#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৫১
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
অভিক চট করে কোলে তুলে নিতেই সুজানা কেঁপে উঠলো তরতরিয়ে। বিস্মিত নয়নে তাকাতেই অভিক ঠোঁট উল্টে বলল
শাড়িটার ভার বেশি। মানুষটার নয়।
সবাই হাসলো একসাথে।
আহ বউয়ের প্রশংসা!
সুজানা তখনও তারদিকে অপলক তাকানো।
অভিক নিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড়িয়ে ডাকল..
সু–জা–না!
সুজানা কোনো কথাই বলতে পারলো না। যাকে সে দূর থেকে দেখে অভ্যস্ত, দূর থেকে অনুভবে অভ্যস্ত। তার ছোঁয়ায় আর কাছ থেকে দেখায় সে অপ্রস্তুত ।
অভিক তার অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। বলল..
এটাই আমি। আপনার মাস্টারমশাই।
সুজানা বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইলো।
গাঁদা আর গোলাপের পাঁপড়ি অভিকের মাথা বেয়ে টুপটাপ পড়লো সুজানার মুখের উপর। এত মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ আর মিষ্টি অনুভূতি সাথে একটা মিষ্টি মানুষ।
___
ঘরের পথটা ফুলেল পরিশোভিত। ফুলের গন্ধে সুজানার নাক পুরোপুরি বন্ধ। তার নাকের মতো চোখজোড়াও বন্ধ। বউ বরের পেছন পেছন সবাই লাইন ধরে আসছে। বাচ্চাগুলোও তাদের পিছু নিয়েছে।
ঘরের পথটাতে পা দিতেই আনিকা বলল
এখানে নামা।
অভিক বলল
কেন?
বাপরে বাপ। সারাক্ষণ কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি? সুজানা হেঁটে ঘরে যাবে এবার।
ফাইন।
সুজানাকে নামিয়ে দিল অভিক। সুজানা এতক্ষণ পর চোখ খুললো। এবার নাক দিয়ে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছে। এত অস্বস্তি, জড়তা কেন? তাও এই মানুষের ছোঁয়ায়। ভাবতে তো প্রশান্তি লাগতো। যদি বুঝতে পারে কি ভাববে?
পায়ের তলায় ফুলের পাঁপড়ি টের পেল সে। জুতো জোড়া সোফায় বসার সময় খুলে রেখেছিল সে। এত উঁচু জুতো পড়ার অভ্যাস নেই তার। সে মেঝেতে চোখ রাখতেই দেখলো ফুল দিয়ে সাজানো পথটার অভিকের ঘরের দিকেই গিয়েছে। মানুষগুলোর পাগলামি দেখে তার হাসি পেল সাথে অদ্ভুত এক আনন্দ হলো। মেঝে থেকে চোখ তুলতেই অভিকের চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসলো। অভিক মাথা দুলিয়ে বলল
যাওয়া যাক।
অনা আবিদ এসে সুজানার আঙুল ধরলো।
সুজান আমার ঘরে আসো।
সবাই একসাথে হাসলো। আনিকা এসে বলল
সুজান অভির ঘরে যাবে। আপনাদের ঘরে কি করবে?
তারা সুজানার দিকে তাকালো। সুজানা মৃদু হাসলো।
সুজান বউ?
হ্যা, অভির বউ। আপনাদের ছোট মা।
ছুটু মা?
হ্যা। এবার সুজানকে ঘরে নিয়ে যান তো।
অনা ঘাড় ঘুরিয়ে অভিককে বলল
অভি সুজানকে কুলে নাও।
আবার?
আবার কুলে নাও।
সুজানা বলে উঠলো।
না, এখন যেতে পারব।
অভিক বলল
আমি আর কোলে নিচ্ছি না।
সবাই আবার একসাথে হেসে উঠলো।
ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে সুজানা ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজাটা কত সুন্দর করে সাজানো। ঘরের ভেতরেও। আনিকা বলল
এটা আপনার ঘর। পুরোটা চেঞ্জ। ছোটমা দারুণ করে সাজিয়েছে। সুন্দর না?
