহ কি বলিস?
হ্যা, আমি বলেছিলাম। মেহুলেরটা তোরটা নিহাতেরটা সবারটা চেনে।
আহিরদেরও?
সবার।
হারামি এগুলা দেখানোর কি ছিল?
মেহুল হাসতে হাসতে বলল
হে হে বান্ধবী। এবার যাবা কই?
শান্তা দুম করে সুজানার পিঠে কিল বসিয়ে বলল
তুই জানতি আমি কমেন্ট বক্সে গিয়া লুচি মাইয়্যাগুলোর উপর হামলা চালায় তারপরও আইডিটা চিনায় দিলি। আমার ইজ্জৎ সম্মান রাখলি না।
সুজানা হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই বাকিরা এসে পড়লো। আহির এক লাফে এসে মেহুলের পাশে বসলো। বলল
আবার কার ইজ্জত সম্মান খোয়ায় গেছে?
মেহুল বলল
শান্তর।
হাহ তার ইজ্জত সম্মান ঝড়ে ঝড়ে পড়তাছে যে খোয়ায় যাইবো।
শান্তা ধমক দিয়ে বলল
ফালতু কথা বলবি না আহিরের বাচ্চা। আমাদের কথায় তুই নাক গলাচ্ছিস কেন?
নিখিল বলল
আচ্ছা থাম।
সুজানা বলল
কথায় কথায় ঝগড়া লাগিয়ে দিস তোরা যেন মনে হয় কত জন্মের শত্রু।
আহির বলল
এরে হটা এখান থেকে। নাম শুধু শান্ত, কিন্তু আস্ত মানুষটাই অশান্তি।
শান্তা ফুঁসতে ফুঁসতে চটাস করে চড় বসালো আহিরের মাথায়। বলল
আমার নাম নিয়ে বিদ্রুপ করবি না আহিরের বাচ্চা।
আহির চড়টা ফিরিয়ে দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চোখ লাল করে বলল
আমারে আমার বাপ আর বাচ্চা বানানো বন্ধ কর।
আহিরের বাচ্চার মা এখনো দুনিয়ায় আসেনি আর তুই সারাক্ষণ আহিরের বাচ্চা আহিরের করোস কিল্লাই? যাহ ভাগ।
শান্তা মাথায় হাত দিয়ে বলল
আমি তোরে অত জোরে মারছি বেয়াদব? জীবনেও আমার সাথে কথা বলবি না আর। এই আমি যাচ্ছি তোরা থাক।
যাহ ফুট।
শান্তাকে হাত ধরে আটকে ফেলল সুজানা।
কি করছিস কি? এখন কোথায় যাবি? বোস। আহির এভাবে মারলি কেন?
আহির বলল
আরেহ আমারে আগে মারলো না?
নিখিল আহিরের পিঠে দুম করে মুঠি বসিয়ে বলল
অশান্তি শান্ত হ এইবার।
তুইও???
নিখিল কান টেনে ধরে বলল,
সরি আপা। ভুল হয়ি গেছে। কমা করি দেন। আর কমুনা। তওবা তওবা।
শান্তা ব্যাগ কোলে রেখে শান্ত হয়ে বসে আহিরের দিকে তীর্যক চোখে তাকালো। আহির শিঁষ বাজাতে বাজাতে চোখ উল্টে তাকালো।
শান্তা বলল
এই দেখ ও কেমন করছে।
সবাই একসাথে আহিরের উপর চটে উঠার আগেই জায়িন এল। বলল
আরেহ তোরা এখানে? আমি সবাইকে খুঁজতে খুঁজতে..
নিখিল কথা কেড়ে নিয়ে বলল
আরেহ কবি তুই নাকি ফার্স্ট ইয়ারের একটা ছেমড়িরে লইয়্যা কবিতা টবিতা লিখে উল্টায় ফালাইছোস।
সবাই হেসে উঠলো।
জায়িন সরলমুখে সুজানার পাশে গিয়ে বসলো। বলল
সারাক্ষণ শুধু পঁচানোর তালে থাকিস।
মেহুল বলল
কিরে বুদ্ধু সত্যি নাকি?
