আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে #পর্ব_৫০ #লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0
79

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৫০
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বধু বিদায়ের সময়ও ঘনিয়ে এল। এমন বিদায়লগ্নের মুহূর্তটাতে বুকের ভেতরে কেমন ভাঙচুর হয় সেটা প্রতিটা মেয়েই জানে। যেখানে বেড়ে উঠা, যাদের কাছে বেড়ে উঠা তাদের ছেড়ে অন্য একটা বাড়িতে নিজের বসতি স্থাপন, মানিয়ে নেওয়া, মেনে নেওয়া একমাত্র মেয়েরাই পারে।

পরম মমতায় সেই ছোট্ট দুধের শিশু থেকে বড় করে সন্তানকে পরের হাতে মেয়ে তুলে দেয়ার সময় একটা মা জানে কতটা যন্ত্রণা হয়। কতটা কষ্ট হয়।

যাদের ছত্রছায়াও এতদিন সুজানার আশেপাশে ছিল না আজ তারাও বিদায় লগ্নে তাকে বিদায় জানালো অশ্রুজলে। পিতৃসম চাচা, ফুপা, খালু মানুষগুলোর অবদানও নেহাত কম নয় তারপরও কোথাও একটা অদৃশ্য দূরত্ব হয়ে গিয়েছে তাদের সাথে।

ওই বাড়ির মানুষগুলোর হাতে মেয়ে তুলে দিতে গিয়ে সাজিয়া বেগম চোখের জলে ভাসলেন। যে দায়িত্ব একসময় তার উপর বর্তিত হয়েছিল আজ স্বয়ং তিনি নিজেই সেই দায়িত্ব অন্যজনের হাতে তুলে দিলেন।

বড়দের হাতে মেয়ে তুলে দেয়ার পর তিনি আসল এবার আসল মানুষের হাতে মেয়ের হাতটা তুলে দিয়ে বললেন

ওকে ভালো রেখো। ছোট থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছে।

মায়ের কথা সুজানা কান্নায় ভেঙে পড়লো।

অভিক তার হাতটা ধরলো ভীষণ যত্ন করে। যে তাকে ভালো রাখে তাকে ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবে সে। সেই একবার সুজানাকে ভুল বুঝার মতো মহাপাপ সে আর কখনো করবে না। যদিও সেদিনও তার অগাধ বিশ্বাস ছিল সুজানার উপর। কিন্তু পরিস্থিতি সব পাল্টে দিয়েছিল।
তার চোখের অবিশ্বাস্য চাহনি সুজানাকে কতটা আঘাত করেছিল সে তা চোখ দেখেই আন্দাজ করে ফেলেছিল।

এবার সে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সে কখনো সুজানার চোখের জলের কারণ হবে না। মন খারাপের কারণ হবে না।
সে হবে শুধু মুচকি হাসির কারণ আর ভরসা, আস্থার আর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার মতো একটা মানুষ।

শ্বাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে বেশ ভালো করে নিজের দায়িত্ব বুঝে নিল সে। শ্বাশুড়ি মা আর তারমধ্য আবার অন্যরকম বুঝাপড়া। তারা একই মানুষের ঢালস্বরূপ। শুধু মালিকানা ভাগাভাগি হয়েছে। মায়ের পর এইবার স্বামী তাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিয়েছে।

সুজানার শ্বশুর,শ্বাশুড়ি, জেঠা শ্বশুর, জেঠশাশুড়ি, দাদী শ্বাশুড়ি, বাসুর, জা সবাই সাজিয়া বেগমকে সান্ত্বনা দিলেন, ভরসা দিলেন।

নবকুঠিরে সুজানা ভালো থাকবে।

সাজিয়া বেগম জানেন এ শুধু মুখের কথা নয়। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন ওই বাড়িতে উনার মেয়ে ভালো থাকবে। যার মাস্টারমশাইয়ের মতো একটা বর থাকে সেখানে সুজানাকে নিয়ে আর ভয় কিসের? মাস্টারমশাইরা সুজানাদের ভালো রাখতে জানে, ভালো বাসতে জানে।

তারপর বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিল সুজানা। ফাজিল বন্ধুগুলোর চোখেমুখে বেদনার ছাপ দেখে সুজানা আরও কাঁদলো। তার ছোট ভাইটা দূরে দাঁড়িয়েছিল। আর বোনকে দেখছি। ভাবছিল গত এক সপ্তাহ ধরে আপাকে এভাবে দূরে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য সে এত খুশি ছিল? আপাহীন বাসাটায় সে কি করবে একলা একা? মাকে এবার সামলাবে কে? মায়ের বকুনি আর মারের হাত থেকে তাকে বাঁচাবে কে? আপারা এভাবে দূরে চলে যায়?