সুজানা মাথা দুলালো।
খুব।
ভেতরে প্রবেশ করুন।
সুজানা পা দিল ঘরে। আজ থেকে এই ঘরটা তার! একান্তই নিজের। এই ঘরের দেয়ালে দেয়ালে ভালোবাসারা লেপ্টে থাকবে। বুক শেলফের বইগুলোর ভাঁজে ভাঁজে তার হাতের স্পর্শ লেগে থাকবে , ফুল টবের ফুলগুলোতে, ঝাড়বাতি আর ঘরের পর্দাগুলো তার ছোঁয়া পাবে।
ঠান্ডা ফ্লোরে পা পড়তেই গায়ে শিহরণ জাগলো। পেছনে ফিরে অভিকের দেখা পেতে চাইলো সে। দেখে শান্ত হলো মনটা। অভিক চোখ নিভিয়ে ভরসা দিল।
সে পেছনে দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে দেখছিল নিজের মানুষকে নিজের ঘরে। হায় আজ থেকে এই ঘরেও মেয়েটা আধিপত্য বিস্তার করবে ঠিক মনের ঘরে যেমন।
আনিকা তার তার দুকাঁধ ধরে পশ্চিম দিকে ফিরিয়ে বলল
দুপুর দুটো থেকে এই ঘর সাজানোর কাজ চলছিল। দেখুন তো কেমন হয়েছে? ভাগ্যিস এরকম ভালো জা পেয়েছেন নাহলে এসব আইডিয়া কে দিত? আমার সময় তো শুধু বেডটা সাজিয়ে এরা সবাই দামে উঠে গিয়েছিল। দেখুন।
সুজানা চোখ না তুলেই বলল
ভালো হয়েছে।
আরেহ আরেহ বেডটা দেখুন।
ননদিনীরা মিটিমিটি হাসা শুরু করলো। সুজানার কান গরম হলো লজ্জায়। সে পেছনে ফিরে অভিককে দেখার চেষ্টা করলো। এবার সে নেই। কোথায় গেল?
জিনিয়া বলল,
এই দেখো বরকে খুঁজছে। আরেহ বরকে অনেক সময় পাবেন নতুন ভাবি। এবার তো দেখুন ঘরটা।
সুজানা চোখ তুললো না।
আনিকা হেসে উঠে বলল
মেয়েটার এত লজ্জা কই থেকে যে আসে। ঠিক আছে। আপনার ঘর আপনি দেখুন, আমরা আসছি কিছুপরেই। মুরব্বিরা বোধহয় দেখতে আসবে। তারপরে শাড়ি গয়না চেঞ্জ করিয়ে দেব।
বাচ্চারা সুজানার সাথে থেকে গেল। বাকিরা হাসতে হাসতে চলে গেল।
অনেকটা সময় পর সুজানা চোখ তুললো। গোলগাল খাটটা যেন মনে হলো কোনো ফুলের রাজ্য। অনা আবিদ ঝুলানো দোলনায় উঠে পড়েছে মোড়ার সাহায্যে। সুজানা তাদের দেখে হাসলো। দোলনার কাছে গিয়ে হালকা দোল দিতেই দুজনেই খিকখিক করে হেসে উঠলো।
সুজানা পুরো ঘরে গুটিগুটি পায়ে হাঁটলো। হাতের স্পর্শ দিল ঘরের দেয়ালে, বুক শেল্ফে, ফুল ছড়ানো চাদরে, আর ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়।
কানদুুটোতে ব্যাথা মনে হলো। কানের দুল খোলায় মনোযোগী হতে গিয়ে ঘরে ঢুকে ফোনে চার্জিং দেয়া মানুষটাকে দেখতে পেল না সে। তবে অনুভবে যখন বুঝতে পারলো তখন সটান হয়ে দাঁড়ালো। আয়নায় হাসিমাখা মুখটা একবার দেখা গেল তারপর হুট করে আবারও উদাও হয়ে গেল। সুজানার হৃদকম্পন তখন আকাশছোঁয়া। এমন কেন হচ্ছে?