আরেহ না। নতুন ক্যাম্পাসে এসেছে তাই কিছু ইনফরমেশন জানতে চাচ্ছিলো। এরা কথা বলতে দেখেছে তাই কাল থেকে শুরু করে দিয়েছে।
সুজানা হাসতে হাসতে বলল
বেচারাকে ছাড় এবার।
নিখিল জায়িনের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল
আরেহ না সুজু। মাইয়্যাটার লগে হেব্বি মানায়ছে।
আচ্ছা যাক বাদ দিলাম। এখন কহ হানিমুনে কবে যাইতাছোস?
সুজানা জিরিয়ে তাকালো। বলল
হানিমুন? পাগল তোরা?
আরেহ বিয়া হয়ছে। হানিমুনে যাবি না? কি কস? আমাগো স্যাররে আনরোম্যান্টিক মনে হয় নাই।
যাহ ওসব কথা রাখ।
ঠিক আছে জানাইস। টিকিট কাইটা দিমু।
সুজানা হেসে উঠে বলল
কচু। শোন না গুড নিউজটা শুনেছিস?
কি আবার?
মেহুলের কাছ থেকে শোন।
সবার চোখ তখন মেহুলের দিকে। সে লাজুক মুখে বলল,
আরেহ আমি কি বলব?
শান্তা বলল
হুহ ঢং। বিয়ার কথা বলতে লজ্জা পাইতেছে।
আহির বলল
লজ্জা পাইবো না। তোর মতো বেশরম নাকি?
শান্তা ফুঁসে উঠতেই নিখিল থামিয়ে বল
এই থাম থাম। সাইফ ভাইয়ের চাকরি হয়ছে নাকি?
মেহুল সুজানার দিকে তাকালো। সুজানা মাথা দুলালো।
সবাই একসাথে হৈহৈ করে উঠলো। মেহুল কান চাপা দিয়ে বলল
বেয়াদবগুলোরে বলছিস। আল্লাহ!
সুজানা বলল
কি হচ্ছেটা কি? এজন্যই তোদের বলতে চাচ্ছিলাম না। পাগল।
আরেহ রাখ। তোগো বিয়ে হবে আর আমাদের সিরিয়াল তত কাছে আসবে। খুশি হব না?
সবাই একসাথে হাসলো।
জায়িন বলল
বিয়ের ডেট ঠিক হয়ছে? আঙ্কেল কিছু বলেনাই সাইফ ভাইয়ের ব্যাপারে?
সুজানা বলল
কি বলবে? সাইফ ভাই কোনদিকে খারাপ? শহরে নিজের বাড়ি আছে। সরকারি চাকরি। আর কি চাই? আঙ্কেল কিছু বলবে না। এই তোকে কিছু বলেনি?
মেহুল বলল
কাল জানাবে বলেছে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে। মামাদেরও জানাতে হবে।
নিখিল বলল
আরেহ চাপ নিস না। হেড মাস্টাররে তুলে আনমু রাজী করানোর লাইগা।
জায়িন বলল
তোদের হাতে না পড়ুক। তার আগেই আঙ্কেল রাজী হয়ে যাক।
সবাই একসাথে হাসলো আবারও।
সুজানা বলল
সময় দেখ। আজ শাটলে যাবি না?
নাহ। আজ ঘুরাঘুরি করব। তোর অসুবিধে হবে?
সুজানা মাথা নাড়ালো।
সমস্যা হওয়ার কথা নয়। স্যার তো সিলেটে। কবে আসবে? ওই বাড়িতে যাবি কবে?
উনি আসলে নিয়ে যাবে বললো। জানিনা সিউর।
স্যার এখানে থাকলে দারুণ মজা হতো। ধুরর ফালতু।
জায়িন জানতে চাইলো
স্যার, সাস্টে ব্যবসায় প্রশাসনে না?
হুম। চল উঠি। কোথায় যাবি আজ?
আশেপাশে কোথাও।
মেহুল বলল
নিহাত কি শাটলে যাবে? ডাকা উচিত না?