সুজানা তাকে দেখতে চাইলো গাড়িতে উঠার সময়। তাকে অনেক ডাকাডাকি করেও কেউ তাকে আনতে পারলো না। সে এল না।
আপা একদিন রেগে বলেছিল যখন চোখের সামনে থেকে চলে যাব তখন বুঝবি আপা কি জিনিস । আজ চোখের সামনে থেকে না সরেও আপা তাকে বুঝিয়ে দিল তার আপা তার জন্য কি ছিল। সে সবার অলক্ষ্যে কাঁদলো। কেউ শুনলো না। কেউ দেখলো না।

তারপর বধূ বিদায় নিল। যতদূর ফুলেল সজ্জিত গাড়িটা দেখা গেল ততোদূর অব্দি চেয়ে রইলেন এক মা।

মেয়েটা ভালো থাকুক।

____________

পুরোটা পথ সুজানা কেঁদেছে। সালমা বেগম তার পাশে বসে এসেছিল। অনেক সান্ত্বনা দেয়ার পরেও তার কান্না থামেনা। নবকুঠিরের গেইট পার হতেই হৈহল্লা করে ছুটে এল সবাই নতুন বউ ঘরে তোলার জন্য। সালমা বেগম গাড়ি থেকে নামার সময় আনিকাকে ইশারায় কিছু বললেন।

আনিকা আর জিনিয়া সুজানাকে শান্ত হতে বললো। তারপর ধীরেসুস্থে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনলো। সবাই বলাবলি করলো

অভি তোর বউ তো এখনো কাঁদছে।

অভিক সুজানাকে একপলক দেখে ভেতরে চলে গেল। বাড়িতে প্রবেশের শুরুতেই সবাই মিষ্টিমুখ করালো। আনিকা মিষ্টিমুখ করিয়ে বলল

আজ থেকে ম্যাডাম ডাকা বন্ধ সুজানা। আমি আপনার বড় আপা। হুমম? হাসুন হাসুন। আর কান্না নয়।

সুজানা আরও ফুঁপিয়ে কাঁদলো। সবার আবারও মন খারাপ হয়ে গেল। আনজুমা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

এমন কেউ করে? তোমার মা ভাই কাল সকাল সকাল চলে আসবে তোমাকে দেখতে। সুজানা তো খুব বুঝদার। আর কেঁদো না। সময়টা উপভোগ করো। এইদিনগুলো আর আসবে না।

সুজানা নিজেকে শান্ত করলো।

তারপর নবকুঠিরে পা রাখলো সে। মনে পড়লো সেইদিনের কথা। যেদিন সে প্রথম এই বাড়িতে পা রেখেছিল। আর এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে তার ভালো লেগেছিল।

সেদিন সে খুবই অপরিচিত একজন ছিল, আর আজ এই বাড়িরই একজন। বাচ্চা দুটো তাকে দেখে খুশিতে লাফাতে লাফাতে শেষ। সুজান আজ থেকে তাদের বাড়িতে থাকবে এটা তাদের কাছে ভারী আনন্দের।

মমতাজ বেগমের পাশে সুজানাকে বসানো হলো। সবাই মিষ্টি মুখ করাতে করাতে হাসি তামাশা করলো নতুন বউয়ের সাথে । সালমা বেগম এসে বললেন

আর মিষ্টি দিওনা। ঘরে নিয়ে যাও। এখানে লোকজন আসবে।

অভিক ততক্ষণে শেরওয়ানি পাল্টে চলে এসেছে। এসেই বলল

এবার আমি নিয়ে যাই?

সবাই হেসে উঠে বলল,

কোলে নাও। হেঁটে যাবে না বউ।

অভিক ভুরু কুঁচকে তাকালো। সুজানা ছোট্ট করে বলল

নাহ আমি হেঁটে যেতে পারব।

আনিকা বলল,

বরের দিকে টানবে না একদম। অভি কোলে করে নিয়ে যাবি। ব্যস।

যেই কথা সেই কাজ। আজকের দিনে সে তর্কে যাবে না। সুজানাকে কোলে নেয়ার ব্যাপারে একদমই নয়। সুজানা তো আর যেচেপড়ে কখনো কোলে উঠবে না। এটা মোক্ষম সুযোগ বললে ভুল হবে না।

অভিক চট করে কোলে তুলে নিতেই সুজানা কেঁপে উঠলো তরতরিয়ে। বিস্মিত নয়নে তাকাতেই অভিক ঠোঁট উল্টে বলল

শাড়িটার ভার বেশি। মানুষটার নয়।

সবাই হাসলো একসাথে।

আহ বউয়ের প্রশংসা!

সুজানা তখনও তারদিকে অপলক তাকানো।

অভিক নিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড়িয়ে ডাকল..

সু–জা–না!

সুজানা কোনো কথাই বলতে পারলো না। যাকে সে দূর থেকে দেখে অভ্যস্ত, দূর থেকে অনুভবে অভ্যস্ত। তার ছোঁয়ায় আর কাছ থেকে দেখায় সে অপ্রস্তুত ।

অভিক তার অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। বলল..

এটাই আমি। আপনার মাস্টারমশাই।

সুজানা বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইলো।

গাঁদা আর গোলাপের পাঁপড়ি অভিকের মাথা বেয়ে টুপটাপ পড়লো সুজানার মুখের উপর। এত মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ আর মিষ্টি অনুভূতি সাথে একটা মিষ্টি মানুষ।

চলমান……

রিচেক করা হয়নি পাঠক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here