———
মুরব্বিরা বউ দেখতে এল যারা তাড়াতাড়ি ক্লাব থেকে চলে এসেছিল। নতুন বউকে অনেক জ্ঞান দিল। সুজানা মাঝখানে বসে থেকে বিরক্ত হচ্ছিল। এতসব ডিটেইলসে বলতে হয়? সে কি খুকী যে কিছু জানেনা?
মুরব্বিরা যাওয়ার পর সালমা বেগম এসে বললেন ভারী শাড়িটা খুলে যাতে একটা নরম কাপড়ের শাড়ি পড়িয়ে দেয়। আর ভারী গয়নাগুলো খুলো যেন চেইন আর দুটো চিকন চুড়ি পড়িয়ে দেয়। সবাই মিলে তাই করলো। নতুন বউয়ের সাথে তাদের সময়গুলো দারুণ কাটলো। জুতোর কারণে সুজানার গায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছে। সে কাউকে তা দেখায়নি। যন্ত্রণা হচ্ছে সেখানে।
ওর চাচা মামা খালুরা এসেছে সবাই নীচে। ক্লাবে কিছু সমস্যা হয়েছিল সেসব নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে কিছু কথা কাটাকাটি লেগেছিল যা মেয়েদের কানে আসেনি। অভিক আর আহনাফ ভুল বুঝাবুঝির ইতি টেনে দিল সেখানে। নতুন আত্মীয়দের মাঝে এসব মানায় না। যেখানে তারা সবাই বাঁধা পড়েছে এক সুঁতোয়। তখন সবাইকে সবার পাশে লাগবে। ওই মুহূর্তগুলো ভুলে যাওয়ায় শ্রেয়।
তাছাড়া আনিকার মামার বাড়ি থেকে বিয়েতে কেউ আসেনি বলে তা নিয়ে একপ্রকার মাতামাতি লেগে গিয়েছিল। অভিক সেসব শুনতে মোটেও রাজী নয়। তার বন্ধুরা আছে পাশাপাশি পুরো বাড়িটা আত্মীয় স্বজনে ভরা। নতুন বউ এনে বাড়িতে এসব কথা তোলার কোনো মানে হয় না। সে কাউকে দমাতে না পেরে বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। সুজানার কানে এসব গেলে সে কষ্ট পাবে না? মনে করবে সে দায়ী সবকিছুর জন্য। সবকিছুতে তার সুজানার জন্য চিন্তা হয়। সুজানা সেনসিটিভ বিষয়ে অল্পতেই কষ্ট পেয়ে যায়। সুজানা দেখায় না কিন্তু সে খুব বুঝে সেটা। সে মেয়েটাকে ভালোবাসে তো।
_____________
সুজানার মামা খালুরা চলে গিয়েছে খাওয়াদাওয়ার পরে। সবাই বিয়ের রান্না নিয়ে এসেছিল। তারা যাওয়ার পর সুজানার মনটা একদম খারাপ হয়ে গেল। মায়ের কথা ভাইয়ের কথা বেশি করে মনে পড়তে লাগলো। মনে হচ্ছে কতদিন দেখেনা তাদের!
কিছু খাবেনা বলে জেদ ধরায় সালমা বেগম ধমক দিয়ে বলেছেন, আসামাত্রই এসব শুরু করে দিয়েছ? লোকে শুনলে কি বলবে, তোমার বাপের বাড়িতে শুনলে কি বলবে? বলবে প্রথমদিনই কেউ ভাত দেয়নি। সুজানা চুপটি করে ছিল তখন। আনজুমা বেগম ভাত নিয়ে এসে খাইয়ে দিয়েছিল তারপর।
শোয়ার আগে দাদু এসে কিছু নিয়মকানুন বলে গেল। যদিও আজকালকার ছেলেমেয়েরা ওসব কানে তুলে না। কিন্তু উনি মনে করেন উনার ছোট নাতবউ ভালো মেয়ে, কথা শুনবে। সুজানা দাদুর কথা শুনে মিটিমিটি হাসলো। উনি বললেন
আরেকটা কথা উপহার না দিলে কিন্তু আমাকে বলবে। অন্যকিছু যা দেয়ার দিক উপহার কিন্তু বাধ্যতামূলক।
সুজানা হাসলো। বলল
আপনি আর কিছুক্ষণ বসুন। আমার ভালো লাগছে। বাবুরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
হ্যা ওদের মা ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। আমার আর বসা যাবেনা তোমার বর আসবে। সে তো মা বাপের সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।
কেন রেগেছে কেন?