শান্তা আর সুজানা সায় জানালো। জায়িন বলল
আমি ডাকতে পারব না। আমাকে ধমকাবে।
আহির বলল
আমি ডেকে আনি।
আহির চলে গেল। নিখিল বলল
সবসময় ডাকতে হয়?
মেহুল বলল
ছাড় না। আমরা আর কতদিন একসাথে আছি। সাইফের খবরটা শুনে ভয় ঢুকে গেছে। সুজু তোরও কি এমন ফিলিংস হয়েছে? মনে হচ্ছে কত দূরে সরে যাচ্ছি। অথচ এই খবরটা শোনার জন্য এতগুলো দিন অপেক্ষা করেছি।
সুজানা মৃদু হেসে বলল
এমন হয়। আমারও হয়েছে। চিন্তার কিছু নেই। সব ভালো হবে।
মেহুল মাথা দুলালো।
তাই যেন হয়।
সুজানা তার শুকনো মুখ দেখে হাসলো।
সেও ভেবেছিল সবটা পাল্টে যাবে। আসলে কিছু পাল্টায়নি। শুধু দূরের মানুষ কাছে এসেছে।
আর এটা আনন্দের। সেসব ভাবতে ভাবতে সুজানার মন খারাপ হলো। আজ পাঁচদিন হয়ে গেল মাষ্টারমশাইকে সে দেখেনি। আজকাল কথা বলে মনে ভরে না।
_______________
২য় খন্ড :
মাগরিবের নামাজ পড়ে সাজিয়া বেগম রান্নাঘরে এসে দেখলো সুজানা চুলোয় চায়ের পানি বসিয়েছে। সায়েম বাজারের থলে থেকে মাছ তরকারি বের করতে করতে বলল
আপা ভাইয়ার আজকে আসার কথা না।
হুমম।
আসবে না?
জানিনা।
মাকে দেখে সুজানা বলল
আম্মা মাছ মাংসগুলো আমি কেটে ফেলি। ফ্রিজে রেখে দেব।
ফ্রিজে রাখব? আমি চেয়েছিলাম ছেলেটাকে তাজা রেঁধে খাওয়াবো।
দেরীতে এলে বাসিই খেতে হবে আম্মা।
একটা ফোন করে দেখ না গাড়িতে উঠেছে কিনা।
সুজানা মায়ের দিকে তাকাতেই উনি কথা ঘুরিয়ে বললেন
ওদিকে সমস্যাও তো হতে পারে। তাই হয়ত ফোন ধরছেনা ।
চা টা বানাও। আমি মাছ কেটে পড়তে বসবো। আমার পড়া আছে।
আচ্ছা।
মেয়ের সাথে আর কথা এগোতে চাইলেন না তিনি।
সুজানা চিংড়ি মাছ আর মাংসগুলো কেটে শেষ করার আগেই তার ফোন বেজে উঠলো। বটি ওভাবে রেখে ঘরে ছুটলো সে।
সায়েম বলল
ভাইয়া নিশ্চয়ই আজ আসবে আম্মা।
তাই যেন হয়। দুটো ভাত খাবে তাও যদি তাজা রেঁধে না খাওয়াতে পারি।
সুজানা ফোন তুলতে তুলতে ফোন কেটে গেল। হতাশ হলো সে। অভিক ফোন করেনি।ফোন করেছেন আজীম সাহেব। তার শ্বশুর আব্বা।
সুজানা কলব্যাক করার আগেই আজীম সাহেবের ফোন থেকে আবারও ফোন দিলেন। তুলে কানে দিতে দিতে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে সালামের উত্তর এল।
বৌমা ভালো আছে তো?
জ্বি বাবা। আপনারা সবাই ভালো আছেন।
আছি। তোমার মা ভাই ভালো?
জ্বি সবাই ভালো।
তোমার মায়ের ফোনে সমস্যা হচ্ছে। ফোন যাচ্ছে না কোথাও। তাই আমারটা থেকে দিলাম। নাও কথা বলো।
সালমা বেগম ফোন কেড়ে নিয়ে বলল
হ্যা বৌমা শুনছো।
আসসালামু আলাইকুম মা। শুনছি।
ওয়ালাইকুমুস সালাম। সব ঠিক আছে। সবাই ভালো আছে তো?
জ্বি।
পড়তে বসেছ বুঝি? শোনো আমি ঘরে এসে চুপিসারে ফোন দিচ্ছি তোমায়। অভি ফিরেছে মাগরিবের কিছু আগে। এই যে নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরলো সবে। কিছু পরেই তোমাদের বাসার দিকে রওনা দেবে।
সুজানা অবাক হয়ে শুনলো।
উনি কখন এলেন?
সে কথা তার কাছ থেকে শুনিও। পাজি ছেলে হয়েছে আমার। তোমাকে নাকি সারপ্রাইজ দেবে। বলি কি শ্বশুর বাড়িতে কেউ ওভাবে যায়? তাও নতুন জামাই? তোমার মায়ের তাড়াহুড়ো না পড়ে যায় তাই আমি জানিয়ে দিয়েছি। জানতে পারলে আমার উপর রেগে যাবে। ওকে বলো না আবার।
না, বলব না। কিন্তু এটা কেমন সারপ্রাইজ? সকাল থেকে ফোন তুলে পরে ফোন করবে বলে কেটে দিল। আর সারাদিন খোঁজখবর নেই।
আমি কি আর বলব? বাপের মতো আক্কেল কম ছেলেটার। তুমি বউ হয়ে গিয়েছ তাই ওর বদনাম করে ফেলছি।
সুজানা মৃদু হাসলো। বলল
আচ্ছা, বলেছেন খুব ভালো হয়েছে। আম্মাকে রান্নাবান্না বসাতে বলি। বাবুরা ভালো আছে?
আছে। সুজানের কাছে যাবে সকালবেলা বায়না ধরেছে। কোনোমতে শান্ত করেছি। এখন অভি যাচ্ছে শুনলে আবার শুরু করবে। আমি অভিকে চুপিসারে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ওদেরও পাঠান। আমি সামলে নেব।
দরকার নেই। কাল ন’টা দশটা করে দু’জন চলে এসো। আগামী সপ্তাহে আবার যেতে পারবে সমস্যা নেই।
সুজানা ছোট্ট করে জবাব দিল।
আচ্ছা।
সালমা বেগম আরও দু একটা কথা বলে ফোন কেটে দিল।
সাজিয়া বেগম জামাই আসছে শুনে খুশিতে নাশতা আর হরেক রকমের রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করে নিল রাশেদা বেগমের সাথে। আজ জামাই আদর।
—
অভিক রেডি হয়ে নীচে এল। সোফায় বসে পায়ের জুতোর ফিতে ঠিক করতে করতে বলল
মা, জেম্মা বেরোচ্ছি।
আনিকা এসে বলল
সুজানা কাল আসছে তো?
হুম।
খুব ভালো। আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব।
অভিক ভুরু কুঁচকে তাকালো।
ওখানে কি?
ওখানে কি মানে? মা আর ছোটমাকে ডাকব? ও আমার জা। ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব না।
ওকে নিয়ে সবাই বেড়ালে আমি কাকে নিয়ে বেড়াবো?
তুই অনেক সময় পাবি।
জিনিয়া দাদুকে ধরে ধরে নিয়ে এসে সোফায় বসিয়ে দিল। সালমা বেগম চায়ের ট্রে এনে রাখতেই সবাই চা নিল। আজীম সাহেব এসে বললেন
আজ চা এত দেরীতে কেন?
সালমা বেগম বললেন
তোমার ছেলের পেছনে ছুটতে গিয়ে দেরী হয়েছে। অভি কিছু খাবি না?