ওই তেমন কিছু না। ওসব তোমার না জানলেও চলবে।
সব ঠিকঠাক আছে দাদু?
সব ঠিক আছে। চিন্তা করো না। যেটা জেনে তোমার কোনো লাভ নেই সেটা জানার দরকার নেই। তোমার বর চলে আসবে। আজ ফিরতেই হবে। বেশী দেরী হলে ফোন দিও একটা। ঠিক আছে?
সুজানা মাথা নাড়ালো। দাদু চলে গেল।
সে ফোন দেবে কি দেবেনা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো না দেয়াটাই ঠিক হবে। উনি সহজে রাগ করেন না। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে যা সবাই লুকোচ্ছে তার কাছ থেকে।
___________
অভিক বাইরে থেকে এসে দেখলো মা আর জেম্মা সোফায় বসে রয়েছে। তারা পান সুপোরি আর মিষ্টির কাটুন গুলো ভাঁজ করে করে রাখছে। সকাল সকাল উঠে অত কাজ করার সময় নেই। এখন করে রাখলে কাজ কমলো। মর্জিনাও আছে সাথে। অভিককে দেখে বলল
ছোট বাবু আইছে ভাবি।
অভিক বলল
কি হচ্ছে এখানে?
তুই গিয়েছিলি কোথায় অভি?
মায়ের প্রশ্নে সে স্বাভাবিক উত্তর দিল।
কালকের রিসিপশনের কিছু কাজ ছিল ওগুলো সেড়ে এলাম।
যেভাবে বেরিয়ে গেলি মনে হলো রাগটাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিস। আজকে পরের মেয়ে ঘরে এনেছিস আর আজকে তোর রাগ দেখাতে হলো।
অভিক চুপ থাকলো। আনজুমা বেগম বললেন
ওসব আমাদের বড়দের কথা। সব কথায় কি রাগ করতে আছে?
আমি রাগ করেছি? আমি বলেছি টপিকগুলো জাস্ট স্টপ রাখতে। সুজানা শুনতে পেলে কি মনে করবে নিজেকে?
সালমা বেগম চোখ বড় বড় করে বললেন
আজব! সুজানা কেন শুনবে? সুজানাকে কে বলতে যাচ্ছে? আমরা কি পাগল এসব সুজানাকে বলতে যাব?
আনজুমা বেগম হাসলেন। বললেন
তোর ছেলে বউয়ের কথা চিন্তা করে রাগ দেখিয়েছে। বাপের মতো না?