দাদু হেসে বললেন
খালি পেটেই যাক। শ্বাশুড়ি জামাইকে মজার মজার রান্না করে খাওয়াবে। পেট খালি রাখাই ভালো।
অভিক মাথা দুলিয়ে বলল
ঠিক।
আনিকা বলল
এই অভি তোর হোয়াটসঅ্যাপটা চেক কর। ওখানে লিস্ট দিয়েছি কতকেজি মিষ্টি লাগবে, আর কি কি লাগবে সব। মনে করে পান সুপারিও কিনবি।
ঠিক আছে।
সালমা বেগম বললেন
আর হ্যা। বউয়ের মায়ের সামনে বলবি যে তোকে সিলেটে একা থাকতে হবে। তাহলে ওর মাকে ওকে বুঝাবে।
কি বুঝাবে? মা সুজানার দিকটাও ভাবতে হবে। পড়ালেখা, চাকরি…
আজীম সাহেব থামিয়ে দিয়ে বললেন
এখন ওসব কথা থাক। সুজানা বাচ্চা মেয়ে নয়, ও বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবে। তাছাড়া ওর মায়ের সামনে কিছু বলার দরকার নেই অভি। ওর মা শুধু শুধু ওর উপর প্রেশার ক্রিয়েট করবে। সালমা তুমি কি চাও আমাদের সিদ্ধান্তে সুজানার খারাপ লাগুক?
সেটা কখন বললাম?
তাহলে ওদেরকে ওদের সিদ্ধান্ত নিতে দাও। অভি তোমার ছেলে ঠিক কিন্তু সুজানার স্বামী। ও অভির ভালোটাই চাইবে।
অভিক সোফা ছেড়ে বলল
থ্যাংকস বাবা।
তারপর মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল
তোমাকে নিয়ে যাব সিলেটে। মা থাকলে আর ভয় কিসের?
সর, পাম দিস না। চালাকি শিখেছে আজকাল।
অভিক হো হো করে হেসে মায়ের মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে বলল
মা, শ্বাশুড়ি মায়ের হাতের নাশতা নিয়ে আসব তোমার জন্য।
তোর শ্বাশুড়ি দিলে তো।
আরেহ আমার চোরা পকেট আছে। জেম্মা কি বলো? আসি।
আনজুমা বেগম মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে বলল
পাগল ছেলে।
অভিক হাসলো। বলল
দাদু আসি। বাবা, জিনি, আপু আসি।
সিঁড়ি থেকে ফুপী বলল
অভি বাবুরা আসছে । তাড়াতাড়ি বেরোহ।
অভিক দ্রুত বেরিয়ে গেল। বিচ্ছুগুলো সাথে গেলে তাকে সুজানার কাছে টাছে ঘেঁষতে দেবে না।
_______
রান্নাবান্না শেষের দিকে। সুজানার কথায় সাজিয়া বেগম নাশতার আইটেম কমিয়ে দিয়েছে। সুজানা বলেছে অভিক তেল চটচটে নাশতা, ঝাল খুব কম খেতে চায়। খাবার-দাবারের প্রতি খুব বেশি যত্নশীল সে। তার পছন্দের খাবারের মধ্যে একটা ডিমপুডিং আর দই। সাজিয়া বেগম তাই এই দুটোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে। বাকিগুলো অভিক খেতে চাইলে খাবে, না খেলে নেই। তাছাড়া সুজানা বলেছে নাশতা খেলে সে আর ভাত খেতে পারবে না। কফি খায় বলে গরুর দুধ জমিয়ে রেখেছেন তিনি।
রান্নাবান্না শেষ করে ঘরদোর গুছিয়ে নিয়েছে সুজানা। রোজাও তাকে হাতে হাতে সাহায্য করেছে। সুজানা বাড়ি আসায় সে ভীষণ খুশি। সুজানা আপার বিয়ের পর তার একা একা ভালো লাগেনা। আজকে দুলাভাই আসবে। দুলাভাই খুব মজার মানুষ।
রাশেদা বেগম এসে বললেন
তোর মায়ের সব হয়ে এসেছে। তোকে বলছে সেলোয়ার-কামিজ পাল্টে নিতে।
সুজানা মাথা নেড়ে বলল
ঠিক আছে।
রোজা বলল
আপা তুমি শাড়ি পড়ো।
কেন?