তুমি আর কথা পাওনা। এই যাহ ঘরে যাহ। বিয়ে হয়েছে বলে বড় হয়ে গিয়েছিস? আর কিছুক্ষণ হলে কান ধরে নিয়ে আসতাম আমি।
অভিক মাথার চুল ঝেড়ে মৃদু হাসলো।
__________
রাত বেড়েছে তাই সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজিনদের ইচ্ছে ছিল তারা অভিককে ঘরে ঢুকতে দেবেনা টাকা ছাড়া কিন্তু বাড়িতে হট্রগোল লাগায় সবাই আপাতত সেই প্ল্যানটা স্কিপ করেছে তবে কাল ঠিক উসুল করে নেবে।
অভিক ঘরে ঢুকেই দেখলো ঘরে লাইটগুলো বন্ধ শুধু গোলাপি রঙা ডিমলাইট ছাড়া। সে হাসলো। এই ঘরের সাথে মেয়েটা পূর্ব পরিচিত তাই ভূত ভয় নেই তার।
কিন্তু সে ভড়কে গেল সুজানাকে কোথাও না দেখে। বিছানায় নেই। চেয়ার টেবিল খালি। পুরো ঘর খালি। গেল কোথায়? সে লাইট জ্বালিয়ে দিল। না কোথাও নেই। আবার লাইট বন্ধ করে দিয়ে বেরুতে যাবে তখনি চোখ পড়লো দোলনায়। দোলনার নীচে দোল খাচ্ছে কয়েক গাছি চুল। যা মেঝে স্পর্শ করেছে। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে দোলনাটা তার দিকে ঘুরাতেই সেখানে ঘুমন্ত দেখলো সুজানাকে। সে কপালে হাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
চিন্তামুক্ত হয়ে হাতমুখ ধুয়ে এল সে। বাহির থেকে ফিরে এটা তার রোজকার অভ্যাস। তারপর তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দোলনার কাছে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটা ভারী ঘুমে তলিয়ে গেছে হয়ত।
হাঁটুভেঙে বসলো সে মেঝেতে। দু’হাতের কনুই ঠেকালো দোলনায় সুজানার মাথার দু’পাশে। গালে হাত রেখে কয়েক মূহুর্ত কেটে গেল মুখটার দিকে তাকিয়ে।
তার এত এত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, তাকে এতগুলো রাত নির্ঘুম রেখে আরামে ঘুমানো হচ্ছে? মুখটা ছোঁয়ার অদ্ভুত মনোবাসনায় হাসি পেল তার। সুজানা তো লজ্জায় মরে যাবে।
অনেকটা সময় পর সুজানার ফোনটা বেজে উঠলো। অভিক খেয়াল করলো সুজানা এলার্ম দিয়ে রেখেছে। সে এলার্ম বন্ধ করে সুজানার দিকে চোখ রাখতেই দেখলো সুজানা ড্যাবড্যাব করে চোখ উল্টে তাকিয়ে আছে। মাথার উপর এত নিকটে কার মুখ সেটা বুঝতে দেরী হয়নি তবে কখন এসব হলো, কি করে হলো তা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল হলো হৃদৎস্পন্দনের গতি বেড়ে যাচ্ছে। সে পায়ের আঙুল গুটিয়ে নিল। অভিক গাল থেকে হাত সরিয়ে হাতের মুঠোয় থাকা ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে দিল তার মুখে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল সে দ্রুত। পুনরায় খুলতেই দেখতে পেল অভিক গোলাপ ফুলের ডাঁটা কামড়ে ধরে আছে ঠোঁটের চাপে দাঁতের দংশনে। সুজানা কাঁপা-কাঁপা হাত তুলে ফুলের ডাঁটাটা ধরলো। নিয়ে মিনমিন করে বলল
কাঁটা আছে।
থাকুক।
নিঃশ্বাস তার মুখের উপর পড়ায় কথাগুলো আটকে আটকে বেরুলো সুজানার।
কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?
বেশি দূরে না। আপনাকে রেখে কোথায় যাব?
সুজানার চোখে লাজ নেমে এল। গাল দুটো রক্তিম।
আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপনাকে না দেখে।
এখানে খুব আরাম।
তাহলে দোল দেই?
নাহহ। এভাবে ভালো লাগছে।
অভিক নিকটে গিয়ে বলল
এভাবে?
সুজানা মৃদু হাসলো। তার দমটা বুঝি বেরিয়ে যাবে!
অভিক সন্তর্পণে ভীষণ যত্নে ঠোঁট দুটো সুজানার কপালে ছোঁয়ালো। এমন যত্নে করা প্রথম স্পর্শে সারা শরীরে অদ্ভুত কম্পন ধরলো সুজানার। পুরো দেহ শীতল হয়ে গেল তার। শক্তি নেই নূন্যতম।
অভিক কপালটা ছেড়ে বলল
এভাবে ঘুমালে হবে? আজকে কত কথা বলার আছে।
সুজানা কিছু বলল না। অভিক উঠে দাঁড়ালো। দোলনায় সুজানার পাশাপাশি গিয়ে বসলো। বললো
মা দোলনাটা বউকে ঘুমানোর জন্য দিয়েছিল। বুঝেছি এবার।
সুজানা উঠে বসার শক্তিটুকু জোগাড় করতে পারলো না। অভিক আধশোয়া হয়ে হাসলো তার সাথে। সুজানা দু’হাতে মুখ ঢাকলো।
অভিক হেসে উঠে বললো
এতে আপনাকে আরও বেশি দেখতে পাচ্ছি।
সুজানা হাত চট করে নামিয়ে নিল। বলল
কিভাবে?