শাড়ি পড়লে তোমাকে সুন্দর লাগে।
তাই?
হুমম। আন্টি বলেছিল শাড়ি পড়ার কথা। নতুন বউদের শাড়ি পড়লে তখন বউ বউ লাগে।
এই যে সেলোয়ার-কামিজ পড়ে আছ একদম বউ বউ লাগছে না।
সুজানা হাসলো। ওর গাল টেনে দিয়ে
পেকে গেছিস খুব।
রোজা গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল
ভাইয়া আর সায়েম ভাই গেইটের ওখানে অপেক্ষা করছে। দুলাভাই এক্ষুণি চলে আসবে। তুমি গিয়ে রেডি হও।
আমার রেডি হওয়ার তাড়া নেই। তোর দুলাভাই কি আমাকে নতুন দেখছে নাকি?
তোমাকে যদি এরকম দেখে বলবে বাপের বাড়িতে কামের বেটি সেজে থাকো।
সুজানা হাসতে হাসতে বলল
বড় আন্টি শোনো তোমার মেয়ের কথা। মেহুলকে তো জ্বালিয়ে মারবে দেখছি।
ভাবিকে কোরবানের আগে ঘরে তুলবে বলেছে আম্মা। আব্বাও ফোন করে বলেছে কথাবার্তা এগোতে।
আঙ্কেল দেশে কবে আসছে?
মাথায় টাক হলে।
সুজানা হেসে উঠলো। রোজাও হাসলো। রাশেদা বেগম এসে তাড়া দিলেন।
আরেহ আরেহ এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন সুজু? যা কাপড়চোপড় পাল্টে মুখহাত ধুঁয়ে নে।
যাচ্ছি। এমন করছ যেন আমাকে এই প্রথম দেখতে আসছে।
সুজানা পেঁয়াজি রঙের শাড়ি পড়লো। মুখ ধুঁতে গিয়ে অর্ধ গোসল সেড়ে নিয়েছে সে। চুল মোছার সময় খবর এল সরিষাবাড়িতে মশাইয়ের পা পড়েছে। চারপাশে এমন হৈচৈ পড়ে গেল যেন নতুন বর এসেছে বিয়ে করতে। যদিও বিয়ের পর নতুন জামাই এসেছে।
মা নতুন জামাইকে সদর দরজা থেকে এগিয়ে নিতে গেলেন রাশেদা বেগম আর আরও কয়েকজন প্রতিবেশীদের সাথে।
সুজানা রোজাকে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ওখান থেকে গেইট অব্দি দেখা যায়।
সাদা কালো থিন সান প্রটেটক্টিভ সামার জ্যাকেট গায়ে দেখা গেল মশাইকে। হেসেখেলে সাইফ আর সায়েমের সাথে হেঁটে আসছে। পাশের বিল্ডিং দেখে কয়েকজন ঠেলাঠেলি করে নতুন জামাই দেখতে চাইলো। বুঝতে না পেরে অভিক সাইফকে বলল
কি ব্যাপার বলুন তো।
সাইফ হেসে বলল
সরিষাবাড়িতে আপনিই একমাত্র জামাই। তাই দেখছে।
আচ্ছাআআ ব্যাপারটা দারুণ।
তারা উঁকি দিয়ে দেখতেই অভিক নিজেও উঁকি দিয়ে তাদের চাইলো। তারা লজ্জা পেয়ে গুটিয়ে যেতেই সাইফ বলল
আন্টি জামাই সালাম দিয়েছে।
উত্তর এল
হ্যা হ্যা নিয়েছি।
আসতে বলছে চা নাশতা খাওয়ার জন্য।
হ্যা হ্যা আসব।
অভিক তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল
ভেবেছি শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পরপরই লজ্জা পাওয়ার ভান করব। কিন্তু এসে দেখি সব উল্টো। সবাই উল্টো আমাকেই লজ্জা পাচ্ছে। কি হলো ব্যাপারটা?