অভিক হাসলো। বলল
আমি তো চোখ বন্ধ করলেই আপনাকে দেখি।
সুজানা কোথায় পালাবে, কোথায় মুখ লুকোবে বুঝে পেল না।
তার ছটফটানি দেখে অভিক বলল
আমি সরে যাই। আপনি উঠুন।
সুজানা বলে উঠলো।
নাহহ।
অভিক হাসলো। তার পিঠের নীচে হাত গলিয়ে কোলে তুলে নিয়ে বলল
ফুলগুলোর আয়োজন বৃথা যাবে আপনি ওখানে গেলে।
সুজানা আগের বারের মতো গুটিয়ে যায়নি তেমন। চোখের দিকে চেয়ে রইলো। অভিক তাকে বেডে বসিয়ে বলল
আপনার জন্য স্পেশাল কিছু সারপ্রাইজ আছে। নিয়ে আসছি। বসুন।
সুজানা নেমে গেল সাথে সাথে। শাড়িটা ভালো করে গুছিয়ে নিয়ে বলল
উপহার?
অভিক ঘাড় ফিরিয়ে বলল
হয়ত।
সুজানা আগাপাশতলা না ভেবে তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। খুব নিবিড়ভাবে। শক্ত বাঁধনে।
অভিক বাকহারা হয়ে গেল। কিছু আগেই না চটপট করছিল ছাড়া পাওয়ার আশায়। সে দু’হাত বেঁধে নিয়ে মাথাটা চেপে ধরে থুতনি ঠেকালো মাথায়। বলল
উপহার গুলো খুব দূরে নয়।
সুজানা আরও চেপে গিয়ে মিনমিন করে জবাব দিল
আপনি আমার পাওয়া শ্রেষ্ট উপহার। আমার আর কিচ্ছু চাই না।
অভিক হেসে চুলে ঠোঁট ছোঁয়ালো। বলল
ঠিক আছে। কাল।
সুজানা মাথা তুললো। অভিক তার মুখের একটা পাশ সুজানার মুখে লাগিয়ে বলল
আপনাকে দূর থেকে দেখায় শান্তি। আর কাছে থেকে, দু বাহুর মধ্যিখানে রেখে তৃপ্তি। ভালোবাসা মানে বুঝেন?
সুজানার উত্তর এল।
হুমম।
কি?
ভালোবাসা মানে আমি আর আমার আপনি।
অভিক মুখের পাশটা মুখের সাথে চেপে ধরলো আরও নিবিড়ভাবে। কিয়ৎক্ষণ পর ভিজিয়ে দিল সুজানার সিক্ত রক্তিম মুখখানা।
সুজানার অস্বস্তি, জড়তাগুলো উবে গেল আর মনে হলো ছেড়ে দিলেই বুঝি হারিয়ে যাবে।
দুজনের দুজনের দিকে তাকিয়ে নির্মল হাসলো তারপর। কপাল কপাল মিলিয়ে নেয়ার পর অভিক বলল
অনেককক গল্প বাকি।
সুজানা হেসে মুখ লুকিয়ে নিল। তার কি কভু কখনো মাস্টারমশাইয়ের মুখ থেকে গল্প শোনার ব্যাপারে আপত্তি ছিল, বিরক্তি ছিল? কভু নয়।
এই ফুলের ঘরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভালোবেসে গল্পে গল্পে কেটে গেল তাদের রাত।
আজকে তাদের গল্পগুলোতে শুধু ভালোবাসারা ছিল।
চলবে…
রিচেক করা হয়নি