সবাই হাসলো তার কথায়।
সুজানা কপাল চাপড়ে বলল
আল্লাহ এত বকবক কি করে করে লোকটা।
নীচের সদর দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সাজিয়া বেগম আর বাকিরা তার কথাশুনে হাসলো। সাইফ আর সায়েমের হাতে অনেক বাক্স, প্যাকেট,কাটুন। অভিকের হাতে সাদা একটা মাঝারি সাইজের শপিংব্যাগ। দরজার কাছে এসেই সবাইকে দেখে সালাম দিতেই সবাই সালাম নিয়ে শাড়ির আঁচল টেনে মুখ ঢেকে নিয়ে পেছনে দাঁড়ালো। সাজিয়া বেগম এগিয়ে আসলেন। অভিক উনাকে দেখে হাসলো চমৎকার করে। ডাকলো
শ্বাশুড়ি মাআআআ..
সাজিয়া বেগম খিক করে হেসে দিলেন। অভিক সালাম করতেই উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন
কত আয়োজন করছি এই চারদিন ধরে। জামাইরাজার আসার নামগন্ধ নেই।
অভিক মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে হাসলো। বলল,
যার জন্য এত আয়োজন তাকেও একটু আয়োজন করে আসতে হয় নাকি।
সাজিয়া বেগম পেছনের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন
উনারা সবাই সুজানার আন্টি।
অভিক রাশেদা বেগমকে চিনলো শুধু। সালাম দিতেই উনারা সালাম নিলেন। অভিক বলল
ব্যাপারটা কি? সরিষাবাড়ির সবাই কি লজ্জাপাওয়া রোগে ভুগছে নাকি?
ওমা তা কেন?
যে-ই আমাকে দেখে সেই লজ্জা পাচ্ছে।
সাজিয়া বেগম আবারও হেসে উঠলেন। মিষ্টি কেটে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
নতুন জামাই, লজ্জা পাবে না?
কিন্তু শ্বাশুড়ি মা তো লজ্জা পাচ্ছে না।
প্রথমদিন একটুআধটু লজ্জা পেয়েছিলাম। এখন আর কিসের লজ্জা। বাপের কাছে মেয়ের লজ্জা কিসের?
অভিক মিষ্টি খেয়ে বলল,
এগজ্যাক্টলী।
তারপর চামচটা সাজিয়া বেগমের দিকে ঘুরিয়ে বলল
একটা পতাকাও নিয়ে আসা উচিত ছিল না?
পতাকা? ওমা পতাকা কেন আবার?
পতাকা উড়িয়ে আসতাম। পতাকায় লেখা থাকতো শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ।
সাইফ, সায়েমসহ সবাই একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো।
সাজিয়া বেগম কোনোমতে মিষ্টিটুকু খেয়ে বললেন
দুষ্টু ছেলে।
এটা অবশ্যই মানতে হবে।
আর এতসব আনার কি দরকার ছিল? আমি শুধু রাজামশাইকে চেয়েছি। সে আসলেই আলোয় ফকফকা হয়ে যায় চারপাশটা । আর কি চায়?
একটা পুরো রাত জেগে গল্প করার পাশাপাশি খাওয়াদাওয়া করতে হবে নাকি?
সাজিয়া বেগম হেসে তার কান টেনে দিয়ে বললেন
দেখা যাবে কত খেতে পারেন।
অভিক কান মলতে মলতে বলল,
ইয়ে মানে আমি একটা খবর জানতে ভীষণ আগ্রহী।
সাজিয়া বেগম মিচকে হেসে বললেন
সেটা উপরে গেলেই আপনি নিজ চোখেই দেখতে পারবেন। সরিষাবাড়িতে মাস্টারের বউদের আবার বিশেষ যত্নে রাখা হয়।
অভিক লজ্জা পেল তাই সশব্দে হেসে উঠলো। বলল
ভারী টেনশনে ছিলাম। শুনেই আমার পালপিটিশন কমে এল।
সবাই একসাথে হেসে উঠলো আবারও।
চলবে…
বোনাস পর্ব ২
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=615229340652242&id=100064955442822&mibextid=Nif5oz